<p style="text-align:justify">ঋণের বোঝা সইতে না পেরে স্ত্রীকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে রাজধানী ঢাকার উত্তরা-আজিমপুর এলাকায় পান-সিগারেটের দোকান নিয়ে ব্যবসা করতেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত আলী হোসেন (৪০)। গ্রামে শাশুড়ির কাছে রেখে যান তিন কন্যাকে। ‌‘স্বামী সারা দিন পান-সিগারেট বেচতেন আর আমি ঢাকার উত্তরা-আজিমপুর এলাকায় বাসায় বাসায় ঝিয়ের কাজ করতাম। সারা দিন কাজ শেষে প্রতিদিনই আমরা আমাদের মেয়েদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে তাদের খোঁজ-খবর নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। </p> <p style="text-align:justify">কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। গত ১৮ জুলাই পান-সিগারেট বিক্রিরত অবস্থায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে চালানো গুলিতে তার বুক ঝাঁজরা হয়ে যায় এবং তিনি নিহত হন। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে স্বামীকে হারিয়ে তিন কন্যাসহ আমার জীবন প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে আমি তিনকন্যাকে নিয়ে কিভাবে সংসার চালাব আর কিভাবে ঋণ পরিশোধ করব, এ চিন্তায় পাগলপ্রায়।’ </p> <p style="text-align:justify">এ অবস্থায় সরকারসহ এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। কথা হচ্ছিল জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত শহীদ আলী হোসেনের স্ত্রী খাইরুন্নেচ্ছার সঙ্গে।</p> <p style="text-align:justify">কান্নাজড়িত কণ্ঠে খাইরুন্নেচ্ছা জানান, স্বামীকে নিয়ে আজমপুর মুন্সিবাজার এলাকায় মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ঘটনার দিন (১৮ জুলাই) সকালে তার স্বামী আলী হোসেনকে পান্তাভাত খাইয়ে তিনি বের হন অন্য বাসায় ঝিয়ের কাজ করার জন্য। দুপুর ২টার দিকে বাসায় ফেরেন খাইরুন্নেচ্ছা। </p> <p style="text-align:justify">‘ওই দিন একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাব এই অপেক্ষায় বসে ছিলাম। কিন্তু বেলা আড়াইটা পর্যন্ত স্বামী বাসায় না ফেরায় চিন্তায় পড়ে যাই। পরে মোবাইল ফোনে স্বজনদের বাসায় না ফেরার বিষয়টি জানালে চারদিক থেকে স্বজনরা খোঁজাখুঁজিতে বের হন। অবশেষে সন্ধ্যার পর তার মরদেহ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পাওয়া যায়। সেখান থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে মরদেহ নিয়ে কেন্দুয়ার বাড়িতে পৌঁছেন রাত অনুমান ৪টার দিকে। পরদিন (১৯ জুলাই) সকালে নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।'</p> <p style="text-align:justify">খাইরুন্নেচ্ছা জীবনের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তিন কন্যাসন্তান রেখে তার স্বামী আলী হোসেন কোটা আন্দোলনে গুলিতে নিহত হয়েছেন। গুলিতে তার বুক ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল। তার বড় কন্যা সাদিয়ার বয়স ১৪ বছর। সে মোজাফরপুর মহিলা মাদরাসায় পড়ে। মেজো মেয়ে মাহিবার বয়স ছয় বছর। সে প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। ছোট মেয়ে সাইবার বয়স তিন বছর। এই তিন কন্যাকে মায়ের কাছে রেখে তারা রাজধানী ঢাকায় ছুটে গিয়েছিলেন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে।</p> <p style="text-align:justify">তার বড় কন্যা সাদিয়ার সঙ্গে কথা হলে সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, ‘আমার বাবা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন। এখন আমার মা কিভাবে আমাদের পড়াশোনা করাবে আর কিভাবে ঋণ পরিশোধ করবে, সেটা নিয়ে মা সারা দিন-রাত শুধু দুশ্চিন্তা আর কান্না করে। আমি সরকারের কাছে আবেদন করছি আমাদের সহযোগিতা করার জন্যে।' </p> <p style="text-align:justify">খাইরুন্নেচ্ছা আরো জানান, তার স্বামী আলী হোসেন অভাবের তাড়নায় গ্রাম্য মহাজনদের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে তিন লাখ টাকার জন্য প্রতি মাসে সুদের লাভ হিসেবে ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। </p> <p style="text-align:justify">আলী হোসেনের ছোট ভাই আবু বক্কর বলেন, ভাই যার কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা নিয়েছিলেন তিনি লাভের টাকা অর্ধেক কমিয়ে প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা দিতে বলেছেন। এই ছয় লাখ টাকা এখন কিভাবে পরিশোধ করবেন, কিভাবে দেবেন প্রতি মাসে লাভের টাকা, তা নিয়ে দিন-রাত শুধু কাঁদছেন আর কাঁদছেন। </p> <p style="text-align:justify">আলী হোসেনের স্ত্রী আরো বলেন, ‘আমার সব শেষ অইয়্যা গেছে। আমি কী কইরা ছয় লাখ টাকার ঋণ দিব? তিন মেয়েরে নিয়া কিভাবে চলব? আমি সরকারের কাছে আমার ঋণের টাকা পরিশোধ করে তিন মেয়েকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে জীবন চলার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতেছি। সরকার আমারে সহযোগিতা না করলে এই ঋণের যন্ত্রনায় আমি মরে যাব।'</p> <p style="text-align:justify">তিনি জানান, ইতিমধ্যে মোজাফরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: জাকির আলম ভূঞা জানাযার দিন এসে নগদ ১০হাজার টাকা, বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম হিলালী ৬ হাজার টাকা এবং উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মওলানা হারুন-অর-রশিদ মেয়ের হাতে দিয়ে গেছেন ১ হাজার টাকা। তাছাড়া এলাকার আলেম সমাজ দিয়ে গেছেন ১১ হাজার টাকা। তবে সরকারী ভাবে এখনো কোনো টাকা পয়সা পাননি তিনি। </p> <p style="text-align:justify">সরকারি কোনো কর্মকর্তা তার সাথে দেখা করতেও যাননি। তবে ইউএনও অফিস থেকে ফোন করে তার মেয়েদের লেখাপড়া বিনা খরচে করানোর জন্য বলে দিয়েছেন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার কথাও বলেছেন।</p> <p style="text-align:justify">এ ব্যাপারে কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমদাদুল হক তালুকদারের সাথে তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি ব্যস্ততার কারণে যেতে পারেনি, তবে নিহত আলী হোসেনের মেয়েদের লেখাপড়া বিনা পয়সায় ব্যবস্থা করার জন্য বলে দিয়েছি। তাছাড়া খুব তাড়াতাড়ি আলী হোসেনের স্ত্রীকে একটি বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করে দেব। সে জন্য ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। অল্পকিছু দিনের মধ্যেই আর্থিক ভাবে সহযোগিতাও করা হবে। তবে কি পরিমাণ সহযোগিতা করা হবে তা তিনি এখনো বলতে পারেন নি।</p> <p style="text-align:justify">ইউএনও ইমদাদুল হক তালুকদার আরো বলেন, আলী হোসেনের স্ত্রী ঢাকায় কারো বাসায় ঝিয়ের কাজ করতেন। এখন যদি উনি মনে করেন এলাকায় থাকবেন, সেক্ষেত্রে আমরা তাকে সেলাই প্রশিক্ষণ ও সেলাই মেশিন দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব। এছাড়াও যদি আরো কোনো সরকারী সহযোগিতার সুযোগ থাকে সেটি তিনি পাবেন।</p> <p style="text-align:justify">নিহত আলী হোসেন নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার ১৪নং মোজাফরপুর ইউনিয়নের মোজাফরপুর (পশ্চিমপাড়া) গ্রামে মৃত আসন আলীর ছেলে। </p> <p style="text-align:justify">উল্লেখ্য, কেন্দুয়ার যুবক কোটা আন্দোলনে গুলিতে নিহত আলী হোসেন। গত ১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের গুলিতে তার বুক ঝাঝরা হয়ে যায়। পরে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে গিয়ে তার মরদেহ খুঁজে পান স্বজনরা।</p>