দেশে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়েই চলেছে। হত্যা ও ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তারা। পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই বছরে ৩৭ শতাংশ বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পেলেও সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এ নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা নেই।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হাতেগোনা কয়েকটি গবেষণা থাকলেও কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা রোধে যেসব পরামর্শ দেওয়া হয়, তারও বাস্তাবায়ন নেই। ফলে ক্রমে মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে হত্যাযজ্ঞের মতো বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে শিশু-কিশোর।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য শুরু হয় ১৯৯০ সালের দিকে। ২০২৪ সালে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ছিল ২৩৭টি।
এসব গ্যাংয়ের সদস্যসংখ্যা অন্তত দুই হাজার ৩৮২ জন। ২০২২ সালে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ছিল ১৭৩টি, সদস্যসংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। অর্থাৎ দুই বছরে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা বেড়েছে ৬৪টি বা ৩৭ শতাংশ। একই সময়ে এসব গ্রুপের সদস্য বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার, যা আগের সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ। তবে পুলিশ সদর দপ্তরে খোঁজ নিয়ে কিশোর অপরাধীদের পৃথক কোনো ডেটা পাওয়া যায়নি।
আইন বিশেজ্ঞরা বলছেন, কিশোর অপরাধ ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও ছিল। তবে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপত্তি ও বিস্তৃতি নজরে আসার বিষয়টি খুব বেশি দিনের নয়।
আরো পড়ুন
আন্দোলন নয়, জনগণ চায় নির্বাচন
সরকারি তথ্য ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন বলছে, মাদক সেবন, চুরি ও ইভ টিজিংয়ের সঙ্গে সমাজের বড় বড় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে এসব শিশু-কিশোর।
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ জার্নালে প্রকাশিত ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা উল্লেখযোগ্যহারে বাড়ছে।
ছয় বছরে এই হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৬ শতাংশ। ২০২০ সালে অপরাধে জড়িত শিশুদের ৬১ শতাংশই ছিল ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে, যা ২০১৪ সালে ছিল ২৪.৭ শতাংশ।
২০২৩ সালে জার্নাল অব এমার্জিং টেকনোলজিস অ্যান্ড ইনোভেশন রিসার্চে (জেইটিআইআর) প্রকাশিত মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের ‘স্টাডি অব চিলড্রেন ক্রাইমস এট আরবান এরিয়াজ ইন বাংলাদেশ’ গবেষণায় বলা হয়, অপরাধে শিশুদের সম্পৃক্ততা বর্তমান সময়ে সত্যিই উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। তাদের মুষ্ঠিমেয়দের কর্মকাণ্ডে সমাজ আক্রান্ত হচ্ছে, যা অদূর ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর।
আরো পড়ুন
একনজরে আজকের কালের কণ্ঠ (৯ এপ্রিল)
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে শিশুদের ৭৫ শতাংশই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। মাদকাসক্তি, মাদক ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, আগ্নেয়াস্ত্র বহন, ধর্ষণ, হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে এসব শিশু। অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হলো দরিদ্রতা ও শিক্ষার অভাব। অধিকাংশ শিশু ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সে অপরাধে যুক্ত হয়। যেসব অপরাধের জন্য শাস্তি অনিবার্য, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তাদের উন্নয়নকেন্দ্রে পাঠানো ছাড়া বড় কোনো শাস্তি দেওয়া হয় না। কিশোর অপরাধের ধরন ও পর্যায় বিবেবেচনায় একটি দেশের আইনের শাসনের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়।
গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, মাদক ব্যবসার মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে অধিকাংশ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে তাদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে কিশোর গ্যাংগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বে প্রায়ই ঘটছে গোলাগুলির ঘটনা, বাড়ছে হত্যাকাণ্ড। তবে এসব অপরাধের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জমি দখল, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি বিভিন্ন থানায় মাদক ব্যবসায়ী ও চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের পৃথক তালিকায় এমন অনেক কিশোর অপরাধীর নাম উঠে এসেছে।
আরো পড়ুন
আজকের নামাজের সময়সূচি, ৯ এপ্রিল ২০২৫
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পল্লবী থানায় মাদক বাণিজ্য এবং চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসীর পৃথক তালিকায় অন্তত দুই ডজন কিশোর অপরাধীর নাম ওঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে মিরপুর ১১ নম্বর বাউনিয়া বাঁধ ও এর আশপাশের এলাকায় মাদক ব্যবসার অন্যতম হোতা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য মুসা (২১)। সে নিজে আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গী, তেজগাঁও ও কারওয়ান বাজার থেকে মাদক এনে ব্যবসা করে। কিশোর অপরাধীদের মধ্যে অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী সরদার সামিউল ইসলাম সামি (২০) ও অনিক ওরফে নাইক্কা অনিক (২২)। তারা প্রত্যেকেই এক থেকে একাধিক মামলার আসামি। এ ছাড়া অস্ত্রধারী কিশোর অপরাধীদের মধ্যে অন্যতম মো. অনিক ইসলাম (২১)। চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনায় আট মামলা ও একটির ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি আশিকুল ইসলাম শান্ত (১৯)।
এশিয়ান জার্নাল অব সোশিয়লজিক্যাল রিসার্চে ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘প্রসেস অব ক্রিমিনালাইজিং স্ট্রিট চিল্ড্রেন ইন বাংলাদেশ; এন এমপায়রিকাল স্টাডি ইন দ্য সিটি অব ঢাকা’ গবেষণায় বলা হয়, অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের ৯০.৫ শতাংশই মাদক ব্যবসা এবং ৩০.১ শতাংশ হত্যার সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া ছিনতাইয়ে জড়িত ৬৬ শতাংশ ও চুরির সঙ্গে জড়িত শতভাগ শিশু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীরা শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ কিশোররা পুলিশের সন্দেহের তালিকায় প্রথমেই আসবে না। এ ছাড়া অপরাধী চক্রও তাদের ব্যবহার করে। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার বা উন্নয়নকেন্দ্রে পাঠালেই সব সমাধান হবে না। এ জন্য পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে। রাতারাতি এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব না।