বাংলাদেশে বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের পথ শিরোনামে একটি প্যারালাল ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও বাদাবন সংঘের আয়োজনে বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) এটি সিএসডব্লিউ-এর ৬৯তম অধিবেশন। এ অধিবেশনে অনলাইনে ‘বাংলাদেশে বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের পথ।’ শিরোনামে প্যারালাল ইভেন্টটি অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত ইভেন্টে স্বাগত বক্তব্য দেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। মডারেটর হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী সুলতানা বেগম।
অতিথি আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ইউএন উইমেনের প্রগ্রাম ম্যানেজার তপতী সাহা।
সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র ফেলো অব প্র্যাকটিস এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান মাহিন সুলতান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, বাংলাদেশের সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন, রাজশাহী বিভাগের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া, বাদাবন সংঘের নির্বাহী পরিচালক লিপি রহমান।
মডারেটরের বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘৫৪ বছরে নারীর অগ্রগতি দৃশ্যমান হলেও নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দিকটি জাতীয় পর্যায়ে এখনো গুরুত্ব পায়নি। এ জন্য আমাদের আরো অনেক পথ হাঁটতে হবে।’
স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, নারীর অগ্রগতি এবং জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে, বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ (বি পি এফএ) একটি মাইলফলক দলিল ছিল।
বেইজিং সম্মেলন শুধু বিভিন্ন শ্রেণির অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা এবং বৈচিত্র্যের জন্যই শুধু নয়, বরং ঘোষিত বেইজিং কর্মপরিকল্পনার দূরদর্শিতাসম্পন্ন অ্যাজেন্ডাগুলোর গভীরতার জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ, যা এখনো লৈঙ্গিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাসঙ্গিক।
বেইজিং ঘোষণার আলোকে এই ৩০ বছরে বাংলাদেশেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত সমতা অর্জনের লক্ষ্য এখনো পূরণ হয়নি। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব, নারীর বিরুদ্ধে ক্রমাগত সহিংসতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, পিতৃতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং নারীবিদ্বেষী ও মৌলবাদী কর্মতৎপরতার বিস্তার এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়ায় নারীর অনুপস্থিতি এবং জেন্ডার সমতার কর্মসূচিতে বিনিয়োগের অঙ্গীকার হ্রাস নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা তথা জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠাকে অনেকটাই কঠিন করে তুলেছে। এই পটভূমিতে বাংলাদেশে নারী আন্দোলন সক্রিয় রয়েছে এবং সমতার অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে কাজ করে যাচ্ছে।
লিখিত বক্তব্যে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী সুলতানা বলেন, বেইজিং সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নারীর আন্দোলনের ভূমিকা তুলে ধরেন এবং আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিভিন্ন নারীবান্ধব নীতিগুলো সম্পর্কে আলোচনা করেন, এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতির দিক উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে অগ্রগতি থাকা সত্ত্বেও, সামাজিক-ধর্মীয় বাধা এবং দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মতো ক্রমাগত চ্যালেঞ্জগুলো পূর্ণ জেন্ডার সমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই বাধা উত্তরণে আইনি সংস্কার, আইন প্রয়োগ, নীতিমালার পরিবর্তন এবং সব গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অতিথি আলোচক হিসেবে ইউএন উইমেনের প্রগ্রাম ম্যানেজার তপতী সাহা বলেন, ‘বেইজিং ঘোষণার আলোকে নারী আন্দোলনের নিরলস ভূমিকার কারণে নারীর অগ্রগতি বেশ সন্তোষজনক। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে। জাতীয় কর্মকৌশল বাস্তবায়নে এখনো ধীরগতি লক্ষ করা যায়। জেন্ডার-সমতা গড়তে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে, গণতান্ত্রিক চর্চায় অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়ায় তরুণীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, কেয়ার ইকোনমিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতি দিতে হবে; নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবেলায় জেন্ডার রেসপনসিভ বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।’
সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন— সিনিয়র ফেলো অব প্র্যাকটিস এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান মাহিন সুলতান। তিনি বলেন, ‘বেইজিং সম্মেলনে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা এবং নাগরিক সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে নারীর অগ্রগতির লক্ষ্যে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও বাস্তবে সেই সম্পৃক্ততা খুব বেশি দেখা যায়নি, এতে ভালো পরিকল্পনা থাকাম সত্ত্বেও নারীর প্রকৃত উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, বাংলাদেশের সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, এসডিজির ৫ নম্বর লক্ষ্য জেন্ডার-সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকার দিতে হবে, শিশুদের জন্য মিড-ডে মিল চালু করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘বাল্যবিয়ের কারণে কন্যাশিশুর শিক্ষাক্ষেত্রে ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। তাদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়ছে। সার্বিকভাবে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমছে। বেইজিং ঘোষণার আলোকে কন্যাশিশুর সুরক্ষা নিশ্চিতে বাল্যবিয়ে বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।'
রাজশাহী বিভাগের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া নিজের কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘বাংলাদেশে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সহিংসতার ঘটনায় এখনো নারীকে দোষারোপ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় সঠিক তদন্ত হলেও অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এ রকম ঘটনায় যৌন নিপীড়নের শিকার নারীরা মানসিক আঘাতজনিত সমস্যায় ভুগতে থাকেন।’
বাদাবন সংঘের নির্বাহী পরিচালক লিপি রহমান বলেন, ৩০ বছর আগে গৃহীত বেইজিং পরিকল্পনা বিষয়ে তরুণ প্রজন্মকে অবহিত করার দায়িত্ব নিতে হবে এবং আন্দোলনে তৃণমূল সংগঠনকে সম্পৃক্ত করতে হবে। জলবায়ুগত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় নারী ও তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
উক্ত প্যারালাল ইভেন্টে দেশ ও বিদেশের নারী অধিকার কর্মী, সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেত্রীবৃন্দ ও সম্পাদকমণ্ডলী যুক্ত ছিলেন। ফেসবুক ইভেন্টে লাইভ সম্প্রচার করা হয়।