ব্রয়লার বা সোনালি বা দেশি—এসব মাংসে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন বি-৬ রয়েছে, যা আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয়তার অর্ধেক পূরণ করে এবং সরাসরি লোহিত ও শ্বেত রক্তকণিকা তৈরিতে সহায়তা করে। প্রাণিজ আমিষ না খাওয়ার ফলে শরীর জিংক, কপার ও ভিটামিন বি-৬ কম পাবে, ফলে শরীরে অ্যান্টিবডি উত্পাদন কমে গিয়ে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কমে যাবে এবং রক্তে লোহিত কণিকা, শ্বেতকণিকা ও নিউট্রোফিলের ফ্যাগোসাইটিক কার্য পরিচালনা করার ক্ষমতা কমে যায়, ফলে জীবাণুকে ধ্বংস করতে পারে না।
করোনাভাইরাসের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তাই শরীরের ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া বিশেষ কিছু করার নেই। মাংস, ডিম, দুধ আমাদের শরীরের প্রোটিনের চাহিদা মেটায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে এবং ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এই সময়ে আমাদের সবার উচিত নিয়মিত মুরগির মাংস, ডিম ও দুধ খেয়ে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো।
কর্মসংস্থানে ডেইরি ও পোল্ট্রি শিল্পের গুরুত্ব :
বাংলাদেশের ডেইরি এবং পোল্ট্রি শিল্প ক্রমবিকাশমান শিল্প। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিকল্পিত কর্মপ্রক্রিয়ায় গত ১০ বছরে ধারাবাহিকভাবে ডেইরি ও পোল্ট্রি শিল্পের অনেক উন্নয়ন হয়েছে এবং উত্পাদন বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। গ্রামে গ্রামে উন্নত জাতের গাভি এবং মাংস ও ডিম উত্পাদনকারী পোল্ট্রি খামার এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি চোখে পড়ে।
ব্রয়লার উৎপাদনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ। নারিশ, কাজি, আফতাব, সিপি, প্রোভিটা, প্যারাগনসহ ৩০০-র ওপর কম্পানি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। যেহেতু স্বল্প জায়গায় ও অল্প পুঁজিতে ব্রয়লার পালন সম্ভব, পাশাপাশি ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মধ্যেই মাংস উত্পাদন করে বাজারজাত করা যায়, তাই অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হয়ে নিজেকে স্বাবলম্বী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। ছোট-বড় অনেক উদ্যোক্তা এই শিল্পে নিজের পুঁজি বিনিয়োগ করেছে।
দুধ ও মাংস উৎপাদনের জন্য দেশে এখন হাজার হাজার ছোট-বড় ডেইরি ও গবাদি পশু মোটাতাজাকরণ খামার গড়ে উঠেছে। সেখানে কাজ করছে লাখ লাখ মানুষ। দেশে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের এবং চামড়ার সামগ্রী তৈরির অনেক প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা রয়েছে। কয়েক হাজার লোক এসব কারখানায় কর্মরত আছে।
আশির দশকে শুরু হয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প এখন ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার শিল্পে পরিণত হয়েছে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ৫০-৬০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা এ খাতের ওপর নির্ভরশীল। করোনা সংক্রমণের কারণে এই শিল্প আজ ক্ষতিগ্রস্ত।
প্রাণিসম্পদে করোনার প্রভাব :
করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লকডাউনের শুরুতে প্রথমেই ধাক্কা খায় ব্রয়লার মুরগি উত্পাদনকারী খাত। লকডাউনে ভোক্তা হারায় পোল্ট্রি শিল্প। ব্রয়লার পচনশীল ও সংরক্ষণ করা সহজ নয় বলে স্থানীয় পর্যায়ে অতি অল্প মূল্যে এবং বড় অঙ্কের ক্ষতিতে বিক্রি করতে বাধ্য হয় খামারিরা। আর এই সময় ব্রয়লার খামারিরা প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করে স্থানভেদে মাত্র ৮০-৯০ টাকায়। মাত্র কিছুদিন আগেও খামারি পর্যায়ে ১৮০-২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে এখন ১৪০ টাকায়।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) দেওয়া তথ্য মতে, লকডাউনের শুরু থেকে শুধু ২১ দিনেই পোল্ট্রি শিল্পে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। সংগঠনটির দেওয়া তথ্য মতে, ওই কদিনে বাচ্চা উত্পাদন খাতে ক্ষতি ২৭১ কোটি টাকা, খাদ্য উত্পাদন খাতে ক্ষতি ১১১ কোটি টাকা, ব্রয়লার ও ডিমে ক্ষতি ৮৬৮ কোটি টাকা, প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে ক্ষতি পাঁচ কোটি এবং ওষুধ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি টাকা।
বাজারে ডিমের দামও অনেক কমে গেছে। একটি ডিম, যার উত্পাদন খরচ পড়ে ৫.৫০ টাকা, তা খামারিরা বিক্রি করছে চার-পাঁচ টাকায়। প্রতিদিন প্রায় চার কোটি ডিম উত্পাদিত হয়, ফলে খামারিরা দিনে প্রায় চার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এক দিনের বাচ্চা উত্পাদনকারী হ্যাচারি বাচ্চা বিক্রি করতে না পেরে তা ধ্বংস করছে।
উৎপাদিত খরচের চেয়েও কম দামে বিক্রি হচ্ছে ডেইরি খামারিদের উত্পাদিত দুধ। গ্রামে প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে ৩০-৪০ টাকায়, যা ন্যূনতম বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই সামনে আসছে ঈদুল আজহা। প্রতিবছরের মতো এবারও প্রায় ৬০ লাখ গরু, মহিষ কোরবানির বাজারে বিক্রির জন্য হূষ্টপুষ্ট করা হয়েছে। দেশের করোনার এই সংকটকালে হূষ্টপুষ্ট করা প্রায় এক কোটি ২০ লাখের বেশি গবাদি পশুর ৫০ শতাংশ বিক্রি করা যাবে কি না বা উপযুক্ত দামে বিক্রি করতে পারবে কি না তা নিয়ে খামারিদের মধ্যে ভয় ও হতাশা কাজ করছে।
অন্যদিকে করোনার কারণে পরিবহনব্যবস্থা বন্ধ থাকা এবং মিলগুলোতে খাদ্য উত্পাদন কমে যাওয়ায় গবাদি পশুর খাবারের দাম বেড়ে গেছে। ফিড মিলগুলো উত্পাদিত ফিড বিক্রি করতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। করোনা দুর্যোগের আগেও ৩৭ কেজি গমের ভুসির দাম ছিল এক হাজার ১০০ টাকা, যা বর্তমানে খামারিদের কিনতে হচ্ছে ১৪শ টাকায়। এ পরিস্থিতিতে খামারিরা গবাদি পশুর খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে।
বিভিন্ন মিডিয়ায় হাঁস, মুরগি, বিভিন্ন পোষা প্রাণী থেকে করোনা ছড়াতে পারে বলে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ সারা দুনিয়ায় কোথাও হাঁস, মুরগি বা অন্য কোনো পোষা প্রাণী থেকে করোনা ছড়িয়েছে এমন কোনো রেকর্ড নেই। আর এটাও হচ্ছে পোল্ট্রি, ডেইরি সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এরই মধ্যে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে খামারিদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ব্রয়লার মুরগি, ডিম, দুধ খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে তা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে বিক্রির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এতে খামারিরা কিছুটা ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে।
খাদ্য নিরাপত্তায় করোনা পরিস্থিতিতে করণীয় :
করোনাভাইরাসের কারণে সামনে আসছে অর্থনৈতিক মহাদুর্যোগ, যাতে প্রথম আঘাত আসবে খাদ্য নিরাপত্তায়। সরকার যেমন একা পারবে না এটি মোকাবেলা করতে, তেমনি বেসরকারি খাতও এ যুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে না সরকারের সহায়তা ছাড়া। তাই এখনই সময় কৌশল নির্ধারণের, যাতে এই খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়।
করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হলো :
১. দেশের গবাদি পশু ও পোল্ট্রি খামারিদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদের প্রতিটি খামারের বিপরীতে সরকারিভাবে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
২. করোনার এই সংকটময় সময়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের যেসব কর্মকর্তা ও কর্মচারী মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় থেকে গবাদি পশুর চিকিত্সা, খামারিদের পণ্য বাজারজাতকরণ ও কৃত্রিম প্রজননের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।
৩. পশুর খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রীর মূল্য কৃষকদের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার জন্য ভর্তুকি প্রদান। ৪. পশু-পাখিজাত পণ্যসামগ্রীর সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণে বিশেষ সুবিধা প্রদান। ৫. প্রাণিসম্পদের উৎপাদিত পণ্য অনলাইনে বিক্রির ব্যবস্থা করা।
৬. গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখার লক্ষ্যে গ্রামাঞ্চলে ভূমিহীন কৃষক ও গ্রামীণ মহিলাদের জন্য গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি প্রতিপালনের বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ। প্রান্তিক খামারিদের জন্য এ লক্ষ্যে বিশেষ কার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আওতায় কৃষক, খামারিদের উত্পাদিত প্রাণিজ পণ্য বাজারজাতকরণে সহায়তা করার জন্য বিপণন বিভাগ চালু করা দরকার।
৮. দেশের প্রাণিজ খাতের অনুকূলে বিদ্যমান ব্যাংকঋণের সুদহার পুনর্বিন্যাস করা এবং খামারিদের জন্য অত্যন্ত স্বল্প সুদহার নির্ধারণ করা।
৯. কভিড-১৯-এর পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক খামারিদের সরকার কর্তৃক প্রণোদনা প্রদান এবং তা খামারিদের তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রদান করা।
১০. প্রাণিজ আমিষ খাওয়ার বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারণার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১১. ভোক্তা পর্যায়ে তথা জনমনে ভ্রান্ত ধারণা নিরসনকল্পে প্রাণিজ আমিষের বিভিন্ন উপকারিতা সম্পর্কে সরকারি পর্যায়ে প্রচারণা বাড়ানো।
দুধ, মাংস ও ডিমের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ এবং গ্রামের দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশীয় বিকাশমান পোল্ট্রি ও ডেইরি শিল্প ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মাংস, ডিম, দুধের জোগান দিতে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৬০-৭০ লাখ মানুষ জড়িত। করোনার প্রাদুর্ভাবে তারা কোনো কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই সেক্টরের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায় থেকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। করোনাভাইরাসের এই ক্রান্তিকালে সরকারের আর্থিক এবং অন্যান্য প্রণোদনার প্রয়োজন অনেক বেশি। বিভিন্ন পণ্যের শুল্কমুক্তি, ব্যাংকঋণের কিস্তিসহ অন্যান্য চাপ অন্তত ছয় মাসের জন্য স্থগিত, বিগত ছয় মাসের ঋণ মওকুফ, স্বল্পসুদে নতুন ঋণ প্রদান জরুরি। প্রাণিসম্পদ উপখাতে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার অনেক বেশি। অতএব, এ উপখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে আয়, কর্মসংস্থান ও সামাজিক অসমতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাতে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, সাধারণ মানুষের আয় বেড়ে যাবে, তাদের পুষ্টিহীনতা হ্রাস পাবে এবং আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা ও বৈষম্য কমে আসবে। তাতে খাদ্য নিরাপত্তাসহ দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্দেশ্য সফল হবে।
লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (প্রাণিসম্পদ বিভাগ) বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল