<article> <p style="text-align: justify;">ইতালি সরকার এবং দেশটির কম্পানি ও মালিকপক্ষ বাংলাদেশি কর্মীদের খুবই পছন্দ করে। সে কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলে প্রথমেই বাংলাদেশিদের প্রতি আগ্রহ দেখায় তারা। কিন্তু নুলস্তা (ওয়ার্ক পারমিট) হওয়ার পরও শুধু ভিসা প্রসেসিংয়ে দীর্ঘসূত্রতার কারণে ইতালিতে জনশক্তি রপ্তানি হুমকির মুখে পড়ছে। এটি নিরসনে সরকারকে অবশ্যই জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">ইতালিতে বসবাসরত মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট ইমাম হোসাইন রতন কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন। তিনি বর্ণবাদবিরোধী সংগঠন ‘ত্রে ফেব্রাইয়ো’র উত্তর নাপলি এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং কাম্পানিয়া অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা গ্রুপের সদস্য।</p> <p style="text-align: justify;">ইমাম হোসাইন রতন বলেন, নুলস্তা হওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে ভিসা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। এতে মালিকপক্ষ তাদের লক্ষ্য অনুযায়ী কাজের পদক্ষেপ নিতে পারছে না।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তাদের কর্মপরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটছে। দেখা যাচ্ছে অন্য দেশের কর্মীরা সঠিক সময়েই ইতালিতে কর্মস্থলে যোগ দিতে পারছেন। এতে বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা বেশি থাকা সত্ত্বেও শুধু ভিসা জটিলতার কারণে তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এই ভিসা প্রসেসিংয়ের দীর্ঘসূত্রতা শ্রমবাজারে বর্ণবাদকে উসকে দিচ্ছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তিনি বলেন, ফ্যামিলি রিইউনিয়ন ভিসার ক্ষেত্রে এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক পরিবারে সন্তান তার বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, স্ত্রী তাঁর স্বামীর কাছ থেকে, স্বামী তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন।</p> <p style="text-align: justify;">অ্যাডভোকেট রতন বলেন, “গত তিন বছরে ইতালি থেকে বাংলাদেশে ওয়ার্ক পারমিট পেয়েছেন আনুমানিক ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার কর্মী। আমাদের সরকারের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত এ কারণেই যে ইতালি সরকার অবৈধ অভিবাসন অর্থাৎ সাগর পাড়ি দিয়ে সেখানে যাওয়া, মৃত্যুবরণ করা ইত্যাদি ঠেকাতে একটি ডিক্রি জারি করেছে, যেটিকে বলে ‘ডিক্রেটো ফ্লুসি’। তারা প্রায় পাঁচ লাখ শ্রমিক ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে সেখানে নেবে। ওই ডিক্রি এখনো চলমান।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে সর্বোচ্চ প্রায় দুই লাখ কর্মী যেতে পেরেছেন। আরো তিন লাখের মতো অপেক্ষমাণ। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মরক্কো, পাকিস্তান, মিসর, তিউনিশিয়া ও সেনেগালের মানুষই বেশি সুযোগ পায়। বাংলাদেশের শ্রমিকরা ওখানে খুবই শান্তিপূর্ণভাবে আছেন এবং তাঁদের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। তাঁরা কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নেই। ওখানকার মালিক, সরকার—সবাই বাংলাদেশি কর্মীদের ওপর খুশি।”</p> <p style="text-align: justify;">অ্যাডভোকেট রতন বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক চেষ্টা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে তা আবারও শুরু হয়। এখন ভিসা নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনে সরকারকেই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এই সমস্যা নিরসনের উপায় হচ্ছে, সরকারের একটি উচ্চমানের টিম গঠন করে এ বিষয়ে ভালোভাবে জেনে ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে একটি ডিপ্লোমেটিক সমাধানে যাওয়া।</p> <p style="text-align: justify;">তিনি আরো বলেন, ইতালিতে শ্রমিকরা সাধারণত রেস্তোরাঁ, গার্মেন্টস ও কৃষিতে নিয়োজিত হন। সামগ্রিকভাবে সবাই এক লাখ টাকা বা তার বেশি মাসিক রোজগার করেন। কেউ চাইলে প্রাত্যহিক ব্যয় বাদে প্রতি মাসে অন্তত ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা দেশে পাঠাতে পারেন। একটু পুরনো হলে এক লাখ টাকাও পাঠাতে পারেন। তাহলে এই যে যাঁরা যেতে পারছেন না, তাঁরা যেতে পারলে দেশ, পরিবার ও ইতালির উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অবদান রাখতে পারতেন।</p> <p style="text-align: justify;">করোনার সময়ের পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিদেশি আয়ের সর্ববৃহৎ উৎস গার্মেন্টস খাত বন্ধ ছিল। তখন এই রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের কারণেই দেশে আয়ে একটা ভারসাম্য বজায় ছিল।’</p> <p style="text-align: justify;">অ্যাপয়েন্টমেন্টের অব্যবস্থাপনা বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট ইমাম হোসাইন রতন বলেন, ‘এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বা যেতে পারেননি এটার দায় তো ভিএফএস এড়াতে পারবে না। কারণ অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যাপারটা তো ইতালি দূতাবাস দেখে না। কেননা দূতাবাস তো বলে না, যেমনটা শুনি আর কি, যে তোমরা রাতে পাঁচ মিনিটের জন্য স্লট ওপেন করো বা অমুক সময়ে অফ রাখো। এই অব্যবস্থাপনার দায় ভিএফএসের এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।’</p> <p style="text-align: justify;">তিনি বলেন, এমন অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন যাঁরা ইতালির জন্য আবেদন করেছেন, ওখান থেকে পরিচিত কারো মাধ্যমে নুলস্তা এনেছেন। তাঁদের পাসপোর্ট আটকে রাখা হচ্ছে সাত মাস থেকে ৯ মাস ধরে, এটা আসলে কোনোভাবেই কাম্য নয়। কেননা প্রথমত ওয়ার্ক পারমিটের ভিসায় ৯০ দিনের বেশি পাসপোর্ট আটকে রাখার কোনো আইন নেই। যদি দূতাবাস এটা করে থাকে তাহলে সে নিজের দেশের আইন অমান্য করছে। দ্বিতীয়ত, এটা করার মাধ্যমে ভিসার জন্য আবেদনকারী ব্যক্তি পূর্বের কর্মস্থলেও ফিরতে পারছেন না, আবার অন্য কোথাও যাওয়ার জন্যও আবেদন করতে পারছেন না। এটা তাঁদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।</p> <p style="text-align: justify;">ফেক নুলস্তা চেক বা নুলস্তার প্রক্রিয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ফেক কাগজপত্র বা ফেক নুলস্তার ব্যাপারে যেসব কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, সুযোগসন্ধানী মানুষ থাকে, অনেকে করতে পারে, কিন্তু প্রথমত ফেক নুলস্তা বা কাগজপত্র চেক না করে কেন জমা নিল? এটা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। দ্বিতীয়ত, নুলস্তার আসল-নকল চেক করা দূতাবাসের জন্য সেকেন্ডের ব্যাপার। কারণ এর প্রক্রিয়াটা এমন যে যখন ইতালিয়ান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নুলস্তাগুলো ছাড়া হয় তখন একই সঙ্গে তিনটি কপি দেওয়া হয়। একটি কপি আবেদনকারী তথা মালিকের নির্ধারিত ডিজিটাল ঠিকানায় যায়; আরেক কপি সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে এবং আরেকটি কপি মালিক যে এলাকায় বসবাস করেন সেই এলাকার ‘প্রেফেত্তুরা’ বা প্রিফেকচার অফিসে। এই তিনটি কপিরই একই কোড নাম্বার থাকে। তো দেখা যাচ্ছে, কোনো ব্যক্তি নুলস্তা নিয়ে ভিএফএস গ্লোবালে ভিসার আবেদন জমা দেওয়ার আগেই দূতাবাসের কাছে তাঁর নুলস্তার মূল কপিটি সংরক্ষিত থাকে। সুতরাং এক ক্লিকেই এটি চেক করা সম্ভব। এটি খুবই সাধারণ বিষয়।</p> <p style="text-align: justify;">নুলস্তা যাচাইয়ের নামে যে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে, তা বড় কোনো ইস্যু নয় উল্লেখ করে রতন বলেন, “এটি যাচাই করা কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার মাত্র। ইতালিয়ান আইন হচ্ছে, ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় ৯০ দিন, ফ্যামিলি রিইউনিয়ন ভিসায় ৩০ দিন এবং অটোনুম ওয়ার্ক ভিসায় ১২০ দিনের বেশি পাসপোর্ট আটকে রাখার কোনো সুযোগ নেই দূতাবাসের। ঢাকায় দূতাবাস কেন এমন করছে এটা আসলে আমার জানা নেই। তবে এ জন্য যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাঁদের ক্ষতি ঠেকাতে ইতালি সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের একটি সমাধানে আসা উচিত। ইতালি সরকার তো বাংলাদেশিদের কোনো ক্ষতি চায় না। বরং ইতালিয়ান মানুষ, সরকার—সবাই বাংলাদেশি কর্মীদের পছন্দ করে। সেখানে তাঁদের সহাবস্থান রয়েছে। বাঙালিরা সেখানে সুখেই থাকে। ইতালিয়ান জাতি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে ইতালির পরিচিতি বিশ্বময়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’। দুই দেশেরই পররাষ্ট্রনীতিতে মানবিক মূল্যবোধের বিষয়টির প্রাধান্য রয়েছে। নুলস্তা—রাষ্ট্র, সরকার বা দূতাবাসের কাছে হয়তো বা একটি কাগজ, কিন্তু এই নুলস্তা একজন মানুষের স্বপ্ন এবং জীবন। জীবন পরিবর্তনের যে স্পৃহা মানুষ লালন করে তা ভিসার দীর্ঘসূত্রতায় কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হোক এটাই প্রত্যাশা।”</p> </article>