<p><em>১৯ নভেম্বর ছিল বিশ্ব পুরুষ দিবস। গণমাধ্যমে বরাবরই অনালোচিত থাকে দিবসটি। কেন থাকে জানি না। তবে এটা জানি, হয়তো পুরুষের চরিত্রের সবচেয়ে বৈপরীত্য হলো সে বন্ধুমহলে ‘টাইগার’ আর স্ত্রী অথবা গার্লফ্রেন্ড মহলে রীতিমতো ‘পুসিক্যাট’। তাই ষাটের দশক থেকে পুরুষ দিবস বরাদ্দের দাবিটি মাত্র ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘ আমলে নেয়। তা-ও পালিত হয় অনাড়ম্বরে, চোখ টাটানো অবিরাম অবহেলায়</em></p> <p>ভারতীয় শিল্পী নচিকেতার একটা গান আছে, ‘জনতা জনার্দন শুনে হবেন বড় প্রীত পুরুষ মানুষ দু’ প্রকারের, জীবিত ও বিবাহিত। পুরুষ মানুষ বেঁচে থাকে বিয়ে করার আগে গো, বিবাহিত মানে প্রকারান্তরেতে মৃত, পুরুষ মানুষ দু’ প্রকারের, জীবিত ও বিবাহিত।’</p> <p>আর এক শ্রেণির ঘোড়েল বিজ্ঞজন নাকি দাবি করেন, ‘পুরুষ মূলত জন্তুবিশেষ। জীবনের বিভিন্ন স্তরে সে বিভিন্ন জন্তুতে রূপ নিতে পারে! প্রথমে সে হয়ে যায় একটি ছোট্ট মেষশাবক। তারপর ছাগলছানা অথবা গরুর বাছুর। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে হতে পারে কুকুরছানা, ভোঁদড় অথবা ছুঁচো! যৌবনে সে একজন যুবতির সঙ্গে পরিচিত হয় আর যুবতি তাকে বাঁদর নাচায়! কিছু সময়ের জন্য সে মর্দা হরিণে পরিণত হয়। তারপর সে বিয়ে করে। বিয়ের পর সে ছাগল অথবা ভারবাহী খচ্চরে পরিণত হয়। মাঝেমধ্যে সে একটি ছোট্ট কোকিল বনে যায়। আর বৃদ্ধ বয়সে সে পরিণত হতে পারে একটি বিশ্বস্ত পুরনো কুকুর অথবা বুড়ো ধূর্ত শিয়ালে। হ্যাঁ, পুরুষ জীবনের নানা বাঁকে নানা জন্তুতে রূপ নেয় বা নিতে পারে। জন্তু খোলস পাল্টাতে পারে না, তবে পুরুষ পারে।’</p> <p>পুরুষের চরিত্রের সবচেয়ে বৈপরীত্য হলো সে বন্ধুমহলে ‘টাইগার’ আর স্ত্রী অথবা গার্লফ্রেন্ড মহলে রীতিমতো ‘পুসিক্যাট’। তার পরও বিপত্নীক পুরুষকে বিয়ে করা ইকোলজিক্যাল দিক থেকে যৌক্তিক। কারণ রিসাইক্লিং থিওরি তো বিজ্ঞানেরই! লোকশ্রুতির সাক্ষ্য, চার বা চারের অধিক নারী জড়ো হলেই আলোচনার মূল প্রসঙ্গ হয়ে যায় ‘পুরুষ’। অথচ পুরুষের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো, সে অনেক কিছুই ভুলে যায়, খেয়ে মুখটি টিস্যু পেপার দিয়ে মুছে ফেলার মতো! নারী কি তার উল্টোটাই করে? কে জানে?</p> <p>দুর্জনেরা বলে থাকেন, ছাঁদনাতলায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত নারী ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে। আর পুরুষকে যাবতীয় চিন্তা গ্রাস করে নেয় বিয়ের মাধ্যমে ‘ফোর-ফুটেড এনিম্যাল’ (টু অ্যান্ড টু মেইক ফোর) হওয়ার পর। পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলতে চান ‘চিরকুমারদের চেয়ে বিবাহিত পুরুষরা বেশিদিন বাঁচে। কথাটা সত্য নয়। বিয়ের পর পুরুষরা মরার আগেই বারবার মরে!’</p> <p>অভিনেত্রী ব্রিজিত বারদোত বলতেন, ‘পুরুষরা মূলত পশু; এমনকি পুরুষরা যা করে তা পশুরাও করতে পারে না।’ ব্রাদোতের অভিজ্ঞতাকে একপাশে ঠেলার সুযোগ নেই। অন্তত তার এই মন্তব্য আংশিক সত্য!</p> <p>তাই পুরুষবন্দনায় সবকালেই পুরুষের পায়ের নখ থেকে শুরু করে চুলের ডগা অবধি চুলচেরা বিশ্লেষণে কবিকুল ব্যতিব্যস্ত না থেকে পুরুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আর শারীরিক শক্তির ওপর রচনা করে গেছেন হাজারো পঙক্তিমালা। পুরুষের সৌন্দর্য বলতে সে কত বলশালী—এই উপজীব্যকেই মাথায় রাখা হয় সব সময়। তবে পুরুষবন্দনার দু-চারখান পঙক্তি বাদ দিলে কবি-সাহিত্যিকরা হাজার বছর ধরে যা উগড়ে দিয়েছেন, তার সারসংক্ষেপ: ‘পুরুষ হিংস্র, পুরুষ দাম্ভিক; পুরুষ যোদ্ধা; পুরুষ অত্যাচারী; পুরুষ দেহলোভী।’</p> <p>নারী-পুরুষের বাহ্যিক গড়নের প্রাকৃতিক পার্থক্যটাই পুরুষকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বেশি ‘পুরুষ’ বানিয়ে দেয়। হয়তো এ কারণেই পুরুষ শক্ত; পুরুষ নির্ভীক! শুধু নারীর ওপর ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক আর পারিবারিক খড়্গ নেমে আসে, এটা পুরোটাই সত্য নয়। একই খড়্গের ধার পুরুষকেও সইতে হয় নানা আঙ্গিকে। তবে পুরুষের ওপর বরাবরের মতো দোষ চাপিয়ে দিতে কার্পণ্য করেন না পুরুষের কথিত অত্যাচারে নিষ্পেষিত নারীকুল!</p> <p>সামাজিকতার নিক্তিতে মাপতে গেলে নারীকে বহন করতে না পারার অজুহাতে গ্লানিময় জীবনের দায়ভাগের বেশির ভাগই চাপে পুরুষের ওপর। অথচ নারীবাদী গোষ্ঠীর অনিয়ন্ত্রিত হুংকার আর আবদারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করতে হয় অসহায় পুরুষকুলকে। পৃথিবী আর মানবসভ্যতাকে যুগে যুগে যারা রক্ষা করেছে তাদের ৯৯ শতাংশই পুরুষ। হাতে গোনা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, মাদার তেরেসা কিংবা ভেলেরির কথা বাদ দিলে এখনো পুরুষের বুদ্ধি আর বাহুবলের আশ্রয়ে লালিত-পালিত হয় পুরো বিশ্ব।</p> <p>মজার ব্যাপার হচ্ছে, নারীকে রক্ষায় পৃথিবীতে যত আইন রয়েছে, পুরুষ রক্ষায় সেই পরিমাণ আইন পৃথিবীতে নেই। পান থেকে চুন খসলেই নারী পুরুষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মিটিং-মিছিলে সোচ্চার হয়ে যেতে পারেন। অবশ্য তাদের এই প্রতিবাদের স্বর তেঁতে ওঠে পুরুষেরই কারণে, নিদেনপক্ষে উসকানিতে!</p> <p>বাসে ৯টি মহিলা সিট দিয়ে নারী অধিকার সংরক্ষিত করা হয় অথচ পুরুষকে টানা দুই ঘণ্টা বাসের রডে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিস করতে হয় শুধু নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। আসলে পুরুষ মুখ বুজে ত্যাগ স্বীকার করতে পারে বলেই তাদের অধিকার রক্ষায় কোনো সমিতি নেই, অফিস নেই, নেই কোনো রাজপথ-কাঁপানো স্লোগান। আর নারীরাও তো পুরুষের অধিকার নিয়ে কথাই বলেন না!</p> <p>নাড়ির টানে বিশ্ব মা দিবস, বিশ্ব নারী দিবসে দুনিয়াজোড়া কত শত জম্পেশ আয়োজন। মাতৃদুগ্ধ দিবস, শিশু দিবস, টিকা দিবস—এগুলোও ঘুরেফিরে নারীর কোলঘেঁষা। গোনায় ধরলে নারীর জন্য বছরজুড়ে নামে-বেনামে অগণিত দিবসের ছড়াছড়ি। অথচ দুনিয়ায় একটি জুতসই ও ফলদায়ী পুরুষ দিবসের আকাল। মুখরক্ষায় যেটিকে পুরুষ দিবস বলা হচ্ছে, ওটা তো স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা, গালভরা নিষ্প্রাণ বুলি। ভাবা যায়, গত শতকের ষাটের দশক থেকে একটি পুরুষ দিবস বরাদ্দের দাবিটি মাত্র ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘ আমলে নেয়। তাও পালিত হয় অনাড়ম্বরে, চোখ টাটানো অবিরাম অবহেলায়। তার পরও পুরুষকুল স্বর্ণইগল দৃষ্টিতে দূর অজানার পানে তাকিয়ে থাকে নতুন ভোরের প্রয়োজনে।</p>