<p style="text-align:justify">ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দক্ষিণ চীন সাগর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অঞ্চলটি আজকের বিশ্বরাজনীতিতে একটি বড় দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই সাগরটি শুধু চীনের মতো উদীয়মান শক্তির জন্য নয়, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ সামুদ্রিক বাণিজ্য এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়।</p> <p style="text-align:justify">তেলের বিশাল ভাণ্ডার, গ্যাসের মজুদ এবং মৎস্যসম্পদ দক্ষিণ চীন সাগরকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। চীনের অর্থনৈতিক উত্থান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব রক্ষার প্রতিযোগিতা দক্ষিণ চীন সাগরে এক বহুমুখী ক্ষমতার লড়াইকে উসকে দিয়েছে। অন্যদিকে এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ; যেমন—ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই এবং তাইওয়ানও এই সংকটের সঙ্গে জড়িত।</p> <p style="text-align:justify">চীন আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং একটি বৈশ্বিক শক্তি।</p> <p style="text-align:justify">অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি চীন সামরিক ও কৌশলগত শক্তি বৃদ্ধি করেছে। দক্ষিণ চীন সাগর চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি চীনের সামুদ্রিক বাণিজ্যের একটি প্রধান রুট এবং তাদের ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড’ উদ্যোগের কেন্দ্রীয় উপাদান। চীন দাবি করে যে দক্ষিণ চীন সাগরের প্রায় ৯০ শতাংশ তার সার্বভৌমত্বের অন্তর্ভুক্ত, যা তাদের ‘নাইন-ড্যাশ লাইন’ মানচিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">তবে এই দাবিগুলো আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষত ১৯৮২ সালের ইউএন কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি</p> <p style="text-align:justify">(UNCLOS)এর পরিপন্থী। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বরাজনীতিতে একক আধিপত্য বিস্তার করেছে। কিন্তু চীনের উত্থান এই আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ‘ফ্রিডম অব নেভিগেশন’ কার্যক্রম চালিয়ে চীনের দখলদারিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ ছাড়া জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মার্কিন মিত্র রাষ্ট্রগুলো এই সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।</p> <p style="text-align:justify">দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের জ্বালানি পরিবহন দক্ষিণ চীন সাগরের মাধ্যমে হয়, যা তাদের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।</p> <p style="text-align:justify">দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য আঞ্চলিক দেশগুলোর জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালত দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের বেশির ভাগ দাবিকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করে ফিলিপিন্সের পক্ষে রায় দিলেও চীন এই রায়কে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে আসছে। বরং চীন তার সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করে দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত এলাকাগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, যা ফিলিপিন্সের সার্বভৌমত্বের প্রতি স্পষ্ট অবমাননা। অন্যদিকে ভিয়েতনাম চীনের এই আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক অবস্থান নিয়েছে। তাদের সামরিক বাহিনী চীনের ক্রমাগত হুমকি মোকাবেলায় সক্রিয় থেকে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এদিকে তাইওয়ান, যাদের দক্ষিণ চীন সাগরে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ রয়েছে, চীনের কার্যক্রমে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাইওয়ান সতর্ক করেছে যে চীনের আগ্রাসী পদক্ষেপ আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এই আঞ্চলিক দেশগুলো চীনের আধিপত্যের ফলে নিজেদের সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে, যা দক্ষিণ চীন সাগরে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।</p> <p style="text-align:justify">দক্ষিণ চীন সাগর চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু, যা বিশ্বরাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তনের পূর্বাভাস দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সীমিত করতে তার নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতি নিশ্চিত করছে। ফ্রিডম অব নেভিগেশন কর্মসূচির আওতায় মার্কিন যুদ্ধজাহাজ নিয়মিত দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত অঞ্চলে প্রবেশ করে, যা আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে চীন দক্ষিণ চীন সাগরের বিভিন্ন দ্বীপ এবং কৃত্রিম দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো তৈরি করে তার কৌশলগত অবস্থান মজবুত করছে। এ ধরনের পদক্ষেপে অঞ্চলটির ওপর চীনের একচেটিয়া দখলের ইঙ্গিত স্পষ্ট। চীন-মার্কিন এই প্রতিযোগিতা শুধু দুই পরাশক্তির সীমিত সংঘাত নয়, বরং এটি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো; যেমন—জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনাম সরাসরি এই প্রতিযোগিতার প্রভাবে পড়ছে। এসব দেশের বাণিজ্যিক এবং সামরিক নীতিগুলোও এই উত্তেজনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পুনর্গঠিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের এই প্রতিযোগিতা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তিকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। একই সঙ্গে এটি ইঙ্গিত দেয় যে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে আগামী দিনে শক্তির ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আসতে পারে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমে চীনের আধিপত্য বাড়তে পারে।</p> <p style="text-align:justify">দক্ষিণ চীন সাগরে প্রায় ১১ বিলিয়ন ব্যারেল তেল এবং ১৯২ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাসের মজুদ রয়েছে। এর ফলে এটি একটি কৌশলগত সম্পদ অঞ্চল হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া এই অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম প্রধান মাছ ধরার এলাকা, যা স্থানীয় অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। সামরিক দিক থেকে চীন এই অঞ্চলে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে সেখানে সামরিক স্থাপনা গড়ে তুলছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোও এই অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে। দক্ষিণ চীন সাগরের সংকট আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। আঞ্চলিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি ও আক্রমণাত্মক নীতির কারণে উদ্বিগ্ন। ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনেইসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো তাদের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনীতিতেও এই সংকট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালত চীনের বেশির ভাগ দাবি অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করলেও চীন সেই রায় উপেক্ষা করে আক্রমণাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব এবং বৈশ্বিক কূটনীতিতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরের সংকট শুধু একটি আঞ্চলিক বিরোধ নয়, এটি একটি বৈশ্বিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে, যা অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক আইন ব্যবস্থাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।</p> <p style="text-align:justify">দক্ষিণ চীন সাগরের সংকট সমাধানে বহুপক্ষীয় আলোচনার প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। জাতিসংঘ, আসিয়ানসহ অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থাকে এখানে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি বহুপক্ষীয় কূটনীতি জোরদার করতে চীন এবং দক্ষিণ চীন সাগরের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ আলোচনা ও সহযোগিতা বাড়ানো অপরিহার্য। এদিকে সামরিক উত্তেজনা কমানোও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক উত্তেজনা এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই উভয় পক্ষের উচিত সামরিক মহড়া সীমিত করা, সামরিক সংলাপ বাড়ানো এবং এমন পদক্ষেপ নেওয়া, যা আস্থার সংকট দূর করবে।</p> <p style="text-align:justify">দক্ষিণ চীন সাগরের সংকট ভূ-রাজনীতির একটি জটিল চিত্র তুলে ধরে। চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতা এবং আঞ্চলিক স্বার্থের সংঘাত এই সংকটকে আরো গভীর করে তুলছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক শান্তি রক্ষায় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং বহুপক্ষীয় সমাধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ চীন সাগর শুধু একটি আঞ্চলিক ইস্যু নয়, এটি বৈশ্বিক রাজনীতির ভারসাম্য নির্ধারণে একটি প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>লেখক : </strong>সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়</p>