তবে আজ আমার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে; অথচ আপনি স্বীকার করতেও রাজি নন যে এমন কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটছে। বরং আপনি ইসরায়েলকে উৎসাহমূলক শব্দ উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। আজ আপনি বলছেন, ‘আরো, আরো, এসব অর্থহীন হত্যাকাণ্ড আরো বেশি হোক।’ আর ইসরায়েল আপনার ইচ্ছা পূরণ করতে পেরে খুবই খুশি।
আমেরিকার পুলিশ বাহিনীর হাতে যখন তাদের কেউ নিহত হয় তখন আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গরা ওই নিহত ব্যক্তির নাম উচ্চৈস্বরে বলে সম্মান জানায়। যেহেতু ইসরায়েলি বাহিনী আমার পরিবারকে হত্যা করছে আমি তাদের নাম উচ্চারণ করে তাদের সম্মান জানাতে চাই।
জনাব বাইডেন, আজ ৭৯ বছর বয়সী আমার নানা নায়েফ আবু শাম্মালা ও তাঁর ৭৬ বছর বয়সী স্ত্রী ফাতিয়াকে হারিয়ে গভীরভাবে শোকাহত।তারা উভয়ে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময়ে ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নির্মূল অভিযান ‘নাকাবা’ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন।
ফিলিস্তিনের অন্য ৫৩০টি শহর গ্রামের সঙ্গে গাজার উত্তরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার (প্রায় ২০ মাইল) দূরের বেইট দারাস গ্রামটি জাতিগতভাবে ধ্বংস করা হয়। নাকবা থেকে রক্ষা পাওয়া সাড়ে সাত লাখ শরণার্থীর অনেকের মতো ফাতিয়া ও নায়েফ খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। নিজ গ্রামে ফেরা পর্যন্ত একমাত্র অস্থায়ী এ শিবিরে তাদের থাকার কথা ছিল। নায়েফ ও ফাতিয়া আর আমাদের মধ্যে নেই। জাতিসংঘ প্রদত্ত নিজ ভূমিতে ফেরার অধিকার প্রয়োগের আগেই তারা মারা গেছে।
বোমা হামলায় নিহদের মধ্যে তাদের তিন মেয়েও রয়েছ। খান ইউনিসের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ও হাসিখুশি মুখের অধিকারী আয়েশা ও তার বোন দৌলত যে আমার পরিবারের সবচেয়ে সুন্দরী নারীদের একজন। কয়েকদিন আগে সে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে পরিবারকে দেখতে এসেছিল। এবং কনিষ্ঠ বোন উমাইমা তার মেয়ে মালাকের সঙ্গে এসেছিল। ক্রমাগত বোমাবর্ষণ থেকে রক্ষা পেতে তারা পরিবারের বাড়িতে ছিলেন।
নায়েফ ও ফাতিয়ার চার ছেলে হাসান, মাহমুদ, মোহাম্মদ ও জুহাইর এবং তাদের স্ত্রী ফাদিয়া, নিমা ও এশাকেও হত্যা করা হয়। ভাগ্যক্রমে একমাত্র জুহাইরের স্ত্রী বেঁচে যান। কারণ সে অন্য পরিবারের কাছে তাদের মৃতদের জন্য সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন। নিহতদের মধ্যে হাসানের তিন সন্তান মোহাম্মদ, ইসমাইল ও সালমাও রয়েছে। নায়েফ ও ফাতিয়ার জীবিত ছেলে ইবরাহিম তার বড় ছেলে নায়েফকে হারিয়েছে। দাদার নামে তার নাম রাখ হয়। কেদেয়াহ ও আল্লাহাম পরিবারের সদস্যদের যারা আমার দাদার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের সবাইকেও হত্যা করা হয়েছে।
জনাব বাইডেন, যেন এটুকুই যথেষ্ট ছিল না। আমার দাদির বাড়িতেও বোমা হামলা হয়েছে। তার নাম উম সাইদ। ৯২ বছর বয়সী আমার দাদিও বেইত দারাস থেকে এসেছিলেন। তিনিও ৪৮ সালের নাকবা থেকে প্রাণে বেঁচেছিলেন। তিনি তার মেয়ে নাজাতকে নিয়ে খান ইউনিসের বাড়িতে থাকতেন। উভয়েই এখন ধ্বংসস্তূপের নিচে বিশ্রামের জায়গা খুঁজে পেয়েছেন। মানুষ তাদের লাশ বের করার চেষ্টা করছে তবে পারেনি। তার দুই ছেলে মারওয়ান ও আসাদ এবং মেয়ে মুনার পাশের বাড়িতেও বোমা হামলা হয়।
মারওয়ান বেঁচে গেলেও তার স্ত্রী সুহায়লা ও চার সন্তান মোহাম্মদ, মাহমুদ, আয়া, শাহদ মারা গেছেন। মুনাও তার দুই ছেলে আমজাদ ও মোহাম্মদের সঙ্গে মারা যান। আসাদ, তার স্ত্রী ইমতিয়াজ এবং তাদের ছেলে মেডিকেলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবদুল রহমানও চলে গেছে।
আসাদের বাড়িসহ তার ছোট মুদির দোকান নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আমরা দেশে বেড়াতে গেলে আমার ছেলে আজিজের কাছে স্থানটি খুবই প্রিয় জায়গা ছিল। খান ইউনুস শিবিরে আসাদ খুবই ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিতি ছিলেন। কারণ তিনি খুবই অল্প মূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। তার কাছে মোটা খাতা থাকলেও প্রায়ই তিনি বাকির অর্থ সংগ্রহ করতে ভুলে যেতেন কিংবা ক্ষমা করে দিতেন। আজ আসাদের সুন্দর হাসি, তার বিনম্র আচরণ, তার পরিবার, তার দোকান সবই আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
বোমা বর্ষণের সময় আমাদের অনেক আত্মীয় ও প্রতিবেশী আসাদের দোকানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে যায়। সে মানুষের ফোন ও ব্যাটারি বিনামূল্যে চার্জ করতে দিতে সৌর বিদ্যুৎ কিনেছিল। তখন অনেকে তার সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে তার দোকানে যায়। এখন সবাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। নিহতদের মধ্যে আকরাম, রিমন, বৈরুত, ইমাদ, নেইমাসহ আরো কয়েকজন রয়েছে যাদের নাম মনে করতে পারছি না।
জনাব বাইডেন, আপনি কি বিশ্বাস করেন, একজন ইসরায়েলি মায়ের ব্যথা একজন ফিলিস্তিনি মায়ের ব্যথার চেয়ে বেশি আঘাত করে? একজন ইসরায়েলি শিশুর জীবন কি ফিলিস্তিনি শিশুর জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান? গাজায় শিশুদের গণহত্যাকে উৎসাহিত করতে আপনি এখন যা করছেন আমার কাছে এটিই একমাত্র ব্যাখ্যা।
আমি যখন শিশুদের নিয়ে কথা বলি তখন আমি তাদের নিজস্ব নাম, মুখ, হাসি ও স্বপ্নসহ মানব শিশুদের কথা বলি। আপনার সহযোগিতায় ইসরায়েল চার হাজারের বেশি শিশুর জীবন কেড়ে নিয়েছে, যার মধ্যে নবজাতকও রয়েছে। চার হাজার সুন্দর আত্মাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
তাদের মধ্যে আমার বোনের নাতনি জুলিয়া আবু হুসেন রয়েছে যার বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। আমার ভাগ্নে আমজাদ ও তার স্ত্রী রাওয়ান জুলিয়াকে আমার বোন সামিয়ার পরিবারের সঙ্গে নিরাপত্তার খোঁজে খান ইউনিসে নিয়ে যান। গাজার উত্তরে তাদের বাড়ি থেকে সেখানে যেতে তিন দিন লাগে। অথচ তা ৩০ মিনিটেরও কম সময়ের দূরত্বে অবস্থিত। ইসরায়েলি সেনাদের স্থান ত্যাগের আহ্বান শোনা গেলেও তাদের কোনো নিরাপত্তা দেওয়া হয়নি।
বোমাবর্ষণ শুরু হওয়ার পর রাওয়ান জুলিয়াকে নিজ কোলে নিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে রান্নাঘরে চলে যায়। ইসরায়েলি বোমায় আমাদের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জানালাগুলো ভেঙে বেশ কিছু টুকরো ঘরে ঢুকে পড়ে। জুলিয়া তার মায়ের কোলে মারা যায়। আর তার খালা নাজাম মারাত্মকভাবে আহত হয়।
জনাব বাইডেন, অতএব এখানে এমন শিশু রয়েছে যার জীবন এমন যুদ্ধের সহিংসতায় কেড়ে নেওয়া হয়েছে যা আপনি আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছেন। আপনি কি বিষয়টি কল্পনা করতে পারছেন? আপনি কি সত্যিই এসব ট্র্যাজেডির মাত্রা বুঝতে পারছেন? নাকি আপনি এখনও প্রশ্ন করতে চাচ্ছেন যে ইসরাইল কি ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার জন্য দোষী?
গাজায় প্রতিদিন আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের নিহত হওয়ার কথা শুনছি। আমি নানা উপায়ে মৃত্যুর খবর বর্ণনার চেষ্টা করছি। মারা গেছে, চলে গেছে, তাদের আত্মা জান্নাতে গেছে এমন ভাষায় আমি মৃত্যুর খবর দিচ্ছি। এদিকে মিডিয়া আমাকে বলছে যে তারা হয় মৃত নয়; কিংবা তারা মৃত, তবে তারা সন্ত্রাসী।
গত গ্রীষ্মে গাজায় গেলে আমার দাদি উম সাইদ আমাকে তার এমব্রয়ডারি করা পোশাক দিয়েছিল। তিনি জোরাজুরি করে করেছিলেন যেন আমি তা নিয়ে কানাডায় ফিরি। আমি তার কথা রাখতে পেরে কৃতজ্ঞ। আজ উম সাইদও তার বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছে। তাকে মনে রাখার জন্য আমার কাছে কেবল তার এমব্রয়ডারি করা পোশাকই রয়েছে।
আমি নিশ্চিত, বর্তমানে যা ঘটছে এসব ইতিহাস লেখা হলে আপনি তাতে এমন ব্যক্তি হিসেবে থাকবেন যে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি গণহত্যাকে উৎসাহ দিয়েছে ও শক্তি যুগিয়েছে। আপনাকে এমন একজন হিসেবে স্মরণ করা হবে যার সরকার সক্রিয়ভাবে যুদ্ধাপরাধে অংশ নিয়েছে।
জনাব প্রেসিডেন্ট, আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আপনি এমন ব্যক্তি যিনি সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখেন। সেই হিসেবে আপনার হাতের রক্ত বৈধ করতে প্রার্থনায় আপনি তাঁকে কী বলেন?