<p>সার্ভার থেকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন (বিডিআরআইএস) তথ্য-উপাত্ত উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে খবর বেরিয়েছিল, তা ঠিক না। দায়িত্বে থাকা নিবন্ধকদের অনেকে হাতে লেখা নিবন্ধনের তথ্য-উপাত্ত অনলাইনে অন্তর্ভুক্ত করতে না পারার কারণে তা সার্ভারে পাওয়া যাচ্ছে না। </p> <p>হাইকোর্টে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলেরে কার্যালয়ের দেওয়া এক প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে। কার্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার জেনারেল সামিউল ইসলাম রাহাদের স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনটি রবিবার বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের দ্বৈত বেঞ্চে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান। এ সময় রিটের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ। </p> <p>পরে আইনজীবী তানভীর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, “নির্দেশ অনুযায়ী জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলেরে কার্যালয় একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। কিন্তু সেটি অসম্পূর্ণ হওয়ায় আগামী ১০ আগস্ট পরবর্তী তারিখ রেখেছেন। এই সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত।”</p> <p>জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে নাগরিকদের ভোগান্তি ও সার্ভারে জন্মনিবন্ধনের তথ্য না থাকা নিয়ে গত বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন যুক্ত করে পরে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী তানভীর আহমেদ। </p> <p>আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৪ সালে জন্মনিবন্ধন আইন করা হয়, কার্যকর হয় ২০০৬ সালে। পাসপোর্ট ইস্যু, বিবাহ নিবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়া, জমি রেজিস্ট্রেশনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। শুরুতে হাতে লেখা সনদ দেওয়া হতো। এরপর ২০১০ সালের শেষ দিকে এসে তা ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত নিবন্ধকদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের জন্য সরকার আলাদা বরাদ্দও দেয়। কিন্তু সে সময় সব তথ্য ডিজিটাল করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জনবসতি বেশি এমন এলাকাগুলো, বিশেষ করে সিটি করপোরেশনে তথ্য হালানাগাদ পুরোপুরি হয়নি।</p> <p>নাম প্রকাশ না করে সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তাকে উদ্বৃতি করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালের পর যে সার্ভারে কাজ করা হতো, তা বছরখানেক আগে পাল্টানো হয়। নতুন সার্ভারে আগের সার্ভারের সব তথ্য স্থানান্তর করা হয়নি। আগে জন্ম নিবন্ধন করে সনদ নিয়েছেন এমন কয়েক কোটি মানুষকে এখন সম্পূর্ণ নতুন করে অনলাইনে জন্মনিবন্ধন করাতে হবে। কারণ তাদের আগের নিবন্ধন গায়েব হয়ে গেছে।</p> <p>এ রিটের প্রাথমিক শুনানির পর গত বছর ২৯ মে রুলসহ আদেশ দেন হাইকোর্ট। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন তথ্য-উপাত্ত উধাওয়ের অভিযোগ অনুসন্ধান বা তদন্তের উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টদের এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। </p> <p>জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন তথ্য-উপাত্ত উধাও হওয়ার কারণে দেশের নাগরিকদের বড় একটি অংশ যে ভোগান্তিতে পড়েছে, সে ভোগান্তি লাঘবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা ও উদাসীনতা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন তথ্য-উপাত্ত উধাওয়ের অভিযোগ অনুসন্ধান বা তদন্তের উদ্যোগ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, জানতে রুল জারি করা হয়। সেই সঙ্গে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০১৮ এর  রুল-১৯ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তৈরি করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে।</p> <p>স্থানীয় সরকার সচিব, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার‌্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল, পরিকল্পনা-পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন কার্যালয়ের মহাপরিচালক এবং আইন বিভাগের যুগ্ম সচিবকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। </p> <p>হাইকোর্টের এ আদেশের পর গত বছর ৪ অক্টোবর একজন উপরেজিস্ট্রার জেনারেলকে (প্রশাসন) আহ্বায়ক ও একজন সহকারী রেজিস্ট্রার জেনারেলকে সদস্য সচিব করে চার সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। এ কমিটির পর্যবেক্ষণ, মতামতের ভিত্তিতে দেওয়া প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করা হলো।  </p> <p><strong>যা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে</strong></p> <p>ইউনিসেফ-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর আদ্যেপান্ত তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, জন্ম নিবন্ধন তথ্য ২০১৩ সালের ৩০ জুনের মধ্য বিআরআইএস সফটওয়্যারে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নিবন্ধকদের অনুরোধ করা হলেও অনেক নিবন্ধক কার্যালয়ই তা করেননি। এ অবস্থায় ২০১৫ সালে ফেব্রুয়ারিতে ব্যবহারকারীর চাপে বিআরআইএস সফটওয়্যার আইডি অকার‌্যকর হয়ে পড়ে। তিন মাস অকার্যকর অবস্থায় পরে থাকায় অনলাইনে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের কাজ বন্ধ ছিল। </p> <p>প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু তাই না, কারিগরি ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে জন্ম ও মৃত্যুর তথ্য ডাটাবেস থেকে বিনষ্ট হয়ে যায়। এ পর্যায়ে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আসতে থাকলে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) থেকে একটি উন্নতমানের সার্ভার বরাদ্দ নেওয়া হয়। পরে ইউনিসেফের সহায়তায় একজন ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্টও নিয়োগ দিয়ে সার্ভারটি সচল করা হয়। তখন পর্যন্ত ১৪ কোটির বেশি মানুষের উপাত্ত নতুন সর্ভারে স্থানান্তর করা হয়। স্থানান্তরের পর সিস্টেমটি অটো বেকআপসহ চালু করা হয়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত সার্ভারটি ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট, বিসিসি ও প্রকল্পের কারিগরি টিমের পর‌্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে ছিল। তখন সিস্টেমটি কখনো কখনো সাসপেক্ট মুডে চলে যাওয়ায় সার্ভারটিকে বারবার রিস্টার্ট দিতে হচ্ছিল। এ পরিস্থিতির কারণে জন্ম নিবন্ধন অনলাইনভুক্তকরণ কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু উপাত্তের অবলুপ্তিও ঘটে।  </p> <p>ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, ক্যান্টনম্যান্ট বোর্ড ও দূতাবাস মিলিয়ে ৫ হাজার ১৬০টি নিবন্ধক কার্যালয়ের মাধ্যমে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কাজ পরিচালিত হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব নিবন্ধক কার্যালয় সরাসরি রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের অধীনস্থ না বলে রেজিস্ট্রার কার‌্যালয়ের সরাসরি কর্তৃত্ব নেই। আইনগতভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও দূতাবাসগুলো জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্ব পালন করছে।</p> <p>প্রতিবেদনে বলা হয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সার্ভার খুবই সুরক্ষিত। রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের আইটি বিশেষজ্ঞ ছাড়া আর কারো এই সার্ভারে ঢুকার এক্সেস নেই। রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের আইটি বিশেষজ্ঞরা জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সার্ভারের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে থাকেন। তাই এই সার্ভার থেকে তথ্য-উপাত্ত উধাও হওয়ার বিষয়টি সত্য না। </p> <p>ইনপুট দেওয়া তথ্য এই সার্ভারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষিত হয়। কিন্তু অনেক নিবন্ধক কার্যালয় হাতে লেখা জন্ম নিবন্ধন তথ্য-উপাত্ত ইনপুট দিতে না পারায় নাগরিকের জন্ম নিবন্ধন তথ্য অনলাইনে অর্থাৎ সার্ভারে নেই। অর্থাৎ ওই নিবন্ধন তথ্যসমূহ কখনো অনলাইনে আপলোড করা হয়নি। </p> <p>প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সার্ভার থেকে তথ্য উধাও হয়ে যাওয়া বা সার্ভারের সংরক্ষিত তথ্যের গোপনীয়তা নষ্ট হওয়ার কোনো বিষয় নেই। কোনো তথ্য-উপাত্ত চুরি হয়নি। ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ নষ্টও করেনি বা উধাও হয়নি। </p> <p>প্রতিবেদনের শেষ অংশে বলা হয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন নম্বরটি সিস্টেম থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়। তাই যে সব জন্ম নিবন্ধন সনদ অনলাইনভুক্ত হয়নি সেসব জন্ম নিবন্ধন সনদে যে নিবন্ধন নাম্বার ছিল তা হুবুহু ফিরে পাওয়া সম্ভব না। তাই নতুন করে জন্ম নিবন্ধনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।</p>