<p>আমলাদের মতো বিচারকরাও সুদমুক্ত ঋণে ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে চান। গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের গাড়ি কেনার নীতিমালার অনুমোদনও দিয়ে গেছেন। এখন অর্থ বিভাগের অনুমতি পেলেই গাড়ি কেনা শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।</p> <p>নীতিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ এবং চাকরিকাল ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছে এমন যুগ্ম জেলা জজ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত গাড়ি ক্রয়ের জন্য সুদমুক্ত ঋণ ও গাড়ি সেবা নগদায়ন সুবিধা পাবেন।</p> <p>ঋণের টাকায় ১৫০০ থেকে ২০০০ সিসি মডেলের গাড়ি কেনা যাবে। ২০২০ সালে জারীকৃত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ ও গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ‘বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের সুদমুক্ত ঋণ ও গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালা-২০২৩’-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।</p> <p>বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জুডিশিয়াল সার্ভিস কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত গাড়ির সুদমুক্ত ঋণের জন্য নিয়মিত চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখনো অর্থ বিভাগ চূড়ান্ত অনুমোদন দিচ্ছে না।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘আইন ও বিচার বিভাগের উপদেষ্টা ও সচিবকে কয়েকবার বলা হয়েছে। তাঁরা আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। আইন উপদেষ্টা বলেছেন, উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তারা যদি গাড়ি পান, তাহলে সমমর্যাদার যাঁরা আছেন তাঁদের অবশ্যই গাড়ি পাওয়া উচিত।’</p> <p>ব্যয় সাশ্রয়ের যুক্তি দেখিয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যুগ্ম সচিব থেকে শুরু করে ওপরের পদের কর্মকর্তাদের প্রাধিকারপ্রাপ্ত হিসেবে ২০১১ সালে সুদমুক্ত গাড়ির ঋণ চালু করে আওয়ামী লীগ সরকার।</p> <p>এরপর ২০১৭ সাল থেকে উপসচিবরা এ ঋণ পাচ্ছেন। এ সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের ব্যয় যেমন বেড়েছে, তেমনি অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারের দূরত্ব বেড়ে গেছে। বর্তমানে প্রশাসনে কর্মরত উপসচিবদের সবাই পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তা। এরপর অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাসহ পঞ্চম গ্রেডের প্রায় সব কর্মকর্তা সুদমুক্ত গাড়ির ঋণের জন্য আন্দোলন ও তদবির শুরু করেন। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যাঁরা সরাসরি যেতে পেরেছেন, তাঁরা এ সুবিধা পেয়ে গেছেন। তবে জেলা জজ হলেন গ্রেড-১, অতিরিক্ত জেলা জজ গ্রেড-২, যুগ্ম জেলা জজ গ্রেড-৩ পর্যায়ের কর্মকর্তা।</p> <p>এর মধ্যে ২০১৯ সাল থেকে সশস্ত্র বাহিনীর মেজর ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল বা সমমর্যাদার ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ সুবিধা পাচ্ছেন। একইভাবে ২০১৯ সাল থেকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব ও তদূর্ধ্ব এবং সংসদ সচিবালয়ের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ সুবিধা পাচ্ছেন। বিচারকদের মতো একটি গোয়েন্দা সংস্থার জন্যও এ ঋণের অনুমোদন দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এসব কর্মকর্তা গাড়ি কিনতে ৩০ লাখ টাকা এবং রক্ষণাবেক্ষণ, তেল ও চালকের বেতন বাবদ মাসে ৫০ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন। তবে প্রেষণ, মাঠ প্রশাসন ও প্রকল্পে কর্মরত প্রাধিকারপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার সার্বক্ষণিক গাড়ি ব্যবহারের সুবিধা থাকলে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২৫ হাজার টাকা পাবেন। সচিব ও জ্যেষ্ঠ সচিব এবং সচিব পদমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তারা আরো ২৫০ লিটার পেট্রল বা অকটেন পাচ্ছেন। ফলে ঋণের টাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার পরও সরকারের যাতায়াত খাতে ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ। কারণ সরকারিভাবে সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কেনার পরও বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থার প্রকল্পের বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করছেন আমলারা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় গত ২ সেপ্টেম্বর সব জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিবদের এক চিঠিতে জানিয়েছেন, প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত গাড়ি সুবিধা পাওয়ার পরও অনৈতিক ও বিধিবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ব্যবহার করছেন। অথচ নীতিমালার ১৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সুদমুক্ত ঋণসুবিধা গ্রহণকারী কোনো কর্মকর্তা তাঁর দপ্তর থেকে রিকুইজিশনের ভিত্তিতে কোনো গাড়ি সরকারি বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবেন না।</p> <p>এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় যে পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এখন গাড়ি দেওয়া হয় তাঁদের কাউকে দেওয়া উচিত হয়নি। কারণ একটা গরিব দেশে সবচেয়ে বেশি থাকবে গণপরিবহন।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে এখানে আমরা একটা বড় বিভাজন করে রেখেছি। কোনো কোনো সার্ভিসে উপসচিব হলে গাড়ি পাচ্ছে। অন্তত সংগত কারণেই অন্যদের মধ্যে এই গাড়ির প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। তুমি যদি পাও, আমি পাব না কেন—এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বৈষম্য থেকে এই যন্ত্রণা সৃষ্টি।’</p> <p>সবাই মিলে এই সুবিধা ত্যাগ করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গণপরিবহন ব্যবহার করলে দেশের জন্য ভালো হবে জানিয়ে ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমি উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত রিকশা, গণপরিবহন ও সিএনজিতে চড়তাম। আমার খুব শখ ছিল উপদেষ্টা হওয়ার পরও এসব পরিবহনে চড়ব। কিন্তু আমাকে অসম্ভব ভয় দেখানো হয়েছে। নিরাপত্তার কারণে যেটা অসম্ভব। আমরা বিদেশে দেখি মন্ত্রীরা ট্রেনে করে অফিস করছেন। আমাদের এখানে এটাই হওয়া উচিত ছিল।’</p> <p>সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সুদমুক্ত ঋণের মাধ্যমে গাড়ি সুবিধা ছিল এক প্রকার ঘুষ। এ জন্য আমি এই ঋণ নেইনি। ঋণ নিয়ে তাঁরা গাড়ি কিনলেও বেশির ভাগ কর্মকর্তা বেআইনিভাবে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। এতে অনাচার বেড়েছে, খরচ বেড়েছে, রাষ্ট্রের ওপর অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো লাভ হয়নি। সুশাসন পরিপন্থী কাজ হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে ঋণ দেওয়া হয়েছিল, সেটা আদৌও সাধন হয়নি।’</p> <p><strong>গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে বছরে ব্যয় হচ্ছে ২০৪ কোটি টাকা</strong></p> <p>এ পর্যন্ত উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের প্রায় চার হাজার কর্মকর্তা এ ঋণ পেয়েছেন। এর মধ্যে কর্মরত দুই হাজার ৫০০ জন। অবসরে গেছেন প্রায় এক হাজার ৫০০ জন। কর্মরতদের মধ্যে সার্বক্ষণিক গাড়ি ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছেন প্রায় এক হাজার কর্মকর্তা। সশস্ত্র বাহিনীর মেজর ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল বা সমমর্যাদা ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কর্মকর্তা এই সুবিধা পাচ্ছেন। এর মধ্যে কর্মরত প্রায় সাড়ে চার হাজার কর্মকর্তা। অবসরে গেছেন দুই হাজার কর্মকর্তা। কর্মরতদের মধ্যে সার্বক্ষণিক গাড়ি ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছেন প্রায় এক হাজার কর্মকর্তা। ফলে প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীর এসব কর্মকর্তার জন্য প্রতি মাসে সাড়ে ১৭ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে। বছরে ব্যয় হচ্ছে ২০৪ কোটি টাকা। </p> <p>এ বিষয়ে অর্থসচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘কৃচ্ছ্রসাধনের লক্ষ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সব ধরনের যানবাহন ক্রয় বন্ধ রেখেছে সরকার। গত ৪ জুলাই এসংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করা হয়। এর মধ্যে গাড়ি ক্রয়ের অনুমোদন দেওয়া হলে সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।’ </p> <p><strong>বিচারকদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণে বছরে ব্যয় হবে প্রায় ৬০ কোটি টাকা</strong></p> <p>বর্তমানে জেলা জজ আছেন ৩২২, অতিরিক্ত জেলা জজ ৩৫৬ জন ও যুগ্ম জেলা জজ ৩১৭ জন। তাঁদের এ ঋণ দেওয়া হলে প্রতি মাসে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যয় হবে চার কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বছরে ব্যয় হবে ৫৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা।</p> <p>প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গাড়ি ক্রয়ের জন্য সুদমুক্ত ঋণ ও গাড়ি সেবা নগদায়ন সুবিধা প্রদানসংক্রান্ত সারসংক্ষেপ ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন করেন। সারসংক্ষেপ অনুযায়ী, আইন ও বিচার বিভাগ গাড়ি ক্রয়ের সুদমুক্ত ঋণ মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ উদ্দেশ্যে অর্থ বিভাগ প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করবে। এরপর জুডিশিয়াল সার্ভিসের কর্মকর্তারা এককালীন সুদমুক্ত ঋণ, মাসিক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় এবং অবচয় সুবিধা পাবেন।</p> <p>সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ থাকায় ‘বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের সুদমুক্ত ঋণ ও গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালা-২০২৩’ জারির আগে অর্থ বিভাগের মতামত গ্রহণের জন্য ২০২৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর চিঠি পাঠানো হয়। অর্থ বিভাগ ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ এবং চাকরিকাল ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছে এমন যুগ্ম জেলা জজ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গাড়ি ক্রয়ের জন্য সুদমুক্ত ঋণ ও গাড়ি সেবা নগদায়ন সুবিধা প্রদান বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণপূর্বক স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রস্তাব পাঠাতে বলেন। এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর সুদমুক্ত ঋণ ও গাড়ি সেবা নগদায়ন সুবিধা প্রদান বিষয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেছে। এখন অর্থ বিভাগ অনুমোদন দিলেই কেনা হবে গাড়ি।</p>