তুলসীর পর টাইমসে ভর : বাংলাদেশকে  কলঙ্কিত করার অপচেষ্টায় নতুন হাইপ

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল
শেয়ার
তুলসীর পর টাইমসে ভর : বাংলাদেশকে 
কলঙ্কিত করার অপচেষ্টায় নতুন হাইপ

ঐতিহ্যগতভাবেই বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বর্গভূমি। বিশ্বব্যাপী এর স্বীকৃতি মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষ নিয়ে এ দেশের সমাজ-সংস্কৃতি। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে তাদের বসবাস।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সম্পদ ও সৌন্দর্যও। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা ও অন্যান্য শিল্প মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির বেশ প্রভাব ও ছোঁয়া। এর বিপরীতে দেশটিতে গণ্ডগোল পাকাতেও সময়ে সময়ে ইস্যু করা হয় সাম্প্রদায়িকতাকে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা রাজনৈতিক।

আবার ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলে অঘটন ঘটিয়ে রাজনৈতিক মোড়ক দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। কখনো কখনো বড় রকমের ইস্যু আড়াল করতে সাম্প্রদায়িক গোলমাল বাধানোর কাণ্ডকীর্তি এ অঞ্চলে বেশ কয়বার হয়েছে। সেনা, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতায় সেই অপচেষ্টা মারও খেয়েছে। এর পরও থেমে নেই অপচেষ্টাটি।
সামান্য সুযোগ পেলেই খাবলে ধরার মতো লয়ে পড়ে মহলবিশেষ।
  
কিছুদিন আগে একটি মিশন চালানো হয়েছিল ভারত সফরে আসা মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের ওপর ভর করে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ‘গভীর উদ্বিগ্ন’ বলে তার দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ মহলটি বেশ আশাবাদী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের  অবস্থান বদলে গেছে—এ মর্মে তাদের প্রচারণা তুঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা বুমেরাং হয়ে যায় অল্প ক’দিনেই। ট্রাম্পের সেন্ট্রাল প্রশাসন থেকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় বর্তমান সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করেছে।

ওই বাস্তবতায় সেই যাত্রায় ব্যর্থ হয়ে এখন তা হাইপ তোলার অপচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের ঘাড়ে চড়ে। ‘বাংলাদেশ নতুন করে গড়ে উঠছে, ইসলামী কট্টরপন্থীরা সুযোগ খুঁজছে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিকে পুঁজি করে আবার একটা নাড়া দেওয়ার আয়োজন যে কারোই বোধগম্য। বিভ্রান্তিকর ও একপক্ষীয়’ মন্তব্যশ্রায়ী তথ্য দিয়ে হাইপ তোলার এ প্রকল্পে বিশাল বিনিয়োগ। প্রতিবেদনটি প্রকারান্তরে একটি প্রবন্ধ। যার বর্ণনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতাকে অতিসরলীকৃতভাবে দেখানো হয়েছে। সেই সঙ্গে অস্বীকার করা হয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতিকে। বাছাই করা কিছু ঘটনা তুলে ধরে সাজানো প্রবন্ধটিতে রক্ষণশীল আন্দোলনের কথা বলা হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের নারী উন্নয়নে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি, সেখানে নারীদের দেখানো হয়েছে অনগ্রসর করে। এবারের ‘যুব উৎসব ২০২৫ এখানে উদাহরণ হিসেবে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ২৭ লাখ মেয়ে অংশ নিয়েছে। তিন হাজার খেলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে নারীরা। এই বিশাল ইভেন্টে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী তরুণী ও বিভিন্ন স্তরের নারীদের যুক্ত হওয়া বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রাণবন্ততা প্রমাণ করে। একটি মাত্র ফুটবল খেলা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়া মানে এই নয় যে, বাকি দুই হাজার ৯৯৯টি সফল আয়োজনের মূল্য নেই। টাইমস তা-ই বোঝানোর চেষ্টা করেছে। একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সামনে এনে গোটা অগ্রগতিকে খাটো করে দেখানো মোটেই সাংবাদিকতা নয়। এটি চাতুরীর রাজনীতি।
 
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে। টাইমসের প্রতিবেদনে এর সামান্যতম উল্লেখ নেই। বেশ গুছিয়ে আরেকটি ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস চরমপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেননি ‘মন্তব্যে’র মধ্য দিয়ে। যা কেবল অসত্য-বিভ্রান্তিকরই নয়, বরং এটি তার দীর্ঘদিনের নারী ক্ষমতায়নের কাজকে অস্বীকার করা। ড. ইউনূসের নারীর ক্ষমতায়নের অন্তপ্রাণ চেষ্টা বিশ্বব্যাপী একটি রোল মডেল। গ্রামীণ ব্যাংক ও তার ক্যারিয়ারজুড়ে তিনি নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার স্বীকৃতি তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে। 

বাংলাদেশের নারীরা দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও ক্রীড়াঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের লিঙ্গ সমতা সূচকে ৭৩তম অবস্থানে বাংলাদেশ। নারী ফুটবল ও ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতকে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকে ৪০% কর্মকর্তা নারী। পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে হাজারো নারী কাজ করছেন। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো একজন নারী মেজর জেনারেল নিয়োগ দিয়েছে। অথচ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশে নারীদের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ধর্মীয় সহিংসতা হিসেবে চিত্রিত করার অপচেষ্টাও চালানো হয়েছে। শেখ হাসিনার বিদায়ের পর যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তা মূলত রাজনৈতিক এবং এর অনেকগুলো ঘটনাকে ধর্মীয় সংঘাত হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই জনসমর্থন পেতে ধর্মকে ব্যবহার করে, যা সমস্যাটিকে আরো জটিল করে তোলে। রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ধর্মীয় নিপীড়ন বলে চালানোর মওকা খোঁজা হয়। টাইমসেও তা করা হয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর পর দিন তিনেক বাংলাদেশ ছিল পুলিশহীন, কার্যত সরকারহীন। এ সময়টাতে সাম্প্রদায়িক গোলমালসহ সামাজিক গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা চলে।

অবাক-বিস্ময়করভাবে ছাত্র-জনতা, আলেম-ওলামারা তখন নিজ থেকেই এগিয়ে আসে ঐক্যের আলোকবর্তিকা হয়ে। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় দাঁড়িয়ে গেছে কারো নির্দেশ ছাড়াই। পাহারা দিয়েছে মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনা। দায়বদ্ধতা ও ঐক্যের ওই বাতাবরণ অটুট থাকলে এখন ঐক্য ঐক্য করে মাথা পানি করতে হয় না। ৮ আগস্ট ক্ষমতা নেয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষাকে টপ প্রায়োরিটি হিসেবে নিয়েছে। এই লক্ষ্যে সেনা-জনতা এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। যা বাংলাদেশে চরমপন্থার বিরুদ্ধে একটি লাল সংকেত। এর পরও দেশে চরমপন্থার উত্থানের গল্প সাংবাদিকতার অপমান।

কারো বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ এখন এশিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক শক্তি। বিগত কয়েক মাসে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রায় ১২ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে তা বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজার হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও বেশ আলোচিত। বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশ বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের চোখ-চশমায় ঘুরছে। কেবল গত সপ্তাহে ড. ইউনূসের চীন সফরের সময় বাংলাদেশ ২.১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে।

‘ইনভেস্টরস কনফারেন্সে ৫০টি দেশের দুই হাজার ৩০০ প্রতিনিধিসহ মেটা, উবার, স্যামসাং-এর মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। পরিবর্তন ও অগ্রগতির এমন এক সন্ধিক্ষণে নিউইয়র্ক টাইমস অবিচার করেছে বাংলাদেশের ওপর। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ, তাদের ঘরবাড়ি দখল, জ্বালাও-পোড়াও, মাজারে আক্রমণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাধা, নারীদের পোশাক নিয়ে কটূক্তি কিংবা পোশাকের কারণে নারীদের হেনস্থা করার মতো কিছু ঘটনাকে রঙিন মোড়কে সামনে এনে বাংলাদেশে উগ্রবাদের উত্থানের কাহিনি প্রচারের এজেন্ডা নতুন আয়োজনে আরো জোরদার করা হয়েছে। উগ্রবাদ এখন বৈশ্বিক সমস্যা। এর জেরে গণতন্ত্র একটি নতুন চ্যালেঞ্জে।

বাংলাদেশ আইন প্রয়োগ, সামাজিক সংস্কার ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রমের মাধ্যমে তা মোকাবেলায় আগেভাগেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেখানে বিচ্ছিন্ন  কিছু উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর বক্তব্য ও কার্যকলাপকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাথে পরিচায়ক করা দুরভিসন্ধিমূলক। বাংলাদেশে মৌলবাদীরা নারী ফুটবল বন্ধ করে দিয়েছে মর্মে পুরনো রেকর্ডটি নতুন করে বাজিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়, জয়পুর হাটে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়াজক কমিটি বিনা টিকেটে ফুটবল আয়াজনের অনুমতি নিলেও শর্ত ভঙ্গ করে টিনের বেড়া দিয়ে টিকেটের ব্যবস্থা করে। এতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এছাড়া মাঠের পাশে অশ্লীল নৃত্যের কারণে স্থানীয় কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষের সাথে ভুল-বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটে। তবে মূলত টিকিট ব্যবস্থার অনিয়মের কারণে সেখানে বিশৃঙ্খলা ঘটে যা নিয়ে মিডিয়ায় ভুলভাবে তথ্য ছড়ানো হয়৷ সেদিনের ম্যাচটি পরিত্যক্ত হলেও ৭  দিন পরে ম্যাচটি কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়। অভিযোগ করা হয়েছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রী হয়রানির শিকার হন। তবে এটি একটি ব্যক্তিগত অপরাধ, ধর্মীয় কোনো বিষয় নয়। আর পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে। এই ঘটনাগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আরো দাবি করা হয়েছে, ইসলাম অবমাননার শাস্তি না দিলে মৌলবাদীরা নিজেরাই বিচার করবে। ২০১৩ সালে একটি ইসলামি দল হাইকোর্টে ধর্ম অবমাননার শাস্তি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে রিট করেছিল, যা আদালত খারিজ করে দেয়। বর্তমানে সরকার এই ধরনের কোনো দাবি গ্রহণ করেনি। 

দাবি করা হয়েছে যে নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ বেড়েছে। সরকার হিজবুত তাহরিরের মতো সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে। গত এক বছরে ২০০ জনের বেশি উগ্রপন্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর যে মিছিলের কথা বলা হচ্ছে, তা বিগত ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী সরকার ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র এর একটি অপচেষ্টা, যা বর্তমান সরকার ব্যর্থ করে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এটি মুসলিম উগ্রপন্থীরা ছিল না, বরং হিন্দু উগ্রপন্থী সংগঠন ইসকনই সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে প্রবল আন্দোলন পরিচালনা করেছিল। সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি পরিস্থিতি মোকাবিলায় অত্যন্ত ধৈর্যশীলতা দেখিয়েছে। দাবি করা হয়েছে নতুন সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সরিয়ে বহুত্ববাদ আনা হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে বহুত্ববাদ আনার দাবির বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং বহুত্ববাদ নিয়ে আলোচনা করেছে, তবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিলের কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি।

বহুত্ববাদ একটি সামাজিক ধারণা, যা বিভিন্ন ধর্ম, মতাদর্শ ও সংস্কৃতির সহাবস্থান নিশ্চিত করে, কিন্তু এটি ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীত নয়। বরং ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি এটি রাষ্ট্রীয় নীতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। অতএব, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে-এমন তথ্য অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক। বাংলাদেশ আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মতো উগ্রবাদী হচ্ছে তথ্যও একটি রটনা। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় দেশগুলো বলছে, মডারেট মুসলিম কান্ট্রি। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে স্থিতিশীল দেশগুলোর একটি।
এরপরও একের পর এক অভিযোগের তীর যখন ছোঁড়া হচ্ছে, সেইক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতার আবশ্যকতা রয়েছে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলা ভিশন

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

গণতন্ত্র, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার দুঃশাসন

মো. আবদুর রাজ্জাক
মো. আবদুর রাজ্জাক
শেয়ার
গণতন্ত্র, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার দুঃশাসন
সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে যদি গণতন্ত্রের সুবাতাস প্রবাহিত হয় তাহলে সেখানে মানুষের বাকস্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আর যখন দেশে গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে তখন মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে স্বৈরতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটেছে এবং সেটাকে রোধ করার জন্য একজন মহান ব্যক্তির জন্ম হয়েছে, যার দক্ষ নেতৃত্বে স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটেছে।

তিনি স্বমহিমায় মানুষের হৃদয়পটে বীরের বেশে নেতা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন। যাকে মানুষ বরণ করে নিয়েছে ফুল দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে স্থান করে নিয়েছে মনের গভীরে, যা অম্লান। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র দেশ। এখানেও বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্রের লেবাস পরে দেশ শাসন করেছে স্বৈরশাসকরা।
ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে লড়াই-সংগ্রাম করে যারা স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।

একেবারে গৃহিণী থেকে কালের বিবর্তনে পরিপক্ব রাজনীতিবিদ। যার নামের আগে শোভা পায় দেশনেত্রী, আপসহীন নেত্রী, গণতন্ত্রের মানস কন্যা। যাকে কোনো লোভ-লালসা স্পর্শ করতে পারেনি।

যার হৃদয় কোমল, কিন্তু সিদ্ধান্তে ছিলেন হিমালয়ের মতো অটল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে যার নেতৃত্বে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার অদম্য সাহস, বজ্র কঠিন ভাষণ, দৃঢ় মনোবল, বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত, যা ছাত্রসমাজকে নতুন পথ দেখাতে উজ্জীবিত করেছিল। তার দিকনির্দেশনায় বাঙালি জাতি ফিরে পেয়েছিল গণতান্ত্রিক পরিবেশে গণতন্ত্র চর্চা করার সুযোগ।

বাঙালি জাতিকে হতাশায় ডুবিয়ে কোনো দিকনির্দেশনা না দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছিলেন, তখন বেগম খালেদা জিয়া পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মেজর জিয়াউর রহমানের পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছিলেন। তিনিও স্ত্রী-পুত্রের মায়া না করে দেশকে ভালোবেসে কোনো আপস না করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে সেনাবাহিনীপ্রধান, রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত
করেছিলেন। ওআইসিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হয়েছিলেন সমাদৃত। তিনি ছিলেন একজন নির্লোভ, নিরাহংকার, সদালাপী, পরোপকার, দেশপ্রেমিক একজন খাঁটি মুসলমান। সংবিধানে বিসমিল্লাহ তারই সংযোজন। বেগম খালেদা জিয়া ছায়ার মতো সঙ্গী হয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সব গুণ অর্জন করেছিলেন। যার সবটুকু তিনি দেশের সেবায় মানব কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন। 

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর দলের প্রয়োজনে তাকে দলের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। কখনো সম্মুখ সারিতে, কখনো আত্মগোপনে থেকে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে দেশকে উপহার দিয়েছেন সোনালি সূর্য। এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ যখন সমগ্র বাংলাদেশ অগ্নিগর্ভ তখন তার ব্যক্তিত্ব, উদারতা, মননশীলতা, ধৈর্য, ত্যাগ বজ্রকঠিন সিদ্ধান্ত দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা অন্ধকারে আলোকবর্তিকা হিসেবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পাশে থেকে গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন। পেয়েছেন সফলতা পাহাড়সম সম্মান, মর্যাদা। এরশাদ সরকারের ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে নামের আগে যুক্ত করেছেন আপসহীন নেত্রী অথচ শেখ হাসিনা তার অধীনে নির্বাচন করে খেতাব পেয়েছিলেন জাতীয় বেঈমানের। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। এমনভাবে বই-পুস্তক লেখা হয়েছে যাতে শেখ পরিবারের কথা ছাত্র-ছাত্রীরা মুখস্থ করতে করতে বড় হয়। স্বাধীনতার ঘোষক যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেই কথা প্রমাণসহ আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতার বইয়ের মধ্যে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তার বড় সন্তান তারেক জিয়া, যার শ্বশুর নৌবাহিনীপ্রধান, তার স্ত্রী একজন দেশে এবং বিদেশে স্বনামধন্য চিকিৎসক। তার মেয়ে জায়মা রহমান একজন ব্যারিস্টার। বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান বাংলাদেশ ক্রিকেটের আধুনিক রূপকার। অথচ এই পরিবারকে ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী সহ্য করতে পারতেন না। ঈষান্বিত হয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অশালীন মন্তব্য সব সময় করতেন, যা দেশপ্রেমিক জনগণও সুশীল সমাজের নিকট কাম্য ছিল না। 

বেগম জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেছেন, কী খেলে লিভার সিরোসিস হয়, মরার বয়স হয়েছে এখানো কেন মরে না, অথচ ৫ আগস্ট গণভবন থেকে বের হওয়ার পর অনেক মানুষের হাতে বিদেশি দামি মদের বোতল দেখা গেছে। গণতন্ত্রের অহংকার, স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ, তারুণ্যের অহংকার, কোটি মানুষের নয়নমণি তারেক জিয়াকে কুলাঙ্গার বলেছেন। অথচ তারেক জিয়া একবার গোপালগঞ্জে গেলে শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করেছিলেন। এটা হলো জিয়া পরিবারের পারিবারিক শিক্ষা। ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী বলতেন, দশটা হুন্ডা, বিশটা গুণ্ডা, নির্বাচন ঠাণ্ডা।

ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী বলতেন, ‘আমার শুধু পাওয়ার চাই’। তিনি পাওয়ার নিয়েই ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালে দিনের ভোট রাতে করে গণতন্ত্রকে হত্যা করে স্বৈরশাসক পদবি পেয়েছিলেন। তিনি দেশ এবং দেশের মানুষদের নিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে যা ইচ্ছা, তাই করেছিলেন, কিন্তু মানুষের মন জয় করতে পারেননি। তার আমলে কত মায়ের বুক খালি হয়েছে। হত্যা, খুন, গুম, জেল, জুলুম, আয়নাঘর সবই ফ্যাসিস্ট সরকারের অত্যাচারের জ্বলন্ত উদাহরণ। কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, কত সন্তান বাবা হারিয়েছে, কত মা সন্তান হারিয়েছে, কত স্ত্রী স্বামী হারিয়েছেন। তাদের কান্না ও চোখের পানিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছে। অথচ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার হৃদয় গলেনি।

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের জননী তাকে বিনা দোষে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় যে টাকা তিনি স্পর্শ করেননি তাকে শেখ হাসিনা নাজিম উদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মানবতার সব দিক বিসর্জন দিয়ে, মেরে ফেলার জন্য দিনের পর দিন বিনা চিকিৎসায় কারাগারে ফেলে রেখেছিলেন। আত্মীয়-স্বজন, চিকিৎসক—এমনকি আইনজীবীদের সঙ্গেও দেখা করতে দেননি। ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ছাড়ার সময় এবং কেন্দ্রীয় কারাগারে বেগম জিয়ার চোখের পানি আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছে অথচ শেখ হাসিনার হৃদয় গলেনি মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তার প্রমাণ শেখ হাসিনা নিজেই। কতটুকু হৃদয়হীন হলে শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে বলতে পারেন, মরার বয়স হয়েছে এখনো মরে না কেন, পদ্মায় চুবানোর কথা বলেছেন। আমাদের বাড়িতে গেলে বসার জায়গা পেত না, মোড়ায় বসত। যা ছিল শিষ্টাচারবহির্ভূত। অথচ সর্বকালের সেরা রাষ্ট্রপতি বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন।

বেগম খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার বহু ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। সব ষড়যন্ত্র থেকে তাকে রক্ষা করেছেন আল্লাহ এবং দেশের জনগণের ভালোবাসা। তিনি বলেছিলেন, বিদেশে আমার কোনো বাড়ি-ঘর নেই। এটাই আমার দেশ। তিনি দেশের জনগণকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছেন বলেই তাদের দোয়ায় তিনি বেঁচে আছেন। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন তিনি দেশপ্রেমিক জনগণের মনের মণিকোঠায় অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে গণতন্ত্রের মানস কন্যা হিসেবে ভালোবাসার প্রতীক হয়ে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে যথার্থই বলা যায়—
She is the man of honour, principle, mother of Democracy and humanity in a true sense.

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান সমাজকর্ম বিভাগ, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ, ঢাকা।

মন্তব্য

শিষ্টাচারের রাজনীতি এবং বেগম জিয়া

    অদিতি করিম
শেয়ার
শিষ্টাচারের রাজনীতি এবং বেগম জিয়া
ফাইল ছবি

রাজনীতিতে এখন প্রতিহিংসা, আক্রমণ, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অসহিষ্ণু প্রবণতা বেড়েছে ভীষণ। পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ যেন লোপ পেয়েছে। রাজনীতির মাঠে এখন কুৎসিত নোংরামি এবং কাদা ছোড়াছুড়ির জয়জয়কার। সহনশীলতা শব্দটি যেন আজ বিলুপ্ত।

এক পক্ষ অন্য পক্ষকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করা, এমনকি প্রয়াত ব্যক্তিদের অসম্মান করার একটি রীতি আতঙ্কজনকভাবে বেড়ে গেছে। কিন্তু এটি প্রকৃত রাজনীতি নয়। এটি রাজনীতির শিক্ষাও নয়। রাজনীতি হলো রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল।

রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা সমাজের আদর্শ। তাঁরা সমাজকে পথ দেখান। একটি রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে তার পথনির্দেশ নির্মাণ করেন। কাজেই রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে দেশের জনগণ শিখবে, এটিই সবার প্রত্যাশা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের রাজনীতি এখন যেন প্রতিহিংসার প্রতিযোগিতা, ভিন্নমতকে খতম করাই যেন আজকের রাজনীতির প্রধান কৌশল। বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে মতের অমিল থাকবে, বিরোধ থাকবে, কিন্তু এই বিরোধ সহিংসতার পথে পা বাড়াবে না। রাজনীতিতে শিষ্টাচার, প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা অত্যন্ত জরুরি। ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করা বরেণ্য রাজনীতিবিদরা এই বৈশিষ্ট্যগুলোর চর্চা করেছেন তাঁদের জীবনে। এই বৈশিষ্ট্য একজন রাজনীতিবিদকে পরিণত করে, বড় করে এবং আদর্শবান করে তোলে।

এই রাজনৈতিক শিষ্টাচারের জন্যই তাঁকে জনগণ শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। তাঁরা অনুকরণীয় হন। কিন্তু কিছুদিন ধরে রাজনীতিতে যেমন বিভক্তি দেখা দিচ্ছে, বিভক্তির সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিহিংসা। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে নির্মমভাবে আক্রমণ, সুযোগ পেলেই প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করে দেওয়া এবং যেকোনো ভিন্নমত হলেই তাকে অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ ভাষায় দমন করা, কখনো কখনো পাশবিক শক্তি প্রয়োগের একটা হিংস্র প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনীতিতে হিংস্রতা এবং ভাষাজ্ঞানহীন কথাবার্তার প্রবণতা বাড়ছে। একজন প্রতিপক্ষের রাজনীতিবিদকে কী ভাষায় কথা বলতে হবে, ভিন্নমতের ব্যাপারে কী ধরনের শিষ্টাচার দেখাতে হবে, সেই বোধগুলো আমাদের রাজনীতি থেকে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

এ রকম একটি অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিবেশে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম খালেদা জিয়া। তিনি রাজনীতিতে শিষ্টাচারের এক প্রতীক হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছেন। বিশেষ করে ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর তিনি যখন প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায় মুক্তিলাভ করেন, এর পর থেকে তাঁর প্রতিটি আচরণ এ দেশের মানুষকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে। দল-মত-নির্বিশেষে সবাই তাঁর প্রাজ্ঞ উদারতা, ধৈর্য ও ক্ষমাশীলতায় মুগ্ধ। এই মুহূর্তে রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি খালেদা জিয়া। নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে সব মানুষের হৃদয় জয় করেছেন তিনি। তাঁর পরিমিতিবোধ, ব্যবহার, আচার-আচরণ এবং সংযত কথাবার্তা এ দেশের শান্তিকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। খালেদা জিয়া সেই বিরল রাজনীতিবিদদের একজন, যিনি জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য গৃহবধূ থেকে রাজনীতির মাঠে এসেছিলেন। তাঁর আপসহীন নেতৃত্ব, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অবস্থান এবং জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধের কারণে বারবার নিপীড়িত-নির্যাতিত হয়েও তিনি তাঁর নীতি এবং আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন, কিন্তু সেই সমালোচনা কখনো শিষ্টাচারবহির্ভূত হয়নি। অশালীন নোংরামির পর্যায়ে যায়নি। তিনি কোনো সময় প্রয়াত রাজনীতিবিদদের অসম্মানসূচক, অসত্য, কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করেননি, আক্রমণ করেননি। এই ধারাটি তিনি অব্যাহত রেখেছেন গোটা রাজনৈতিক জীবনে। রাজনীতিতে নিজের অবস্থান আদর্শ থেকে এতটুকু চ্যুত না হয়েও যে একজন রাজনীতিবিদ শিষ্টাচার মেনে চলতে পারেন, নম্র ভদ্রোচিত ভাষায় তীব্র সমালোচনা করতে পারেন, সেই নজির তিনি রেখেছেন তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে। জনগণের প্রয়োজনে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে বৈঠক করতে কার্পণ্য করেননি। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ব্যক্তির চেয়ে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন সব সময়। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময়। সে শিষ্টাচারের রাজনীতি এবং বেগম জিয়াসময় খালেদা জিয়াকে ড. ফখরুদ্দীন সরকার মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে। শুধু তাঁকে নয়, তাঁর দুই পুত্রকেও গ্রেপ্তার করা হয়। চলে চরিত্র হননের চেষ্টা। এই সময় খালেদা জিয়া আপস করেননি। কারাগার থেকে বেরিয়ে যখন তিনি আবার রাজনীতিতে এসেছেন, তখন এক-এগারোর কুশীলবদের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু সেই সমালোচনাটা শালীনতার সীমা কখনো অতিক্রম করেনি। বেগম জিয়া সম্ভবত সাম্প্রতিক সময়ে একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি অশালীন শব্দ প্রয়োগ ছাড়াই বিরোধী পক্ষের কঠোর সমালোচনা করেন। এক-এগারোর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে একটি অসত্য, ভিত্তিহীন মিথ্যা মামলায় তাঁকে প্রহসনের বিচারে নজিরবিহীনভাবে আটকে রাখা হয় কারাগারে। দিনের পর দিন কারা প্রকোষ্ঠে রেখে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। এই অবস্থায় তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকেই মনে করেছিলেন যে খালেদা জিয়া যদি কখনো সুযোগ পান, তাহলে হয়তো ভয়ংকর প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু বেগম জিয়া যেন তাঁর ওপর সব নিপীড়নের বিচারের ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর ওপর নিপীড়নের ব্যাপারে একটি কথাও বলেননি। ৫ আগস্ট মুক্ত হয়ে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে একটি কটূক্তিও করেননি। এমনকি তাঁর নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। নোংরা ভাষায় কথা বলেননি। তিনি শুধু বলেছেন, ‘আল্লাহ বাংলাদেশের জনগণকে এই দিনটি দেখালেন, আলহামদুলিল্লাহ।’ এর বেশি তিনি কোনো কথা বলেননি। অথচ বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে নিপীড়িত-নির্যাতিত ব্যক্তির নাম হলো খালেদা জিয়া। সাবেক সরকারের পাতি নেতারাও বেগম জিয়া সম্পর্কে যে কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন, তা চিন্তা করাও কুরুচির পরিচয় বহন করে। কিন্তু এসব অমার্জনীয় নোংরামির জবাব না দিয়ে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। নীরবতাই তাঁর শক্তি। তাঁর প্রতিবাদহীনতাই যেন মানুষের ভালোবাসা। তাঁর তো সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ করার কথা ছিল, কিন্তু তাঁর পারিবারিক ও রাজনৈতিক এই শিক্ষা তাঁকে সেই স্বীকৃতি দেয়নি। বরং তিনি তাদের শুধু নীতির সমালোচনা করেছেন। তাদের ভোট চুরির সমালোচনা করেছেন। তাদের লুণ্ঠনের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু কোনো ব্যক্তিকে নোংরা, কুৎসিত ভাষায় তিনি আক্রমণ করেননি। খালেদা জিয়ার এই ধরনের রাজনৈতিক শিষ্টাচার আজকের দিনে সবার জন্য অনুকরণীয়।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে খালেদা জিয়ার বাড়ি থেকে তাঁকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, যে বাড়িতে তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বামী শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন। ক্যান্টনমেন্টে শহীদ মইনুল হোসেন সড়কের বাড়িটি কেবল একটি বাড়ি ছিল না, এটি ছিল ইতিহাসের একটি অংশ। সেই বাড়ি থেকে যখন তাঁকে এক কাপড়ে বের করে দেওয়া হয়, তখনো খালেদা জিয়া রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে যাননি। নোংরা, কুৎসিত ভাষায় তিনি কথা বলেননি। এমনকি বাড়ি নিয়ে নজিরবিহীন অপপ্রচারে তিনি জবাব দেননি। খালেদা জিয়া মূলত এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি একজন আদর্শবান, জাতির অভিভাবকের মতোই আচরণ করেন। সবার ঐক্য, দেশের ভালো, দেশের মঙ্গল—এই বিষয়গুলো তাঁর সমস্ত বক্তব্যের মধ্যে উৎসারিত। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর খালেদা জিয়া কারাগার থেকে বেরিয়ে চিকিৎসার জন্য যান লন্ডনে, সেখানে ঈদ করেন তাঁর পুত্রের সঙ্গে। যুক্তরাজ্য থেকে তিনি ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে। সেখানেও তিনি বিভক্তির কথা বলেননি। অনৈক্যের কথা বলেননি, ধ্বংসাত্মক কথাবার্তা বলেননি, উসকানিমূলক বক্তব্য দেননি। এটিই একজন আদর্শ রাজনীতিবিদের বৈশিষ্ট্য। একজন রাজনীতিবিদ যে পরিশীলিত ভাষায় কথা বলেই জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, তাঁর আদর্শের অবস্থানটা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করার জন্য তাঁকে কোনো নোংরা বা অরুচিকর কথাবার্তা বলতে হয় না, তার প্রমাণ খালেদা জিয়া। আর এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন উজ্জ্বল নক্ষত্র বেগম জিয়া। ৮০ বছর হতে চলল তাঁর। কিন্তু এখনো সাধারণ জনগণের মধ্যে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা। বিশেষ করে এই সময় যখন রাজনীতিতে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে নিঃশেষ করে দিতে চায়, এক পক্ষ অন্য পক্ষের চরিত্র হননের জন্য অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করে, সেই সময় খালেদা জিয়া যেন জাতির এক আলোকবর্তিকা। তিনি সব রাজনীতিবিদের জন্য একজন শিক্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। কিভাবে রাজনীতিবিদদের কথা বলতে হয়, সমালোচনা করেও কিভাবে মানুষকে সম্মান জানাতে হয়, সেটির উদাহরণ হলেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া প্রতিশোধপ্রবণ নন। তিনি এক উদার গণতান্ত্রিক চেতনার ধারক-বাহক। এ কারণেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে অন্যায়-অবিচারগুলো করা হয়েছে, সেই অন্যায়-অবিচারগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তিনি দিয়েছেন দেশের আপামর জনগণকে। তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে এ পর্যন্ত কিছু কথা বলেছেন জনগণের উদ্দেশে, কিন্তু একটিবারও নিজের কথা বলেননি। জনগণের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা বলেছেন, নতুন করে দেশ বিনির্মাণের কথা বলেছেন। এটি তাঁর মহত্ত্ব। আমাদের রাজনীতিতে এখন উদারতার বড় অভাব, মহত্ত্বের বড় অভাব। এ রকম অবস্থায় বেগম জিয়ার মতো একজন অনুকরণীয় উদাহরণ বড় প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ রাজনীতিতে প্রতিহিংসা, কুৎসিত আক্রমণ, গালাগালি ইত্যাদি পছন্দ করে না। আর পছন্দ করে না বলেই খালেদা জিয়া এখন অনিবার্যভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। তিনি নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যেখানে দল-মত-নির্বিশেষে সব মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করে। সব মানুষ মনে করে যে এ রকম একজন রাজনীতিবিদই যেন দেশের জন্য প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ মনে করে, এ দেশের হাল ধরার মতো সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হলেন তিনি। তিনিই যেন বাংলাদেশের অভিভাবক। একজন মানুষের জনগণের প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেম এবং পারিবারিক শিক্ষা যে তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে, বেগম জিয়া তার প্রমাণ। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, যিনি প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেন না, বরং জনগণের হাতে তার বিচারের ভার ছেড়ে দেন। জনগণের বিপুল জনপ্রিয়তায় তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন। পেশিশক্তি প্রয়োগ বা কটূক্তি করে নয়, বরং জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন।

 লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক

E-mail : auditekarim@gmail.com

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
দৃষ্টিপাত

সোশ্যাল মিডিয়ার বিকৃত রুচি— শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মনুষ্যত্বের অবক্ষয়

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

শেয়ার
সোশ্যাল মিডিয়ার বিকৃত রুচি— শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মনুষ্যত্বের অবক্ষয়
প্রতীকী ছবি

আজকের ডিজিটাল যুগে সোশ্যাল মিডিয়া শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি হয়ে উঠেছে অর্থোপার্জনের হাতিয়ার, সমাজের রুচির দর্পণ, এমনকি নৈতিকতার মাপকাঠি। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা যখন কেবল অশালীনতা, ভাঁড়ামি আর সস্তা সেন্সেশনের উপর নির্ভর করে, তখন তা সমাজের জন্য এক ভয়াবহ সংকটের ইঙ্গিত দেয়। একজন নারী যখন টাওয়েল বা নাইটি পরে নাচলে লাখো ভিউ পায়, আর একজন গুণী কবি বা জ্ঞানী ব্যক্তির কথায় মানুষ নাক সিঁটকায়, তখন বুঝতে হবে আমাদের সমাজের মূল্যবোধ কোথায় হোঁচট খাচ্ছে।

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো আজ মনিটাইজেশনের লোভে মানুষের নৈতিকতা ও লজ্জাকে পণ্যে পরিণত করেছে।

দেবরকে আজ যা দিলাম!—এমন ক্যাপশনে কৌতূহল জাগিয়ে ভিডিও তৈরি করলে তা ভাইরাল হয়, কিন্তু সমাজসংস্কার, শিক্ষা বা শিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপেক্ষিত থেকে যায়। এখানে কবিতার চেয়ে বক্ষ প্রদর্শন বেশি মূল্য পায়, জ্ঞানের চেয়ে খিস্তির কদর বেশি। যেন মানুষ এখন শুধু চায় উত্তেজনা, চায় অশ্লীলতার মাঝে হারিয়ে যেতে। এমনকি মাঝবয়সী নারীরাও আজ প্রেমের কবিতা পড়ার চেয়ে শারীরিক প্রদর্শনেই বেশি সাড়া পাচ্ছেন।

কমেডির নামে আজ যা চলছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অশ্লীলতা ও খিস্তির মিশেল। পাবলিক হাসছে, কিন্তু সেই হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে আমাদেরই রুচির দৈন্য। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, সমাজের উন্নতি ঘটে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার মাধ্যমে, নাইটি বা শারীরিক প্রদর্শনের মাধ্যমে নয়। যখন একজন মা-বোন স্কুলের পড়া ছেড়ে রিলস বানাতে উৎসাহিত হন শুধু টাকার লোভে, তখন আমাদের ভাবতে হবে—আমরা আসলে কোন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছি?

মনিটাইজেশনের এই উন্মত্ততা আমাদের নতুন প্রজন্মকে কী শিক্ষা দিচ্ছে? তারা শিখছে যে, পড়াশোনা বা সততার চেয়ে সস্তা সেলিব্রিটি হওয়াটাই বড় সাফল্য।

তারা দেখছে, সমাজে সম্মান পেতে হলে বুকের খাঁজ দেখাতে হবে, দেবর-ভাসুর নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কন্টেন্ট বানাতে হবে। এভাবে কি আমরা একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারব? নাকি আমাদের সন্তানদের হাতে তুলে দেব শুধু বিকৃত রুচি আর নৈতিক অধঃপতনের উত্তরাধিকার?

সময় এসেছে জেগে ওঠার। সোশ্যাল মিডিয়ার অপসংস্কৃতি রোধ করতে হবে। প্যারেন্টস, টিচার্স ও ইনফ্লুয়েন্সারদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, পেট চালানোর জন্য নৈতিকতা বিক্রি করা কখনই সমাধান নয়।

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি ফিরে যেতে হবে। নইলে একদিন আমাদের সন্তানরা প্রশ্ন করবে—আপনারা আমাদের জন্য কী রেখে গেলেন? নাইটি নাচ, নাকি জ্ঞানের আলো? উত্তর দিতে পারব কি?

মন্তব্য

মিডিয়া সংস্কারে কার স্বার্থে একচোখা সুপারিশ

মাহফুজ জুয়েল
মাহফুজ জুয়েল
শেয়ার
মিডিয়া সংস্কারে কার স্বার্থে একচোখা সুপারিশ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কামনায় রাষ্ট্র সংস্কারের প্রসঙ্গটি জোরালোভাবে সামনে আসে। সংস্কারের বাসনায় একে একে গঠন করা হয় সাতটি কমিশন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন।

এর মধ্যে ১৮ নভেম্বর ১১ সদস্যের গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার।

কমিশনের প্রধান করা হয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদকে। ২২ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। কমিশনের সদস্যদের অনেকেই নিজ নিজ কর্মগুণে স্বনামখ্যাত সুশীল এবং নিঃসন্দেহে জ্ঞানীগুণী। তাঁরা তুলনামূলক দ্রুততম সময়ে তথ্যসমুদ্র মন্থন করে ১৮০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জাতিকে উপহার দিয়েছেন।
আমরা আশা করি, দেশ ও জাতির সার্বিক মঙ্গল বা ইতিবাচক পরিবর্তনের বাসনা থেকেই তাঁরা তাঁদের মূল্যবান সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন। কষ্ট করে পড়তে গেলেই তা ধরতে পারা যায়।

কমিশনের সুপারিশমালার শুরুতেই গণমাধ্যমের মালিকানার কথা বলা হয়েছে। একই কোম্পানি, গোষ্ঠী, ব্যক্তি, পরিবার বা উদ্যোক্তা যাতে একই সঙ্গে একাধিক মাধ্যমের মালিক হতে না পারে, সেজন্য বিশ্বের বহু দেশে ‘ক্রস-ওনার শিপ’ (টেলিভিশনের মালিক সংবাদপত্রের মালিক হতে পারেন না বা সংবাদপত্রের মালিক টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক হতে পারেন না) নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে কমিশন ‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া’র সুপারিশ করেছে।

কমিশন মনে করে, বাংলাদেশেও অচিরেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ক্রস-ওনার শিপ নিষিদ্ধ করে অধ্যাদেশ করা যায়। যেসব ক্ষেত্রে এটি বিদ্যমান সেগুলোয় পরিবর্তন আনার নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তাদের ব্যবসা পুনর্গঠনের লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া প্রয়োজন। এগুলো নানা পদ্ধতিতে হতে পারে।

যেসব কোম্পানি, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, পরিবার একই সঙ্গে টেলিভিশন ও পত্রিকার মালিক, তারা যে কোনো একটি গণমাধ্যম রেখে অন্যগুলোর মালিকানা বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তর করে দিতে পারে। অথবা দুটি গণমাধ্যমের (টেলিভিশন ও পত্রিকা) সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একত্র করে আরও শক্তিশালী ও বড় আকারে একটি গণমাধ্যম (টেলিভিশন অথবা পত্রিকা) পরিচালনা করতে পারে।

কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, একক মালিকানায় একই ভাষায় একাধিক দৈনিক পত্রিকা বা একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করে। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমের যে প্রভাবক ক্ষমতা, তা নিজস্বার্থে কেন্দ্রীভূত করে। সে কারণে এ ব্যবস্থার অবসান হওয়া দরকার। বিদ্যমান এ ব্যবস্থার দ্রুত সমাধান করতে হবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, একই সাবান একাধিক মোড়কে বাজারজাত করায় যেমন বাজারের প্রতিযোগিতা নষ্ট করে, একই মালিকানায় একই ভাষায় একাধিক দৈনিক পত্রিকাও গণমাধ্যমের প্রতিযোগিতা নষ্ট করে এবং পাঠক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এজন্য ‘এক উদ্যোক্তার একটি গণমাধ্যম (ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া)’ নীতি কার্যকর করাই গণমাধ্যমের কেন্দ্রীকরণ প্রতিরোধের সেরা উপায় বলে মনে করে কমিশন।

আর এ কথাগুলো পড়ার পরই অধমের চোখে খটকা লাগে। প্রতিবেদনটিও অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্যতা ও পবিত্রতা হারায়। মুহূর্তেই ‘অনেক দুধের মধ্যে এক ফোঁটা গোমূত্র পড়ার’ চিত্রকল্পটাও ভেসে ওঠে। প্রতিবেদনটি পক্ষপাতদুষ্ট এক উদ্ভট যাচ্ছেতাই বালখিল্য বিষয়ে পরিণত হয়। বোঝা যায়, নেহাত দেশ ও জনগণ, গণমাধ্যম বা গণমাধ্যমকর্মীদের মঙ্গলাকাক্সক্ষা নয়, এখানেও গতানুগতিক অপরাজনীতি ও ঘৃণ্য গোষ্ঠীস্বার্থ কাজ করেছে। সেই ‘গোষ্ঠীস্বার্থ’ও আবার স্রেফ ‘ব্যবসায়িক বিদ্বেষতাড়িত’। হ্যাঁ, স্রেফ বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসা থেকেই কমিশন এ আজগুবি ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়ার সুপারিশ করেছে এবং ক্রস-ওনার শিপের প্রসঙ্গ টেনেছে।

বিদ্বেষের তাড়নায় কখনোই সর্বজনীন ভালো কিছু হয় না। ফলে কমিশনের এ প্রতিবেদন গণমাধ্যমকে ইতিবাচক নতুন কিছু দেওয়া থাক দূরে, বরং আরও অস্থির ও অস্থিতিশীল করে তুলবে। অদৃশ্য অব্যক্ত অসংখ্য ক্ষত বয়ে চলা নাজুক গণমাধ্যমকর্মীদের জীবনে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ বা ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ দেওয়ার প্রেসক্রিপশন দিয়েছে গণমাধ্যম কমিশন।

কোন প্রতিষ্ঠান কয়টা পত্রিকা বা টেলিভিশন চালু করতে পারবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো বৈধ যুক্তি নেই। যার বৈধ টাকা আছে সে কেন পারবে না? কোনো একটি শিল্পগোষ্ঠীকে মাথায় রেখে এ সুপারিশ সামনে আনা হলে মূল উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠবে এবং সেটাই স্বাভাবিক।

কেননা এর বিপরীত চিত্রটাই পৃথিবীতে সবল সচল। চোখের সামনেই এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকা গ্রুপের কথা ধরুন। তাদের অনেক পত্রিকা রয়েছে। ভারত সরকার কি এ ব্যাপারে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে?

রয়েছেন মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মার্ডক, তাঁর কোম্পানি নিউজ করপোরেশন। তিনি বিশ্বজুড়ে শত শত স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বহুমুখী প্রকাশনা ও সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের মালিক। এ একই প্রতিষ্ঠানের অধীনে যুক্তরাজ্যে রয়েছে দ্য সান এবং দ্য টাইমস, অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, হেরাল্ড সান এবং দি অস্ট্রেলিয়ান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং নিউইয়র্ক পোস্ট। এ ছাড়া তিনি টেলিভিশন চ্যানেল স্কাই নিউজ অস্ট্রেলিয়া এবং ফক্স নিউজ (ফক্স করপোরেশনের মাধ্যমে), টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিস ফক্স এবং নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের (বর্তমানে বিলুপ্ত) মালিকও ছিলেন।

আছেন জন কার্ল মেলোন। এ আমেরিকান মিডিয়া মুঘল, যিনি লিবার্টি মিডিয়ার চেয়ারম্যান। তিনি ‘কেবল কাউবয়’ নামেও পরিচিত। তিনি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া, টেলিযোগাযোগ এবং বিনোদন প্রতিষ্ঠানের মালিক।

জন কার্ল মেলোন ১৯৯২ সালে ‘ফাইভ হানড্রেড চ্যানেল ইউনিভার্স’ ধারণাটি ব্যবহার করেন ভবিষ্যতের মিডিয়ার পরিবেশ-পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য, যেখানে বিপুলসংখ্যক টিভি চ্যানেলের প্রয়োজনীয়তাকে তিনি ইঙ্গিত করেন। তাঁর ডিসকভারি কমিউনিকেশনস, যা এখন ডিসকভারি ইনকরপোরেটেড, এই এক প্রতিষ্ঠানের অধীনে রয়েছে ডিসকভারি চ্যানেল, টিএলসি (দ্য লার্নিং চ্যানেল), অ্যানিমেল প্ল্যানেট, এইচজিটিভি (হোম অ্যান্ড গার্ডেন টেলিভিশন), ফুড নেটওয়ার্ক, ওডব্লিউএন (অপরাহ উইনফ্রে নেটওয়ার্ক), ইউরোস্পোর্ট (ইউরোপীয় স্পোর্টস চ্যানেল নেটওয়ার্ক), কিউভিসি (গুণমান, মূল্য, সুবিধা; যা একটি হোম শপিং নেটওয়ার্ক যা সৌন্দর্য, ইলেকট্রনিক, ফ্যাশন এবং আরও অনেক কিছু বিপণন ও পণ্য সরবরাহ করে লাইভ শো সম্প্রচার করে। কিউভিসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ একাধিক অঞ্চলে কাজ করে।)

লিবার্টি গ্লোবালের অধীনে রয়েছে ভার্জিন মিডিয়া, যা যুক্তরাজ্যের একটি প্রধান টেলিযোগাযোগ এবং মিডিয়া কোম্পানি, কেবল টেলিভিশন, ইন্টারনেট পরিষেবা এবং মোবাইল যোগাযোগ প্রদান করে। ইউপিসি, ইউনাইটেড প্যান-ইউরোপ কমিউনিকেশনস, রয়েছে টেলিনেট, যা বেলজিয়ামের একটি শীর্ষস্থানীয় টেলিযোগাযোগ প্রদানকারী, প্রাথমিকভাবে ইন্টারনেট, টেলিভিশন এবং টেলিফোন পরিষেবা প্রদানকারী।

লিবার্টি ল্যাটিন আমেরিকা, সিরিয়াসএক্সএম, ফর্মুলা ওয়ান, লাইভ নেশান, জিসিআই (জেনারেল কমিউনিকেশন, ইনকরপোরেটেড), লায়ন্সগেটসহ আরও অনেক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম।

শুধু রুপার্ট মার্ডক বা জন কার্ল মেলোন নন, এ রকম এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অধীনে অনেক মিডিয়া থাকা প্রতিষ্ঠানের তালিকা অনেক দীর্ঘ। এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনের নাম আমরা উল্লেখ করছি, যাদের সব প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করলে এ লেখাটা প্রবন্ধ না হয়ে মহাভারত হয়ে যাবে। সে কারণে আমরা শুধু ব্যক্তি বা তার মূল প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করছি। আগ্রহী পাঠক চাইলে হাতের মুঠোয় পৃথিবীর সুবিধা নিয়ে এ মুহূর্তেই সেসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন।

ধরুন, সামনার রেডস্টোন, ভায়াকমসিবিএস, যা বর্তমানে প্যারামাউন্ট গ্লোবাল; টেড টার্নার, টার্নার ব্রডকাস্টিং সিস্টেম, টিবিএস ও সিএনএন; জেফ বেজোস, অ্যামাজন, দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক; ওয়াল্ট ডিজনি, দ্য ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি, ডিজনি মিডিয়া নেটওয়ার্ক; ডেভিড গেফেন, গেফেন রেকর্ডস, ড্রিমওয়ার্কস এসকেজি; মাইকেল ব্লুমবার্গ, ব্লুমবার্গ এলপি, ব্লুমবার্গ নিউজ; ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন, গুগল, বর্তমানে যা অ্যালফাবেট, ইউটিউব এবং গুগল নিউজসহ।

প্রতিবেশী দেশে রয়েছেন সুভাষ চন্দ্র, জি এন্টারটেইনমেন্ট এন্টারপ্রাইজেস, জিটিভি; কালানিথি মরন, সান গ্রুপ, সান টিভি নেটওয়ার্ক, রেডিও এবং চলচ্চিত্র; রাঘব বাহল, নেটওয়ার্ক১৮ গ্রুপ, সিএনবিসি-টিভি১৮, সিএনএন-নিউজ১৮-এর মতো মিডিয়া আউটলেট এবং অন্যান্য বিভিন্ন ডিজিটাল ও টেলিভিশন সম্পত্তির মালিক; ম. কে. আলাগিরি, দ্য হিন্দু গ্রুপ, ভারতের অন্যতম সম্মানিত ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্র দ্য হিন্দু এবং অন্যান্য প্রকাশনার মালিকানার সঙ্গে জড়িত। সম্বিত পাত্র, টাইমস অব ইন্ডিয়া, বেনেট, কোলম্যান অ্যান্ড কোং, আগরওয়াল পরিবারের নেতৃত্বে টাইমস গ্রুপ ভারতের বৃহত্তম মিডিয়া গ্রুপগুলোর মধ্যে একটি, যারা টাইমস অব ইন্ডিয়ার মতো প্রধান সংবাদপত্র প্রকাশ করে এবং জুমের মতো টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মালিক। রজত শর্মা, ইন্ডিয়া টিভি, হিন্দি ভাষার সংবাদ চ্যানেল ইন্ডিয়া টিভির প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতের মিডিয়া শিল্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। এন. আর. নারায়ণ মূর্তি, ইনফোসিস, যদিও প্রাথমিকভাবে একজন প্রযুক্তিসম্রাট, মূর্তির বিনিয়োগ মিডিয়া এবং বিনোদনেও বিস্তৃত। বিজয় মালিয়া, কিংফিশার, ইউবি গ্রুপ এবং মিডিয়া ভেঞ্চারস। কিংফিশার এয়ারলাইনসের জন্য পরিচিত, মালিয়ার কিংফিশার টিভি এবং অন্যান্য বিনোদন উদ্যোগসহ মিডিয়া কোম্পানিগুলোতেও অংশীদারি ছিল। শিব নাদার, এইচসিএল এবং মিডিয়া ইনভেস্টমেন্টস, এইচসিএলের প্রতিষ্ঠাতা। নীতা আম্বানি, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, নেটওয়ার্ক১৮, টিভি১৮, জিও প্ল্যাটফর্মের মালিক।

ডিজিটাল যুগে সংবাদমাধ্যম এমনিতেই কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী ছাপা পত্রিকা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে। অনেক স্বনামখ্যাত বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনোটি বন্ধ হওয়ার পথে, কোনোটি রূপান্তরের মাধ্যমে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।

তাই ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া চিন্তার পেছনে জনহিতকর, গঠনমূলক বা ইতিবাচক কিছু নয়, বরং রয়েছে প্রতিহিংসাপরায়ণ কুচিন্তা ও কূটকৌশল। যাতে লাথি মারা হবে অসংখ্য মিডিয়াকর্মীর পেটে। তাতে বরং বেকারত্বের পাহাড় আরও উঁচু হবে, নানামুখী অসন্তোষ, সীমাহীন হতাশার আকাশ আরও মেঘকালো বা ভারী হবে।

মাহফুজ জুয়েল : কবি ও সাংবাদিক

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ