খান ইউনিসে বসবাসকারী সাংবাদিকদের একটি তাঁবুতে ইসরায়েলি হামলার পর জীবন্ত দগ্ধ হয়ে ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আহমেদ মনসুর মারা গেছেন। এ ঘটনায় গাজাবাসী শোক প্রকাশ করেছে।
দুই সন্তানের জনক মনসুর ইসরায়েলি হামলায় নিহত তিনজনের মধ্যে একজন। যাদের মধ্যে সাংবাদিক হিলমি আল-ফাকাওয়ি এবং নাগরিক ইউসুফ আল-খাজিন্দারও ছিলেন।
তাঁবুতে থাকা আরো বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হন। যাদের মধ্যে হাসান ইসলায়েহ, আহমেদ আল-আগা, মোহাম্মদ ফায়েক, আবদুল্লাহ আল-আত্তার, ইহাব আল-বারদিনি, মাহমুদ আওয়াদ, মাজেদ কুদাইহ এবং আলী ইসলায়হ রয়েছেন। তাদের মধ্যেও কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
জীবন্এত পুড়ে যাওয়ার একটি ভিডিও ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ভিডিওতে স্থানীয় প্যালেস্টাইন টুডে সংবাদ সংস্থার সংবাদদাতাকে গত সোমবার আগুনে পুড়ে যেতে দেখা যায়। তার সহকর্মীরা তাকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে। প্রথমে মনসুরকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তবে ফিলিস্তিনি সংবাদ ওয়েবসাইট আরব৪৮ অনুসারে, গতকাল মঙ্গলবার ফিলিস্তিনি নাগরিক প্রতিরক্ষা মনসুরের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সরকারি বার্তা সংস্থা ওয়াফাও জানিয়েছে, মানসুর গতকাল মঙ্গলবার সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মিডল ইস্ট আইয়ের সংবাদদাতা আহমেদ আজিজ হামলার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘তাঁবুতে থাকা মানুষ আহমেদ মনসুরকে আগুন থেকে উদ্ধার করার জন্য মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারছিলেন না। কারণ তাঁবুতে থাকা স্পঞ্জ, কাঠ এবং নাইলন দ্রুত আগুন ধরে যায়।’
শাত নামে তার একজন সহকর্মী জানান, হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে চারপাশ।
তাঁবুতে থাকা সকল সাংবাদিকদের ঘুম ভেঙে যায়। তারা ভীত ও বিভ্রান্ত হয়ে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। শাত মোবাইল হাতে তুলে ধরেন—অভ্যস্তভাবে ভিডিও ধারণের জন্য প্রস্তুত হন।
হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া সাংবাদিক আবেদ শাত বলেন, ভোর ৩টার দিকে কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই সাংবাদিকরা যেখানে অবস্থান করছিলেন, সেই তাঁবুতে ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালায়। শাত বলেন, ‘সাংবাদিকদের জন্য তাঁবুটি সকলের কাছে পরিচিত ছিল। এটা থেকে নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে, সাংবাদিকদের ওপর ইচ্ছা করে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।’
যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই সাংবাদিকরা হাসপাতাল চত্বরে আশ্রয় নিচ্ছেন, যেখানে অপেক্ষাকৃত ভালো ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ ও নিরাপত্তা থাকে। আবেদ শাত বলেন, আমরা এখানেই থাকি, এখানেই ঘুমাই, এখানেই কাজ করি। পরিবারকে এতটা দেখি না, যতটা একে-অপরকে দেখি। আমাদের বন্ধন এখন শুধু কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা তার চেয়েও গভীর।
হামলা চালানো হয় টিভি চ্যানেল ‘প্যালেস্টাইন টুডে’-র সাংবাদিকদের তাঁবুতে। দূর থেকে শাত ছবি তুলছিলেন, কিন্তু জ্বলন্ত তাঁবুর কাছাকাছি গিয়েই তিনি দেখেন, তার এক সহকর্মী আগুনের মধ্যে পুড়ছেন। ক্যামেরা নামিয়ে রেখে ছুটে যান তাকে বাঁচাতে। শাত বলেন, আগুন ভয়াবহ ছিল। আমি তার পা ধরে টান দিতে চেষ্টা করি, কিন্তু প্যান্ট ছিঁড়ে যায়। এরপর অন্যভাবে চেষ্টা করি, কিন্তু কিছুতেই পারছিলাম না। শেষমেশ আমাকে সরে যেতে হয়। এরপর কিছু মানুষ পানি এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। শাত বলেন, আমি হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়ি, তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে ইসরায়েল ২১১ জন ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে হত্যা করেছে। ওয়াটসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ সাংবাদিকদের জন্য ‘সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি।’
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক্স-এ (সাবেক টুইটার) দাবি করেছে, তারা এই হামলা চালিয়েছে হাসান আবদেল ফাত্তাহ মুহাম্মদ ইসলাইহকে লক্ষ্য করে। ইসরায়েলের অভিযোগ, তিনি হামাসের সদস্য, সাংবাদিকের ছদ্মবেশে ছিলেন। কিন্তু সেই দাবি প্রমাণে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
সাংবাদিক ইসলাইহর সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপুল অনুসারী রয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে দক্ষিণ ইসরায়েলের ওপর চালানো হামলার সময় তিনি ঘটনাস্থল থেকে রিপোর্ট করেছিলেন, যার জেরে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাকে বারবার হুমকি দিয়েছ ঘুমন্ত সাংবাদিকদের তাঁবুতে বোমা হামলা চালিয়ে একজনকে ধরার সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তির ব্যাখ্যা দেয়নি ইসরায়েলি বাহিনী।
সূত্র : মিডিল ইষ্ট আই, আলজাজিরা, আরব নিউজ