<p>সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মথুরাপুর গ্রামের চম্পা রানী মল্লিক ও সরমা রানী। লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে চোখ-মুখ জ্বালাপোড়া, পায়ের চামড়া উঠে যাওয়া, চুলকানিসহ নানা ধরনের জটিলতায় পড়ছেন তাঁরা। একই ধরনের সমস্যায় এই গ্রামের অনেকেই। লবণাক্ততার কারণে উপকূলের মানুষের শারীরিক সমস্যা ছাড়াও কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কমছে খাদ্য উৎপদন। দেশের দক্ষিণের ১৯ জেলার চাষযোগ্য জমির প্রায় অর্ধেকই লবণাক্ততার শিকার।</p> <p>পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান অব বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। মিসরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে।</p> <p><img alt="" src="http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/11.November/19-11-2022/121/7888989.jpg" style="float:left; height:102px; margin:12px; width:300px" />এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী দিনে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে যে ১০টি ক্ষতি ও ঝুঁকির বিষয়ে বলা হচ্ছে, তার মধ্যে শীর্ষে থাকবে লবণাক্ততা। উপকূলীয় এলাকায় ১৯ জেলার ১৪৭টি উপজেলায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে চাষযোগ্য জমি ২১ লাখ ৬২ হাজার হেক্টর। বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততার শিকার  ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর। ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়ে নতুন করে লবণাক্ততার শিকার হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমি।</p> <p>ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লবণাক্ততার মাত্রা এক পিপিটি বাড়লে ২০৫০ সালের মধ্যে লবণাক্ত জমির পরিমাণ সাড়ে ৭ শতাংশ বাড়তে পারে। অন্যদিকে ৫ পিপিটি বাড়লে এই সময়ে লবণাক্ততার শিকার জমির পরিমাণ ৯ শতাংশ বাড়তে পারে।</p> <p>মৃত্তিকাসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এসআরডিআই) তথ্য বলছে, দেশে লবণে আক্রান্ত মোট জমির মধ্যে হালকা লবণাক্ততা জমি এক লাখ ৯০ হাজার হেক্টর, মধ্যম মাত্রার দুই লাখ ৫০ হাজার হেক্টর, তীব্র মাত্রার চার লাখ ২০ হাজার হেক্টর এবং খুব তীব্র মাত্রার লবণাক্ত জমির পরিমাণ দুই লাখ হেক্টর। লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় জেলাগুলোতে খাদ্যশস্য উৎপদন কম হচ্ছে প্রায় ৩০ লাখ ২৭ হাজার টন।</p> <p>জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেই উপকূলীয় অঞ্চলের জমিতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ঢুকছে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে নোনা পানি ঢুকছে উঁচু জমিতেও। সেই পানি সঠিকভাবে নিষ্কাশন করা যাচ্ছে না। নদীতে মিঠা পানির অভাব থাকায় লবণাক্ত পানি অপসারণ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাব, উপকূলীয় নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় জোয়ারের সময় লবণাক্ত পানি বাঁধ উপচে লবণাক্ততা বৃদ্ধি করছে। কৃষিজমির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ফসলের স্বাভাবিক উৎপদন কমছে।</p> <p>বিশ্বব্যাংকের ‘রিভার স্যালাইনিটি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ এভিডেন্স ফ্রম কোস্টাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালে উপকূলের ১৯ জেলার ১৪৮টি থানার মধ্যে মাত্রাতিরিক্তভাবে লবণাক্ততার শিকার হবে ১০ উপজেলার বিভিন্ন নদীর পানি। এগুলো হলো সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালীগঞ্জ, খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, কয়রা, পাইকগাছা, বাগেরহাটের মোংলা এবং পটুয়াখালীর কলাপাড়া। ২০৫০ সালের মধ্যে লবণাক্ততা, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য জলবায়ুসংক্রান্ত বৈরী প্রভাবের কারণে এ অঞ্চলের এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে।</p> <p>এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, লবণাক্ততা বৃদ্ধির জন্য স্বাভাবিক জনজীবন ফিরে পেতে মানুষ সংগ্রাম করছে। সরকার তাদের পাশেই আছে। বাঁধ নির্মাণ ও উন্নত হাসপাতালের সুবিধা দেওয়া ছাড়াও কৃষি উৎপদন বাড়াতে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।</p> <p>লবণাক্ততার কারণে মানুষের শারীরিক সমস্যার বিষয়ে শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পরিবার পরিকল্পনা কর্মী শেফালী বেগম বলেন, লবণাক্ততায় বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন নারীরা। নোনা পানির জন্য এখন নারীদের সন্তান ধারণের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে।</p> <p>বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘ডিজাস্টার রিলেটেড স্টাটিস্টিকস (বিডিআরএস) ২০২১ : ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ন্যাচারাল ডিজাস্টার পারসপেকটিভ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে লবণাক্ততার কারণে অসুস্থ হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৯৭৫ জন। প্রতিবছর গড়ে অসুস্থ হয়েছে ২১ হাজার ৯৯৫ জন। অন্যদিকে আগের ছয় বছরে লবণাক্ততায় অসুস্থ হয় ১৫ হাজার ৭৩ জন। এ ছাড়া ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ক্ষতির সঙ্গে ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের ছয় বছরের ক্ষতির তুলনামূলক তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিএস। এতে দেখা যায়, আগের ছয় বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৬০৭ কোটি ২৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা, যা পরের ছয় বছরে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা।</p>