সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে মূলত বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে। কারণ সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর পশ্চিম পাকিস্তান বৈষম্যমূলক আচরণ করত। আর এই বৈষম্য বেশি ছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। কিন্তু বৈষম্য দূর করার সেই লক্ষ্য কতটা পূরণ হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
এখন অভিজাত সমাজ রাষ্ট্রকে কুক্ষিগত করছে। তারাই সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। মধ্যবিত্তের এখানে কোনো সুযোগ নেই। যেটা পাকিস্তানের শাসকদের সময়ও আমরা দেখিনি।
’
গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক সেমিনারে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে রেহমান সোবহান এ কথা বলেন। বিআইডিএস সন্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সেমিনারে ‘ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ : পূর্ববঙ্গে মধ্যবিত্তের বিকাশ’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।
রেহমান সোবহান বলেন, ‘বর্তমান সমাজে মধ্যবিত্তরা তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না।
তারা সমাজে অগ্রণী ভূমিকাও রাখতে পারছে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে তারা অনেক পিছিয়ে পড়ছে দিনকে দিন।
দেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রসার লাভ করা সত্ত্বেও তারা সেই সুযোগ-সুবিধা নিতে পারছে না। বরং তারা বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সেখান থেকে শিক্ষা নিতে পারছে না।
’ তিনি আরো বলেন, ‘এখন সংসদের ৩০০ সদস্যের মধ্যে যদি জরিপ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে তাঁদের সন্তানদের অনেকে দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করছে। কেউ কেউ দেশের বাইরে পড়াশোনা করছে। ’
প্রখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘১৯৭৫-এর পরবর্তী সময়ে এ দেশের মধ্যবিত্তরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল। তাদের মধ্যে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব ছিল। শেখ মুজিবও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় মধ্যবিত্তের কথা মাথায় রেখে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছিলেন। কিন্তু পরে পরিস্থিতি অন্য রূপ নেয়। মধ্যবিত্তরা তাদের অধিকার হারাতে থাকে এবং একটা বিশেষ শ্রেণির হাতে সমাজের কর্তৃত্ব চলে যায়। তিনি আরো বলেন, ‘একাত্তর-পূর্ববর্তী সময়ে দেখা যেত পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একধরনের অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকত। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করত পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ। সেই বৈষম্য থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু এখন সমাজে অন্য ধরনের বৈষম্য দেখা যাচ্ছে, যা ক্রমবর্ধমান।’
মূল প্রবন্ধে আতিউর রহমান বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যাপক ভূমিকা ছিল। ভাষা আন্দোলনের মূলভাগেই ছিলেন পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তরা। এ ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের বেশি আন্দোলনকারীর পিতা শহরে বাস করতেন। ৭০ শতাংশ আন্দোলনকারীর পিতা ৫ একরের বেশি জমির মালিক ছিলেন। ৬৮ শতাংশ আন্দোলনকারী কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। নেতৃত্বে থাকা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির গ্রামের সঙ্গে, কৃষক-শ্রমিকের সঙ্গে ছিল গভীর সংযোগ। এই সংযোগ নিশ্চিত করতে যাঁরা মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল টানাপড়েনের মধ্যে। তাঁরা ছিলেন সামাজিক জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাড়লেও তারা সাংস্কৃতিক চেতনায় নিমজ্জিত নয়। এখনকার মধ্যবিত্ত অনেক বেশি অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক হলেও কম সাংস্কৃতিক। মধ্যবিত্তরা স্ববিরোধী। টানাপড়েনে কেউ নিচে নামে, আবার কেউ ওপরে ওঠে।’
সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে বিনায়ক সেন বলেন, ষাটের দশকে মাত্র ৫ শতাংশ মধ্যবিত্ত ছিল। তারা আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু এখন মধ্যবিত্ত প্রায় ৩০ শতাংশ। এর পরও তখনকার মতো ভূমিকা কেন রাখতে পারছে না, এটা একটা বড় প্রশ্ন।
আওয়ামী লীগ এবং নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। গতকাল শুক্রবার ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের গুম, খুন, দুর্নীতিসহ সব রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং জুলাই গণহত্যার সাথে জড়িতদের বিচারের দাবিতে গণমিছিল’ শেষে এই দাবি জানান শিবিরের নেতাকর্মীরা।
সারা দেশে কর্মসূচির অংশ হিসেবে জুমার নামাজ শেষে ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে মিছিল শুরু করে শিবির। এ সময় শিবিরের নেতারা ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘হই হই রই রই, ছাত্রলীগ গেলি কই’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘ছাত্রলীগের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না’, ‘ফ্যাসিবাদের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না’, ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
মিছিলটি শাহবাগে এসে শেষ হয়। এখানে সমাবেশে বক্তব্য দেন শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা। সমাবেশের প্রধান অতিথি এবং সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো দেশবাসী আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করতে দেখেনি। অবিলম্বে এই ফ্যাসিবাদের বিচার কার্যকর করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।
কিছু রাজনৈতিক দল ফ্যাসিবাদের বিচারের দাবিতে সরব না থেকে বাসস্ট্যান্ড, টেম্পোস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ছাত্রসমাজকে নিয়ে ছাত্রশিবির মাঠে থাকবে জানিয়ে শিবিরের দপ্তর সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম অচিরেই আওয়ামী লীগের বিচার বাংলাদেশে হবে। কিন্তু দেখছি তাদের এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। ছাত্রলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসীরা এখনো আমাদের ভাইদের হত্যা করছে।
আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’
তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই, আমাদের শহীদ ভাইদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আপনারা ক্ষমতায় গেছেন। আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ছাত্রসমাজকে নিয়ে শিবির মাঠে থাকবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, ২০০৬ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রশিবির তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছে। সামনে কেউ এই ফ্যাসিবাদী দলকে নিয়ে আসতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধেও শিবির সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ফ্যাসিস্ট সরকারের গুম, খুন, দুর্নীতিসহ সব রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগরের উদ্যোগে গণমিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার শিবিরের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক তাওহীদুল হক মিজবাহর নেতৃত্বে মিছিলটি চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে নগরীর নিউ মার্কেট মোড়ে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়।
মিছিল শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তাওহীদুল হক মিজবাহ বলেন, ১৯৭২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ যতসংখ্যক গণহত্যা এবং একদলীয় শাসন ও স্বৈরাচারী ক্ষমতা কায়েমের চেষ্টা করেছে, তাদের এ দেশে আর রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার নেই। অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, স্বৈরাচার হাসিনা ও জুলাই-আগস্টের সব খুনির দ্রুত বিচার করতে হবে।
খুলনা অফিস জানায়, কেন্দ্র ঘোষিত ফ্যাসিস্ট সরকারের গুম, খুন, দুর্নীতিসহ সব রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে খুলনায় গণমিছিল করেছে ছাত্রশিবির খুলনা মহানগর শাখা।
ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম লিটারে এক টাকা করে বাড়িয়েছে সরকার। জ্বালানি তেলের নতুন এ দাম কার্যকর হবে আজ শনিবার ১ ফেব্রুয়ারি থেকে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ গত মার্চ থেকে শুরু করেছে সরকার। সে হিসাবে প্রতি মাসে নতুন দাম ঘোষণা করা হচ্ছে।
জ্বালানি তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করে গতকাল শুক্রবার রাতে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৪ টাকা থেকে বেড়ে ১০৫ টাকা হয়েছে। অকটেন প্রতি লিটার ১২৫ টাকা থেকে বেড়ে ১২৬ টাকা এবং পেট্রল ১২১ টাকা থেকে বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে।
বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে প্রতি মাসে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
একই প্রক্রিয়ায় প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭৪ লাখ টন। মোট চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশই ডিজেল ব্যবহার করা হয়। বাকি ২৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় পেট্রল, অকটেন, কেরোসিন, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েলসহ বিভিন্ন জ্বালানি তেলে।
ডিজেল সাধারণত কৃষি সেচে, পরিবহন ও জেনারেটরে ব্যবহার করা হয়। জ্বালানি তেলের মধ্যে উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েল ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করে বিপিসি।
আর ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম নির্ধারণ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। প্রতিবেশী দেশ ভারত ছাড়াও উন্নত বিশ্বে প্রতি মাসেই জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর চলতি অর্থবছর বিভিন্ন নিত্যপণ্যের সঙ্গে আমদানি করা ফলের দামে দ্বিতীয় দফায় সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে। এর প্রভাবে পাঁচটি ফলে প্রতি কেজিতে দাম ৫০ থেকে ৯০ টাকা বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষের ফল কিনে খাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলের নিয়মিত ক্রেতা অনেকে ফল কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও ভাটারা এলাকার খুচরা বাজার ঘুরে এমন তথ্য জানা গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, শুল্ক বাড়ানোর পর প্রতি কেজি কালো আঙুরের দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ টাকা। একইভাবে মানভেদে আপেলের দাম কেজি প্রতি বেড়েছে ৪০ থেকে ৯০ টাকা। কমলার দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৭০ টাকা, নাশপাতি ও আনারের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ৯ জানুয়ারি আমদানি করা ফলের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করেছে।
বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, কালো আঙুর ৪০০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। সাদা আঙুর মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি। আফ্রিকার আপেল মানভেদে ৩০০ থেকে ৩৮০ টাকা কেজি।
আগে ছিল ২৬০ থেকে ২৯০ টাকা কেজি। সবুজ আপেল ছিল ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি, এখন ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকা। কমলা বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি, আগে ছিল ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। নাশপাতি বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকা কেজি, আগে ছিল ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা। ছোট আনার ৩৫০ টাকা কেজি, মাঝারিটা ৪৫০ টাকা।
সবচেয়ে বড় আনার ৬০০ টাকা কেজি।
কারওয়ান বাজারের ফল বিক্রেতা মো. আমিনুল হক বলেন, ‘দাম শুনলেই ক্রেতা চলে যায়। বিক্রি অনেক কমে গেছে। কেউ কেউ দোকান বন্ধ করে দিচ্ছেন। ক্রেতা না থাকলে কী করা যাবে? আমার এখানে গতকাল একটা ছেলে কাজ চেয়েছে। আগে সে ফল বিক্রি করত। লাভ হয় না বলে ব্যবসা গুটিয়েছে।’
একই বাজারে ফল কিনতে আসেন পশ্চিম তেজতুরি বাজার এলাকার মো. রফিকুল ইসলাম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এই চাকরিজীবী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে সরকারকে আমাদের সাহায্য করতে হবে। ফলের ওপর যে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, এতে আমরা বেশ চাপে আছি। আগের মতো আর কিনতে পারছি না ফল। আগে মাসে পাঁচ কেজি ফল কিনতাম, এখন দেড়-দুই কেজি কম কিনছি।’
জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আপেল, কমলা, আঙুর, নাশপাতি ও আনারের ওপর মোট শুল্ককর ছিল ৮৯.৩২ শতাংশ। পরের বছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুল্ককর বাড়ানো হয়। তখন মোট শুল্ক দাঁড়ায় ১১৩.৮০ শতাংশ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাড়িয়ে তা করা হয় ১১৮.৮০ শতাংশ। চলতি অর্থবছর দ্বিতীয় দফায় আবার বাড়ানোর ফলে মোট শুল্ককর হয়েছে ১৩৬.২০ শতাংশ।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফআইএ) সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। হুমকি দিয়ে সংগঠনটি বলেছে, ফলের ওপর বর্ধিত সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার না করা হলে ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের সব স্থল ও নৌবন্দরে আমদানিকরা ফল খালাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখবেন।
সংগঠনটির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ওই সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ফলে শুল্ক বাড়ানো কোনোভাবেই কাম্য নয়। বর্তমানে আমদানিকারক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের কাছে বর্ধিত শুল্কের কারণে দাম অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলের ওপর বর্ধিত শুল্ক আরোপ হটকারী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই না, যা বাতিল করে দেওয়া আবশ্যক। অন্যথায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে ফল।
তিনি বলেন, আগে প্রতি ট্রাক ফল এক দিনে বিক্রি করা সম্ভব হলেও এখন তিন-চার দিনেও সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য পোর্ট থেকে পণ্য খালাস করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে শিপিং ও পোর্টে জরিমানা দিতে হচ্ছে। উচ্চ শুল্কের কারণে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
খাগড়াছড়ি সদর থেকে উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা ধরে যেতে হয় প্রায় ২৫ কিলোমিটার। দীঘিনালা উপজেলার বোয়ালখালী ইউনিয়নের উত্তর কামাকুছড়া গ্রাম। চারদিকে চোখজুড়ানো সবুজ। কিছুটা নির্জন।
এর মধ্যে একেবারে রাস্তা লাগোয়া বাড়িটা। নাম অবসর ভবন। বৃদ্ধ মা-বাবার আরাম-আয়েশের জন্য নিজে এটি তৈরি করেছেন চঞ্চল কান্তি চাকমা। যদিও এখন আর তাঁরা বেঁচে নেই।
সামনে বড় উঠান। ভেতরে পা রাখতেই মন ভালো করে দেবে চারপাশে ফুটে থাকা গাঁদা, গোলাপ আর থোকা থোকা পলাশ ফুল। এল আকৃতির ভবন। ফুলগাছের আড়ালে যেন ঢাকা পড়েছে।
সামনে বিশাল করিডর। সেখানে বসে আলাপ করছিলেন তিনজন।
একজন বিমলা দেবী, বয়স আশির ঘরে। জানতে চাইলাম, ‘কেমন আছেন?’
ইশারায় তিনি বোঝালেন, শুনতে সমস্যা। এবার কানের কাছে গিয়ে গলার স্বর বাড়িয়ে বললাম, ‘কেমন আছেন?’
ছল ছল চোখে এমনভাবে চেয়ে রইলেন—যেন এই প্রশ্নটা শুনেছেন অনেক দিন পর! পরে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে ধরা গলায় বললেন, ‘বাবা, শুধু চঞ্চল বাবু মাঝে মাঝে জানতে চায়—ভালো আছি কি না।’
শুধু বিমলা দেবীরই নন, এমন আরো অনেক প্রবীণের নিয়মিত খোঁজ নেন চঞ্চল। চেষ্টা করেন সাধ্যমতো পাশে দাঁড়াতে। তিনি নিজেও প্রবীণ। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ২০১৮ সালে। পেনশন পেতেন ১২ হাজার টাকা। এই সম্বল দিয়েই বছর সাতেক আগে শুরু করেছেন মহৎ এই উদ্যোগ। পাঁচজন মানুষকে ৫০০ টাকা করে প্রতি মাসে মোট আড়াই হাজার টাকা বয়স্ক ভাতা হিসেবে দিচ্ছেন। তাঁদের একজন বিমলা দেবী।
এসএসসিতেই ইতি
রাঙামাটির বালুখালীতে এক হতদরিদ্র পরিবারে চঞ্চল কান্তির জন্ম। মা-বাবা কৃষক। শৈশবে কাপ্তাই লেকের পানিতে ডুবে যায় ঘরবাড়ি। পরিবার চলে আসে খাগড়াছড়িতে, দীঘিনালার উত্তর কামাকুছড়ায়। তখন চঞ্চলের বয়স মোটে ছয়। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়। খেয়ে না-খেয়ে স্কুলে যেতেন। ইউনিফর্মের জন্য শিক্ষকদের বকাও কম খাননি। এসবের মধ্যেই ১৯৭৫ সালে দীঘিনালা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। সেখানে তখন কলেজ না থাকায় যেতে হতো খাগড়াছড়ি রাঙামাটি সদরে। সেখানে বাসা ভাড়া করে থাকার মতো সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। ফলে পড়াশোনা আর এগোল না!
কাঁধে পরিবারের বোঝা
বাবার বয়স হওয়ায় চঞ্চলের ছোট্ট কাঁধে পড়ল পরিবারের বড় বোঝা। স্টোরকিপারের কাজ নেন কর্ণফুলী পেপার মিলে। বছর তিনেক পর ক্লার্ক পদে চাকরি নেন তৎকালীন সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন বোর্ডে। মাস ছয়েক ছিলেন। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে রাঙামাটি মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে ক্লার্ক কাম টাইপিস্ট পদে যোগ দেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক। তাঁরা সবাই সরকারি চাকুরে। তিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। ওই সময় এককালীন ২৩ লাখ টাকা পেয়েছিলেন।
তাঁরাও মানুষ
মাঝ বয়সে এসে কিছুটা সচ্ছলতার মুখ দেখেন চঞ্চল। শৈশবে দেখা এলাকার বয়স্কদের দুঃখ-কষ্ট আর দুর্ভোগের স্মৃতি তাঁকে নাড়া দেয়। বয়স হলে মানুষ কত অসহায়! এ সময় ভালো কিছু খেতে মন চাইলেও সামর্থ্য থাকে না। সন্তানকে মুখ ফুটে বলতে অস্বস্তি লাগে।
সরকারি কর্মচারীরা অবসরের পর পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু অন্যদের সে সুযোগ নেই। দরিদ্র ও শ্রমজীবীরা জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে মানবেতর জীবনযাপন করেন। এসব বয়স্ক মানুষের জন্য কিছু কথার কথা ভাবেন চঞ্চল।
গ্রামের প্রবীণ, বয়স্ক ও দুস্থদের জন্য বয়স্ক ভাতা চালুর উদ্যোগ নিলেন চঞ্চল। তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবীরা অবসর ভাতা পান। কিন্তু শ্রমজীবীদের বয়স হলে একেবারে অসহায়। যাঁদের শ্রমে-ঘামে ফসল ফলে, ইমারত গড়ে ওঠে, তাঁরা কখনো অবসর ভাতা পান না। এমনকি সন্তানরাও অনেক সময় বৃদ্ধ মা-বাবার খোঁজ রাখে না। ভাবলাম, আমার সামান্য পেনশনের মধ্য থেকে কিছু যদি অসহায়দের দিই, অন্যরা এতে উদ্বুদ্ধ হবে। তাই এমন উদ্যোগ নিয়েছি।’
সাত বছর ধরে চলছে
২০১৮ সালের ১ অক্টোবর বিশ্বপ্রবীণ দিবসে গ্রামের হতদরিদ্র চারজন নারী ও একজন পুরুষকে মাসিক ৫০০ টাকা হারে দিয়ে বয়স্ক ভাতা প্রদান শুরু করেন চঞ্চল। গত সাত বছর ধরে কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন। শুরুতে পাঁচজনকে দিয়েছেন। গত বছর একজন মারা গেছেন। এখন চারজন নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। চঞ্চল বললেন, ‘আমি তো নিজেও প্রবীণ। তাই এই বয়সী মানুষগুলোর কষ্ট বুঝি। পেনশন যা পাই, তা দিয়ে আমার ভালোই চলে যায়। পেনশনের একটা অংশে যদি কয়েকজনের সামান্য উপকার হয়, এতেই আমার আনন্দ।’
এ জন্য একটা নীতিমালাও করেছেন। তাঁর প্রতিপাদ্য ‘কৃতজ্ঞতা ও মানবতার সঙ্গে একটু মমতা মিশিয়ে অসহায় প্রবীণদের প্রতি সহায় হোন’।
বয়স্ক ভাতা যাঁরা পাচ্ছেন, তাঁদের একজন দোষা চাকমা। বয়স আশির ঘরে। তাঁর ছেলে-মেয়ের সংসারেও অভাবের কালো ছায়া। ফলে মাকে আর তেমন খরচ দিতে পারেন না। তিনি বয়স্ক ভাতার টাকা দিয়ে নিজের জন্য কিছু ওষুধ কিনেছেন।
চঞ্চল কান্তি চাকমার প্রতি কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ল দোষার কণ্ঠে। চাকমা ভাষায় যা বললেন, তা বাংলা করলে দাঁড়ায়—‘টাকাটা খুব কাজে দেয়। ওষুধ কিনি। ভগবান তাঁকে (চঞ্চল) অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখুক।’
আরেকজন উপকারভোগী পূর্ণরঞ্জন চাকমা বললেন, ‘মাঝেমধ্যে ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছা হয়। ছেলের অবস্থাও ভালো নয় যে তাকে বলব। এই টাকা দিয়ে ইচ্ছাপূরণ করি।’
চঞ্চল বললেন, ‘ভবিষ্যতে আরো বয়স্ক ব্যক্তিকে এতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যা করছি, এটা সামান্য। চাইলে যে এভাবেও পাশে দাঁড়ানো যায়, সে পথটা দেখানোই ছিল উদ্দেশ্য। সাধ্য অনুযায়ী সবাই যদি নিজ এলাকার অসহায় প্রবীণদের সহায়তা দেয়, তাহলে শেষ বয়সে মানুষগুলোর কষ্ট দেখতে হবে না।’
আরো মানবিক কাজ
বয়স্ক ভাতা প্রদান ছাড়াও আরো অনেক মানবিক কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছেন চঞ্চল। এলাকায় প্রজ্ঞা ভাবনা বৌদ্ধবিহারে চার লাখ টাকা ব্যয়ে ভিক্ষুসীমা ভবন নির্মাণ করে দিয়েছেন। কামাকুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের জমি কেনার জন্য দান করেছেন ৪০ হাজার টাকা। অসহায় দুজন তরুণীকেও ২৪ হাজার টাকা দিয়েছেন। প্রতিবছর দরিদ্রদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন।
এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এলাকাবাসীর কাছ থেকে গুণীজন সম্মাননা পেয়েছেন। এ ছাড়া ২০২০ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন থেকে পেয়েছেন মানবাধিকার পদক।
পৃষ্ঠপোষক পেলে বৃদ্ধাশ্রম হবে
সবার আগে মা-বাবার সেবা এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো মানুষের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করেন চঞ্চল। তাঁর মা-বাবা থাকতেন মাটির ঘরে। শহরে যেতে বললেও গ্রামের মায়া ছাড়তে রাজি হননি তাঁরা। তাই অবসরের সময় পাওয়া অর্থ থেকে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা দিয়ে তিনি মা-বাবার জন্য বানিয়েছেন ‘অবসর ভবন’। এ প্রসঙ্গে চঞ্চল বললেন, ‘আমি বিলাসবহুল জীবনে বিশ্বাসী নই। মা-বাবা বয়সের ভারে দুর্বল। ঘরে একটি পরিবারের সুবিধাজনক বসবাসের জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সবই আছে।’
সেই ঘরে বেশ আনন্দেই জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন চঞ্চল কান্তির মা সুনীতি বালা চাকমা ও বাবা নিরতা রঞ্জন চাকমা। বছর তিনেক আগে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন তাঁরা।
অবসর ভবনটি এখন বৃদ্ধাশ্রম হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছা চঞ্চলের। বললেন, ‘বৃদ্ধাশ্রম চালানোর মতো প্রয়োজনীয় অর্থ নেই আমার কাছে। কিন্তু ভবনটি মানুষের কাজে লাগছে দেখে যেতে পারলে মরেও সুখ পাব। পৃষ্ঠপোষক পেলে বিনা শর্তে এটি বৃদ্ধাশ্রম হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দেব।’