নারীর প্রতি বিদ্বেষ ও নানা ধরনের হামলা বেড়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় অচলাবস্থা কাটলেও পুরোপুরি গতি ফেরেনি।
গত সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক একাধিক সংবাদমাধ্যমে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। কবে নাগাদ নির্বাচন হচ্ছে, সেটিও জানানোর চেষ্টা করেছেন। গণহত্যাসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না সে বিষয়েও প্রশ্নের সম্মুখীন হন তিনি।
এ বিষয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনে অংশ নেবে কি না এ সিদ্ধান্ত তাদের (আওয়ামী লীগের)। আর কে অংশগ্রহণ করতে পারবে সেটা যাচাই করে দেখবে নির্বাচন কমিশন। আমার তো এখানে কিছু বলার নেই।’
দেশের দুর্দশাপূর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য ড. ইউনূস পতিত শেখ হাসিনার সরকারকে দায়ী করে বলেন, অর্থনীতি, শান্তি ও শৃঙ্খলা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অর্থনীতির অবস্থা এতটা ভয়াবহ, যেন এর ওপর দিয়ে ১৬ বছর ধরে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতি ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এখন অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য বলে জানান তিনি।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভালো পরিস্থিতি তো আসলে আপেক্ষিক বিষয়। গত বছরের একই সময়কালের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখবেন, পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। এখন যা হচ্ছে, সেটা অন্য সময়ের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের ডিসেম্বর বা সামনের বছর মার্চ নাগাদ নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। যদি সংস্কারকাজ যথাযথভাবে শেষ হয়, তবে ডিসেম্বরেই সেটা করা যেতে পারে। নইলে কিছুদিন বিলম্ব হবে।’ আবার প্রায় একই সময়ে স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে বলে জানান। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দুই কূটনীতিক উইলিয়াম বি মাইলাম ও জন ড্যানিলোউইচকে বলেন, ‘নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বরে অথবা আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে।’ এ অবস্থায় কবে নির্বাচন হবে—এই প্রশ্নের জবাব এখনো অস্পষ্ট।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সাম্প্রতিক কড়া সতর্কবার্তাও দেশের রাজনৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এক ধরনের মূল্যায়ন বলে অনেকে মনে করে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমরা নিজেরা হানাহানি নিয়ে ব্যস্ত। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যস্ত। এটা একটা চমৎকার সুযোগ অপরাধীদের জন্য। যেহেতু আমরা একটা অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করছি, তারা খুব ভালোভাবেই জানে, এই সময় যদি এসব অপরাধ করা যায়, তাহলে এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। সে কারণে এই অপরাধগুলো হচ্ছে। আমরা যদি সংগঠিত, একত্র থাকি, তাহলে অবশ্যই সম্মিলিতভাবে এটা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।’
সেনাপ্রধান ওই দিন আরো বলেন, ‘দেশের উচ্ছৃঙ্খল কাজগুলো আমাদের (দেশের মানুষ) নিজস্ব তৈরি। বিপরীতমুখী কাজ করলে দেশে কখনো শান্তি-শৃঙ্খলা আসবে না। জিনিসটা আপনাদের মনে রাখতে হবে।’
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির দাবি : সরকারের সাত মাসে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে বলে মনে করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেছেন, এখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। আরো যাতে ভালো করা যায়, সেই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
ডিএমপির ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, জননিরাপত্তা বিধান ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে ঢাকা মহানগর এলাকায় পুলিশি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ডিএমপিসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে সমন্বিত চেকপোস্ট ও টহল কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে। রাজধানীতে এখন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ঢাকা নগরবাসীর সার্বিক নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিত করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গতি ফেরেনি শিক্ষায় : অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে শিক্ষাব্যবস্থার অচলাবস্থা কাটলেও পুরোপুরি গতি ফেরেনি। শিক্ষা উপদেষ্টা শুরুতেই জোর দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগে। প্রথম দুই মাসের মধ্যেই সেটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের নানা দাবি আর আন্দোলনের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রমে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাবর্ষের প্রথম দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো সব শিক্ষার্থী বই পায়নি। মূলত কারিকুলামে পরিবর্তন ও বই ছাপার দরপত্র প্রক্রিয়ায় দেরি হওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রমজানের ছুটি শুরু হয়েছে। স্কুল খুললেই পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। ফলে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা বড় সংকটের মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষকরা নানা দাবি নিয়ে আন্দোলনের মাঠে থাকায় পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটেছে।
তবে সরকারের সাত মাসের প্রাক্কালে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তাঁর দায়িত্ব ছেড়েছেন। গত বুধবার শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন অধ্যাপক সি আর আবরার। ফলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এখন তাঁর পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
রাজনীতিবিদরা যা বলছেন : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নজর দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সরকার তা করতে পারেনি। ফলে এখন দেশব্যাপী অরাজকতা চলছে।
অর্থনীতির গতি সচল করার ওপর নজর দিলেও নির্বাচিত সরকার না থাকায় বিনিয়োগ বাড়ছে না, বেকারত্ব বাড়ছে। সব কিছু মিলিয়ে সরকার জনগণের সঙ্গে নেই। তাই সাত মাস পর মানুষ চরম হতাশ।
তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কবে আলোচনা হবে, কবে তা বাস্তবায়ন করবে, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে সরকারের পরিকল্পনায় গলদ এবং উপদেষ্টাদের অপরিপক্বতা প্রমাণ হয়ে গেছে। সরকারের উচিত ছিল দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করা। কখনো সরকার বলছে এই বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে, কখনো বলছে পরের বছরের মার্চে। সংকট কাটাতে দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত এবং আন্দোলনকারী সব দলের সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য গত সাত মাস অনেক সময়। কিন্তু এই সময় তারা জনগণের সাধারণ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। বরং দিন দিন মানুষের এই প্রত্যাশা ফিকে হতে চলেছে। বাজারব্যবস্থা ও জনজীবনের নিরাপত্তা, জানমালের নিরাপত্তা ছিল অগ্রাধিকারের বিষয়। কিন্তু এ বিষয়ে জনগণ হতাশ। বিভিন্ন এলাকায় জানমালের নিরাপত্তা হুমকিতে। নারীর প্রতি বিদ্বেষ ও নানা ধরনের হামলা বেড়েছে। ভয়ের নতুন ধরন ও সেলফ সেন্সরশিপের আরেক ধারা শুরু হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সরকারের অনেক কাজের মধ্যে অগ্রাধিকার ছিল সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন ততটুকু সংস্কার করে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা। অথচ সরকার ‘সংস্কার’ ‘সংস্কার’ শব্দ চয়নের মধ্যে থাকলেও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কার্যক্রম এখনো শুরু করতে পারেনি। ফলে নির্বাচনের বিষয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে। আর এই অবস্থা চলতে থাকলে নানা অপশক্তি নানা অপতৎপরতা চালানোর সুযোগ পাবে এবং পাচ্ছে।
রুহিন হোসেন প্রিন্স আরো বলেন, ‘এই মুহূর্তে সরকার নতুন কোনো দল গড়ে তুলে তাদের সুবিধামতো সময়ে নির্বাচন এবং নিজেদের নানা ধরনের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অথচ গণ-অভ্যুত্থানে যাঁরা জীবন দিয়েছেন সেই শহীদদের পূর্ণ তালিকা, আহতদের চিকিৎসা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের ওপর যারা আক্রমণ করল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বুলডোজার ও মব নানাভাবে আলোচনায় রয়েছে, যা শুধু গণতন্ত্রের পরিপন্থী নয়, নতুন করে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি। এই অবস্থায় নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা বেশ কিছু সংকট কাটিয়েই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম চেতনা গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করতে পারব বলে মনে করি।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা আকবর খান বলেন, ‘নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে অন্তর্বর্তী সরকার সাত মাস টিকে আছে, এটাই বড় সাফল্য। এখন আমরা রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করে একটা জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যাত্রা করতে চাই। এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।’
তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি মানুষকে নাজেহাল করে তুলছে। অর্থনৈতিক সংকট বাড়ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ প্রশাসনকে পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। ফলে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা এই উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ওই সব ঘটনা গণ-অভ্যুত্থানে উত্খাত হওয়া আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও সামাজিক পুনর্বাসনের রাস্তা প্রশস্ত করবে। এতে গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকিও বাড়বে। তাই প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে।