কবিরা ও সগিরা গুনাহর সংজ্ঞা জানার আগে এ কথা বিশদভাবে জেনে নেওয়া বাঞ্ছনীয় যে গুনাহ বলতে সেসব কাজকে বোঝায়, যা আল্লাহর নির্দেশ ও ইচ্ছাবিরুদ্ধ। এতে অনুমান করা যায় যে পরিভাষাগতভাবে যাকে সগিরা গুনাহ বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে সেগুলোও ছোট গুনাহ নয়। যেকোনো অবস্থায়ই আল্লাহর নাফরমানি ও তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করা অত্যন্ত কঠিন অপরাধ। তবে কবিরা ও সগিরার যে পার্থক্য, তা শুধু তুলনামূলক।
কবিরা ও সগিরা গুনাহর পরিচয়
মুফতি কাসেম শরীফ

কবিরা ও সগিরা গুনাহর পরিচয়
যে গুনাহর জন্য পার্থিব জীবনে হদ বা শাস্তি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যেমন—নিরপরাধ মানুষ হত্যা, ব্যভিচার, চুরি ইত্যাদি। কিংবা যে পাপের জন্য পরকালে জাহান্নাম বা আল্লাহর ক্রোধ কিংবা অভিসম্পাতের কারণ বলে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে, যেমন—সুদ খাওয়া, মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া ইত্যাদি।
কবিরা ও সগিরা গুনাহর মধ্যে পার্থক্য
প্রথমত, কোনো গুনাহর প্রাথমিক পর্বগুলো হলো সগিরা গুনাহ। আর ওই গুনাহর চূড়ান্ত পর্ব হলো কবিরা গুনাহ।
দ্বিতীয়ত, কোনো গুনাহর অনিষ্ট ও পরিণতি যদি কোনো কবিরা গুনাহর মতো হয়, তবে তা কবিরা গুনাহ, অন্যথায় সগিরা গুনাহ।
তৃতীয়ত, ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেছেন, প্রতিটি গুনাহ তার চেয়ে বড় ও ওপরের স্তরের গুনাহর হিসেবে সগিরা বা ছোট গুনাহ। আবার কোনো গুনাহ তার চেয়ে ছোট ও নিচের স্তরের গুনাহর হিসেবে কবিরা গুনাহ।
কবিরা গুনাহর সংখ্যা কত?
স্থান-কাল-পাত্রভেদে হাদিস শরিফে কবিরা গুনাহ তিন বা চার অথবা সাতটি বলা হয়েছে। আল্লামা জাহাবি (রহ.) তাঁর গ্রন্থ ‘আল-কাবায়ের’-এর মধ্যে বলেছেন, কবিরা গুনাহ ৭০টি।
আল্লামা ইবনে হাজর হাইসামি (রহ.) ‘আয-যাওয়াজের’ নামক গ্রন্থে কবিরা গুনাহ ৪৬৭টি বলে উল্লেখ করেছেন।
আল্লামা মুফতি শফি (রহ.) ‘ইনযারুল আশায়ের’ নামক গ্রন্থে কবিরা গুনাহ ৮৩টি ও সগিরা গুনাহ ১২৬টি বলে উল্লেখ করেছেন।
প্রসিদ্ধ কিছু কবিরা গুনাহ
(১) শিরক করা। (২) মাতা-পিতাকে কষ্ট দেওয়া। (৩) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা। (৪) ব্যভিচার করা। নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো নারী বা নিজের স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করা। (৫) চুরি করা। (৬) অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা। (৭) মিথ্যা অপবাদ ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। (৮) পণ্যে ভেজাল মিশ্রিত করা। (৯) অঙ্গীকার ভঙ্গ করা। (১০) মিথ্যা বলা ও ধোঁকা দেওয়া।
(১১) খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখা। (১২) মাপে কম দেওয়া। (১৩) অন্যায়ভাবে কারো জমি দখল করা। (১৪) শ্রমিকের মজুরি কম দেওয়া বা না দেওয়া। (১৫) জুয়া খেলা ও লটারি ধরা। (১৬) নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়া বা পান করা। (১৭) সুদ খাওয়া। (১৮) ঘুষ খাওয়া। (১৯) চাঁদাবাজি বা জোর-জুলুম করে অর্থ-সম্পদ লুটে নেওয়া। (২০) অনাথ, এতিম ও বিধবার সম্পদ গ্রাস করা।
(২১) আমানতের খিয়ানত করা। (২২) অহংকার করা, অন্যকে হেয় করা। (২৩) কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া। (২৪) নিজের স্ত্রী, কন্যা, বোন ও অন্য অধীন নারীদের পরপুরুষের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতে দেওয়া। (২৫) স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে তাকে নিয়েই ঘর-সংসার করতে থাকা। (২৬) চোগলখুরি করা। (২৭) গিবত-পরনিন্দা তথা কারো অগোচরে তার বদনাম করা, যদিও তা সত্য হয়। (২৮) প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া। (২৯) অসৎ কাজ দেখে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাধা না দেওয়া। (৩০) তাকদিরের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস না রাখা। (৩১) অবহেলা করে নামাজ কাজা করা, রোজা না রাখা, জাকাত না দেওয়া ও হজ ফরজ হওয়া সত্ত্বেও আদায় না করা।
(বুখারি, হাদিস : ৬৮৫৭, ফাতাওয়া আলমগিরি : ৩/৫৩২, আদ্দুররুল মুখতার : ১/৫৬০, মিরকাত : ১/২২১, কামুসুল ফিকহ : ৪/৫৪৯)
পাপের শাস্তি দুনিয়ায়ও ভোগ করতে হয়
এক শ্রেণির মানুষের বদ্ধমূল ধারণা হলো, পাপের সাজা শুধু পরকালেই দেওয়া হয়। অথচ কোরআন-হাদিসের বহু স্থানে স্পষ্ট করে বলা আছে যে পাপাচারের শাস্তি দুনিয়ায়ও পেতে হয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘(আখিরাতের) গুরু শাস্তির আগে (দুনিয়ায়ও) তাদের আমি লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা : সাজদা, আয়াত : ২১)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে, তা তো তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল...।’ (সুরা : শুরা, আয়াত : ৩০)
আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন। অতঃপর তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুহাজিররা, আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যেন তোমরা পাঁচটি বিষয়ে আক্রান্ত না হও। তা হলো, কোনো সম্প্রদায় অশ্লীল কাজ প্রকাশ্যে করলে তাদের মধ্যে মহামারি ও এমন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটবে, যা এর আগে কখনো হয়নি। ওজন ও পরিমাপে ত্রুটি করলে তারা দুর্ভিক্ষ, মূল্যস্ফীতি ও শাসকের অত্যাচারের সম্মুখীন হবে। জাকাত আদায় না করলে তারা বৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হবে। দুনিয়ায় চতুষ্পদ জন্তু না থাকলে তারা বৃষ্টি লাভ করত না। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে তাদের ওপর আল্লাহ তাআলা বাইরের এমন শত্রু চাপিয়ে দেবেন যে তাদের সব সম্পদ আত্মসাৎ করবে। তাদের শাসকরা আল্লাহর কিতাব তথা কোরআন ও আল্লাহর অবতীর্ণ দ্বিনের আলোকে শাসনকার্য পরিচালনা না করলে আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ তৈরি করে দেবেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০১৯)
মহান আল্লাহ আমাদের পাপমুক্ত জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা
- পর্ব, ৭৪৬

আয়াতের অর্থ : ‘কিন্তু তারা কিয়ামতকে অস্বীকার করেছে এবং যে কিয়ামতকে অস্বীকার করে তার জন্য আমি প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত অগ্নি। দূর থেকে অগ্নি যখন তাদেরকে দেখবে তখন তারা শুনতে পাবে তার ক্রুদ্ধ গর্জন ও চিৎকার; আর তাদেরকে শৃঙ্খলিত অবস্থায় তার কোনো সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, তখন তারা তথায় ধ্বংস কামনা করবে। তাদেরকে বলা হবে, আজ তোমরা একবারের জন্য ধ্বংস কামনা কোরো না, বহুবার ধ্বংস হওয়ার কামনা করতে থাকো। ...সেথায় তারা যা চাইবে তাদের জন্য তাই থাকবে এবং তারা স্থায়ী হবে; এই প্রতিশ্রুতি পূরণ তোমার প্রতিপালকেরই দায়িত্ব।
আয়াতগুলোতে জাহান্নামের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে।
শিক্ষা ও বিধান
১. কিয়ামতের বিশ্বাস ঈমানের অপরিহার্য অংশ। কিয়ামতে বিশ্বাস না করলে কেউ মুসলমান হতে পারে না।
২. কিয়ামতে অবিশ্বাসের শাস্তি জাহান্নাম।
৩. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস হলো, জাহান্নাম এখনো বিদ্যমান। আল্লাহ তা অনাদিকাল থেকে জাহান্নামিদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন।
৪. পৃথিবীতে মানুষের কাছে মৃত্যু যতটা অনাকাঙ্ক্ষিত, জাহান্নামে পাপীদের কাছে মৃত্যু ততটা কাঙ্ক্ষিত হবে।
৫. আল্লাহ অনুগ্রহপূর্বক বান্দাকে জান্নাত দানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। নতুবা আল্লাহর ওপর কোনো কিছু অপরিহার্য নয়। (বুরহানুল কুরআন : ২/৬০৭)

জাহেলি আরবে যেসব মূর্তির পূজা হতো
মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ

লাত ও উজ্জা ছিল কুরাইশের দুই দেবতা। কুরাইশের লোকেরা ঘুমানোর আগে লাত ও উজ্জার পূজা করত।
(মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২২২)
এ দুটির নামে কসম খেতো। হজের সময় তারা ‘মানাত’কে ঘিরে তাওয়াফ করত।
(মুজামুল বুলদান, ‘আল-উজ্জা’ ভুক্তি)
সুরা নুহের ভেতর যেসব মূর্তির কথা বলা হয়েছে আরবের বিভিন্ন গোত্র এগুলোর পূজা করত। ‘ওয়াদ্দ’ ছিল দুমাতুল জান্দালে বনি কালবের দেবতা। ‘সুওয়াআ’ ছিল হুজাইল গোত্রের দেবতা। মুরাদ ও বনি গাতফানের গোত্রগুলোর দেবতা ছিল ‘ইয়াগুস’।
মূর্তির নাম বিশ্লেষণ
লাত : আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) ও অন্যদের থেকে বর্ণিত হয়েছে যে লাত শব্দটি থেকে এটা নিষ্পন্ন, এর অর্থ হলো সংমিশ্রণ।
আল-উজ্জা : আল-উজ্জা অর্থ হলো প্রতাপ, প্রতিপত্তি। এই শব্দের ইসমুত তাফজিল বা অগ্রাধিকার-বিশেষণ ও স্ত্রীলিঙ্গ হলো উজ্জা। অর্থাৎ মহাপরাক্রমশালী দেবী।
(সহিহ বুখারি, গাজওয়াতু উহুদ)
মানাত : মানাত শব্দটি কয়েকটি মূল ধাতু থেকে নির্গত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। ‘লিসানুল আরব’ প্রণেতা উল্লেখ করেছেন যে মানাত-এর ‘তা’ স্ত্রীলিঙ্গবাচক। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, মানাত ভাগ্য ও মৃত্যুর দেবী ছিল।
ওয়াদ্দ : ওয়াদ্দ অর্থ অনুরাগ ও ভালোবাসা। এর বিপরীতে ছিল ঘৃণা ও শত্রুতার দেবী, তার নাম ছিল নিকরা। ওয়াদ্দ দেবতার কথা বিভিন্ন শিলালিপিতে পাওয়া যায়।
সুওয়াআ : আরবি ভাষা সুওয়াআ শব্দটির মূল ধাতু পাওয়া যায় না। যার অর্থ যুগ।
ইয়াউক : যার অর্থ রুখে দেওয়া। এই মূর্তির পূজা করত ইয়ামানবাসীরা। তাদের মধ্যে প্রতীক হিসেবে ভবিষ্যত্বাচক ক্রিয়াপদের ব্যাপকতা ছিল।
ইয়াগুস : ইয়াউকের পদ্ধতি অনুযায়ী ইয়াগুসও একটি প্রতীক। এর অর্থ হলো ফরিয়াদ করা। সুতরাং ইয়াগুসের অর্থ হলো যে ফরিয়াদ শোনে এবং ফরিয়াদের প্রতিকার করে।
নাসর : নাসর একটি পরিচিত পাখি শকুন। আকাশে শকুন আকৃতি ধারণকারী একগুচ্ছ নক্ষত্রকে নাসর (ভেগা) বলা হয়। ভেগা নক্ষত্র একটি দেবতা হিসেবে দীর্ঘকাল পর্যন্ত সেমেটিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর পূজা লাভ করেছে। বাবেলের অন্যতম দেবতা ছিল নাসরুক। ইদানীংকালে বাবেলে এই দেবতার মূর্তি উদ্ঘাটিত হয়েছে।
বায়াল : বায়াল সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে যে এই দেবতা শামের উপাস্য ছিল। এ প্রসঙ্গেই এটির উল্লেখ কোরআন মাজিদে রয়েছে। বায়ালের শাব্দিক অর্থ শক্তি। রূপকার্থে নেতা ও সর্দারকেও বায়াল বলা হয়। একইভাবে স্বামী অর্থেও বায়াল শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কোরআন মাজিদে শব্দটি দ্বিতীয় অর্থে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। আরবের একটি বিখ্যাত দেবতা ছিল হুবাল। হুবাল ছিল কুরাইশের সবচেয়ে বড় উপাস্য। হুবাল বায়ালেরই
বিকৃতরূপ।
আরবের মূর্তি ইউরোপে
বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে আরবের তাওহিদবাদীরাই প্রথমে ইউরোপীয় দেশগুলোতে একত্ববাদের আলো ছড়ান, একইভাবে আরবের জাহেলি যুগই ইউরোপের মূর্তিপূজাকালের শিক্ষক ছিল। আরব বণিকদের মাধ্যমে গ্রিসে, গ্রিস থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে আরবের দেবদেবী ছড়িয়ে পড়ে। সেসব দেশের লোকেরা এসব মূর্তির সামনে সিজদাবনত হয়ে এগুলো উপাসনা করতে শুরু করে। কথিত আছে যে গ্রিক দেবী লেটো (জিউসের পত্নী খবঃড়) আরবের লাতেরই বিকৃতরূপ। একইভাবে হুবাল হার্মিস হয়েছে। হুবাল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে ‘মুজামুল বুলদান’ নামক গ্রন্থে। কিছু প্রাচ্যবিদ এ বিষয়ে পুস্তিকা রচনা করেছেন। (এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম,
খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৮০)

নবীযুগের প্রখ্যাত কারি উবাই ইবনে কাব (রা.)
মাওলানা মুহিউদ্দীন হাতিয়ূভী

নবীজি (সা.)-এর বিশেষ প্রতিভাবান সাহাবিদের একজন সাইয়্যিদুল কুররা উবাই ইবনে কাব (রা.)। তাঁর নাম উবাই। উপনাম আবু মুনযির ও আবুত তুফাইল। প্রথমটি দিয়েছেন রাসুল (সা.) এবং দ্বিতীয়টি হজরত উমর (রা.)।
ইসলাম-পূর্ব জীবন ও ইসলাম গ্রহণ
হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে ইসলাম-পূর্ব জীবনে মদিনায় ইহুদিদের অন্যতম ধর্মগুরু গণ্য করা হতো।
রাসুল (সা.) মদিনায় হিজরতের পূর্বে কোনো একসময় উবাই ইবনে কাব (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন।
ওহি লেখার সৌভাগ্য
যাঁরা রাসুল (সা.)-এর ওহি লিখতেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)। হজরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)-এর পূর্বে তিনিই ওহি লিখতেন। তিনি উপস্থিত না থাকলে রাসুল (সা.) হজরত যায়েদ (রা.)-কে ডেকে নিতেন। পরবর্তী সময়ে হজরত যায়েদ (রা.) বেশি লিখতেন।
(আল-ইস্তিআব : ১/৬৮)
ইলমি দক্ষতা
উবাই ইবনে কাব (রা.) ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে ব্যস্ত না হয়ে মসজিদে নববীতে কোরআনের পাঠ-পঠন-পদ্ধতিসহ দ্বিনি ইলম অর্জনের পেছনে সময় দিতেন। এভাবে রাসুল (সা.)-এর সাহচর্যে থেকে ইলমে ওহির বিশাল ভাণ্ডার অর্জন করেন। একসময় তিনি ইলম ও আমলের সাজে সজ্জিত হয়ে মহান মর্যাদার অধিকারী হন। রাসুল (সা.)-এর যুগেই তিনি ফতোয়া দিতেন। দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) তারাবির জামাত চালু করেন। ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেন হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে।
(আল-আ‘লাম : ১/৮২; সিয়ার আ‘লামিন নুবালা : ১/৩৯৪; আবু দাউদ : ১/২০২)
ইমাম শাবি (রহ.) তাবেঈ মাসরূক (রহ.) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত বিচারক ও ফতোয়া দাতা ছয়জনের একজন ছিলেন উবাই ইবনে কাব (রা.)।
(উসদুল গাবাহ : ১/৬২)
ইলমে কিরাআত ও উবাই ইবনে কাব (রা.)
রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় তিনি কোরআনের একটি পূর্ণ সংকলন প্রস্তুত করেন এবং তা রাসুল (সা.)-এর সামনে পেশ করেন। এই সংকলনটি ‘মাসহাবে উবাই’ নামে খ্যাত ছিল। কোরআনের বিভিন্ন পাঠ-পদ্ধতিতে ছিল তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। তাঁর তিলাওয়াতে ছিল বিশেষ আকর্ষণ। রাসুল (সা.) মাঝেমধ্যে তাঁর থেকে কোরআন শুনতেন। আনাস (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) উবাইকে বললেন, আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন, তোমাকে কোরআন শোনাতে। হজরত উবাই বললেন, ‘আল্লাহ কি আমার নাম উল্লেখ করেছেন?’ ইরশাদ করলেন, ‘হ্যাঁ।’ এরপর বললেন, ‘আমি রাব্বুল আলামিনের দরবারে আলোচিত হয়েছি?’ ইরশাদ করলেন, ‘হ্যাঁ।’ তখন তাঁর দুই চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। (বুখারি : ৭৪১, মুসলিম : ১/২৬৯,
সিয়ার আ‘লামিন নুবালা : ১/৩৯৪)
হাদিস : উবাই ইবনে কাব (রা.) সূত্রে ১৬৪টি হাদিস বর্ণিত আছে। এর মধ্যে বুখারি-মুসলিম যৌথভাবে তিনটি এবং পৃথকভাবে বুখারি তিনটি ও মুসলিম সাতটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।
ইন্তেকাল : উবাই ইবনে কাব (রা.) মদিনায় ইন্তেকাল করেন। (মু‘জামুস সাহাবা : ১/৩)
তবে কোন সনে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আবু নু‘আইম (রহ.) বলেন, এক মতে ২২ হিজরি উমর (রা.)-এর খিলাফতে, আবার এক মতে ৩০ হিজরি উসমান (রা.)-এর খিলাফতে। দ্বিতীয় মতই গ্রহণযোগ্য। (উসদুল গাবাহ : ১/৬৩ পৃ.; আল-ইসাবাহ : ১/১৮১-১৮২ পৃ.; আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা : ৩/৩৮১ পৃ., ক্র.১৭৪; তাহজিবুল আসমা ওয়াল লুগাত : ১/১০৯-১১০ পৃ.)
লেখক : মুহাদ্দিস ও গবেষক

জান্নাতে আল্লাহর দিদার লাভের ৬ আমল
আসআদ শাহীন

আল্লাহ তাআলাকে নিজ চোখে দেখা মহা সৌভাগ্যের বিষয়, যা পরকালে মুমিনদের জন্য নির্ধারিত। জান্নাতের অফুরন্ত সুখ-সুবিধা ও অনাবিল আনন্দের মধ্যেও আল্লাহর দিদার হবে এমন এক পরম আনন্দ, যা জান্নাতবাসীরা অন্য সব আনন্দ ভুলে যাবে।
আসুন, জান্নাতে আল্লাহর দিদার লাভের কিছু আমল জেনে নিই—
প্রথম আমল : ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করা
আল্লাহর দিদার লাভের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো, একজন ব্যক্তি ইসলামের অনুসরণে থেকে মৃত্যুবরণ করবে। কারণ অবিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর দিদার হারাম করা হয়েছে।
(সুরা : আল মুতাফফিফীন, আয়াত : ১৫)
অর্থাৎ গুনাহ ও কুফরির জন্য তাদের কঠিন শাস্তি হলো, তারা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার দিদার থেকে বঞ্চিত হবে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে মুমিনরা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলাকে দেখতে পাবে, আর কাফিররা এই মহান নিয়ামত থেকে বঞ্চিত থাকবে।
দ্বিতীয় আমল : আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করা
আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো—তাঁর কাছে এই মহান নিয়ামত লাভের জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করা।
তৃতীয় আমল : ফজর ও আসরের নামাজের পাবন্দি করা
জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো সব নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া, বিশেষত ফজর ও আসরের নামাজ নিয়মিতভাবে আদায় করা। জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন : একদা আমরা নবী করিম (সা.)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি রাতে (পূর্ণিমার) চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ওই চাঁদকে তোমরা যেমন দেখছ, ঠিক তেমনি অচিরেই তোমাদের প্রতিপালককে তোমরা দেখতে পাবে। তাঁকে দেখতে তোমরা কোনো ভিড়ের সম্মুখীন হবে না। কাজেই সূর্য উদয়ের ও অস্ত যাওয়ার আগের নামাজ (শয়তানের প্রভাবমুক্ত হয়ে) আদায় করতে পারলে তোমরা তা-ই করবে।
চতুর্থ আমল : গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা
জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো—সব ধরনের গুনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। হজরত আবু জর গিফারি (রা.) বর্ণনা করেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদের পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি। বর্ণনাকারী বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এ কথাটি তিনবার পাঠ করলেন। আবু জর (রা.) বলে উঠলেন, তারা ধ্বংস হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হে আল্লাহর রাসুল! এরা কারা? তিনি বলেন, যে লোক পায়ের গোছার নিচে কাপড় ঝুলিয়ে চলে, কোনো কিছু দান করে খোঁটা দেয় এবং মিথ্যা শপথ করে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৪)
পঞ্চম আমল : আল্লাহ তাআলার সাক্ষাৎ ও দিদারের আকাঙ্ক্ষা
জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো—আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ পছন্দ করে, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে না, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫০৭)
ষষ্ঠ আমল : ইহসান করা
জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো ইহসান বা সৎকর্ম করা।
ইহসানের অর্থ হলো, সৃষ্টিজীবের প্রতি যেকোনো ভালো কাজ করা এবং কল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা। এটি এমন একটি গুণ, যা মানুষের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ সুগম করে। ইমাম জুরজানি (রহ.) ইহসানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ইহসান হলো সেই কাজ, যা দুনিয়াতে প্রশংসিত হয় এবং পরকালে প্রতিদান ও সওয়াবের কারণ হয়। (আল-তারিফাত, পৃষ্ঠা-৯১)
আল্লাহ তাআলা আমাদের উপরিউক্ত আমল পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।