৩০. ইহুদিরা বলে, উজাইর আল্লাহর পুত্র, আর খ্রিস্টানরা বলে, (ঈসা) মাসিহ আল্লাহর পুত্র। এ সবই তাদের মুখের (বানানো) কথা। তাদের আগে যারা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে গিয়েছিল, তাদের মতোই এরা কথা বলছে। আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন! এরা বিভ্রান্ত হয়ে কোন দিকে যাচ্ছে? (সুরা তাওবা, আয়াত : ৩০)
তাফসির : ইহুদি ও খ্রিস্টানরা আদিতে একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল; কিন্তু তাদের ধর্মবিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে অনেক বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি ঢুকে পড়েছিল।
আলোচ্য আয়াতে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের দ্বারা একত্ববাদ কিভাবে বিকৃত হয়েছে এবং তারা কিভাবে একত্ববাদের শিক্ষা থেকে দূরে সরে পড়েছে, তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইহুদিরা উজাইর নামের পাদ্রিকে আল্লাহর পুত্র বলে থাকে, আর খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যে ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র। সব খ্রিস্টান ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র হওয়ার আকিদা পোষণ করলেও সব ইহুদি উজাইর আল্লাহর পুত্র হওয়ার আকিদায় বিশ্বাসী নয়। তাদের মধ্যে যারা এই আকিদায় বিশ্বাসী তাদের 'উজাইরি' বলা হয়। মদিনার ইহুদিদের কেউ কেউ এই আকিদায় বিশ্বাসী ছিল। বর্তমানেও কোনো কোনো অঞ্চলে তাদের বংশধর বিদ্যমান আছে।
ইহুদিদের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস : খ্রিস্টপূর্ব ৪৫৭ সালে উজাইর নামে ইহুদিদের একজন পাদ্রি ছিলেন। ইহুদিদের কাছে তিনি উজরা নামে পরিচিত।
তিনি ইহুদি ধর্ম পুনর্জীবিত করেছেন। প্রসিদ্ধ ধর্মগ্রন্থ কিতাবুল মুকাদ্দাস সংকলন করেছেন। নতুনভাবে তিনি ইহুদি ধর্মের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটিয়েছেন। ইহুদিরা তাঁকে খুবই ভক্তি ও শ্রদ্ধা করে। এমনকি কেউ কেউ তাঁকে আল্লাহর পুত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত, এমনকি খোদ ইহুদিরাও স্বীকার করে যে মুসা (আ.) যে তাওরাত শরিফ লিপিবদ্ধ করেছেন এবং তাবুত নামের সিন্দুকে সংরক্ষণ করেছেন, সেটি সুলাইমান (আ.)-এর আমলের আগেই হারিয়ে গিয়েছিল। বনি ইসরাইলের ওপর আমালাকা গোত্র, মতান্তরে বুখতে নছর বাদশাহ যখন চড়াও হয়েছিল, তখন এ ঘটনা ঘটেছে। সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামলে যখন তিনি ওই সিন্দুক খোলেন, তখন তিনি কেবল ১০টা উপদেশ দেখতে পান। বর্তমানে তাদের ধর্মীয় গ্রন্থের 'রাজাদের কাহিনী'তেও এ-সংক্রান্ত বিবরণ পাওয়া যায়। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর উজাইর বা উজরা ইবরানি ভাষার পাশাপাশি কিলদানি অক্ষরে তাওরাত ও অন্যান্য পুস্তক লিখেছেন। এনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটেনিকার মতে, উজরার সংকলিত পুস্তকগুলোতে বর্ণনাকারীদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা যায়। (তাফসিরে মুনির : ১/১৮২)। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত দেখুন তাফসিরে মানার, তাফসির ফি জিলালিল কোরআন ও ইজহারে হক। শেষ দুটি গ্রন্থ বাংলা ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।
খ্রিস্টানদের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস : খ্রিস্টানরা 'ত্রিত্ববাদে' বিশ্বাস করে। এটা তাদের বহুল আলোচিত ধর্মবিশ্বাস। 'ত্রিত্ববাদ'-এর অর্থ হচ্ছে পিতা (গড), পুত্র (ঈসা মাসিহ) ও পবিত্র আত্মার সমন্বয়েই গড। তিনের মধ্যে একজন অংশীদার হলেন গড। এরপর তাঁরা তিনজনই এক এবং একজনই তিন। তিনের সমষ্টি 'এক' কিভাবে হয়- এর কোনো যুক্তিসংগত উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই একাধিক গডের অস্তিত্ব নিয়ে পোপদের আমলেই বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রধানত হেলেনি ও গনোস্টীয় দার্শনিকদের শিক্ষা থেকে এর উদ্ভব হয়েছে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে আন্তাকিয়ার পাদ্রি সিওফিলোস গ্রিক ভাষায় 'ত্রিয়াস' পরিভাষা ব্যবহার করে। তারপর তারতালিয়ালুস 'ত্রিনিতাস' শব্দের ব্যবহার করে, যার অর্থ ত্রিত্ববাদ বা তিন গডের ধারণা। তিন গডের মধ্যে কার ভূমিকা কী হবে- ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে এ নিয়ে চূড়ান্ত মীমাংসা দেয় নিকিয়া একাডেমি। এরপর ৩৮১ খ্রিস্টাব্দে একই বিশ্বাস প্রচার করে কনস্টানটিনোপল একাডেমি। তাদের মতে, পিতা ও পবিত্র আত্মা ঐশ্বরিক সত্তার অংশ হিসেবে সমমর্যাদার অধিকারী। পুত্র পিতার ঔরস থেকে অনাদিকালে জন্ম নিয়েছে। আর পবিত্র আত্মা পিতা থেকেই আবিভূর্ত। উল্লেখ্য, ঈসা (আ.)-এর নিয়ে আসা ইঞ্জিল কিতাব একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর প্রায় তিন শতাব্দী পর তা নতুনভাবে গ্রন্থনা করা হয়। (তাফসিরে মুনির, তাফসিরে জিলালিল কোরআন)
গ্রন্থনা : মাওলানা কাসেম শরীফ