<p> ধান, নদী, খাল- এই তিনে বরিশাল। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসেছে প্রবাদটি। নদী খাল থাকলেও বরিশালের সেই ঐতিহ্যবাহী সুপ্রসিদ্ধ চিকন বালাম চাল এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না। আদিকাল থেকেই বৃহত্তর বরিশালের দক্ষিণাঞ্চলের নদীবিধৌত পলিসমৃদ্ধ জমিতে রোপা আমন মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ বালাম ধানের চাষ হতো। প্রাকৃতিক জৈব সারনির্ভর এ ধান চাষে খরচও ছিল কম। সুস্বাদু সরু বালাম চালের ভাত খেয়ে তৃপ্ত হতেন দক্ষিণাঞ্চলসহ সারা দেশের মানুষ। এ ধান নিয়ে রচিত সেই গান এখনো শোনা যায়, 'বাংলাদেশের অভাব কি ভাই বাংলাদেশের অভাব কি, বরিশালের বালাম চাল আর ঢাকার আছে গাওয়া ঘি।'</p> <p> তখন অল্প যত্নে বালাম ধানের উৎপাদন ছিল প্রতি হেক্টর জমিতে চার টনের কাছাকাছি। বালামের চাল রান্নার পর দীর্ঘ সময় স্বাভাবিক থাকার কারণে এর চাহিদাও ছিল বেশি। কথিত আছে, এ অঞ্চলের বালাম চাল দেখে অবাক হয়েছিলেন চীনের পর্যটক হিউয়েন সাং। মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলার এ চালের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। সে সময় এলাকার কৃষকদের বালামি উপাধি দিয়েছিলেন খাদ্যরসিকরা। বালাম চালের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তির পথে কালিজিরা, স্বাক্ষরকোড়া ও রাজাশাইল প্রজাতির স্থানীয় দেড় শতাধিক জাতের ধানও।</p> <p> জানা যায়, ষাটের দশকে কৃষি বিভাগ ও তৎকালীন পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এ দেশে প্রথম উচ্চ ফলনশীল ইরি ধানের বীজ কৃষকদের হাতে তুলে দেয়। এর পরই এ দেশে শুরু হয় রাসায়নিক সার ব্যবহারনির্ভর উফশী ধানের চাষ। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে খাদ্যের জোগান দিতে বাড়তি চালের উৎপাদন অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে দক্ষিণাঞ্চলের বালামসহ রোপা আমনের স্থানীয় জাতের ধান। বাড়তে থাকে উচ্চ ফলনশীল ধানের চাষ। এ কারণে এ অঞ্চলের মাঝারি উঁচু জমিতে আমন মৌসুমে চাষ উপযোগী বালাম ধানের জায়গা দখল করে নেয় উচ্চ ফলনশীল জাতের বিরি ধান। বর্তমানে দেশে রোপা আমন মৌসুমে উচ্চ ফলনশীল জাতের ২৯টি প্রজাতি রয়েছে।</p> <p> সদর উপজেলায় কর্মরত কৃষি কর্মকর্তা জগৎ প্রিয়দাস বিশু জানান, বালাম চাল মূলত, নাজিরশাইল, রাজাশাইল, চাপলাইশ, বালিচিকন, পাটনাই চিকন, সীতাভোগ, বাঁশফুল ইত্যাদি স্থানীয় জাতের হয়ে থাকে। এসব ধানের বর্তমান গড় ফলন হেক্টরপ্রতি এক দশমিক ৬৮ মেট্রিক টন। আর একই সময় কৃষক পর্যায়ে উফশী আমন জাতের ফলন হেক্টরপ্রতি চার টনের ওপরে। বিশুদাস বলেন, যদিও স্থানীয় রোপা আমন জাতের ধানচাষ সহজ, ব্যয়সাশ্রয়ী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনশীল, তারপরও ফলন পার্থক্যের কারণে বালাম জাতের ধানগুলো প্রকৃতি থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া এসব স্থানীয় প্রায় দেড় শ প্রজাতির ধানের বয়স অনেক বেশি হওয়ায় এর সহজাত গুণাগুণ কমে গিয়ে এবং বীজ সংরক্ষণে কৃষকের অসতর্কতার কারণে বীজের গুণগত মান ক্ষুণ্ণ হওয়ায় ফলনও কমে যাচ্ছে।</p> <p> জানা গেছে, ১৯৭৪ সালে দেশে খাদ্যাভাবের সময় ভারতীয় ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে এক প্যাকেট করে উফশী জাতের ভোজন ধানের বীজ বিতরণ করা হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলে এ ধানের বীজে সাফল্য না এলেও দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের মুখে হাসি ফোটে। অল্প জমিতে বীজ বপন করে অনেক বেশি ফলন ঘরে তোলেন কৃষকরা। স্থানীয় কৃষকরা জানান, বালাম, কালিজিরা কিংবা রাজাশাইল ধান এখন অনেকটা দাদা-দাদির কাছ থেকে শোনা গল্পের মতো। কালের বিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও শিল্পোন্নয়নের ফলে সেসব বিলুপ্তপ্রায়।</p> <p> বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ ও সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রফিকুল ইসলাম জানান, একসময় এ অঞ্চলে জনসংখ্যা ছিল কম। তখন যে পরিমাণ বালাম উৎপন্ন হতো, তা দিয়ে কৃষক পরিবারের সারা বছর চলত।</p> <p>  </p> <p>  </p> <p>  </p>