<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সংস্কার প্রয়োজন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই কথাটি যেমন বাস্তব সত্য, ঠিক তেমনি এই সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি শক্তিশালী ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দাবিও দীর্ঘদিনের। দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, মুদ্রাবাজার বিশেষজ্ঞ এবং আর্থিক খাতের বিশ্লেষক ক্রমাগত এই দাবিটি করে আসছেন। কয়েক বছর ধরে অনেকে লেখালেখির মাধ্যমে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় অংশ নিয়ে সরাসরি এই ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথা জোর দিয়ে বলে আসছেন। এর যুক্তিসংগত কারণও আছে। দেশের ব্যাংকিং খাত নানা রকম সমস্যায় যেভাবে জর্জরিত এবং ব্যাংক পরিচালনার মান যে পর্যায়ে নেমে এসেছে, তাতে শক্তিশালী কমিশন গঠন ছাড়া অর্থনীতির অত্যাবশ্যিক এই খাত ঠিক করা সম্ভব হবে না। আজ হোক আর কাল হোক, ব্যাংকিং কমিশন গঠনের মাধ্যমেই দেশের ব্যাংকিং খাতের সংস্কার এবং এই খাতের মান উন্নয়ন করতে হবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দেশের ব্যাংকিং খাত সংস্কারের উদ্দেশ্যে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার কথা বেশ স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ও মানোন্নয়নের বিষয়ে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন, তাঁদের মধ্যে বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অন্যতম। সুতরাং দেশে যে ব্যাংকিং কমিশন গঠিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং এটি হয়তো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। অবশ্য এই ব্যাংকিং কমিশন গঠনের ব্যাপারে গভর্নরের একদিনের এক মন্তব্য ছাড়া বিষয়টি নিয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি এ ব্যাপারে সে রকম কোনো আলোচনাও আর চলছে না। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এ কথা অনস্বীকার্য যে দেশ এখন এক কঠিন সময় পার করছে। আগে থেকেই কিছু সমস্যা ছিল। পরিবর্তিত অবস্থার কারণে আরো নতুন নতুন জটিল সমস্যা এসে জেঁকে বসেছে। সমস্যার মাত্রা এবং অগ্রাধিকারের তালিকা এত লম্বা ও জটিল আকার ধারণ করেছে যে এর সঠিক <img alt="ব্যাংকিং কমিশন গঠনে অগ্রাধিকার প্রয়োজন" height="314" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/04-09-2024/0.jpg" style="float:left" width="400" />সমাধান খুঁজে বের করতে অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর, উভয়ের দিশাহারা অবস্থা। সত্যি বলতে কি, স্মরণকালের ইতিহাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে, যা মোকাবেলা করা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকেই বলার চেষ্টা করবেন যে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়, ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর, নব্বইয়ের দশকের স্বৈরাচার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক এ রকম কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছিল। খুবই সঠিক কথা এবং এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কোনো অবকাশ নেই। তবে পার্থক্য হচ্ছে, তখন দেশের মানুষ উন্নত অর্থনীতি বা জীবনযাত্রার স্বাদ নিতে শেখেনি। এখন এ রকম কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে। ১৫ বছরের শাসনামলের পরিবর্তন, বিশেষ করে যাঁরা এত দিন ভালো ভালো কথা শুনিয়েছেন এবং যাঁদের ওপর মানুষের আস্থা অনেক বেশি, তাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় মানুষের এই প্রত্যাশা আরো অনেক বেড়ে গেছে। এই আকাশচুম্বী প্রত্যাশার সামান্যও যদি পূরণ করা সম্ভব না হয়, তখন এই মানুষের হতাশ হতে এক মুহূর্ত সময় লাগবে না। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সংগত কারণেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনেক তাত্ক্ষণিক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে হয়তো ব্যাংকিং কমিশন গঠনের বিষয়টি অগ্রাধিকারের তালিকার নিচে পড়ে গেছে। সেটি খুবই স্বাভাবিক এবং এটিই হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অন্যান্য সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের বিষয়টিও সমান গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে। কেননা ব্যাংকিং খাতের সংস্কার এবং মানোন্নয়নের ওপর নির্ভর করে বিরাজমান অন্যান্য সমস্যার সন্তোষজনক ও টেকসই সমাধান। যেমন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিদ্যমান ডলার সংকটের সমাধান, আমদানি-রপ্তানি সহজ করা, আমদানি ব্যায় হ্রাস করা, দেশে তারল্য সংকটের সমাধান, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা, ব্যবসায় গতি ফেরানো, অর্থনীতির চাকা সচল রাখাসহ যেসব সমস্যা আছে, সেগুলোর সঠিক সমাধান করতে হলে মানসম্পন্ন ব্যাংকিং খাত নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বর্তমান অর্থনীতি যত না অর্থনীতির তত্ত্বনির্ভর, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যাংকনির্ভর। সমগ্র বিশ্বেই এখন অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অর্থনীতিবিদদের চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রাখেন ব্যাংকার, মানি ম্যানেজার ও মুদ্রাবাজার বিশেষজ্ঞ। এখন যুক্তরাষ্ট্রে একজন অর্থনীতির অধ্যাপকের চেয়ে ওয়ারেন বাফেটের মন্তব্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ওয়ারেন বাফেট একজন প্রখ্যাত মানি ম্যানেজার বা হেজ ফান্ড সম্রাট ছাড়া আর কিছুই না। এখনকার মূলকথাই হচ্ছে দেশের অর্থনীতি ভালো রাখতে হলে দেশের ব্যাংকব্যবস্থাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। বর্তমান অর্থনীতির এই মৌলিক সূত্রটি চীন খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও তারা একটি মানসম্পন্ন ব্যাংকব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের সেরা ২০টি ব্যাংকের ১০টিই চীনের ব্যাংক এবং সেগুলো আবার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক। এখানেও চীন একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রেখেও যে ভালো মানের ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যায়, তার বড় উদাহরণ হচ্ছে চীনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দেশের ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে ব্যাকিং কমিশন গঠন করতে হবে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এটি যেমন বাস্তবতা, তেমনি যেনতেনভাবে একটি কমিশন গঠন করা হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না, বরং এতে জটিলতা আরো বৃদ্ধি পাবে। এ ব্যাপারে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। অতীতে ব্যাংকিং কমিশন না হলেও এর কাছাকাছি দু-একটি উদ্যোগ যে নেওয়া হয়নি, তেমন নয়। যেমন গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি বিদেশি কনসালট্যান্টদের সমন্বয়ে ফিন্যানশিয়াল সেক্টর রিফরম প্রগ্রাম, যা সংক্ষেপে এফএসআরপি নামে পরিচিত, সে রকম একটি ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল দেশের ব্যাংকিং খাতের মানোন্নয়নে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি, বরং পশ্চিমা বিশ্বের ব্যাংকগুলোর ত্যাগ করা সিএল বা ক্লাসিফিকেশন অব লোনস গ্রহণ করা হয়েছে, যা মূলত দেশের ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ সমস্যার অন্যতম একটি কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অনেকেই বলে থাকে এবং আমিও মনে করি যে সেই এফএসআরপি নামের সংস্কার কর্মসূচির একমাত্র সফলতা হচ্ছে সিআইবি অর্থাৎ ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো। সেখানেও কথা আছে। যখন ক্রেডিট ইনফরমেশন এবং ঋণ পরিশোধ বা ডেট সার্ভিসিংয়ের ওপর ভিত্তি করে ক্রেডিট এবং ঋণগ্রহীতার রেটিং পদ্ধতির প্রচলন হওয়ার কথা, তখন আমরা সিআইবি নিয়েই পড়ে আছি। একইভাবে এই শতাব্দীর শুরুর দিকে অর্থাৎ ২০০৩-০৪ সালের দিকে ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বা সিআরএম (ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট) কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু এতেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সঠিকভাবে সিআরএম বাস্তবায়নের অর্থই হচ্ছে বেনামি ঋণ বা জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ মঞ্জুর বন্ধ করা এবং খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হ্রাস পাওয়া। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে, তা সবারই জানা। এতেই বোঝা যায় যে সিআরএম বাস্তবায়নের নামে বিদেশি কনসালট্যান্টরা তাঁদের পারিশ্রমিক নিয়ে চলে গেছেন ঠিক, কিন্তু দেশের ব্যাংকিং খাতের কোনো লাভ হয়নি।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এসব কারণে এবার যে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের আলোচনা চলছে, সেটি করতে হবে যথেষ্ট ভেবেচিন্তে এবং সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে, যাতে কমিশনটি শক্তিশালী এবং কার্যকর হয়। দেশের এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে যাঁদের স্বচ্ছ ধারণা আছে, তাঁদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করেই এই ব্যাংকিং কমিশন গঠনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তবে সবার আগে প্রয়োজন ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য সঠিক কর্মপরিকল্পনা বা স্কোপ অব ওয়ার্ক নির্ধারণ করা। আমরা সবাই ব্যাংকিং খাতের সমস্যার কথা বলি, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে যখন সমস্যাগুলো জানতে চাওয়া হয়, তখন দু-একটির বেশি আর কেউ কিছু বলতে পারে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাব এবং খেলাপি ঋণকেই সমস্যা হিসেবে দেখে। কিন্তু এই দুটি বিষয় সমস্যা হলেও এগুলো অন্যান্য মূল সমস্যার ফল। তাই এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সঠিকভাবে এবং বিস্তারিত বিচার-বিশ্লেষণ করে দক্ষ ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে পারলে দেশের ব্যাংকিং খাতে সংস্কার করা সহজ হবে। সেই সঙ্গে দেশের ব্যাংকব্যবস্থাকে একটি পর্যায়ে উন্নীত করার কাজটিও সম্ভব হবে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সব কিছু মিলিয়ে বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের সংস্কার করা অপরিহার্য। আর সঠিকভাবে সংস্কার করতে হলে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কোনো বিকল্প নেই। ব্যাংকিং কমিশন গঠনের উদ্যোগকে সমান গুরুত্ব দিয়েই শুরু করতে হবে। অন্যান্য বিরাজমান সমস্যার সমাধান করে তারপর ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কাজে হাত দিতে গেলে যথেষ্ট বিলম্ব হয়ে যেতে পারে। এতে দেশের ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান সমস্যা আরো জটিল হতে থাকবে। এমনকি বিষয়টির গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিকতাও হারিয়ে যেতে পারে। এ কারণেই দেশের অর্থনীতি ও আর্থিক খাতের অনেক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের উদ্দেশ্যে ব্যাংকিং কমিশন গঠনকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">nironjankumar_roy@yahoo.com</span></span></span></span></p> <p> </p>