<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশ্লেষকদের দীর্ঘদিনের বিশ্লেষণের পর অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ফেডারেল রিজার্ভ, তাদের নীতি সুদ হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে। দীর্ঘ চার বছর ধরে উচ্চ সুদের হার বজায় রাখার পর গত সপ্তাহে ফেডারেল রিজার্ভ তাদের নীতি সুদ হার প্রথম দফায়ই ৫০ বেসিস পয়েন্ট বা ০.৫০ শতাংশ  হ্রাস করেছে। উল্লেখ্য, ব্যাংক রেট, নীতি সুদ হার বা বেঞ্চমার্ক রেট একই অর্থে ব্যবহৃত হয়, যা মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ধার্য সুদের হারকে বুঝিয়ে থাকে। ফেডারেল রিজার্ভের এই সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না। কেননা যুক্তরাষ্ট্র গত এক বছরের বেশি সময় ধরে বলে আসছে যে তাদের অর্থনীতি সঠিক পথে আছে। মূল্যস্ফীতি তাদের লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশের কাছাকাছি নেমে এসেছে, বেকারত্বের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে এবং চাকরির বাজারে যথেষ্ট চাঙ্গা অবস্থা বিরাজ করছে। স্টক মার্কেটও বলা চলে ঊর্ধ্বমুখী ধারা বজায় রেখেছে এবং হাউজিং মার্কেট অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থায় থাকলেও তাকে খারাপ বলার সুযোগ নেই। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এককথায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের ভাষ্য এবং অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনীতির সব ইন্ডিকেটর ইতিবাচক অবস্থায় আছে প্রায় এক বছর ধরে। সেই হিসাবে ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদ হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নেওয়ার কথা ছিল। বিশেষ করে বছরের শুরু থেকে এই নীতি সুদ হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস করার ব্যাপারে সবাই দারুণ আশাবাদী ছিল। কিন্তু ফেডারেল রিজার্ভ সে পথে না হেঁটে এক ধরনের ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করে এবং বেঞ্চমার্ক রেট হ্রাসে বিলম্ব করে। অবশ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর এখনই তাদের নীতি সুদ হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার ব্যাপারে আইএমএফের সতর্কবার্তা ছিল। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভই নয়, আরো অনেক উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ আগে থেকেই তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করতে শুরু করেছে। যেমন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ব্যাংক অব কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইউরোপ এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ড আগেই তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করেছে। এমনকি উন্নয়নশীল বিশ্বের কোনো কোনো দেশ তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আগেই। যেমন ইন্দোনেশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সপ্তাহ দু-এক আগেই তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করেছে। বিশ্বব্যাপী বেঞ্চমার্ক রেট হ্রাসের ক্ষেত্রে এবারই মনে হয় ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটল। কেননা সাধারণত বিশ্বব্যাপী আর্থিক নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বেঞ্চমার্ক রেট পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং অন্যান্য দেশ তখন সেটি অনুসরণ করে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার হ্রাসে কমছে ডলার সংকট" height="436" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/24-09-2024/2_kaler-kantho--21-9-2024.jpg" style="float:left" width="500" />এবারও সমগ্র বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে ছিল বছরের শুরু থেকেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ তাদের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ আরো অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেরাই তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করতে শুরু করে। বলা যেতে পারে যে অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্তকে ত্বরান্বিত করেছে। এখন আশা করা যায়, অন্যান্য দেশ যারা তাদের সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে রেখেছিল, তারাও তাদের নীতি সুদ হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত অচিরেই গ্রহণ করবে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, আগামী মাসেই ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও চলতি বছরের শেষ নাগাদ তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করবে মর্মে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোর আলোচনা আছে। এভাবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার হ্রাস করার কারণে বিশ্বব্যাপী ঋণের সুদ বা বরোইং কস্ট </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">(Borrowing Cost) </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কমতে শুরু করবে বলে অনুমান করা যায়।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তাদের মুদ্রা ডলারকে হার্ড কারেন্সি (অতি চাহিদার মুদ্রা) হিসেবে ধরে রাখার কৌশল অবলম্বন করে। এটি করতে গিয়ে প্রথমেই তারা খুবই দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের বেঞ্চমার্ক রেট বাড়িয়ে দেয়। ২০০৮ সালের ভয়াবহ আর্থিক মন্দার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি বিরাজ করছিল। সেখানে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্র এই বেঞ্চমার্ক রেট ৫ শতাংশে বৃদ্ধি করে। অল্প সময়ের ব্যবধানে এই উচ্চ সুদের হার বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যুক্তি দেখানো হলেও মূল উদ্দেশ্য ছিল ডলারকে হার্ড কারেন্সিতে পরিণত করা। ফলে উচ্চ সুদের হারের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের কষ্ট হলেও যুক্তরাষ্ট্র সুকৌশলে দুটি উদ্দেশ্য হাসিল করতে পেরেছিল। প্রথমত, তারা নিজেদের অর্থনৈতিক মন্দাটা ঠেকাতে পেরেছিল। দ্বিতীয়ত, ডলারনির্ভর দেশগুলোকে সমস্যায় ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। কেননা সেসব দেশে ডলার সংকট চরমে পৌঁছেছিল।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ সুদের হার নীতির কারণে যেসব উন্নয়নশীল দেশ চরম ডলার সংকটে পড়েছিল, তার মধ্যে আমাদের দেশও ছিল। আমাদের দেশে ডলার সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। একসময়ের ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে চলে আসে এবং ডলারের বিপরীত টাকার অতি অবমূল্যায়ন ঘটে। বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও অবস্থার দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। এখন আগের সরকারের রেখে যাওয়া সংকট কাটানোর চেষ্টা করতে হবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে। আশার কথা এই যে দুজন প্রথিতযশা এবং অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ আছেন অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্বে। বাংলাদেশের এই দুই ব্যক্তি ডলার সংকটের বিষয় এবং সমাধানের ব্যাপারে অন্য যে কারো চেয়ে অনেক বেশি ভালো জানেন। তাই এই সংকট উত্তরণে সঠিক পদক্ষেপ যে গৃহীত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এরই মধ্যে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ভালো অঙ্কের আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এসব কারণে আপাতদৃষ্টিতে হয়তো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে এবং অবস্থার উন্নতি হবে বলেও আশা করা যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কয়েক বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ বেঞ্চমার্ক রেট হ্রাস করায় আমাদের দেশের মতো ইমার্জিং মার্কেটের দেশগুলোর ডলার সংকটের সমাধান হবে কি না। এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়ার সুযোগ যেমন নেই, তেমনি সেই উত্তর দেওয়ার মতো উপযুক্ত সময় এখনো হয়নি। প্রথমত, আজকের যে ডলার সংকট, তা মূলত যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি থেকে ৫ শতাংশে উন্নীত করার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। তাই মাত্র ৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদের হার হ্রাস করলেই বিরাজমান ডলার সংকটের উন্নতি হবে, তেমনটি আশা করা কঠিন। তা ছাড়া এই সামান্য সুদের হার হ্রাসের কারণে ডলার রাতারাতি হার্ড কারেন্সি থেকে সফট কারেন্সিতে পরিণত হবে, তেমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। ফেডারেল রিজার্ভের এক কর্মকর্তা তো স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন যে এই একটিমাত্র পদক্ষেপের কারণে ডলার তার শক্ত অবস্থান হারাবে না। এ কথা ঠিক যে ডলারে ঋণের ওপর সুদ কিছুটা কমবে, তা-ও সব ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে হবে না। তা ছাড়া যেসব কারণে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে, তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ সুদের হার একটিমাত্র কারণ। তাই অন্যান্য সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান করতে না পারলে এই সংকটের টেকসই সমাধান আশা করা কঠিন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সবচেয়ে বড় কথা, এবারের উচ্চ সুদের হার এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ডলার সংকট যত না অর্থনৈতিক কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক কারণে হয়েছিল। আবার এখন যে সুদের হার হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা-ও যত না অর্থনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। যুক্তরাষ্ট্রে দেড় মাস পরেই নির্বাচন। তাই যেসব আমেরিকানের উচ্চ সুদের হারের কারণে নাভিশ্বাস অবস্থা, তাদের কিছুটা হলেও কাছে টানার উদ্দেশ্যেই এই সুদের হার হ্রাস করা হয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। কানাডায়ও একই অবস্থা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তায় ধস নামায় সুদের হার হ্রাসের মাধ্যমে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর প্রয়াস মাত্র। না হলে আমেরিকান ডলারের বিপরীতে কানাডিয়ান ডলারের বিনিময়মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে পড়ে আছে অনেক দিন ধরে। এই অবস্থায় সুদের হার হ্রাসের পেছনে অর্থনৈতিক কারণ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। যে রাজনৈতিক কারণে সুদের হারে ওঠানামা এবং ডলার সংকট, তার সুরাহা এখনো হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা মিটছে না। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে। সব কিছু মিলিয়ে অবস্থা মোটেই সুখকর নয় যে খুব শিগগির এই ডলার সংকট কেটে যাবে। তবে যদি সব কিছু স্বাভাবিক থাকে এবং আগামী বছর যদি যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার হ্রাসের ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী বছরের শেষ দিক থেকে হয়তো এই ডলার সংকটের একটা সন্তোষজনক সমাধান হতে পারে মর্মে ধারণা করা যায়। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">nironjankumar_roy@yahoo.com</span></span></span></span></p> <p> </p>