নির্বাসন

  • মনজুর আহমদ
শেয়ার
নির্বাসন
অঙ্কন : তানভীর মালেক

আকাশ থেকেই কলম্বাস শহরটাকে একটু দেখে নেওয়ার চেষ্টা করল মিমি। বিমানের জানালা দিয়ে যত দূর দেখা যায়, চোখ মেলে দিল। কিন্তু না, শহরটার কিছুই নজরে এলো না। বিমানবন্দর কি খুব বেশি দূরে শহর থেকে? রিনির দেওয়া বর্ণনা থেকে তো তেমন মনে হয়নি।

ও তো জানিয়েছিল, শহরের গা ঘেঁষেই বিমানবন্দর। শহর নয়, বরং ওর চোখে পড়ল একটা গ্রামীণ পরিবেশ। মাঠ, প্রান্তর, শস্যক্ষেত। আর এইসব দেখতে দেখতেই ওর বিমানটা নেমে এলো মাটিতে।
রানওয়ে ধরে ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল টার্মিনাল ভবনের সামনে।

ওকে নিতে নিজেই বিমানবন্দরে হাজির ছিল রিনি। গাড়িটা পার্কিংয়ে রেখে অপেক্ষা করছিল প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে একেবারে দরজার মুখে। পথনির্দেশ দেওয়াই ছিল মিমিকে।

কনভেয়ার বেল্ট থেকে স্যুটকেসটা নিয়ে বহির্গমনের পথ ধরে এগিয়েছিল মিমি। ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে চাকা লাগানো স্যুটকেসটা টানতে টানতে বেরিয়ে আসতেই রিনির মুখোমুখি। আর দেখা হতেই উচ্ছ্বসিত রিনি ছুটে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল মিমিকে। মুখে কথার খই ছোটাতে লাগল।

ভালো আছিস মিমি? কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

আরে না, অসুবিধা কী হবে? তুই যেভাবে বলে দিয়েছিলি, ঠিক সেইমতো চলে এসেছি।

তুই কতক্ষণ এসেছিস?

এইতো একটু আগে। দে, স্যুটকেসটা আমার কাছে দে। রিনি স্যুটকেসটা টেনে নেওয়ার চেষ্টা করল মিমির হাত থেকে।

রাখ তো। চল এখন। কোন দিকে যাব বল। মিমি একঝটকায় রিনির হাত সরিয়ে দেয়।

ঠিক আছে, তাহলে ব্যাগটা দে। মিমির ঘাড় থেকে ব্যাগটা খুলে নেয় রিনি।

কদ্দিন পরে দেখা হলো রে তোর সঙ্গে?  প্রায় দশ বছর, না? রিনির কণ্ঠে তখনো উচ্ছ্বাস।

দশ বছর? মিমি একটু ভাবল। তা তো হবেই। ওই যে তুই দেশে গেলি। সে তো দশ বছরই হয়ে গেল। এরপর তো আর যাসনি? নাকি গেছিস?

না রে। গেলে তো দেখাই হতো। বাইরের দিকে এগোতে এগোতে রিনি জবাব দেয়। ঢাকায় যাব আর তোর সঙ্গে দেখা করব না এমন কথা ভাবতে পারিস?

নিশ্চয় না। যাবি আর দেখা হবে না, তা কি হয়? চলতে চলতেই বলে মিমি। তোর সেই শেষ যাওয়া এরই মধ্যে দশ বছর হয়ে গেছে।

হ্যাঁ রে। কিভাবে দিনগুলো চলে যায়। মনে হয় এইতো সেদিন।

পার্কিংয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দেয় রিনি। মিমির স্যুটকেসটা পেছনের ট্রাংকে তুলে নেয়। মিমি দাঁড়িয়ে একনজর গাড়িটা দেখে। তারপর সামনের দরজা খুলে উঠে বসে সিটবেল্টটা বেঁধে নেয়। রিনিও উঠে বসে ড্রাইভিং সিটে। স্টার্ট দিয়ে গাড়িটা পার্কিং থেকে বের করে আনার আগে নাইমকে ফোন দেয়। জানায় মিমির আসার কথা। বিমানবন্দর পেছনে ফেলে এগিয়ে চলে গাড়ি।

কত দিন ধরে চালাচ্ছিস? মিমি জানতে চায়।

অনেক দিন ধরেই তো। এখানে আসার কয়েক বছর পরেই শিখে নিয়েছি। তা কুড়ি-একুশ বছর তো হবেই।

ভালোই তো চালাস। হাত বেশ পাকিয়েছিস।

ওই চালাতে চালাতে হয়ে গেছে আর কি। কম দিন তো আর চালাচ্ছি না। প্রথম প্রথম অবশ্য খুব নার্ভাস লাগত।

আমি তো শেখার চেষ্টাই করলাম না। সুমন চালায়, তবে মাঝে মাঝে, শখে। ড্রাইভার যতক্ষণ আছে ততক্ষণ আর এ ঝামেলায় কেন যাওয়া!

ড্রাইভার? রিনি হাসে। আমেরিকায় তো এক মহার্ঘ বস্তু!

তোর সেই মুদ্রাদোষটা এখনো আছে দেখছি। মিমি ওর দিকে তাকায়।

কী? কোন মুদ্রাদোষ?

ওই যে কথায় কথায় মহার্ঘ বলা।

হাসল রিনি। এখন আর কই তেমন বলি! আর বলবই বা কোথায়? তোর সঙ্গে কথায় কথায় অনেক দিন পরে মুখে এসে গেল। আচ্ছা, সুমন মানে তোর বরটা আমেরিকার দিকে আর আসেটাসে না? সেই কবে একবার এসে ওয়াশিংটন থেকে ফোন করেছিল। এদিকে আসেনি বলে দেখা হয়নি।

না, আর আসেনি। কাজটাজ না পড়লে কি আর নিজের পয়সায় আসা যায়? আমারও কি আসা হতো? নেহাত একটা প্রোগ্রাম পেয়ে গেলাম, তাই আসা।

গাড়ি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে এসে পড়ল। কলম্বাস শহর। কিছু উঁচু উঁচু বাড়িঘর বাঁয়ে রেখে ২৭০ সরণি ধরে এগিয়ে যেতে যেতে রিনি বলল, এটাই কলম্বাস শহরের ডাউনটাউন। বলল, পরে একসময় তোকে নিয়ে আসব এখানে।

আচ্ছা শহরটার নাম কলম্বাস কেন রে? এটা কি সেই আমেরিকা আবিষ্কারক কলম্বাসের নামে? এখানে আসার পর থেকেই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছিল মিমির।

হবে হয়তো। নির্লিপ্ত জবাব রিনির। আমেরিকায় কত কিছুই তো কলম্বাসের নামে। ও নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। একটু থেমে রিনি আবার বলে, বাস্তবে এই লোকটা তো ছিল দখলদার। স্পেনের রানি ইসাবেলার টাকায় তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে এসেছিল। এখানকার মানুষদের মেরে-কেটে বহু রক্তপাত ঘটিয়ে তারা এইসব দেশ দখল করেছিল। ইউরোপীয়দের কাছে এটা ছিল কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার।

আমরাও ওদের শেখানো বুলিতে বলি কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার। মিমি বলে।

সেই নিষ্ঠুর দখলদার পরিচয়ে এখানে কেউ কলম্বাসকে চেনে না। কলম্বাস এদের কাছে হিরো। তার নামে কত কত প্রতিষ্ঠান, এই পুরো একটা শহর, কত জায়গায় রয়েছে তার বড় বড় স্ট্যাচু। তার নামে ঘটা করে দিবসও পালন করা হয়। এদিন কোথাও কোথাও সরকারি ছুটিও থাকে। রিনি আলোচনাটা চালিয়ে যায়। বলে, জানিস তো কলম্বাস কিন্তু কখনো এই আমেরিকায় পা রাখেনি। তার আগমন ছিল ভিন্ন দ্বীপ পুয়ের্তোরিকোতে।

অনেক আগে দেখেছিলাম ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ কলম্বাসকে নিয়ে দিবস পালনের বিরোধিতা করেছিলেন। বলেছিলেন, আমাদের ভূখণ্ড দখলকারী অত্যাচারী হানাদারদের স্মরণে দিবস পালন করা আমাদের জন্য অবমাননাকর।

হ্যাঁ, শাভেজের মন্তব্যটা এখানকার পত্রপত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিল। রিনি জানায়। ওতে এদের কিছু যায়-আসে না। তা ছাড়া শাভেজ তো ছিল আমেরিকার শত্রু।

আসলে আমার কী মনে হয় জানিস? মিমি বলে, কলম্বাস এদের কাছে হিরো হয়েই রইবে। এরা তো সব ইউরোপ থেকে আসা অভিবাসী। কলম্বাসই তো এদের আমেরিকা চিনিয়েছিল, এখানে আসার পথ দেখিয়েছিল।

ঠিকই বলেছিস। ডানে একটা এক্সিট নিতে নিতে রিনি বলল। কলম্বাস এদের কাছে হিরো।

ওরা ক্রমেই শহর ছাড়িয়ে আসছিল। আরেকটু এগোতেই এলাকাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগল মিমির কাছে। আসলে নিউইয়র্ক থেকে এসে কলম্বাস শহরকে ওর কেমন মফস্বল মফস্বল মনে হচ্ছিল। বলেই ফেলল, তোদের শহরটা তো খুব ফাঁকা ফাঁকা।

হ্যাঁ, আর তুই নিউইয়র্ক দেখে আসছিস তো, তোর কাছে বেশি ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। আমাদেরও প্রথম দিকে তা-ই মনে হতো। এখন আর তেমন লাগে না।

তা এত জায়গা থাকতে তোরা এখানে ঘাঁটি গাড়লি কেন?

নাইমের কাজটা যে এখানে।

গাড়ি শহর ছাড়িয়ে আরো নির্জনতায় ঢুকতে লাগল। বাড়িঘর, দোকানপাট—সব পেছনে রয়ে গেল। রাস্তার দুধারে শুধু খোলা মাঠ। একটা নদীও বুঝি দেখা যায় মাঠের শেষে ওপ্রান্ত দিয়ে।

মনে হচ্ছে যেন কোনো গ্রামে চলেছিস। মিমি বেশ কৌতূহলী।

গ্রামই বলতে পারিস। রিনি জবাব দেয়। তা-ও পুরো গ্রাম এখনো গড়ে উঠতে পারেনি। সেই যে বলে না, বন কেটে বসত, তেমনই আর কি। বন কেটে বসতের কাজ এখনো চলছে। এরই একটা বসতিতে আমরা বাড়ি কিনেছি। অনেক বড় এলাকা নিয়ে গড়ে উঠছে আমাদের বসতি। দেখলে তোর ভালো লাগবে। নির্জন, নির্মল নিসর্গ। দেখলে মাথায় তোর শুধু কবিতা ঘুরপাক খাবে।

রিনির কথায় হেসে উঠল মিমি। মাথায় কবিতা আর ঘোরে না রে এখন। সেই মাথা আর নেই। মাথাটা কেমন নিরেট হয়ে গেছে।

অথচ আমাদের সেই সময়টায়, এমন দিন গেছে, দিনে অন্তত একটা কবিতা না লিখলে অস্বস্তি লাগত। মনে হতো দিনটা বৃথা গেল। রিনি মনে হয় তাদের পুরনো দিনগুলোতে পা রাখার চেষ্টা করছিল। বলল, তুই এখনো কেন্দ্রে যাস মিমি? আগের মতো যোগাযোগ রাখিস?

পাগল হয়েছিস? বলতে পারিস পুরোপুরিই বিচ্ছিন্ন। সময় কোথায়? মাঝেসাঝে এক-দুটি অনুষ্ঠানের ডাক আসে। যাওয়ার চেষ্টা করি। তা-ও বছরে হয়তো এক-আধবার।

আমাদের সঙ্গে যারা ছিল, সবারই কি তোর মতো একই অবস্থা?

সঙ্গে যারা ছিল? মিমি ঝটতি একবার চাইল রিনির মুখের দিকে। সঙ্গে যারা ছিল বলতে ও কি বিশেষ কারো কথা জানতে চাইছে?

মিমির তাকানো দেখে রিনিও ওর দিকে চাইল। দ্রুত বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করল মিমির তাকানোর অর্থ। আর তখনই ও প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। বলল, এখানে কিন্তু আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যে কয়েক ঘর বাঙালি আছি, ছোট্ট করে হলেও একটু সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে থাকার চেষ্টা করি। সন্ধ্যায় তোকে নিয়ে যাব একখানে। একটা গানের আসরের ব্যবস্থা হচ্ছে তোর জন্য। এখানে বাঙালির সংখ্যা তো একেবারেই হাতে গোনা। তার মধ্যেও দু-একজন আছেন ভালো গান করেন। এক মহিলা আছেন, ভালো নাচেন। ঢাকায় নাচ করতেন, নাটক করতেন।

তাই নাকি? খুব ভালো লাগছে তো শুনে।

দেখলে আরো ভালো লাগবে। সন্ধ্যায় চল, দেখবি।

গাড়ি ডানে মোড় নিয়ে আরেকটা এক্সিটে ঢুকল। আশপাশে বাড়িঘর আর কিছুই নেই। ফাঁকা, রাস্তার দুধারে সবুজের সমারোহ, শুধুই সবুজ।

আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী? মিমি এবার কবিতা না আওড়ে পারল না। বলল, কত দূরে থাকিস তুই শহর থেকে?

তা একটু দূরেই হবে। ধর এক ঘণ্টার ড্রাইভ।

তোদের এই ঘণ্টার ড্রাইভটা আমি বুঝি না। বিষয়টা তো নির্ভর করে স্পিডের ওপর। স্পিড কি সব সময় একই থাকে। কম-বেশি হয় না?

হাইওয়েতে মোটামুটি একই থাকে। আরেকটা নতুন এক্সিট নিতে নিতে রিনি বলল। সার্ভিস রোডের মতো হাইওয়েতে তো কোনো ট্রাফিক সিগনাল নেই, লাল-সবুজে আটকে পড়তে হয় না, একটানা যাওয়া যায়। অবশ্য সামনের গাড়িগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে স্পিড কখনো কখনো কম-বেশি করতে হয়। তবে এই কম-বেশি মিলিয়ে একটা স্ট্যান্ডার্ড ঠিক হয়ে যায়। সেই স্ট্যান্ডার্ড অনুসারেই জিপিএস জানিয়ে দেয় দূরত্ব কত আর কত সময় লাগবে।

জিপিএস ছাড়া তো এখন সব ড্রাইভারই অচল।

হ্যাঁ, এই দ্যাখ না, হাতের মুঠোয় সেলফোনে জিপিএস। সামনে লাগিয়ে নিয়েছি। দুই যুগ ধরে এই একই পথে যাওয়া-আসা করছি, বিশ বছর ধরে এখানে ড্রাইভ করছি, এত দিন জিপিএস লাগেনি। অথচ এখন স্টিয়ারিংয়ে হাত দেওয়ার আগেই সামনে সেলফোনটা লাগিয়ে নেওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে।

তুই এখন কতয় যাচ্ছিস? মিমি গাড়ির গতিটা জানতে চায়।

খুব বেশি স্পিড দিই না। পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে থাকি। এখন পঞ্চান্নতে আছি।

তার মানে তোর বাড়ির দূরত্ব পঞ্চাশ মাইল?

ওই রকমই। জিপিএসের হিসাবে ঠিক আটচল্লিশ মাইল। তবে এই দূরত্ব তেমন কিছু না। দিনে বার দু-তিন তো আমাদের এই পথ পাড়ি দিতে হয়।

নাইমের কাজ কি কলম্বাস শহরে? মিমি কবজিটা উল্টে ঘড়িটা দেখতে দেখতে একটা হাই তোলে।

 হ্যাঁ, ওর অফিসের প্রায় সামনে দিয়েই তো এলাম। আহা, তোকে দেখাতে ভুলে গেলাম।

ওর কি আলাদা গাড়ি?

হ্যাঁ, এ ছাড়া তো উপায় নেই। এখানে তো সাবওয়ে কিংবা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট কিছু নেই। গাড়িই ভরসা। সবারই একটা করে গাড়ি লাগে। আমাদের স্বামী-স্ত্রী-ছেলে তিনজনের তিন গাড়ি।

তোর ছেলের কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি। ও কি এখানেই? কী করে। মিমি জানতে চায়।

ও, তোকে তো বলা হয়নি। রুমি এখানে থাকে না। ফাইন্যান্সে মাস্টার্স করে ও কাজ নিয়েছে মেরিল্যান্ডে এক কমার্শিয়াল ফার্মে। ওখানেই বাসা নিয়ে থাকে। ছুটিছাটায় আসে।

বিয়ের বয়স হয়নি?

হলেও উপায় নেই। ওদের বিয়ে ওরাই করবে। কবে করবে তা-ও বলে না। বলে এখনই বিয়ের কি?

বাংলাদেশেও তো প্রায় একই অবস্থা। যাদের বিয়ে তারাই করে। মা-বাবাদের কাজ শুধু মেনে নেওয়া। মিমি আরেকটা হাই তোলে।

মিমির হাই তোলা দেখে রিনি বলে, তোর নিশ্চয় খুব ক্লান্তি লাগছে। দাঁড়া একটা গান চালিয়ে দিই। গান ঠিক করাই ছিল, বোতামে আঙুল ছোঁয়াতেই বেজে উঠল রবীন্দ্রসংগীত, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’।

হেসে উঠল মিমি। কোন দেশের মাটি রে? তোর দেশ তো এখন আমেরিকা।

মিমির মুখের দিকে তাকাল রিনি। বিষণ্ন গলায় বলল, বলিস না রে, ওভাবে বলিস না। আমেরিকার সিটিজেন বটে, তবে আমেরিকার নাগরিক হতে পারিনি। বিচ্ছিন্নই রয়ে গেছি। এখানে শিকড় গাঁথতে পারিনি। এ দেশের সমাজ-সামাজিকতার ভেতরে ঢুকতে পারিনি। পারবও না মনে হয় কোনো দিন। মনপ্রাণ সবই তো পড়ে আছে বাংলাদেশেই।

এত বছরেও এ দেশের নাগরিক হয়ে উঠতে পারিসনি, এ মাটির প্রতি আকর্ষণ নেই, তাহলে আর এখানে পড়ে থাকার অর্থ কী? এভাবে জীবন কাটানোর মধ্যে কি কোনো আনন্দ আছে, কোনো প্রাণ আছে?  মিমির কণ্ঠে একটু ঝাঁজ।

চলে যাব রে। আলটিমেটলি এ দেশে আর থাকব না। এ দেশে থাকতে মন চায় না। দেশ বড় টানে।

হেসে উঠল মিমি। এ কথা নিউইয়র্কে অনেক বাঙালির মুখেই তো শুনলাম। কিন্তু কেউ কি ফিরে যেতে পেরেছে? কারো আর কখনো ফিরে যাওয়া হবে বলেও তো মনে হয় না। না পারার পেছনে যুক্তি সবার প্রায় এক। ছেলেমেয়ে। সবাই দোহাই দেয় ছেলেমেয়ের। তারা বাংলাদেশে যেতে চায় না। তারা এখানকার জীবনের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে বাংলাদেশে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মিমি ওর অভিজ্ঞতার কথা জানায়।

কথাটা  ঠিকই রে। রিনি সমর্থন জানায়। আমি নিজেই তো আমার ছেলেকে দিয়ে বুঝতে পারছি। এ দেশে জন্ম। বাংলা শিখিয়েছি, লিখতে-পড়তে তেমন না পারলেও বলতে পারে। কিন্তু আর সব দিক দিয়েই ও আমেরিকান। ও ওদের মতো একটা পরিবেশ এখানে তৈরি করে নিয়েছে। ওর পরিবেশ থেকে আমরা অনেক দূরে। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, ছেলে বড় হয়ে গেলে ওর আমেরিকায় ও থাকবে, আমরা দেশে ফিরে যাব।

আবার হাসল মিমি। একটু জোরেই হাসল। বলল, সে দিনটা কবে আসবে রে? তত দিনে কি আর তোর দেশ তোর মতো থাকবে? তোর মতো করে কি আর তোর দেশকে পাবি? তত দিনে তো দেশ তোর কাছে অচেনা-অপরিচিত হয়ে যাবে।

জানি না, জানি না রে মিমি। এসব ভাবতে গেলে বড় এলোমেলো হয়ে যাই। এসব ভাবনার কোনো তল পাই না। স্পষ্ট করে ভবিষ্যৎ কিছু দেখতে পাই না।

গাড়িটা ডানে আরেকটা এক্সিট নিয়ে একটুু এগোতেই একটা মুগ্ধতায় আবিষ্ট হলো মিমি। সামনে একটু দূরে সারি সারি ছবির মতো বাড়িঘর। মিমির মনে হলো, কোনো শিল্পী যত্ন করে যেন একটা ল্যান্ডস্কেপ এঁকে রেখেছে।      

চমৎকার তো এলাকাটা। মিমির মুখ দিয়ে একটা ভালো লাগার অভিব্যক্তি বেরিয়ে এলো।

ভালো লাগছে তোর? রিনির মুখে একটা তৃপ্তি। সবারই ভালো লাগে। ওই যে বললাম, বন কেটে বসত। খুব যত্ন করেই এরা এইসব বসতি গড়ে তুলছে। বললাম না, এখানে এলে তোর মাথায় কবিতা ঘুরপাক খাবে।

তোদের বাড়ি এখানেই?

হ্যাঁ। এইতো এসে গেছি।

আবাসিক এলাকায় ঢোকার মুখে একটা ছোট ফটকের গায়ে শৈল্পিক আঁচড়ে কাঠের ফলকে লেখা ‘হিলেগাস প্যারাডাইস’, বসতির নাম। ভেতরে ঢুকে ডানের রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে গোটা ছয়েক বাড়ি পেরিয়ে একটা দেতলার সামনে এসে থামল রিনি। মিমি দেখল, বসতির সব বাড়িই দোতলা এবং সবগুলো বাড়ির স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী একই ধরনের। এ কারণেই এলাকাটির প্রতিবেশ কেমন ছন্দোময় হয়ে উঠেছে।

নাম। সিটবেল্টটা খুলতে খুলতে বলল রিনি।

মিমি দরজা খুলে গাড়ির বাইরে পা রাখল। গাড়ির পেছনে রাখা ওর স্যুটকেসটা বের করল রিনি। তারপর টানতে টানতে এগিয়ে গেল বাসার দিকে।

লিভিংরুমে ঢুকেই ভালো লাগল মিমির। বেশ বড়সড় ঘর। সুন্দর করে সাজানো। রিনি তার সমস্ত রুচির পরিচয় ঢেলে দিয়ে সাজিয়েছে ঘরটাকে। শুধু লিভিংরুম নয়, মিমি ভেতরে ঢুকে যেদিকে তাকাল সেদিকেই রিনির হাতের স্পর্শ দেখতে পেল।

দোতলায় মিমির যে ঘরে থাকার ব্যবস্থা, সেখান থেকে জানালা দিয়ে পেছনে শুধু দিগন্তজোড়া সবুজের সমারোহ চোখে পড়ে। সবুজ, কী দারুণ সবুজ! কী অফুরন্ত সবুজ! মিমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল জানালায়।

নিচে তাড়া শোনা গেল রিনির। দেরি করিস না মিমি। চা করছি।

জানালা ছেড়ে নিচে নেমে এলো মিমি। চা খেতে খেতে ঘড়ির দিকে তাকাল, পাঁচটা বেজে গেছে।

ঘড়ি দেখছিস কেন? এখানে গরমকালে সূর্য ডোবে নয়টারও পরে। ফলে বেলা এখনো অনেক রয়েছে।

সে জন্য না। ঘড়ি দেখছি তোর বরের জন্য। নাইম কখন আসে?

এইতো পাঁচটা পর্যন্ত অফিস। বাসায় আসতে আসতে ছয়টা বেজে যায়।

লিভিংরুমে দেয়ালজুড়ে একটা বড় টেলিভিশন। এক কোনায় একটা নকল ফায়ার প্লেস। রিনি বলল, ফায়ার  প্লেসটা ঘরের অলংকার। কখনোই ওটা জ্বালানো হয় না। টেলিভিশনটা বন্ধ ছিল। রিনি জানাল, ওদের একটা কেবল কম্পানির বক্স আছে, সেখানে ইংরেজি ছাড়াও বাংলাদেশ-ভারতের প্রায় সব টিভি চ্যানেল দেখা যায়। আর দেখা যায় বাংলা-হিন্দি ছবি। মিমি চাইলে এগুলো দেখতে পারে।

তখনই এসব দেখার কোনো ইচ্ছা ছিল না মিমির। চা আর রিনির তৈরি নাশতা খাওয়া শেষ করতেই বাইরে গাড়ি থামার শব্দ পাওয়া গেল।

নাইম এলো। রিনি জানাল। তারপর দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

আসসালামু আলাইকুম। পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো। ঘরে ঢুকেই কথাগুলো বলল নাইম। হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে টাইয়ের নটটা ঢিলা করতে করতে একটা চেয়ার টেনে বসল।

না না, কোনো অসুবিধা হয়নি। দিব্যি চলে এসেছি। 

এখনই চা দেব নাকি কাপড়টা ছেড়ে আসবে? নাইমের কাছে জানতে চাইল রিনি।

দাও, চা-টা খেয়েই ওপরে যাই।

মিমি চেয়ে দেখছিল নাইমকে। একটু গম্ভীর স্বভাবের মানুষটা। খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ ওর সঙ্গে মিমির আগে হয়নি। রিনির বিয়ের আগে একবার এক রেস্টুরেন্টে ওদের সঙ্গে একবার চা খেয়েছিল। রিনি ডেকেছিল ওর হবু বরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য। তারপর দেখা ওদের বিয়েতে। নাইম তখনকার চেয়ে একটু মুটিয়েছে মনে হলো।

আর কোথায় কোথায় গেলেন আমেরিকায়? নাইম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্নটা রাখল মিমির উদ্দেশে।

তেমন কোথাও না। মূল প্রোগ্রাম ছিল ওয়াশিংটনে। কাজ শেষ করে নিউইয়র্কে ননদের বাসায়। ওদের গাড়িতেই বোস্টনে আমার এক খালাতো বোনের কাছে। আর দুদিনের জন্য ঘুরে এসেছি নায়াগ্রা।

অল্পের মধ্যে তো ভালোই ঘুরেছেন। আর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা আছে?

না, আমার নিজের আর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তা ছাড়া এবার আর সময় হবে না। আমার ফেরার টিকিট কনফার্ম করা এ মাসের সাতাশে। এর মধ্যে সব বেড়ানো শেষ করে নিউইয়র্ক ফিরতে হবে।

তাহলে আপনাকে তো আর দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া যাবে না। ঠিক আছে, এই কদিনে যতটা পারা যায় আশপাশেই ঘোরা যাবে।

 

পরদিন বেশ দেরিতেই ঘুম ভাঙল মিমির। গানের আসর থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়েছিল। রিনি যেমন বলেছিল, তেমন একটা কাছে ছিল না বাসাটা। বেশ অনেকটা পথ ড্রাইভ করে যেতে হয়েছিল রিনির ঘনিষ্ঠ সুমনার বাসায়। সুমনা গানের শিল্পী, ঢাকায় ছায়ানটে ছিল। বিয়ে হয়ে স্বামীর সঙ্গে চলে এসেছে আমেরিকায়। স্বামীরও অল্পস্বল্প গানের চর্চা আছে। সুমনার সঙ্গে দুটি গানে গলা মেলালেন। সুমনা কয়েকটা রবীন্দ্রসংগীতও শোনাল। মিমির ভালো লাগল ওদের স্বামী-স্ত্রীর দ্বৈত কণ্ঠে নজরুলের ‘তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন’ গানটি। বাসায় হারমোনিয়াম আছে, তবলা অছে। মিমি একটা সেতারও দেখল ঘরের কোনায় যত্ন করে দাঁড় করিয়ে রাখা। বোঝাই যায়, এটা একজন শিল্পীর বাসা। সুমনা সুন্দর করে সেজেছিল, খোঁপায় সাদা ফুলের মালা জড়িয়েছিল। সুমনাকে খুব সুন্দর লেগেছিল। তার বাসায় এসেছিলেন আরো জনা পাঁচেক অতিথি। তাঁদেরও দুজন গান গেয়ে শোনালেন। মিমির জন্যই এ আয়োজন। সব শেষে মিমিকে তার অনুভূতি জানাতে অনুরোধ করা হয়েছিল। মিমি তার মুগ্ধতার কথা জানিয়েছিল। বলেছিল, সুদূর আমেরিকার এক প্রত্যন্ত প্রান্তে বাংলা সংস্কৃতির এমন উজ্জ্বল অবস্থানের কথা আমার ধারণায়ও ছিল না। রাতে ওখানেই খাওয়াদাওয়া হয়েছিল। রিনি বাড়ি থেকে কিছু রান্না করে নিয়ে গিয়েছিল। সেগুলোও ওখানে পরিবেশন করা হলো।

রাত করে ফেরা, তা ছাড়া সারা দিনের ধকলে শরীরটাও ক্লান্ত ছিল। সব মিলিয়ে ঘুমটাও বেশ জম্পেশ হয়েছে। মিমি যখন বিছানা ছাড়ল, বাইরে তখন হা হা রোদ। মিমি প্রথমে গিয়ে দাঁড়াল জানালায়। বাইরে চোখ মেলে দিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর গিয়ে ঢুকল বাথরুমে।

ঘর থেকে বেরিয়ে মিমির কাছে পুরো বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগল। পাশে দুটি ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল কেউ নেই। মিমি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে। লিভিংরুম, হলওয়েতে কেউ নেই। ডাইনিং টেবিলে খাবার ঢাকা দেওয়া। পাশে একটা কাগজে লেখা চিঠি। ওকেই লিখেছে রিনি। লিখেছে, তুই ঘুমাচ্ছিস তাই ডাকলাম না। আমি একটু দোকানে যাচ্ছি। তোর নাশতা ঢাকা দিয়ে রেখে গেলাম। আমি আসার আগেই যদি ঘুম থেকে উঠিস তাহলে নিজে নিজে খেয়ে নিস। বাজারটা করেই আমি এসে পড়ব।

চেয়ারটা টেনে খাবার টেবিলে বসল মিমি। অনেক কিছু দিয়েছে রিনি। ডিম ভাজি দিয়ে একটা পরোটা খেয়ে নিল মিমি। একটু পুডিং কেটে মুখে পুরল। মিষ্টিও ছিল। একেবারে বাংলাদেশি সন্দেশ আর চমচম। এগুলো এরা ঘরেই বানায়। মিষ্টির দিকে আর হাত বাড়াল না মিমি। কাপে পানি দিয়ে চা চাপাল মাইক্রোওভেনে। তারপর চা নিয়ে জানালার ধারে সোফায় বসল।

পুরো বাড়িতে ও একা। বাড়িটা নির্জন, নিস্তব্ধ। শুধু এই বাড়িই নয়, এই পুরো এলাকাটাই নির্জন। এত নির্জন, এত নিঃশব্দ! কোথাও কারো সাড়াশব্দ নেই, নেই কোনো গাড়ির আওয়াজ। মিমির মনে হলো এখানকার সব বাড়ির অবস্থাই বোধ হয় একই রকম। সবাই বোধ হয় সকালে কাজে বেরিয়ে যায়। ছেলেমেয়েরাও নিশ্চয় সব স্কুলে। নির্জন, কী ভয়াবহ নির্জন! মিমির বেশ অস্বস্তি লাগতে লাগল। রিনি কখন আসবে? কত দূরে গেছে ও? এখানে ও যা দেখল তাতে তো মনে হলো কাছাকাছি কিছু নেই। দোকানপাট সবই দূরে দূরে।

রিনির কথায়ই মিমির মনে হলো, রিনি তো এখানে একা থাকে। প্রথম দিকে কোথায় কী একটা কাজ নিয়েছিল, কিন্তু টানা আট ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার কাজ ও আর করে উঠতে পারেনি। ঢাকা বিশ্বদ্যািলয় থেকে বাংলাায় এমএ রিনির উপযুক্ত কোনো কাজ এখানে ছিল না। এখানে যেকোনো কাজেই এখানকার ডিগ্রি বা সনদ লাগবে। তার জন্য ভর্তি হয়ে নিয়মিত ক্লাস করতে হবে, পরীক্ষা দিতে হবে। মিমি শুনেছিল, এসব রিনির পোষায়নি। সে আর কোনো কাজে না ঢুকে সংসার নিয়েই থেকেছে। ছেলেটা হওয়ার পর ছেলের পেছনেই সময় দিতে হয়েছে। ছেলে এখন নেই। এখন রিনি একা। নিতান্তই একা। কেমন করে থাকে ও? দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। ও কেমন করে থাকে এই ভয়ংকর নির্জনতায়?

মিমি নিজের কথা ভাবল। এই অবস্থায় আমি তো দুদিনেই পাগল হয়ে যেতাম। রিনির এই জীবন মিমিকে একটু বিষণ্ন করে তুলল।

রিনির ফেরার নাম নেই। মিমি উঠে রাস্তার ধারের জানালায় গিয়ে দাঁড়াল। রাস্তা দিয়ে যত দূর চোখ যায় তাকিয়ে রইল। সব ফাঁকা। কোনো গাড়ি-ঘোড়ার চিহ্নও নেই। মিমি আবার এসে বসল সোফায়। টেলিভিশনটা চালিয়ে দিয়ে রিমোট টিপে টিপে চ্যানেল ঘোরাতে লাগল। কোনো চ্যানেলেই মন বসাতে পারল না।

অবশেষে বাইরে গাড়ি থামার শব্দ কানে এলো। মিমি ছুটে গেল জানালায়। রিনি। গাড়ি থেকে নেমে জানালায় মিমিকে দেখে একটু হাসল। তারপর গাড়ির পেছনের ডালা খুলে বাজার নামাতে লাগল। মিমি বেরিয়ে এলো বাইরে।

কত দূরে গিয়েছিলি? এত সময় লাগল?

হ্যাঁ, একটু সময় লেগে গেল। তোর জন্য পছন্দসই বাজার করতে গিয়ে একটু ঘুরতে হলো। বাজারগুলো নামাতে নামাতে রিনি বলল।

আমার জন্য কেন এত কষ্ট করতে গেলি? আমার খাওয়াদাওয়া নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। বাজার নামাতে রিনির সঙ্গে মিমিও হাত লাগাল।

ভেবেছিলাম তোকে নিয়ে যাব। তা তুই যা ঘুম দিয়েছিলি! ডেকে তুলতে আর ইচ্ছা হলো না। নাশতা করেছিস?

হ্যাঁ, করেছি।

দুজনে মিলে বাজারের পোঁটলাগুলো নিয়ে এলো ভেতরে। রিনি সেগুলো খুলে খুলে দেখাতে লাগল মিমিকে। গুছিয়ে ফ্রিজে তুলতে লাগল। মিমি বলল, তুই একা থাকিস কেমন করে এই বাড়িতে? এত নির্জন, এত নিস্তব্ধ। এলাকাটা একেবারে জনমানবশূন্য।

কেন রে? তোর বুঝি খুব খারাপ লেগেছে একা থাকতে? রিনি একটু হাসে। তোর অভ্যাস নেই তো তাই। আমি তো এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তা ছাড়া উপায়ই বা কী আছে বল। নাইম সেই সকালে বেরিয়ে যায়, বিকেলে আসে। ছেলে দূরে। আমাকে তো একাই থাকতে হয়।

আর কোনো কথা বলেনি মিমি। হাতে হাতে বাজার গোছাতে থাকে রিনির সঙ্গে। শুধু বাজার গোছানোই না, রিনির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সাহায্য করতে লাগল ওর রান্নায়। ওরা মেতে গেল নানা কথায়। কথা মানে সেই পুরনো দিনের স্মৃতি। ওদের সেই পুরনো দিনে ফিরে যাওয়া।

আমাদের কেন্দ্রের সাথিরা কে কোথায় রে? রিনি হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে।

কার কথা জানতে চাস বল? মিমি সরাসরি চাইল রিনির দিকে।

না, তেমন বিশেষ কারো কথা না। সবার কথাই মনে পড়ে, সবার কথাই জানতে ইচ্ছা করে।

আমাদের সময়কার কেউ বোধ হয় আর কেন্দ্রের সঙ্গে নেই। আসলে ওখানে তো সব সময় নতুনের ভিড়। আমরা ওখানে পুরনো হয়ে গেছি। নতুনরাই কেন্দ্রকে জমজমাট করে রেখেছে।

রিপা শুনেছিলাম কেন্দ্রে কাজ নিয়েছে। ও কেমন আছে? রিনি জানতে চায়।

না, ও কেন্দ্রের কাজ ছেড়ে একটা কলেজে জয়েন করেছে।

রিনি আর কিছু বলল না। অথবা মিমির মনে হলো, কিছু একটা বলতে গিয়েও রিনি চুপ করে গেল।

মিমি ওর দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে রইল। তারপর বলেই ফেলল, মামুনের কথা জানতে চাইলি না?

চমকে ওর দিকে চাইল রিনি। তারপর ধীরে ধীরৈ বলল, ওর খবর রাখিস? কেমন আছে ও?

ভালো আছে, পত্রিকায় কাজ করে, সাংবাদিকতা। লেখালেখিও করে। বেশ কিছুদিন আগে বিয়ে করেছে।

বিয়ের খবর পেয়েছি। কাকে করল চিনতে পারলাম না। তোরা গিয়েছিলি বিয়েতে?

গিয়েছিলাম। তবে ওকে আগের মতো আর হাসিখুশি দেখিনি। আসলে ও খুব আঘাত পেয়েছে তোর ব্যবহারে।

একটু চুপ করে থাকে রিনি। তারপর অনেকটা আপন মনেই বলে, আমার কিছু করার ছিল না রে। ও লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে যেভাবে মদের নেশায় মেতে উঠল, তাতে ওকে কিছুতেই আমার বাড়িতে অ্যাকসেপ্ট করাতে পারতাম না। ওকে অনেক বুঝিয়েছি। ও আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে বলেছিল। এটা তো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

মিমি আর কিছু বলল না।

 

প্রতিদিন বিকেলেই রিনি-নাইমের সঙ্গে এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করে মিমির সময়টা কেটে গেল। অল্প সময়েই প্রায় সব জায়গা দেখে নিল। দেখে নিল কলম্বাস শহরটা। রিনি ওকে নিয়ে বের হয়েছে কেনাকাটায়। একদিন সবাই মিলে খেয়ে এসেছে বাইরে থেকে।

মিমি এসেছিল পাঁচ দিনের জন্য। বেড়ানোর সব আনন্দের মধ্যেও রিনির সঙ্গে কাটানো অলস দুপুরগুলো ওকে এক ভিন্ন অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে ফেলল। সেই রিনি, প্রাণবন্ত উচ্ছ্বল রিনি, হাসি-কৌতুকে আসর মাতিয়ে রাখা রিনি, এখন ওর একি জীবন! সেই উচ্ছলতা ওর মাঝে আর খুঁজে পেল না মিমি। সেই খিলখিল হাসি ওর আর নেই। এই পরিবেশ ওকে ভিন্ন রিনি করে তুলেছে। মিমিকে পেয়ে এই কদিনে ওর যে আনন্দ, তা ওকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। ওর মুখে কথার খই ফুটছে।

কিন্তু এখন তো ওর বিদায় নেওয়ার সময় হয়ে গেছে। ও না থাকলে রিনি আবার ফিরে যাবে ওর অভ্যস্ত জীবনে। সেই নির্জনতা, সেই নিস্তব্ধতা, সেই নিঃসঙ্গতা। এটা কি কোনো জীবন? রিনির কথা ভেবে ও একটা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হলো।

কেটে গেল সময়টা। এবার মিমির ফেরার পালা। আবার নিউইয়র্ক। সেখান থেকে উড়াল দেওয়া দেশের পথে।

সেদিনের মতো রিনিই মিমিকে নিয়ে চলল বিমানবন্দরে। সকালে কাজে বেরোনোর আগে নাইম বিদায় জানিয়ে গেছে। আবার আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। মিমিও তাকে দেশ থেকে ঘুরে আসতে অনুরোধ জানিয়েছে। নাইম বলেছে, যাবে, যখন সুযোগ হবে।

গাড়িতে ওঠার পর থেকেই রিনি একটু গম্ভীর। কয়েকবারই বলল, তুই ছিলি, কদিন ভালো কাটল। একঘেয়ে জীবনে কয়েকটা ব্যতিক্রমী দিন।

মিমি বুঝল ওর মনের অবস্থা। খারাপ লাগতে লাগল রিনির কথা ভেবে। এমন অসম্ভব একাকিত্ব নিয়ে ও আছে কেমন করে? মিমি কয়েকবারই কথাটা বলেছে রিনিকে। রিনি হেসেছে। ওর একই জবাব, অভ্যাস হয়ে গেছে। বলেছে, আমার এখন আর কোনো অসুবিধা হয় না। অথচ এখন রিনির মুখে ওর একঘেয়ে জীবনের কথা।

গাড়ি এসে দাঁড়াল বিমানবন্দরের পার্কিংয়ে। দরজা খুলে নামল রিনি। নেমে এলো মিমি। পেছন থেকে স্যুটকেসটা নামিয়ে নিল। ব্যাগটা রিনির ঘাড়ে। ওরা এগিয়ে গেল টার্মিনাল ভবনের দিকে। চেকইনের আনুষ্ঠানিকতা পর্যন্ত রিনি সঙ্গে রইল। ভেতরে যতটা যাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে গেল। তারপর আর যাওয়ার অনুমতি নেই। এবার বিদায় নেওয়ার পালা। দাঁড়াল মিমি। রিনির কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, আসি রে রিনি। ভালো থাকিস।

রিনি হঠাৎ জড়িয়ে ধরল মিমিকে। বুকের সঙ্গে ওকে আঁকড়ে ধরে রইল। মিমি দেখল, রিনি কাঁদছে। মিমির বুকের মধ্যে রিনির শরীর কান্নার গমকে ফুলে ফুলে উঠছে। বুঝতে পারল, রিনির চোখের পানি ওকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। মিমি দুই হাতে রিনির মুখটা তুলে ধরল।

তুই কাঁদছিস রিনি? আমারও খুব খারাপ লাগছে তোকে ছেড়ে যেতে। কত দিন পরে দেখা হলো। আবার কত দিনে দেখা হবে কে জানে!

মিমি। আস্তে করে ডাকল রিনি। আর কি দেখা হবে? আর কি আমরা আবারও এমন আনন্দ করতে পারব? তুই তো দেখেই গেলি আমার জীবন। আমার তো আনন্দ করার মতো কিছু নেই। আমার চারদিকে তোদের মতো কেউ নেই। এখানে আমার তো কোনো শিকড় নেই। এই শিকড় না থাকা যে কত কষ্টের তোকে বোঝাতে পারব না। এই কষ্ট শুধু প্রলেপ দিয়ে চলি। তোদের বলি, ভালো আছি। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে বলি, এ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তোদের সঙ্গে মিলে যেভাবে জীবনটা গড়তে চেয়েছিলাম, সেই জীবনটা হারিয়ে ফেলেছি রে।

মিমি একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল রিনির দিকে। রিনি ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল—যা, তোর সময় হয়ে যাচ্ছে। মিমি ওর শাড়ির আঁচল দিয়ে রিনির চোখ মুছিয়ে দিল। বলল, ভালো না লাগলে এ জায়গা ছেড়ে দে। নিউইয়র্কে তো বাংলাদেশিরা চমৎকার পরিবেশ তৈরি করে নিয়েছে।

তা আর হওয়ার নয় রে মিমি। নিউইয়র্কে গেলেই কি আর আমি আমার শিকড় খুঁজে পাব? শিকড় তো আমার এখনো দেশের মাটিতেই পোঁতা আছে। সেখান থেকে তো উপড়ে আসতে পারিনি। একটু থেমে রিনি আবার বলল, এই ভাগ্যটাই তো মেনে নিয়েছি মিমি। এই নির্বাসনেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে।

মিমি ওকে আরেকবার বুকে টেনে নিল। বলল, একটু ঘন ঘন যোগাযোগ করিস। মনটা ভালো লাগবে। ফেসবুক তো আছেই।

সে তো করাই যায়। কিন্তু ওতে কি মন ভরে মিমি?

সিকিউরিটি চেকিং পর্যন্ত এগিয়ে পেছন ফিরে চাইল মিমি। রিনি তখনো দাঁড়িয়ে। সেখান থেকে হাত নাড়ল। মিমি হাত নেড়ে রিনির জবাব দিল। ওয়েটিংয়ে ঢুকে গেলে রিনিকে আর দেখা যাবে না। ঢোকার আগে মিমি আবার পেছনে চাইল। দেখল, রিনি দাঁড়িয়ে। আরেকবার হাত নেড়ে রিনি ওর দুচোখ চেপে ধরল। রিনি কাঁদছে।

মিমি জানে, রিনি এখন ওর গাড়িতে গিয়ে উঠবে। তারপর পঞ্চাশ থেকে ষাট মাইল বেগে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর নিজের জগতে, ওর শিকড়বিহীন নির্বাসিত জীবনে।

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শীত বিকেল

    শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
শেয়ার
শীত বিকেল
অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’

কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।

যে শহরে তার নিজেরই ঠিকানার ঠিক নেই, সেখানে আবার কাক!

মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।

‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’

প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।

‘দেখান তো ভাই।’

র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।

লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।

দুজনই মোবাইল নিয়ে রাতভর পড়ে থাকে। ফেসবুক, টিকটক—আরো কত কী দেখে! ফাঁক পেলেই এসব নিয়ে কথা বলে দুজন। ফেসবুক অবশ্য মাশুকও দেখে। রাতে ঘুম না এলে ফেসবুকের ভিডিওগুলো দেখে।

অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’

নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।

মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!

লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’

লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!

তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?

পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।

‘কী করছ, বাবা?’

‘এইতো—দোকানে বসছি।’

‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’

‘কেন?’

‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’

‘খুব দরকার?’

‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’

‘দেখি।’

‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’

লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।

মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’

বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।

এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।

দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।

মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।

এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।

‘তুমি!’

যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।

মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’

‘আসো।’

দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’

নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’

‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’

‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’

‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’

‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’

নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।

মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’

নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’

মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’

নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’

‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’

নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’

এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’

নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।

নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।

নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’

নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’

এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।

নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’

হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা  মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’

মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’

‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’

‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’

নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।

বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’

‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’

‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’

মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!

নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’

মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’

নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’

নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।

 

 

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

একটি পুরনো গল্প

    ইউসুফ শরীফ
শেয়ার
একটি পুরনো গল্প
অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

বেশ ক’দিন ধরে এই রিনঝিন চাপা সুবাস ছড়ানো হাসির ঢেউ ঠিক এখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আছড়ে পড়ে।

সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।

হাসি মানবীয় সম্পর্কের এক আদি নির্ভরযোগ্য সেতু। এটা আদৌ যদি তত্ত্বকথা হয়, তাহলে ভাবতে পেরে ইলিয়াস মুচকি হাসল—অতৃপ্ত মানুষের তৃপ্তির হাসি।

স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।

তবে আমি কথা দিচ্ছি, দু-একটা ভালো টিউশনি আপনাকে জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!

হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।

তার হাত যদি তেমন হতো তাহলে হয়তো এই হাসির খনিকটা উপড়ে নিয়ে আসতে পারত! তবু হাসিটাকে সে ঠিক চিনে ফেলেছে—এই হাসি অদৃশ্য হাতের আঙুল হয়ে হৃদয়ের গোপন দরজায় টুকটুক করে কড়া নাড়ে।

গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!

মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।

ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।

রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!

রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।

ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?

রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।

ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?

রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!

ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!

রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!

ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।

রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।

ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—

রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।

লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।

খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।

ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।

তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?

রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।

ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?

রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—

ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?

রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!

ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?

রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!

ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।

অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?

ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।

রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!

রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?

রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?

ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!

রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?

ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...

রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!

ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!

রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।

ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না! 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

ঈদে অভিজাত সাজ

    ঈদে গরম থাকবে, তাই স্টাইলের সঙ্গে সাজে আরামের দিকটাও খেয়াল রাখুন। ঈদের সাজ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন রেড বিউটি স্যালনের রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। লিখেছেন মোনালিসা মেহরিন
শেয়ার
ঈদে অভিজাত সাজ

ঈদের দিনের অনুভূতিই অন্য রকম। এদিন সাজে সুন্দর ও সাবলীল থাকা চাই। ঈদ সকালটা শুরু হয় কাজের ব্যস্ততা দিয়ে। দুপুরে অতিথি আপ্যায়নে সময় কাটে।

বিকেল আর রাতে নিজের জন্য একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি, আড্ডা কিংবা দাওয়াতে যাওয়া হয়। এ জন্য তিন বেলায় চাই তিন রকম সাজ।

সকালে হালকা সাজ

সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।

সকালে যেহেতু কাজের ব্যস্ততা থাকে তাই সাজ-পোশাক আরামদায়ক হওয়া চাই। শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী শোভন সাহা বললেন, ‘ঈদের দিন ব্যস্ততায় তিনবার লুক বদলানো বেশ ঝামেলার কাজ। সকালের সাজ দিয়েই দুপুর ও রাতের সাজটা সেরে ফেলতে পারেন। সকালে হালকা ফাউন্ডেশন দিন।
ঠোঁটে এ সময় ন্যুড রঙের লিপস্টিক দিতে পারেন। চোখ সাজাতে হালকা আইশ্যাডো দিলে সুন্দর লাগবে।’

সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।

কম বয়সীরা কপালের দুই পাশে একটু স্টাইলিশ বেণি করে নিলে সুন্দর দেখাবে।

 

ঈদে অভিজাত সাজ

দুপুরে চাই আরাম

গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’

 

ঈদে অভিজাত সাজ

রাতে জমকালো

রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’

যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
ফ্যাশন

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

    ঈদের দিন পাঞ্জাবি না পরলে ছেলেদের ফ্যাশন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। প্রতিবছর নতুন নকশা, থিম ও প্যাটার্নের পাঞ্জাবি নিয়ে আসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে এবারকার ঈদের পাঞ্জাবির খোঁজ জানাচ্ছেন আতিফ আতাউর
শেয়ার
ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।

লাল, নীল, সাদা, কালো, খয়েরিসহ বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে পাঞ্জাবিতে। গলা ও হাতায় রয়েছে আলাদা নকশা ও কাজ। ঐতিহ্যবাহী কাঁথা স্টিচ, মোগল শৈলী, উইভিং মোটিফের অনুপ্রেরণা ছাড়াও গুজরাটি, ইক্কত, কলকা আর্ট, জামদানি, ফ্লোরাল, ট্র্যাডিশনাল, টার্কিশ আর্ট ও ইসলামিক মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে আরামদায়ক কাপড়ের ব্যবহার।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘পাঞ্জাবির গলা, বুক ও হাতার পাশাপাশি কাঁধেও নতুন নকশা করা হয়েছে। কটন, ডিজাইন কটন, হ্যান্ডলুম কটন, লিনেন, জর্জেট, সিল্ক, হাফসিল্ক, টিস্যু ও সাটিনের মতো আরামদায়ক কাপড় বেছে নেওয়া হয়েছে। যেন গরমে স্বস্তি পাওয়া যায়। হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ও ব্লক প্রিন্ট, কারচুপি ও টাইডাইয়ের সাহায্যে পাঞ্জাবির নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।

একই সঙ্গে মোটিফেও থাকছে ইসলামিক, ফ্লোরাল, ফুল, লতাপাতা ও মোগল কারুকার্য।’

 

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

প্রিন্টে পরিপাটি

প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।

 

কাটছাঁটে নতুন কী

গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’

একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।

 

কখন কেমন পাঞ্জাবি

ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।

 

কোথায় পাবেন, কেমন দাম

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ