যুক্তরাষ্ট্রের একজন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম পোসেন। তিনি চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপকে তুলনা করেছেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের সঙ্গে। তাঁর মতে, এই যুদ্ধে কেউ জিতবে না। উভয়ই কাদায় আটকে যাবে, যেখান থেকে আর বের হওয়ার পথ খুঁজে পাবে না।
পেটারসন ইনস্টিটিউট ইন ওয়াশিংটনের প্রধান অ্যাডাম পোসেন গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আরো বলেন, ‘ট্রাম্পের এই কৌশল প্রেসিডেন্ট জনসন ও নিক্সনের ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় এই যুদ্ধে তারা জিতবে না, যদি আলোচনার পথে না যায়।’
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আলোচনায় না গেলেও অন্য দেশগুলোকে আলোচনায় এগিয়ে নিচ্ছে চীন। বিশ্বজুড়ে শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প যখন শত্রু-মিত্র সব দেশকেই দূরে ঠেলে দিচ্ছেন, তখন সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে চীন।
ট্রাম্পের পাহাড়সম শুল্কের বিরুদ্ধে চীন একদিকে পাল্টা জবাব দিচ্ছে, অন্যদিকে মার্কিন মিত্র ইউরোপ ও এশিয়ার দেশগুলোকে কাছে টানার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
গত বুধবার অন্যান্য দেশের বাড়তি শুল্ক স্থগিত রাখলেও চীনের ওপর শুল্ক অব্যাহত রাখেন ট্রাম্প। চীনের প্রতিশোধমূলক শুল্কের জবাবে সেদিন শুল্কের হার আরো বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করেন। গত বৃহস্পতিবার সেই শুল্ক আরো বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশ করেন তিনি।
এর জবাবে শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক ৮৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করেছে চীন।
এর মধ্যেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং চেষ্টা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের এই অযৌক্তিক চেষ্টার বিরুদ্ধে অন্য দেশগুলোকে কাছে টানার। চিনপিং বলেছেন, ‘শুল্কযুদ্ধে কেউ জেতে না। বিশ্বের বিরুদ্ধে গেলে তা নিজেকেই একঘরে করে রাখার শামিল।’ যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘পীড়নের’ মোকাবেলা করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ভারতের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়াই করার বার্তা দিয়েছেন তিনি।
এরই মধ্যে মার্কিন শুল্কের জবাব দিতে ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে চীন। গত শুক্রবার বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট চিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কের মুখে নিজেদের বাণিজ্য সামাল দিতে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সফরের পরিকল্পনা রয়েছে চীনের প্রেসিডেন্টের। স্পেনের প্রধানমন্ত্রীকে চিনপিং বলেন, ‘এই বাণিজ্যযুদ্ধে কেউ জিতবে না। বিশ্বায়নপ্রক্রিয়া রক্ষা করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নিপীড়ন রুখে দিতে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে হাত মেলাতে হবে। শুধু নিজ স্বার্থ নয়, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এটা করতে হবে।’
ট্রাম্পের শুল্কের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আঞ্চলিক বাণিজ্য গড়ে তুলতে গত মাসে বৈঠক করেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও জাপানের মন্ত্রীরা। আওয়াজ উঠছে মুক্তবাণিজ্যেরও। গত বৃহস্পতিবার নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে, তারা উভয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলোচনা করছে সম্ভাব্য একটি মুক্তবাণিজ্য গড়ে তোলার ব্যাপারে। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টোফার লুক্সন বলেন, তিনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহযোগিতার ব্যাপারে সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এর পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাহী প্রধানের সঙ্গেও কথা বলেছেন।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি উয়ং বলেন, ট্রাম্পের শুল্কের বিরুদ্ধে একটি যৌথ জবাব দেওয়ার জন্য তাঁরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি সম্প্রচারমাধ্যম এবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বেশ কিছু দেশ মুক্ত, স্বচ্ছ ও ন্যায্য বাণিজ্যের বিশাল সম্ভাবনা দেখছে।’
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টোফার লুক্সন এক্সে দেওয়া এক পোস্টে জানান, তিনি সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী, ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নিতে মুক্তবাণিজ্যের বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি আরো জানান, তিনি ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের একতরফা কৌশল হয়তো উল্টো ফল দেবে। বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকার বদলে ঝুঁকছে একে অন্যের দিকে; এবং অবশ্যই চীনের দিকেও।
থিংক চায়নাতে এক কলামে চারহার ইনস্টিটিউটের গবেষণা সহকারী হাও নান লেখেন, ‘পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামো দিন দিন একে অন্যের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানের মতো মিত্র দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা চাপের মুখে নত হয়নি। তারা বরং নিজেদের মধ্যে ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করতে মনোযোগ দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অঞ্চলটির ভেতরে আঞ্চলিক বাণিজ্য জোটগুলো আঞ্চলিক বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারি আরসিইপি, ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারি চুক্তির পরিমার্জিত রূপ সিপিটিপিপি এবং বহুদিন ধরে স্থগিত থাকা চীন-জাপান-কোরিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সিজেকেএফটিএ) গতি বাড়তে পারে।’
তিনি বলেন, ‘এই শুল্কই যুক্তরাষ্ট্রকে একঘরে করে ফেলছে। আঞ্চলিক বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারি এখন বিশ্বের ৩০ শতাংশ জিডিপি নিয়ন্ত্রণ করছে। ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারিতে চীনের প্রবেশ নিয়েও আলোচনা চলছে, যেটা একসময় যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই তৈরি হয়েছিল চীনকে রুখতে। এখন সেটাই যুক্তরাষ্ট্রের হাতের বাইরে। চীন, জাপান, কোরিয়া—এই তিন দেশ আবারও কাছাকাছি আসছে। গত ২২ ও ৩০ মার্চ টোকিও ও সিউলে তাদের বৈঠকে এ বার্তাই এসেছে যে তারা একসঙ্গে মোকাবেলা করবে এই শুল্ক সংকট।’
এদিকে দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরো পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তারই অংশ হিসেবে হলিউডের চলচ্চিত্র আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৮টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে চীনের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) নালিশ করেছে বেইজিং। চীন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র যে হারে তাদের পণ্যে শুল্ক আরোপ করেছে, তাতে এমনিতেই চীনের কম্পানিগুলোর পক্ষে বাণিজ্য করা সম্ভব নয়। এরপর আরো শুল্ক আরোপিত হলে অগ্রাহ্য করবে তারা। ট্রাম্প সেই সিদ্ধান্ত নিলে বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসে তা ‘প্রহসন’ হিসেবেই থেকে যাবে। পাশাপাশি আলোচনার টেবিলে আসতে পরস্পরের প্রতি সম্মান বজায় রাখতে হবে বলে বার্তা দিয়েছে বেইজিং। সেই সঙ্গে তাদের হুঁশিয়ারি, ওয়াশিংটন চীনের স্বার্থে আঘাত হানলে পাল্টা জবাব দিতে তৈরি চীন।
সূত্র : রয়টার্স, এএফপি, গার্ডিয়ান