বলিউডের অন্যতম প্রভাবশালী প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ধর্ম প্রোডাকশন। ৪৫ বছরের এ প্রতিষ্ঠান উপহার দিয়েছে অনেক কালজয়ী ও ব্যবসাসফল ছবি। তবে কয়েক বছর ধরে টিকে থাকার জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চারটি ছবি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিয়েছিল তাঁরা।
মুনাফা করতে পেরেছে শুধু একটি। ২০২৩-এ প্রতিষ্ঠানটির আয় ছিল ১২ লাখ মার্কিন ডলার, সেটা গত বছর কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬৮ হাজার ১৩৫ ডলারে! ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের বেতনও বাকি কয়েক মাসের। অবস্থা এমনই নাজুক।
গত বছরের অক্টোবরের ঘটনা, বসন বালার ‘জিগরা’ মুক্তির তোড়জোড় করছিলেন করণ জোহর ও তাঁর দল।
তত দিনে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কানাঘুষা শুরু হয়ে গিয়েছিল, ছবিটি বক্স অফিসে ব্যবসা করবে তো! তবে নিজেদের শঙ্কা লুকিয়ে রেখে প্রচারে কমতি রাখেননি তাঁরা। দর্শকের সামনে এমন ভাবমূর্তি বজায় রেখেছিল যে ‘জিগরা’ বক্স অফিসে হিট হতে চলেছে। ছবির পোস্টার ও ট্রেলার প্রকাশের পর যত প্রশংসা দেখা গিয়েছিল, এর অধিকাংশই ছিল প্রতিষ্ঠানটির স্বার্থসংশ্লিষ্টদের!
৭ অক্টোবর করণ জোহর ঘোষণা দেন, এখন থেকে আর ধর্ম প্রোডাকশনের ছবির প্রি-রিলিজ স্ক্রিনিং [মুক্তি-পূর্ববর্তী প্রদর্শনী] হবে না। যেটা মূলত চলচ্চিত্র সমালোচক ও সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সারদের জন্য হয়ে থাকে।
ওই ঘোষণার মধ্য দিয়ে করণ পরোক্ষভাবে বলে দিয়েছেন, ছবির প্রশংসার জন্য ইউটিউবার, ভ্লগার, সমালোচকদের তিনি আর টাকা দেবেন না। এটাই বক্স অফিসে কাল হয়ে দাঁড়ায় ‘জিগরা’র সামনে।
আরেক নামজাদা প্রতিষ্ঠান যশরাজ ফিল্মসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আল জাজিরাকে বলেন, ‘বলিউডের ৭০-৮০ শতাংশ রিভিউ [প্রতিক্রিয়া] আসে টাকার বিনিময়ে। অন্য যেকোনো ব্যবসার চেয়ে সিনেমা ব্যবসায় পেইড রিভিউর চর্চা বেশি।’
বলিউডের অন্তত ২০ জন পেশাদার, সমালোচক, পিআর কর্মকর্তা ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারের কাছ থেকেও জানা গেছে, ছবির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য বড় অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়।
যাঁরা করেন না, ছবির সাফল্যের জন্য তাঁদের রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়। যদিও অধিকাংশই মনে করেন, রিভিউ বা প্রতিক্রিয়া ছবির সাফল্য নির্ধারণ করে না। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে ছবির ভাবমূর্তি তৈরিতে ভূমিকা রাখে। এমনকি প্রথম সপ্তাহে ছবির ব্যবসা কিংবা ব্যর্থতার প্রায় ১৫ শতাংশ নির্ভর করে এসব পেইড প্রতিক্রিয়ার ওপর।
২০২৩ সালে মুক্তি পায় টি-সিরিজের বিশাল বাজেটের ছবি ‘আদিপুরুষ’। সস্তা সংলাপ ও আনাড়ি ভিএফএক্সের কারণে ছবিটি সাধারণ দর্শক ও স্বাধীন সমালোচকদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল। অথচ কিছু গণমাধ্যম ও নামজাদা সমালোচক ছবিটির ভূয়সী প্রশংসা করে এবং ৫-এর মধ্যে ৪ রেটিংও দিয়েছিল! অর্থ ছাড়া এমন প্রশংসা এককথায় অসম্ভব। এমনও শোনা যায়, টুইটারে নেতিবাচক রিভিউ সরানোর জন্য অনেককে অর্থপ্রদানের প্রস্তাবও দিয়েছিল টি-সিরিজ।
এসব রিভিউর জন্য রয়েছে মেন্যু কার্ড! যেখানে প্রত্যেক সমালোচক, ইনফ্লুয়েন্সার ও গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়ার দাম উল্লেখ আছে। যার যেটা প্রয়োজন, সেটা বেছে নিতে পারেন। গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের একেকটি পোস্টের দাম ৫০ হাজার থেকে চার লাখ ৫০ হাজার রুপি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ তালিকায় রয়েছে ভারতের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে, এনডিটিভি, ফিল্মফেয়ার, বলিউড হাঙ্গামা, পিঙ্কভিলা, সমালোচক তরণ আদর্শ থেকে রমেশ বালা, জোগিন্দর তুতেজাসহ অনেকেই। ব্যক্তিবিশেষে এসব লেনদেন হয়ে থাকে নগদ অর্থে। ছবি ঘিরে মানুষের আগ্রহ যত কম, ফি তত বেশি! প্রিভিউর জন্য ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে রিভিউয়ার, ইনফ্লুয়েন্সারদের বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়ে আসা হয়, অভিজাত হোটেলে থাকার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ব্যবহারের জন্য আইফোন—সবই দিয়ে থাকেন প্রযোজকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নির্মাতা বলেন, ‘এটা এখন পরিষ্কার, আপনি যদি তাদের অর্থ না দেন, তাহলে তারা আপনার ছবির বদনাম করবে। এটা স্পষ্ট চাঁদাবাজি।’
বর্ষীয়ান বক্স অফিস বিশ্লেষক ও সমালোচক কমল নাহতা জানান, ছবির প্রচারে তিনি প্রতিটি পোস্টের জন্য ৬০ থেকে ৭০ হাজার রুপি নিয়ে থাকেন। একটি ছবির জন্য কমবেশি ১৫টি পোস্টের জন্য চুক্তি হয়। সে ক্ষেত্রে তাঁর ফি দাঁড়ায় পাঁচ থেকে সাত লাখ রুপি। তবে তাঁর দাবি, অর্থের বিনিময়ে তিনি শুধু প্রচারণা করেন। এর বাইরে যেসব পোস্ট দেন, সেগুলো সততার সঙ্গেই দেন। তাঁর ভাষ্যে, ‘আপনি আমাকে প্রচারণার জন্য অনেক টাকা দিতে পারেন, আমি প্রচারণা করব। তবে ছবি যদি ভালো না হয়, আমি সেটাও বলব।’
এই ‘চাঁদাবাজি’ ফাঁদ থেকে বের হতেই ‘জিগরা’ মুক্তির আগে প্রিভিউ করেনি ধর্ম প্রোডাকশন। তবে প্রথম সারির গণমাধ্যম ও ফিল্ম ম্যাগাজিনগুলোতে ঠিকই আর্থিক চুক্তি বলবৎ রেখেছিল। শুধু তা-ই নয়, সিনেমা হলের টিকিটও অগ্রিম বুকিং করেছিল ধর্ম। যাতে মানুষ মনে করে, ‘জিগরা’ দেখতে দর্শকের সমাগম হচ্ছে। তাতেও রক্ষা মেলেনি। শুধু বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ তুলতে পেরেছিল বক্স অফিস থেকে। কেউ কেউ বলেন, ছবির দুর্বলতার কারণেই এই ব্যর্থতা। বিপরীতে আরেক পক্ষের মতে, ‘জিগরা’ বুঝিয়ে দিয়েছে, বলিউড এখন তার নিজের তৈরি করা দানবের হাতে বন্দি! ভুয়া প্রশংসার জন্য শুধু বলিউড ভুখা, এমন নয়। অন্তর্জালের এই সময়ে গোটা বিশ্বের শোবিজ জগতেই এই চর্চা চলছে। এমনকি বাংলাদেশের শোবিজেও পেইড রিভিউ এখন পোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে বেশ।
এই রিভিউ-বাণিজ্য বন্ধের জন্য ধীরে ধীরে সরব হচ্ছেন অনেকে। গত বছর তামিলনাড়ুর কয়েকজন প্রযোজক আদালতে দাবি জানিয়েছিলেন, যেন ছবি মুক্তির প্রথম তিন দিনে কোনো রিভিউ না দেওয়া হয়। যদিও আদালত সে দাবি আমলে নেয়নি। বলিউডে প্রথম পদক্ষেপটা নিলেন করণ জোহর। যদিও অনেকের শঙ্কা, ধর্ম প্রোডাকশন এই সিদ্ধান্তে অটল থাকবে কি না।