<p>মাদরাসার ভিত্তিপ্রস্তর ও প্রথম মাদরাসা কোথায় স্থাপন করা হয়েছিল? কিভাবে হয়েছিল এবং কেন হয়েছিল? প্রথম মাদরাসার প্রতিষ্ঠা কর্ডোভা ও গ্রানাডায় হয়নি, কারাউইন ও কায়রোতে হয়নি, দিল্লি ও লখনউতে হয়নি, ফেরেঙ্গি মহল, নদওয়াতুল ওলামা বা দেওবন্দে হয়নি। ইতিহাসের প্রথম মাদরাসা স্থাপন করা হয়েছিল মসজিদে নববীতে এবং সে মাদরাসার নাম ছিল সুফফা। সে মাদরাসার প্রাণপুরুষ ছিলেন মানবজাতির মহান শিক্ষক মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর পুণ্যাত্মা সাহাবিরা ছিলেন তাঁর ছাত্র।</p> <p>খুব ছোট আয়োজনে, অল্প উপায়-উপকরণ দিয়ে সে মাদরাসার গোড়াপত্তন হয়েছিল। কিন্তু তার ফলাফল ছিল অভাবনীয়। সে মাদরাসাটিই পরবর্তী যুগের সব মাদরাসার জন্য আদর্শ ও মাপকাঠি। সুতরাং মাদরাসাগুলোর ভেতরে যে মাদরাসাকেই বিশুদ্ধ ধারার এবং উচ্চ মর্যাদাশীল মাদরাসা বলা হবে, যার ধারাক্রম সুফফার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।</p> <p>একইভাবে যে মসজিদের ধারাক্রম মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর সঙ্গে মিলিত হয় তাকেই আমরা সঠিক ধারার মসজিদ বলতে পারি। যে মসজিদের সংযোগ পবিত্র এই দুই মসজিদের সঙ্গে নেই তাকে মসজিদুল দিরার বলা হবে। কোরআনেই এই নামকরণ হয়েছে। তাই আমাদের নতুন কোনো নামকরণের প্রয়োজন নেই।</p> <p>যে মাদরাসার ধারাক্রম সুফফার সঙ্গে মিলিত হয়নি, মসজিদে নববীর সঙ্গে মিলিত হয়নি এবং তার আলোকিত কাফেলা আবু জর (রা.), সালমান ফারসি (রা.), আবু বকর সিদ্দিক (রা.), আয়েশা (রা.) ও আলী (রা.)-এর সঙ্গে যে মাদরাসার কোনো সংযোগ নেই, সে মাদরাসাকে সত্যিকারার্থে আমরা মাদরাসা বলতে পারি না। কেননা তাঁরা ছিলেন দ্বিন প্রচারক ও মানবতার শিক্ষক। মানবজাতির এই অগ্রগামী ব্যক্তিরাই মানুষকে আলোর পথ দেখিয়েছেন, আত্মত্যাগ শিখিয়েছেন, তাঁরা নিজের ক্ষতি করে উপকার করার শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁরা শিখিয়েছেন নিজের ঘর অন্ধকারের মধ্যে রেখে অন্যের ঘর কিভাবে আলোকিত করতে হয়; যাঁরা নিজের পেটে পাথর বেঁধে অন্যের মুখে আহার পৌঁছে দিয়েছেন। সুফফার আলোকিত সেসব শিক্ষার্থীরা শিখিয়েছেন মাদরাসার কাজ চাকরি দেওয়া নয়, মাদরাসার কাজ সম্পদ বণ্টন নয়, মাদরাসার কাজ এমন ব্যক্তি তৈরি করা নয়, যারা তাদের ভাষার জাদুতে মানুষকে মোহিত করবে।</p> <p>মাদরাসার কাজ হলো, কোরআন শোনানো, কোরআন শেখানো, দ্বিন ও শরিয়ত শেখানো, মানবতা ও মনুষ্যত্ব শেখানো।<br /> আধুনিক ও বস্তুবাদী পৃথিবীতে যখন স্বার্থ ও শক্তি (স্বার্থ হাসিলের মাধ্যম হিসেবে) ছাড়া সব বাস্তবতায় অস্বীকার করা হচ্ছে। মানুষকে বোঝানো হচ্ছে ক্ষমতার (অর্থ ও প্রতিপত্তির) চর্চা ছাড়া সব কিছু পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। সব বাস্তবতার মৃত্যু ঘটেছে। নৈতিকতা, সততা, সম্মান, আত্মমর্যাদাবোধ, সম্ভ্রম, মানবতা—সব কিছুর মৃত্যু ঘটেছে। কেবল একটি বাস্তবতা টিকে আছে তাহলো নিজের স্বার্থ রক্ষা। আর সেটা করতে হবে যেকোনো মূল্যে। এমন প্রতিকূল সময়ে মাদরাসা ঘোষণা করছে মানবতা মরে যায়নি, নিজের ক্ষতি মেনে নেওয়ার মধ্যেই লাভ, হেরে যাওয়ার মধ্যে বিজয় এবং ক্ষুধায় এমন তৃপ্তি আছে, যা আহারে নেই।</p> <p>মাদরাসার শিক্ষা হলো কখনো কখনো অসম্মান মেনে নেওয়ার মধ্যে এমন সম্মান আছে, যা বহু সাধনার পরও মেলে না। মানবজাতির প্রতি মাদরাসার বার্তা হলো সবচেয়ে বড় শক্তি আল্লাহর শক্তি, সত্যকে সত্য বলাই সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। মাদরাসার কাজ হলো এমন মানুষ তৈরি করা, যাদের নিলামে তোলা হলে মানুষ সব কিছুর বিনিময়ে তাদের পেতে চাইবে। মাদরাসা যদি মাদরাসার কাজ ছেড়ে দেয়, তার দায়িত্ব ভুলে যায়, তবে সেটা মাদরাসা হওয়ার যোগ্য নয়।</p> <p>যখন মনুষ্যত্বের অবমূল্যায়ন ঘটেছে, নৈতিকতার বিদায় ঘণ্টা বেজেছে, যখন মানুষ সত্য ও মিথ্যার সীমারেখা মানছে না, যখন হক-বাতিল ও হালাল-হারামের পার্থক্য ভুলে গেছে, যখন কুফর ও ঈমানের ধার ধারছে না, যখন সবার মুখ্য উদ্দেশ্য অর্থ, শক্তি, ক্ষমতা, পদ-পদবি, তখন মাদরাসার কাজ হলো এমন ব্যক্তি তৈরি করা, যারা মানবতা, সততা, নির্মোহ জীবন, মানুষের প্রতি কল্যাণকামিতার ধারক হবে। যারা চলমান অন্ধকারের পিঠে আলোর প্রদীপ জ্বেলে দেবে। আমার দৃষ্টিতে মাদরাসার সবচেয়ে বড় কাজ হলো, হক্কানি রব্বানি (সত্যপন্থী ও আল্লাহপ্রেমী) আলেম তৈরি করা। যাদের একমাত্র কাজ হবে মানুষের অন্তর প্রস্তুত করা, অন্তর থেকে পৃথিবীর মাহাত্ম্য দূর করে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাস দৃঢ় করা। কেননা মানুষের অন্তর সবচেয়ে মূল্যবান রসদ ও সম্পদ।</p> <p>আধুনিককালেও মাদরাসার কাছে আমাদের প্রত্যাশা জাগতিক উন্নয়ন নয়, বরং দ্বিনি উন্নয়ন। কেননা ইসলাম এমন দ্বিন, যা কখনো দুনিয়াকে অস্বীকার করেনি, দুনিয়াকে আল্লাহর নির্দেশের আলোকে সঙ্গে নিয়ে চলতে বলেছে। তাই কারো দ্বিনি জীবন সুন্দর হলে তার ইহকালীন ও পরকালীন উভয় জীবন সমানভাবে আলোকিত হবে। দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদরাসার কাছে এ যুগের প্রত্যাশা ও দাবি হলো—এমন একদল মানুষ তৈরি করা, যাদের বিশ্বাস হবে সুদৃঢ়, যারা ঈমানের আলোয় আলোকিত হবে, যারা হবে সৎ কাজে উদ্যমী ও সাহসী। যারা জাগতিক স্বার্থের কাছে পরাজিত হবে না, যারা নিজেকে কখনো বিক্রি করবে না, যাদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধও বিক্রি হবে না। যারা সুফফার আলোকিত কাফেলার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে এবং তাদের মতো নিজের সব কিছুর ওপর দ্বিনকে প্রাধান্য দেবে। তারা দ্বিন প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। মাতৃভূমির মায়া, পরিবারের পিছুটান, জাগতিক স্বার্থগুলো কিংবা ব্যক্তিগত অপারগতা তাদের দ্বিনি দায়িত্ব পালনে বাধা হতে পারবে না। তারা হবে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মূলধন এবং পুরো মানবজাতির সম্পদ। তাদের নিয়ে ইতিহাস যুগের পর যুগ গর্ব করবে এবং তারা হবে মানব ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র।</p> <p><em>তামিরে হায়াত থেকে আলেমা হাবিবা আক্তারের ভাষান্তর</em></p> <p> </p>