আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আমদানি করা সারের মূল্য বাবদ আট কোটি আট লাখ ডলার বা প্রায় এক হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়নি। চুক্তির খেলাপ হওয়ার কারণে সরবরাহকারী চারটি দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সার রপ্তানির চুক্তি বাতিল করেছে। এতে তিন মাস ধরে বন্ধ রয়েছে নন-ইউরিয়া জাতীয় সার আমদানি। এসব ঋণ পরিশোধ করে পুনরায় সার আমদানির দ্রুত উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সার রপ্তানি করা চারটি দেশ হলো চীন, সৌদি আরব, মরক্কো ও কানাডা। তাদের বকেয়া অর্থ পরিশোধ করে আমদানি শুরু করতে চায় বর্তমান সরকার। এ ব্যাপারে কৃৃষিসচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের মনিটরিং টিম কাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্য এর মধ্যে চীনের বকেয়া অর্থ আংশিকভাবে পরিশোধ করেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার চীনের পাওনা ৬০ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। একই দিন আরো প্রায় দুই কোটি ৫৩ লাখ ডলার বকেয়া পরিশোধের জন্য অর্থ ছাড়করণ অনুমোদন করা হয়েছে। সেই অর্থ থেকে সৌদি আরবের এক কোটি ৫৮ লাখ ডলার এবং মরক্কোর জন্য ৮৪ লাখ ৯০ হাজার ডলার এবং কানাডার জন্য ১০ লাখ ডলার পরিশোধ করা হবে। এ ছাড়া আরো বেশ কিছু অর্থ ছাড়করণের জন্য চিঠি দেওয়া হয়ছে।
সেই অর্থ পাওয়া মাত্র বকেয়া বাকি অর্থ পরিশোধ করা হবে। এই বকেয়া অর্থ পরিশোধ করতে পারলে অন্যান্য দেশ থেকে সার আমদানি আরো সহজ হবে।
অর্থ ও কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সার আমদানি বাবদ বাংলাদেশের কাছে সৌদি আরব পাবে এক কোটি ৫৮ লাখ ডলার, মরক্কো পাবে দুই কোটি ১০ লাখ ডলার এবং কানাডা পাবে এক কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ ছাড়া এসব দেশ থেকে সার আমদানি করতে জাহাজভাড়া বকেয়া রয়েছে প্রায় তিন কোটি এক লাখ ডলার। সব মিলিয়ে সার কেনা বাবদ বাংলাদেশকে প্রায় আট কোটি আট লাখ ডলার পরিশোধ করতে হবে।
এই অর্থ পরিশোধ না করায় নানা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এসব জটিলতার কারণে এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের এলসি খোলা প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
গত সরকারের আমলের এসব দায় পরিশোধ করে সারের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে দ্রুত উদ্যোগ নিচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়। গত কয়েক দিন টানা আলোচনা করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে। এসব দেশের বকেয়া পরিশোধ করে সরকার একদিকে যেমন সারের সংকট সমাধান করতে চায়, তেমনি বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যাংকিং খাতের আস্থা ফিরিয়ে আনতে চায়। চুক্তি বন্ধ থাকা এসব দেশের সঙ্গে নতুন করে সার আমদানির চুক্তি করাসহ অর্থ পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য কৃষি উপদেষ্টার পরামর্শে কৃষিসচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম কাজ করছে। এ ছাড়া বাড়তি দামে যেসব সার আমদানির চুক্তি হয় বা টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো বাতিল করা হচ্ছে। সার আমদানিতে অর্থ সাশ্রয়ে মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সম্প্রতি ডলার সংকট ও আর্থিক খাতের নানান সংস্কারের মধ্যে বর্তমান সরকার কৃষি খাতের জন্য সার আমদানির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। বিষয়টি সার্বক্ষণিকভাবে কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী তদারক করছেন ও নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছেন। আগামী ডিসেম্বরের পর থেকে বোরো মৌসুম শুরু হবে। সেই সময়ে চাহিদা অনুসারে সারের সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমরা সব ধরনের বকেয়া পরিশোধ করে আমদানি স্বাভাবিক করতে উদ্যোগ নিয়েছি। এ ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরগুলো এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করছে।’
বাড়তি দামে আর সার আমদানি করা হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতি টন সার আমদানিতে প্রায় ১০০ ডলার বেশি দাম চাওয়া হয়েছিল। সেটি আমরা বাতিল করে দাম কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছি। এ ছাড়া সারের ব্যবহার বিধিতে আমরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করার উদ্যোগ নিচ্ছি। কৃষকের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তায় সারের সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমরা সব ধরনের উদ্যোগ নেব।’
জানা গেছে, দেশে প্রায় ৬৫ লাখ টন সারের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ২৬ লাখ টন ইউরিয়া, সাড়ে সাত লাখ টন টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট), সাড়ে ১৬ লাখ টন ডিএপি (ডাই-অ্যামোনিয়া ফসফেট) এবং সাড়ে আট লাখ টন এমওপি সারের চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য সারের চাহিদা প্রায় আট লাখ টন। এর মধ্যে দেশে ইউরিয়া সার উৎপাদন হয় ৯-১০ লাখ টন। ইউরিয়া সার মূলত মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করা হয়। এ ছাড়া টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সার আমদানি করা হয়। সব মিলিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিতে হয়েছে। ফলে সারের সঠিক মাত্রায় ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে জমির উর্বরাশক্তি যেমন ধরে রাখা সম্ভব হবে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে। পাশাপাশি সরকারের সার খাতে ভর্তুকি ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।