<p style="text-align: justify;">ফিনল্যান্ড, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, সৌদি আরবসহ বেশ কিছু দেশের শিক্ষকরা অনেক বেশি বেতন পান। বাংলাদেশি টাকার হিসাবে তাদের মাসিক বেতন গড়ে আট লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা, যা বাংলাদেশের একজন শিক্ষকের কয়েক বছরের বেতনের সমান।</p> <p style="text-align: justify;">প্রতিবেশী দেশ ভারতের শিক্ষকরাও বাংলাদেশের শিক্ষকদের চেয়ে বেশি বেতন পান। এখানে সরকারি প্রাথমিক ও এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন যেখানে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায় শুরু, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকদের বেতন শুরু হয় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা থেকে। অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে শিক্ষকদের বেতন বেশি হলেও কয়েকটিতে জীবনযাত্রার ব্যয়ও অনেক বেশি। মালদ্বীপের শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশি টাকার অঙ্কে বেশি মনে হলেও সেখানে দ্রব্যমূল্য ও অন্যান্য খরচও অনেক বেশি।</p> <p style="text-align: justify;">দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষকরা বেশ পিছিয়ে। বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে। গত ১৫ বছরে সরকার একাধিকবার শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন করে শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের আওতায় আনা হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কয়েক হাজার নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেড কয়েক ধাপ উন্নীত করা হয়েছে। এর পরও অন্যান্য দেশের তুলনায় বেতন-ভাতা ও মর্যাদার দিক থেকে বাংলাদেশের শিক্ষকরা পিছিয়ে।</p> <p style="text-align: justify;">প্রাথমিক পর্যায়ে সহকারী শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদা পান। শুধু প্রধান শিক্ষকের পদ দ্বিতীয় শ্রেণির। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে জাতীয় বেতন স্কেলের শুধু মূল বেতন পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।</p> <p style="text-align: justify;">বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি তথ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রারম্ভিক মাসিক বেতন প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ টাকা, ভারতে ৩৫ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ৩০ হাজার টাকা, শ্রীলঙ্কায় ২৭ হাজার টাকা, নেপালে ৩৫ হাজার টাকা, ভুটানে ৩৩ হাজার টাকা ও মালদ্বীপে ৬৩ হাজার টাকা।</p> <p style="text-align: justify;">মাধ্যমিকে বাংলাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন ১৭ হাজার ৫০০ টাকা, ভারতে ৪০ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ৩০ হাজার টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৩২ হাজার টাকা, নেপালে ৩৫ হাজার টাকা, ভুটানে ৩৯ হাজার টাকা ও মালদ্বীপে ৯০ হাজার টাকা।</p> <p style="text-align: justify;">ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো দুর্বল, সেটা ঠিক। তবে আমরা দেখেছি, কয়েক বছর আগে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে। মাধ্যমিক এমপিওভুক্ত ও সরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতনবৈষম্য রয়েছে। আবার যারা নন-এমপিও, তারা বেতনই পান না। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের দায়িত্ব বাড়ানো হচ্ছে। সেখানে তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানো দরকার। আমার জানা মতে, সরকার এ ব্যাপারে ভাবছে।’</p> <p style="text-align: justify;">অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, ‘শিক্ষার অবকাঠামোতে বরাদ্দ বাড়লেই কিন্তু গুণগত মানের উন্নয়ন হবে না। শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন, মান-মর্যাদা ও বেতন—তিনটিই সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা যদি ভুটানের দিকে তাকাই, তারা চিকিৎসক ও শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি বেতন দেয়। কোরিয়া, হংকং, জাপানে শিক্ষকদের আলাদা বেতন কাঠামো। এর ফল কিন্তু তারা পাচ্ছে। আমাদেরও স্মার্ট বাংলাদেশ হতে হলে শিক্ষকদের মর্যাদা আরো বাড়াতে হবে।’  </p> <p style="text-align: justify;">সূত্র জানায়, আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষার প্রায় ৯৭ শতাংশ বেসরকারি। মূলত এগুলো এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে কর্মরত প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। সরকার সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেডের সমপরিমাণ মূল বেতন দেয়। সেখানে তাদের ১৬ হাজার টাকা স্কেলে বেতন শুরু হয়। এর বাইরে তারা বাড়িভাড়া বাবদ মাসে এক হাজার টাকা ও চিকিৎসা ভাতা বাবদ মাসে ৫০০ টাকা পান। সেই হিসাবে শুরুতে একজন শিক্ষক সরকারি ভাতা ১৭ হাজার ৫০০ টাকা পান। এর বাইরে যেসব স্কুলের আয় আছে, তারা ফান্ড থেকেও কিছু টাকা শিক্ষকদের দেয়। তবে সব স্কুল তা দিতে পারে না। </p> <p style="text-align: justify;">এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের ২৫ শতাংশ। তবে স্কুলের কর্মচারীরা উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া তারা সরকারি কর্মচারীদের মতো বৈশাখী ভাতা পান। তবে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যারা সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে যোগ দেন, তারা শুরুতেই দশম গ্রেডে ২৬ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তারা সন্তানদের পড়ালেখার জন্য ভাতা পান। পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতাসহ নানা ধরনের সুবিধা পান। তবে সরকারি বা এমপিওভুক্ত উভয় ধরনের স্কুলেই শিক্ষকরা উচ্চতর গ্রেড বিএড সম্পন্ন হলে আলাদা ইনক্রিমেন্ট পান, তাদের বেতনও কিছুটা বাড়ে। কিন্তু সারা দেশে প্রায় ৩২ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও সেখানে মাধ্যমিক পর্যায়ের সরকারি স্কুলের সংখ্যা মাত্র ৭০০-র কাছাকাছি। </p> <p style="text-align: justify;">মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ব্যাপারে সব সময় আন্তরিক। আমরা চাই, তাদের বেতন-ভাতা বাড়ুক। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উৎসব ভাতা ও বাড়িভাড়া বাড়াতে একটা হিসাব করছি, যা শিগগিরই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে। সরকার হয়তো তাদের সক্ষমতা বিবেচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।’</p> <p style="text-align: justify;">অন্যদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা পান। স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেডের বেতন স্কেলে মূল বেতন ১১ হাজার টাকা, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতা ও টিফিন ভাতা মিলিয়ে শুরুতে প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পান। সারা দেশে এই সহকারী শিক্ষকদের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। এর বাইরে তারা নিয়মানুযায়ী সন্তানদের জন্য শিক্ষা ভাতা পান।</p> <p style="text-align: justify;">এ ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকরা শুরুতে নবম গ্রেডে ২২ হাজার টাকা স্কেলে বেতন পান। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা এই বেতন স্কেলের বাইরে খুব একটা সুবিধা না পেলেও সরকারি কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাড়িভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসাসহ আরো নানা সুবিধা পান।</p> <p style="text-align: justify;">উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা প্রাথমিক শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। সবচেয়ে বেশি মেধাবীদের নিয়োগ দেওয়া হয় প্রাথমিকে। তাদের বেতন-ভাতাও অন্যান্য শিক্ষকদের চেয়ে বেশি।</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়নের সভাপতি আবুল বাশার হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকতা পেশা কিন্তু দিন দিন শ্রীহীন হয়ে পড়ছে। অনেকে অন্য কোনো চাকরি পেলে শিক্ষকতা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এখন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার পদ খালি। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন না। এর মূল কারণ শিক্ষকদের মানবেতর জীবন। এত অল্প টাকা বেতন পেয়ে কোনোভাবেই তারা চলতে পারছেন না। আমরা এখন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে যাচ্ছি। এই সময়ে শিক্ষকদের বেতন-ভাতার উন্নয়ন সবার আগে জরুরি হয়ে পড়েছে।’</p> <p style="text-align: justify;">সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ‘আমাদের শিক্ষকদের বেতন যেহেতু কম, তাই তারা অন্য কিছু করার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকতা পেশায় ঢুকলেই তারা প্রাইভেট-কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এখানে আয় বেশি হওয়ায় স্কুলের চেয়ে তারা প্রাইভেটেই বেশি মনোযোগী হন। সরকার বারবার প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ করার চেষ্টা করলেও এতে সফল হয়নি।’</p> <p style="text-align: justify;">শিক্ষকরা বলছেন, সরকার নতুন শিক্ষাক্রম চালু করেছে। সেখানে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি বেড়েছে। কিন্তু বেতন-ভাতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের প্রস্তাব করা হলেও, তা বাস্তবায়নে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।</p> <p style="text-align: justify;">জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ২০১০-এর সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিক্ষার উন্নয়নে আগে শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে যেমন উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনি তাদের বেতন-ভাতাও সম্মানজনক হতে হবে। আমরা যদি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে তাদের শিক্ষকদের বেতন আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। শিক্ষকদের জন্য আমরা স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলেছিলাম, সেটার কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। এখন দক্ষতার ভিত্তিতে বেতন কাঠামোর সংশোধন আনা প্রয়োজন। নয়তো মেধাবীরা আগামীতে শিক্ষকতায় আসবেন না।’<br />  </p>