অনিয়ম ঢাকতেই তড়িঘড়ি নির্বাচনের আয়োজনের চেষ্টা:
অনিয়ম ও অপকর্ম ঢাকতে তড়িঘড়ি নির্বাচনের আয়োজন চলছে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ী নারীদের। তারা বলেছেন, ‘সারা দেশে কোথাও নির্বাচন নেই অথচ যে প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনের সংস্কৃতিই নেই, সেখানে নির্বাচন আয়োজনের তোড়জোড়। মূলত অনুগতদের হাতে নেতৃত্ব রাখতে এই তড়িঘড়ি। এতে অতীতের অনিয়মগুলো চাপা দেওয়া সহজ হবে।’
সদ্য উইমেন চেম্বারের সদস্য হওয়া আরশি বিজনেস হাউসের স্বত্বাধিকারী সামিয়া বেগম চৌধুরী বলেন, ‘এত বছর আমাকে সদস্য হতে দেওয়া হয়নি। সবশেষ গত নভেম্বরেও সদস্য ফরম সংগ্রহ করতে গেলে তারা বললেন, সংগঠনের অফিসে কোনো ফরম নেই। পরে অন্য আরেক উদ্যোক্তার সংগ্রহ করা ফরম চেয়ে নিয়ে সদস্য হয়েছি।’
নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সারা দেশে সংস্কারের দাবি উঠেছে। অথচ এখানে তারা অপকর্ম ধামাচাপা দিতে সংস্কার ছাড়াই তড়িঘড়ি নির্বাচন চান। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মূলত তড়িঘড়ি করছেন।’ তার দাবি, নির্বাচনের আগে অবশ্যই সংস্কার প্রয়োজন। যোগ্য যারা তাদের আগে সদস্য করা হোক। এজন্য প্রশাসক নিয়োগ করে সংস্কার প্রয়োজন।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা:
সর্বশেষ তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৮ মে উইমেন চেম্বারের নির্বাচন হওয়ার কথা। এর আগে প্রথমবার ঘোষিত তফসিলে ২৩ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের দিন ধার্য হয়। পরে নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে সালিশি বৈঠকে নির্বাচন পেছানো হয় এবং ১২ থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সদস্য অন্তর্ভুক্তির জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়।
সদস্য না করতে নানা অপকৌলের অভিযোগ:
সব যোগ্যতা থাকার পরও উইমেন চেম্বারের সদস্য হতে পারেননি এমন অভিযোগ অসংখ্য নারী ব্যবসায়ীর। অনেককে ফরমই দেওয়া হয়নি। আবার অনেকে সদস্য ফি জমা দিয়ে সদস্য হলেও পরবর্তীসময়ে জানানো হয় তিনি সংগঠনের সদস্যই নন। তেমনই একজন স্বনামধন্য অনলাইন শপ ‘প্রিংক’-এর স্বত্বাধিকারী রেহানা আফরোজ খান।
তিনি বলেন, ‘আমি গত বছরের অক্টোবরে উইমেন চেম্বারের অ্যাসোসিয়েট সদস্য হই। ৩ হাজার ২৫০ টাকা সদস্য ফি জমার মানি রিসিটও আমার সংরক্ষণে আছে। এমনকি উইমেন চেম্বারের ওয়েবসাইটের সাকসেস স্টোরিতেও আমার ও আমার প্রতিষ্ঠানের ছবি-ভিডিওসহ স্টোরি আছে। সেখানেও তারা আমাকে উইমেন চেম্বারের সদস্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অথচ যখনই আমি নির্বাচন করার ইচ্ছে পোষণ করি তখন জানানো হয়, আমি নাকি উইমেন চেম্বারের সদস্যই নই। সদস্য হিসেবে আমার কোনো কাগজপত্র তাদের সংরক্ষণে নেই!’
তিনি বলেন, ‘এরপর আমি আবারো অর্ডিনারি সদস্য ফরম (গোলাপি ফরম) সংগ্রহ করি। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও সদস্য ফি’র টাকাসহ লোক মারফতে ফরম জমা দিতে পাঠালে তারা তা গ্রহণ করেননি।’
প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ফরম জমা দেওয়ায় ব্যর্থ হয়েছেন এমন অভিযোগ আরো অনেকের। তাদের একজন ইয়াসিন এন্টারপ্রাইজের পরিচালক শেখ আমিনা রহমান শিউলি। তিনি বলেন, ‘আমি সব ধরনের প্রয়োজনীয় কাগজসহ ফরম ফিলআপ করে সদস্য ফি’সহ ফরম জমা দিতে পাঠিয়েছিলাম। তারা জমা রাখেননি।’
এসব বিষয়ে চেম্বারের বর্তমান সভাপতি লুবানা ইয়াসমিন শম্পা বলেন, ‘নানা ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। রেহানা আফরোজ ও ন্যান্সি নামের দুজনের ফরম নিয়ে এক ব্যক্তি এসেছিলেন। ওই ব্যক্তি ন্যান্সির স্টাফ হওয়ায় তার ফরম আমরা রেখেছি। কিন্তু রেহানা আফরোজের ফরম রাখিনি।’
সশরীরে আসতে হবে এমন নিয়ম নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মূলত চলমান পরিস্থিতিতে জটিলতা এড়াতে জমা রাখা হয়নি। কারণ পরে তিনিই যদি অস্বীকার করেন, তিনি পাঠাননি।’
সদস্য ফি নিয়ে সদস্য করার পর রেহানা আফরোজকে বাদ দেওয়া এবং সদস্য না হলেও ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজের সাকসেস স্টোরিতে সদস্য হিসেবে তাকে দেখানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এগুলো আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগের ঘটনা। পূর্বের বিষয়গুলোর দায় আমি নেবো না।’
প্রশাসনকে প্রভাবিত করার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ:
সিলেট উইমেন চেম্বারের অস্বচ্ছতা ও অনিয়ম তুলে ধরে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ বাতিল ও প্রশাসক নিয়োগের গত ১৫ ডিসেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠনের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ১০ ব্যবসায়ী নারী। অভিযোগ আমলে নিয়ে ২৪ ডিসেম্বর সিলেটের জেলা প্রশাসককে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু এ বিষয়ে শুরু থেকেই ধীর গতি দেখা দেয় বলে দাবি অভিযোগকারীদের।
বারবার তাগাদা দেওয়ার পর গত ২৩ জানুয়ারি উভয়পক্ষের শুনানির দিন নির্ধারণ করে প্রশাসন। শুনানি শেষে অভিযোগগুলো লিখিত আকারে দিতে বলা হয়। ২৬ জানুয়ারি অভিযোগকারীরা লিখিতভাবে অভিযোগ জমা দেন। এরপর এক মাসেরও অধিক সময় অতিবাহিত হলেও আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
অভিযোগকারীরা বলছেন, ‘এখনো প্রশাসনের আড়ালে ঘাপটি মেরে আছে পতিত সরকারের দোসররা। তাদের মাধ্যমেই স্বর্ণলতা আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ায় কাজ গতি হারাচ্ছে।’
এ বিষয়ে নারী উদ্যোক্তা সামিয়া বেগম চৌধুরী বলেন, ‘জেলা প্রশাসক মহোদয় আমাদের অভিযোগগুলো গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে আন্তরিক থাকার পরও এসব কার্যক্রম বারবার গতি হারাচ্ছে। আমাদের ধারণা, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এখনো স্বৈরাচারের দোসররা ঘাপটি মেরে রয়েছে। পূর্বের সভাপতি তাদের মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে সময়ক্ষেপণ করাচ্ছেন। যাতে কোনো সংস্কার ছাড়া ঘোষিত সময়ে নির্বাচন করে ফেলা যায়।’
এ বিষয়ে উইমেন চেম্বার সভাপতি বলেন, ‘অভিযোগ সত্য নয়। বরং তারা নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। আমাদের নথি গায়েব হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।’
বেশি সদস্য দেখাতে জালিয়াতির অভিযোগ:
সংগঠনের সদস্য সংখ্যা বেশি দেখাতে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে উইমেন চেম্বার সভাপতি স্বর্ণলতার বিরুদ্ধে। তৎকালীন সদস্য তালিকার ৮ নম্বর সদস্য নাসরিন সুলতানা ও ২৪ নম্বর সদস্য নাসরিন বেগম একই ব্যক্তি বলে নিশ্চিত করেছেন উইমেন চেম্বারের একাধিক সদস্য। একইভাবে ১৪ নম্বরে ফাহিমা আক্তার ও ১৮ নম্বর সদস্য ফাহিমা একই ব্যক্তি, ২৬ নম্বর সদস্য আসমাউল হুসনা খান ও ৩৯ নম্বর সদস্য হাসনা উল হাসনা একই ব্যক্তি। তালিকা ভালোভাবে ঘাটালে এরকম আরো অস্তিত্বহীন ভুয়া সদস্যের সন্ধান মিলবে বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে ২৬ নম্বর সদস্য আসমাউল হুসনা খান বলেন, ‘আমার নামকে একটু পরিবর্তন করে ৩৯ নম্বরে আরেকজন হিসেবে দেখানো হয়েছে। এরকম অনেক জালিয়াতি হয়েছে বিগত দিনে। তারা খুবই চতুরতার সঙ্গে এসব করেছেন। অনুসন্ধান করলে আরো অনেককিছু বেরিয়ে আসবে।’
দেশে না থাকায় সাবেক সভাপতি স্বর্ণলতা রায়ের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
পাল্টা অভিযোগ:
যারা সংস্কারের দাবি তুলেছেন তারাই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন বলে অভিযোগ চেম্বার সভাপতি লুবানার। তিনি বলেন, পরিচালনা পরিষদ বরখাস্ত করে প্রশাসক নিয়োগের যে আবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে করা হয়েছে তাতেও জালিয়াতি হয়েছে। সেখানে যে ১০ জন স্বাক্ষর করেছেন তারমধ্যে আরমান আরা বেগম যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেছেন। তিনি আবেদনে স্বাক্ষর করলেন কীভাবে?’
অভিযোগ অস্বীকার করে সামিয়া বেগম চৌধুরী বলেন, ‘এটা মিথ্যাচার। কারণ আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছি ১৫ ডিসেম্বর। আর আরমান আরা বেগম যুক্তরাষ্ট্রে যান ২৪ ডিসেম্বর।’
স্বচ্ছতা ফেরাতে কাজ করছেন বর্তমান সভাপতি:
স্বর্ণলতা রায় পদত্যাগের পর সভাপতির দায়িত্ব পান সৈয়দা রাবেয়া আক্তার রিয়া। অসুস্থতাজনিত কারণে তিনি সরে দাঁড়ালে গত ১২ জানুয়ারি উইমেন চেম্বারের সভাপতির দায়িত্ব পান লুবানা ইয়াছমিন শম্পা। দায়িত্ব পেয়ে সংগঠনে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করছেন দাবি জানিয়ে লুবানা বলেন, ‘পালাবদলে আমি সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর সংগঠনে স্বচ্ছতা আনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। প্রতিষ্ঠার ১০ বছরেও উইমেন চেম্বার ট্যাক্সের আওতায় ছিল না। আমি ট্যাক্সের আওতায় এনেছি। প্রথমবারের মতো অডিট করিয়েছি। ডিভিএস-এর (ডকুমেন্ট ভেরিফাইড সিস্টেম) অন্তর্ভুক্ত অডিট করিয়েছি।’
গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে স্বর্ণলতা রায় টানা ৫ বার সভাপতি হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘টানা ৩ বারের বেশি এক পদে না থাকার নিয়ম থাকলেও পরবর্তীসময়ে ২০১৮ সালে সেটি সংশোধন করা হয়। সেসময় আমি যেহেতু পরিচালনা পর্ষদে ছিলাম না, তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব না।’
আগে কখনো নির্বাচন হয়নি অভিযোগের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন হয়নি এভাবে বলা যাবে না। যেহেতু ভোটার সংখ্যা ৩৩ জন ছিল না। তাই প্রসিকিউর মেইনটেইন হয়েছে, অপ্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচন হয়েছে।’
সিলেটের জেল প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছিল। আমরা সেটা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। পরবর্তী ধাপ তো আর আমাদের হাতে নেই।’