<p>শৈশবেই পালা পরিবেশনা চর্চায় যুক্ত হন। দেশজ বিভিন্ন পালা, কিচ্ছা, ঝুমুর যাত্রা প্রভৃতি পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন। স্বীয় কর্ম ও কৃতিত্ব দিয়ে তিনি নিজেকে এক অন্যতর উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশের দেশজ সাংস্কৃতিক পরিবেশনাকে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করতে তিনি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে চলেছেন। প্রায় চার দশক ধরে পালাগান করছেন ইসলাম উদ্দিন পালাকার। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিস বিভাগ আয়োজিত ‘১৮তম কেন্দ্রীয় বার্ষিক নাট্যোৎসব’-এ সম্মাননা জানানো হবে তাকে। এই সূত্র ধরে তার সঙ্গে কথা বলেছেন সুদীপ কুমার দীপ।</p> <p><strong>ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মাননা পাচ্ছেন। কেমন লাগছে?</strong><br /> এই অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের দেশের শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমাকে এই সম্মান দিচ্ছে, আমি আনন্দিত, গর্বিত। আমরা গ্রাম্য শিল্পী। শহুরে হাবভাব বুঝি না। আমাদের যে সম্মান জানানো যায় সেটাই তো কোনো দিন ভাবিনি। কৃতজ্ঞতা জানাই সবাইকে। সম্মাননা নেওয়ার দিন ‘কমলা রাণীর সাগর দীঘি’ পরিবেশন করবেন।</p> <p><strong>প্রস্তুতি কেমন?</strong></p> <p>এখনো (গতকাল বিকেল) অনুশীলন করছি। এটা আমার একক পরিবেশনা। সঙ্গে দুজন মিউজিশিয়ান থাকবেন। তবে পুরোটা আমাকেই দেখভাল করতে হবে। শৈশব থেকেই পালা পরিবেশনা করে আসছেন। দীর্ঘ সংগীতজীবনের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাই। যখন সিদ্ধান্ত নিলাম পালা গান শিখব, তখনই মা-বাবা, ভাই-বোন ত্যাগ করে ৯ মাস গুরুর কাছে ছিলাম। এটা অনেক বড় সাধনার ব্যাপার। অনেক ত্যাগের পর আত্মস্থ করি। একটা সময় গ্রামে হালখাতা হলেই পালা গান, জারি গান, পুঁথিগানের আয়োজন হতো। এখন তো সেটা হয় না। তা ছাড়া নতুন কেউ এটা শিখবে এমন আগ্রহও দেখি না। এখন কেউ এই ত্যাগ স্বীকার করতে চায় না। কত দিন ধরে চেষ্টা করছি একজন যোগ্য শিষ্য তৈরি করব, পাচ্ছি না। এর মধ্যে এক ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছে, সে বলেছে, সব ছেড়ে সাধনায় মনোযোগ দেবে। যদি সত্যিই সে পারে তাহলে মনপ্রাণ দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করব। এখনকার প্রজন্ম পর্যন্ত পালাগান সম্পর্কে কিছুটা জানে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এটাকে পৌঁছে দিতে হলে যোগ্য উত্তরসূরি তৈরির বিকল্প নেই।</p> <p><strong>আপনি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশজ পরিবেশনার নন্দন-কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেন। কতটা উপভোগ করেন?</strong></p> <p>পালা পরিবেশনার চেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সময় কাটাতে বেশি আনন্দ লাগে। মেধাবী ছেলে-মেয়েরা যখন আমার কাছে সময় চায়, তখন আবেগে চোখে পানি ধরে রাখতে পারি না। আরে! আমি কে? গ্রামের একজন শিল্পী। কোনো দিন ভাবিনি সারা দেশের মানুষ আমাকে চিনবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমার কাছে আসবে। এটা এখনো বিশ্বাস করতে পারি না। ১২ ডিসেম্বর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ ২০ জনের একটা দল আসবে। কিশোরগঞ্জে আমার গ্রামে থাকবে তারা। আমি প্রশিক্ষণ দেব তাদের। এখন চলছে মঞ্চ তৈরির কাজ।</p> <p><strong>কোক স্টুডিও বাংলার ‘দেওরা’ গানের পর নিশ্চয়ই আপনার জীবনে পরিবর্তন এসেছে?</strong></p> <p>অবশ্যই। দেখেন পালা পরিবেশনা করে আর কয় টাকা আসে! পরিবারের কথা ভেবে গানের পাশাপাশি একটা ব্যবসা শুরু করেছিলাম। তবে ‘দেওরা’ প্রকাশের পর আমার শো বেড়েছে প্রচুর। পালায় এখন সবাই ‘দেওরা’ শুনতে চায়। প্রায়ই নতুন নতুন গানের প্রস্তাব পাই। এই ব্যস্ততা আগে ছিল না। কিছুদিন আগে কলকাতায় গেলাম, সেখানেও সবাই অনুরোধ করল আগে ‘দেওরা’ গাইতে।</p> <p><strong>দেশের বাইরেও গেয়েছেন। সেখানকার মানুষ পালা গান কতটা উপভোগ করেন?</strong></p> <p>ব্রিটেনের একটা ঘটনা বলি। আমি তো ইংরেজি পারি না। আমার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ছিলেন। পালা পরিবেশনের আগে ব্রিটিশ এক নাগরিকের সঙ্গে বসলাম। আমি বন্দনা থেকে শুরু করে সব বাংলায় করলাম। স্যার ওই ব্রিটিশকে সেটা ইংরেজিতে বললেন। বিশ্বাস করবেন! ব্রিটিশ সেই নাগরিক মুহূর্তেই সেটা মুখস্থ করে ফেললেন। পরদিন মঞ্চে আমি একটা করে অধ্যায় পরিবেশন করলাম আর ওই ব্রিটিশ নাগরিক সেটা ইংরেজিতে বর্ণনা করতে লাগলেন। হলভর্তি মানুষ সেটা মুগ্ধ হয়ে শুনলেন। এই অভিজ্ঞতার কথা ভুলব না। </p> <p><strong>দেশজ সংস্কৃতি ক্রমেই বিলুপ্তির পথে। এটা রক্ষা করার বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?</strong></p> <p>প্রতিটি মঞ্চেই আমি এটা নিয়ে কথা বলি। যারা উচ্চস্থানীয় ব্যক্তি আছেন, তাদের সঙ্গে দেখা হলেও অনুরোধ করি আমাদের ঐতিহ্যকে বাঁচাতে। আসলে যোগ্য উত্তরসূরি না হলে এটা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। শুধু শুধু মন খারাপ করে তো লাভ নেই। দেখেন, যাত্রাপালা প্রায় শেষ। পুঁথিগান কোথায় হয় এখন! জারি গানও তো শুনতে পাই না। আসলে কেউ এগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য শিষ্য পাচ্ছে না। আমি নিজেই তো বছরের পর বছর ধরে একজন শিষ্য তৈরি করতে মরিয়া হয়ে আছি। পাচ্ছি না। যদি মৃত্যুর আগে না পাই, তাহলে আমার ভেতরে যেটুকু আছে তা তো রেখে যেতে পারব না। এভাবে একদিন সব বিলীন হয়ে যাবে।</p> <p><strong>চলচ্চিত্রেও গেয়েছেন। নতুন কোনো গান আসছে আপনার কণ্ঠে?</strong></p> <p>৫ ডিসেম্বর একটা গানের শুটিং করতে যাব চট্টগ্রাম। নুহাশ হুমায়ূনের একটি নাটকে গানটি ব্যবহার করা হবে। আদি যুগের কথা নিয়ে গানটি। সুর ও সংগীত করেছেন প্রীতম হাসান। গাওয়ার পাশাপাশি সেখানে দেখা যাবে আমাকেও।</p>