<p style="text-align: justify;">বেশ অনেককাল পর এই বছর, অর্থাৎ ১৪৩১ বঙ্গাব্দের নববর্ষের দিনটির অনেকটা সময় কাটল কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায়। এই বছর বাংলা নববর্ষ পড়েছিল রবিবারে। কলেজ স্ট্রিট রবিবারে একটু কেন, বেশ অনেকটাই অন্যরকম থাকে। সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে সন্ধ্যা সাতটা, সাড়ে সাতটার পর কলেজ স্ট্রিটকে যেমন একাকিত্ব জেঁকে ধরে, ঠিক সেই রকমই, রবিবার নিজের ছন্দে থাকে না কলেজ স্ট্রিট। রবিবারে থাকে না এই পাড়ার কোনো ব্যস্ততা। সেদিন যে কেউ সে পাড়ার গলিতে গলিতে ঢাউস গাড়ি নিয়ে অবলীলায় ঢুকে পড়তে পারে। বই, কাগজে স্তূপ হয়ে থাকা ঠেলাগাড়ির ঠেলাঠেলি নেই।</p> <p style="text-align: justify;">রবিবার দিন কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতগুলো একটা অসীম নিঃসঙ্গতায় পড়ে থাকে। যেসব খাবারদাবারের আজকাল নাম হয়েছে স্ট্রিট ফুড, সেকালে সেইসব খাবার, আজকের মতো এত না বিকোলেও কলেজ স্ট্রিটের পথচলতি রাস্তার আনাচ-কানাচে তাদের কদর বেশি বৈ কম ছিল না। এখন আরো হরেক কিসিমের খাবার ‘স্ট্রিট ফুড’ নামে গোটা কলকাতায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে। হারিয়ে গেছে, সেকালে ‘স্ট্রিট ফুড’ শিরোপা না পাওয়া কুলফি মালাই, পাঁঠার ঘুগনি-এসব মান-অভিমান জুড়ে রবিবারে একলা পড়ে থাকা কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাত, একটু হলেও পহেলা বোশেখের রংদারিতে রঙিন হয়ে উঠেছিল এই ১৪৩১ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখে।</p> <p style="text-align: justify;">কলেজ স্ট্রিটে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছিল বেশ কিছু যুবক-যুবতী। কিছু যুবক ধুতি পরে আছেন বলে তাঁদের দাবি। যদিও যে কেউ ভেবেই নিতে পারে, মায়ের শাড়ি বা বউয়ের অষ্টমী দিন দুগ্গা পুজোতে অঞ্জলি দেওয়ার শাড়ি বা অপরের আইব্রু ভাতে পরে যাওয়া বান্ধবীর শাড়িটাই সেই যুবক ধুতি মনে করে পরেছে। আর সেটা পরে মনে মনে বাঙালি হিসেবে যথেষ্ট আত্মশ্লাঘা অনুভব করে পথ চলতে চলতে রণদাচরণের মতো ইতিউতি চেয়ে চেয়ে দেখছে, কেউ তাকে নজর করছে নাকি। বিশেষ কেউ ভেবে চেয়ে চেয়ে দেখছে নাকি!</p> <p style="text-align: justify;">এই কদিন আগে শিল্পী মমতাশঙ্করের কিছু কথা ঘিরে সমাজমাধ্যম একেবারে মেতে উঠেছিল। তেতেও উঠেছিল। একলা বোশেখের দিনটি কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়াতে নববর্ষ পালন করতে অমন তাপোত্তাপ কম ছিল না। আসলে আমাদের কালের রকবাজির ভাষায়, ‘জামাই’ আর ‘নিমাই’-এর এহেন সম্মুখ সমর যে নতুন বছরের শুরুতে বইপাড়াতে দেখতে পাব, সত্যিই আন্দাজ করতে পারিনি। এমন লড়াই আমরা শারোৎসবের কালে ম্যাডান স্কয়ারে দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। তবে সেকালের বাগবাজার সার্বজনীনের মাঠে এলোকেশীদের দেখে আমাদের চোখ সয়ে গেছে বলে আর ম্যাডান স্কোয়ার , ‘চোখে ঘনায় ঘোর’-কে  শেষ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখে চোখেই। মাথা অবধি পৌঁছতে দেয় না।<br />  <br /> কোন লেখক কত বেশি প্রকাশকের কাছে এককভাবে গ্রহণযোগ্য- এটা নিয়ে লেখকদের নিজেদের ভেতরেই একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলে। চলে অপরকে হেঁট করবার ও একটা না-প্রকাশ পাওয়ার ছলে প্রকাশ্য হয়ে উঠবার উদগ্র কামনা।</p> <p style="text-align: justify;">তেমনই এক কামনার শিকার হতে হলো বৈকি। বসে ছিলুম এক বইয়ের হোল সেলার তথা প্রকাশকের ঘরে। এলেন এক স্বঘোষিত  ‘বিশেষ অজ্ঞ’। একটু আগেই হাভানা ক্যাপ পরিহিত ওই ব্যক্তিটিকে দেখেছি আরেক প্রকাশকের ঘরে। সেই প্রকাশকের সঙ্গে বুঝি বেশি স্পর্শকাতরতার সুযোগ ওই টুপি শোভিতের হয়নি। তাই প্রকাশকের খাস চেম্বারে ঠাঁই জোটেনি তার। বেশ একটু দূরেই বসেছিলেন ভদ্রলোক।</p> <p style="text-align: justify;">যে কামনার শিকার হলুম আমি, সেই মোকামে, ওই, ‘বিশেষ অজ্ঞ’ আসবার পর, যখন তার বই সাজাবার বিজ্ঞাপন সমাজ মাধ্যমে দেখবার অভিজ্ঞতার কথা বললাম, হই হই করে উঠলেন হাভানা ক্যাপের অর্ধাঙ্গিনী। রে রে করে ধেয়ে উঠে বললেন- ‘  আপনি গোটা ব্যাপারটার কৃতিত্ব ওঁকে একা দিচ্ছেন?’ </p> <p style="text-align: justify;">এই মলো যা।, ‘বিশেষ অজ্ঞে’ র ঘরের সুলুক সন্ধান করা তো আমার কাজ না। আমি পড়তে পারি। পড়াতে পারি। লেখবার চেষ্টা করি। তবে লিখে খাই না। পড়িয়ে খাই। তাই ‘বিশেষ অজ্ঞে’র প্রতি ফেলু মিত্তিরীয় আচরণ করবার স্পর্ধা বা যোগ্যতা- কোনোটাই আমার জম্মাতেই পারে না। হাভানা ক্যাপের কৃতিত্বে মনীন্দ্রলাল বসুর স্বপ্নবাসবদত্তার পরে নতুন কারো যে আবির্ভাব ঘটেছে, সেটা জানবার বা বোঝবার মতো বুদ্ধি বা মেধা কিছুই আমার নেই।</p> <p style="text-align: justify;">তাই উঠে পড়ে ‘দোকানে’ বই দেখতে লাগলুম। ‘দোকান’ শব্দটা ঘিরে অনেকের  ‘মানে’ লাগবার ব্যাপার ছিল। আছেও। থাকবে কি-না বলতে পারি না। কারণ, ‘লট’, অর্থাৎ ভাগ্য শব্দটায় বিশ্বাস করি না। তাই অনেকেই ‘দোকান’ কে  ‘শোরুম’ বললেও এই শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে ‘বিপনী’ ঘিরে, রবীন্দ্রনাথের আপত্তি ঘিরে বিশ্বজিৎ রায়ের কথা শোনা স্বত্ত্বেও বলি, গোঁসাই কে, খেঁজুর গাছে দেখবার স্মৃতি কেন যেন মনটাতে উচাটন প্রক্রিয়া তীব্র করে তোলে।</p> <p style="text-align: justify;">বই দেখতে দেখতে দেখি, সেই ‘বিশেষ অজ্ঞে’ র সঙ্গে আসা এক মহিলা, আমি যে চেয়ারটাতে বসেছিলাম, বেমালুম সেই চেয়ারখানাতে পা তুলে দিয়ে বসে রয়েছেন। একটা প্রকাশ্য জায়গাতে, সদ্য উঠে যাওয়া একজন মানুষের চেয়ারে, যে মানুষটা নববর্ষের আসর ছেড়ে চলে যাননি, পাশেই রয়েছেন, আবার এসে বসবার সম্ভাবনা কোনো অবস্থাতেই বাতিল হয়ে যায়নি, সেই চেয়ারটার উপর পা তুলে বসে গল্প করতে পারে- এই রুচিটা দেখে মনে হলো, নতুন বছরে অনেক কিছু বদলে যাওয়াটাই হয়তো এখন থেকে দেখতে হবে।</p> <p style="text-align: justify;">আমার সৌভাগ্য হয়েছিল মনীষী মহম্মদ মনসুরউদ্দিন কে দেখবার। লোকসংস্কৃতিবিদ হিসেবে তাঁর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল অন্নদাশঙ্কর রায়ের। যদি ও সুধীর চক্রবর্তী, লোকসংস্কৃতি ঘিরে, বিশেষ করে লালন ঘিরে অন্নদাশঙ্করের মেধা ঘিরে সন্দেহ প্রকাশ করে নিজের মেধাকেই সংশয়তিমিরে নিক্ষেপ করেছিলেন। মহাত্মা লালনের মৃত্যুশতবর্ষ ঘিরে অন্নদাশঙ্করের লেখার অনুলিখন করবার (অন্নদাশঙ্করের ‘লালন ও তাঁর গান’ গ্রন্থে লেখাটা সঙ্কলিত আছে) সময়ে দেখেছিলাম, লালন ঘিরে অন্নদাশঙ্কর নিরপেক্ষ শ্রদ্ধা। ‘নিরপেক্ষ’ শব্দটা বললাম এই কারণে যে, সাধনপথে লালনের অনুগামীদের এককালের অনুগামীদের ধারণা ছিল; মহাত্মা লালনের খাতা ছেঁউড়ে থেকে এনে, সেখার কিছু সংযোজন-বিয়োজন করেই রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি’ লেখেন। নোবেল পান। তথ্যযুক্তির প্রমাণ দিয়ে অন্নদাশঙ্করই প্রথম সেই ভ্রান্ত ধারণাটির অবসান ঘটিয়েছেন। তাই সুধীর চক্রবর্তী লালন ঘিরে অন্নদাশঙ্করের মেধা নিয়ে কুরুচিকর কী কথা বলেছেন, তার ভিত্তিতে তো আর অন্নদাশঙ্করের মূল্যায়ন হয় না।</p> <p style="text-align: justify;">এত কথা বললুম এই কারণেই যে, সেই ‘বিশেষ অজ্ঞ’ তরজায় নয়, পরস্পরের পিঠ চাপড়ানিতে মেতে উঠেছিলেন একালের এক একাধারে বাউল-  অন্যদিকে ভূত-প্রেত-পিশাচ-তন্ত্র -শ্মশান ‘বিশেষ অজ্ঞে’ র সঙ্গে। পাঠক লক্ষ্য করবেন, আমি কিন্তু ‘কবরস্থান’ কথাটা লিখলাম না। যাঁরা পেশাগতভাবে কবর খোঁড়েন, সেই ‘গোরখাদক’দের নিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটা অসামান্য গল্প আছে। যেসব বিশেষজ্ঞের কথা লিখছি, তারা বুঝি, ‘স্পর্শ বাঁচায়ে পুণ্যের পথে’  হাঁটতে গিয়ে কেবল হিন্দু সংস্কৃতিকেই, বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে দাগিয়ে দিতে আত্মনিবেদিত। </p> <p style="text-align: justify;">বাঙালি সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করতে, পরিপুষ্ট করতে, বাঙালি হিন্দুর মতোই বাঙালি মুসলমানের ও সমমাত্রায় ভূমিকা এবং অবদান রয়েছে, এসব শৌখিন মজদুর বাউল ‘বিশেষ অজ্ঞ’দের একটা অংশ জানেই না। আর একটা অংশ রাজনৈতিক কারণে, জানা বিষয়টাকে প্রকাশ্যে আনে না।</p> <p style="text-align: justify;">মনসুরউদ্দিন থেকে শুরু করে শামসুজ্জামান খান হয়ে আবুল আহসান চৌধুরী প্রত্যেকেই বাঙালি সংস্কৃতি বলতে অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন, হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সংস্কৃতি। যেমনটা রবীন্দ্রনাথ থেকে ক্ষিতিমোহন সেন হয়ে অন্নদাশঙ্কর বিশ্বাস করতেন। এ বিশ্বাস এ সময়ের শৌখিন, ‘বিশেষ অজ্ঞ’ রা করেন না। আবার এই ‘বিশেষ অজ্ঞ’ দের মধ্যে অনেকে থার্ড কমিউনিটির মাদুলি-তাবিজ-কবচে বিশ্বাসকে জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠিত করতে যথেষ্ট পরিশ্রম করেন। রাঢ় বঙ্গের অমন একজনকে জানি, যিনি নিজে বাউলদের মাদুলি-তাবিজ বিক্রির বিষয়ে একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন। তখন আমরা যারা মনসুরউদ্দিনের মতো মানুষকে পেয়েছিলাম, আবুল আহসান চৌধুরীর মতো মানুষকে পাই, আমাদের বলতে ইচ্ছে করে , ‘ভ্রমি বিস্ময়ে’!</p> <p style="text-align: justify;">সেদিন ওই নববর্ষের দুপুরে কলেজ স্ট্রীটে অমন এক , ‘বিশেষ অজ্ঞে’ র সঙ্গে অনেকটা সময় কাটালুম, যিনি মারফতী ঘরের ধারায় মাথাটা ঢেকে রাখেন রঙিন রুমালে। অনেককাল আগে আমার বাড়িতে সে একবার এসেছিল। তখন ওই রুমালের রহস্য শুধিয়েছিলুম। তার জবাব, কোন গুরুমা নাকি তাঁকে অমন রুমাল দিয়েছিলেন। তা সেই জাদুকর পি সি সরকারের, ‘ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া’র মতো, এই বিশেষ অজ্ঞের সেই গুরুমার দেওয়া রুমালেও তদনুরূপ মহিমা আছে কি না, জানি না। তবে আমার গ্রহের দোষ কাটাতে সে যে আমাকে ঘোড়ার নাল পড়তে বলেছিল, এতকাল পরে দুই বিশেষ অজ্ঞের কথোপকথনে সেটা আবার মনে পড়ে গেল।</p>