<p>হিজড়া, দলিতসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সদস্যরা সমাজে প্রতিনিয়ত অবহেলা, বৈষম্য ও অবমাননার শিকার হচ্ছে। বৈষম্য দূরীকরণে ২০২২ সালে বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। খসড়া আইনটির কিছু বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনাও রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনসহ আইনটি পাস করা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে বৈষম্য দূর করতে সমাজে সচেতনতা তৈরিরও কোনো বিকল্প নেই।     </p> <p>গতকাল সোমবার রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইডাব্লিউএমজিপিএলসি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা এসব কথা বলেন। ‘বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী আইন ও আমাদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিলটি আয়োজন করে কালের কণ্ঠ ও ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ।</p> <p>বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের হুইপ ও সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম বলেন, ‘২০২২ সালে বৈষম্যবিরোধী আইনটি সংসদে বিল আকারে ওঠার পর সংসদীয় কমিটিতে যায়।</p> <p>এরপর (২০২৪ সালের জানুয়ারিতে) জাতীয় নির্বাচন চলে আসে। এটি আর আইন আকারে পাস হয়নি। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করতে চাই, সংসদে দাঁড়িয়ে এই আইনটির কথা উল্লেখ করে বক্তব্য দেব।’</p> <p>সানজিদা খানম বলেন, ‘আমরা ২০১৩ সালে হিজড়াদের নিয়ে নীতিমালা করেছি। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে হিজড়ারা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। এতে তাদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নাগরিকত্বের সনদ মিলেছে। আশা করছি, এই সংসদেই বৈষম্যবিরোধী আইনটি পাস হবে।’</p> <p>কালের কণ্ঠ’র প্রধান সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘বৈষম্য শুরু হয় আমাদের ঘর ও প্রতিদিনের জীবন থেকে। আমরা যখন ঘরে বসে খাই, আমাদের বাড়িতে যে ছেলে বা মেয়েটি কাজ করে তাকে কখনোই আমরা আমাদের খাওয়ার টেবিলে বসতে অনুমতি দিই না। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা বৈষম্য তৈরি করেছি। মানুষ সচেতন না হলে দেশ বদলায় না, পৃথিবী বদলায় না। তাই মানুষের সচেতনতা দরকার।’</p> <p>জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, ‘বৈষম্য শুরু হয় পরিবার থেকে, সেটা রাষ্ট্রে গিয়ে পৌঁছে। সুতরাং আমাদের আইনে বৈষম্যে সংজ্ঞার পরিবর্তন আনতে হবে। মানবিক সমাজ তৈরি করতে হলে আমাদের শক্ত আইন তৈরি করতে হবে।’</p> <p>বৈঠকে ক্রিশ্চিয়ান এইডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাহেনুর আলম চৌধুরী “বৈষম্য‘বিরোধী’ আইন ও আমাদের প্রত্যাশা” শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে আইন কমিশন বৈষম্য বিলোপ আইনের প্রথম খসড়া তৈরি করে। ২০১৮ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন খসড়া আইনটি পরিমার্জন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ২০২২ সালে বিলটি সংসদে উত্থাপনের পর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।</p> <p>সাবেক সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য থাকার সময় আমার মানবাধিকার কমিশনের খসড়াটি দেখার সুযোগ হয়েছিল। ওই খসড়া একদম যথার্থ (পারফেক্ট) ছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল, কমিশন হঠাৎ করে দৃশ্যের বাইরে চলে গেছে।’</p> <p>শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “আইনটির নাম ‘বৈষম্যবিরোধী’ আইন না হয়ে ‘বৈষম্যবিলোপ’ আইন হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এ ছাড়া এই আইনে ‘দলিত’দের সংজ্ঞা নেই, যেটি থাকা উচিত। যৌনকর্মীদের জন্য আলাদা বিধান আসতে পারে। বিষয়টি নজরদারিতে গঠিত মনিটরিং কমিটিতে মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। এই আইনে অপরাধ নামের কোনো শব্দ নেই। এখানে সাজা হিসেবে মৃদু ভর্ত্সনা, ক্ষেত্রবিশেষে জরিমানা অথবা সাত দিনের জেল-জরিমানা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।”</p> <p>জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. এস এম মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘দুটি কারণে এই আইন প্রয়োজন। একটি হলো, জেনেভা কনভেনশনে গিয়ে আইনমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন এবং আরেকটি হলো সরকারের ভাবমূর্তির স্বার্থে তা করতে হবে।’</p> <p>জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ডেপুটি ডিরেক্টর রবিউল ইসলাম বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সবার প্রচেষ্টায় এই আইন আলোর মুখ দেখবে বলে আমরা মনে করেছিলাম। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে এই আইন সংসদে আর আলোর মুখ দেখল না। আমরা খুবই হতাশ হয়েছি।’</p> <p>বাংলাদেশ দলিত অ্যান্ড এক্সক্লুডেড রাইটস মুভমেন্টের (বিডিইআরএম) সভাপতি উত্তম কুমার ভক্ত বলেন, ‘একটি বড় অংশের মানুষকে এই আইনের সপক্ষে আনা প্রয়োজন ছিল। সেখানে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।’</p> <p>মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রগ্রাম কো-অর্ডিনেটর রুমা সুলতানা বলেন, ‘আমাদের আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বৈষম্যের শিকার হলে তাকে পর্যায়ক্রমে জেলা, বিভাগীয় ও জাতীয় কমিটির কাছে যেতে হবে। এই তিনটি কমিটি পার হতেই ভুক্তভোগীর সাড়ে তিন মাস চলে যাবে। এরপর তাকে আদালতে যেতে হতে পারে। আদালতে সময় দেওয়া আছে ৯০ দিন। কিন্তু আমাদের আদালতে ৯০ দিনে কি কোনো মামলা নিষ্পত্তি হয়?’</p> <p>অধিকার আন্দোলন ও আইন প্রণয়নের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘২০০২ সালের দিকে বাংলাদেশে প্রথম বৈষম্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরপর ২০০৫ সালের দিকে তা আন্দোলনে রূপ নেয়। ২০১২ সালে মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন সংগঠন বৈষম্যবিরোধী আইনের একটি খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল আইনমন্ত্রী আইনটি উত্থাপন করেন। এরপর তা সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে এটি আবার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর আর এই আইনের কোনো খবর নেই।’</p> <p>দলিত নারী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মনি রানী দাস বলেন, ‘১৯৭১ সালে দেশটা যে জায়গায় স্বাধীন হয়েছে, আইন না থাকার কারণে আজ পর্যন্ত আমরা (দলিত জনগোষ্ঠী) ওই জায়গায়ই রয়ে গেছি। এখনো দলিতরা সমাজের অন্য লোকদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খেতে পারে না।’</p> <p>হোপ অ্যান্ড পিস ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সেক্রেটারি রানী চৌধুরী বলেন, ‘আমি একজন হিজড়া—এই পরিচয় দিতে আমি স্বাচ্ছন্দ্য ও গর্ববোধ করি। সংবিধানে আমাদের জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা কিছু বলা নেই, আলাদা আইন নেই। আমরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। আমরা কোথায় যাব? হিজড়াদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেড়ে চলছে।’</p> <p>ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জাবিন বলেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর লোকজন সমাজের সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে। তাদের এই সুযোগ-সুবিধা এমনভাবে দিতে হবে, যেন তারা সহজেই এটি নিতে পারে।</p> <p>নাগরিক উদ্যোগের প্রগ্রাম ম্যানেজার নাদিরা পারভীন বলেন, ‘আইন হওয়া মাত্র সমাজের সব মানুষের চিন্তার পরিবর্তন হবে না। এই পরিবর্তনের জন্য সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচি করতে হবে। আইন কত দূর যেতে পারবে তা জানি না। তবে এটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর একটি রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে।’</p> <p>অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কালের কণ্ঠ’র সহকারী সম্পাদক আলী হাবিব। তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার বাইরেও জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি নানা পরিচয়ের অনেক মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়। তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার অবিলম্বে বৈষম্যবিরোধী আইন পাস করবে—এই প্রত্যাশা আমাদের থাকবে।’</p> <p>বৈঠকে বক্তারা আইনটির নাম ‘বৈষম্য বিলোপ আইন’ করা, বৈষম্যগুলোকে চিহ্নিত ও সংজ্ঞায়িত করা, বৈষম্যমূলক কাজকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচনা করা, শাস্তির বিধান রাখাসহ বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন।</p>