গোলাম মাওলা রনি

কনফিউজড! পুরো জাতি কনফিউজড!

অনলাইন ডেস্ক
অনলাইন ডেস্ক
শেয়ার
কনফিউজড! পুরো জাতি কনফিউজড!
সংগৃহীত ছবি

বহু আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে একটি কাহিনি শুনিয়েছিলাম। ২০১৯ সালের কোনো এক সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার সুদীর্ঘ আলোচনা হয়, যা শেষ অবধি ব্যক্তিগত আড্ডা বা খোশগল্পে পরিণত হয়। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের পর বিএনপি ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়ে। আর আওয়ামী লীগ সেই সুযোগ নিয়ে যে পাল্টা আক্রমণ, অপপ্রচার, মামলা, হামলা দিয়ে এমন এক ভীতিকর অবস্থা তৈরি করে, যার কারণে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূলের সবাই কনফিউজ হয়ে পড়ে।

এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে কনফিউজড শব্দ নিয়ে কিছু বলা অবশ্যক এবং ২০১৯ সালে তারেক রহমানকে শোনানো একটি বড়সড় ঐতিহাসিক কাহিনি কেন ২০২৫ সালে এসে আপনাদের শোনাতে এসেছি, তা-ও ব্যাখ্যা করা জরুরি।

কনফিউজড একটি ইংরেজি শব্দ, যার বাংলা প্রতিশব্দ হলো বিভ্রান্ত। এটি একটি ক্রিয়াবাচক পদ। বিভ্রান্তি যখন কোনো প্রাণীকে গ্রাস করে এবং সে যখন অগ্রপশ্চাত কিছুই বুঝতে পারে না, কী করা উচিত কী বলা উচিত ইত্যাদি বিষয়ে যখন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তখনই সে বিভ্রান্তিতে পড়ে।

চলমান বাংলাদেশে আমরা সবাই যে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছি, তা বিভিন্নরূপে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বহু জনপদের মানবকুল-পক্ষীকুল, জন্তু-জানোয়ারসহ অন্যান্য প্রাণীকে কনফিউজড বা বিভ্রান্ত করেছিল। কেবল লড়াকু বুদ্ধিমান এবং নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন প্রাণীরা সেসব বিভ্রান্তি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল।

পৃথিবীতে লক্ষ-কোটি বিভ্রান্তি বা কনফিউশন রয়েছে যেগুলোর বিরাট অংশ মানবসৃষ্ট এবং বাকিগুলো প্রকৃতিগতভাবে হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক বিভ্রান্তির মধ্যে মরীচিকার মতো ঘটনা যেরূপ রয়েছে তদ্রুপ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলেও প্রাণিকুল বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

বর্তমানে মার্কিন মুলুকের লস অ্যাঞ্জেলেসের যে ভয়াবহ দাবানল তা কেবল আমেরিকাবাসীকে নয়, তামাম দুনিয়ার সভ্যতা-প্রযুক্তি-উন্নতি সবকিছুকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মানবসৃষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে ইয়েমেন-ইসরায়েল, সৌদি আরব দ্বন্দ্ব যেমন ওই এলাকার বাসিন্দাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে তদ্রুপ ২০২৫ সালে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ, জনগণ তো বটেই এমনকি গরুছাগলও মারাত্মক বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছে।

লড়াকু বুদ্ধিমানবিভ্রান্তি নিয়ে লম্বা আলোচনার মাঝে হঠাৎ কেন গরুছাগলের বিভ্রান্ত হওয়ার প্রসঙ্গ এলো, তা একটু পরিষ্কার করে নিই। পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, নেতাকে খুশি করার জন্য কর্মী তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের গরু জোর করে ধরে এনে জবাই করে বিরাট ভোজের আয়োজন করেছে এবং একই ধরনের কয়েকটি ঘটনা দেশের অন্যান্য প্রান্তেও ঘটেছে। ৫ আগস্টের পর অবলা গরুছাগল লুট, পুকুরের মাছ লুটের মতো ঘটনা কেবল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে যেভাবে হয়েছে, তা বাংলার ইতিহাসে ইতোপূর্বে ঘটেনি।

এগুলোকে কী বলবেন- লুট, চুরি-ডাকাতি নাকি গনিমতের মাল, তা নিয়ে যেমন আপনার বিভ্রান্তি থাকতে পারে, তদ্রুপ মোট কতগুলো গরু-ছাগল-মহিষ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে, কতগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে এবং কতগুলোর গলায় ছুরি চালানো হয়েছে, তা হিসাব করতে গেলে আপনাকে বিভ্রান্তি পেয়ে বসবে। বিশেষ করে প্রভুভক্ত গৃহপালিত গরুছাগল সাধারণ অবস্থায় মালিককে দেখলে মাথা নাড়িয়ে সম্ভাষণ জানায় এবং হাম্বা, রব বা ম্যা ম্যা রবে নিজেদের খুশি ব্যক্ত করে। অপরদিকে প্রতিপক্ষ শত্রু বা চোর-ডাকাত দেখলে চিৎকার শুরু করে এবং সাধ্যমতো গুঁতো দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টের ৫ তারিখের পর গরুছাগলগুলো পর্যন্ত এতটা বিভ্রান্তের মধ্যে পড়েছে যে প্রাণীগুলোর একটিও সামান্য প্রতিবাদ করেছে বা গুঁতো দিয়ে দুর্বৃত্তদের আহত করেছে, অমন খবর শোনা যায়নি।

আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম যে পৃথিবীতে বহু রকমের বিভ্রান্তি রয়েছে। এসব বিভ্রান্তির মধ্যে রাজনৈতিক বিভ্রান্তির ক্ষতিকর দিক সবচেয়ে ভয়াবহ। রাজনীতিতে বিভ্রান্তির কারণে কোটি কোটি মানুষ মারা পড়ে। দেশে দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়- যুদ্ধবিগ্রহ, মারামারি, হানাহানি অনিবার্য হয়ে পড়ে। বিভ্রান্তি দীর্ঘ মেয়াদে চললে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব লুণ্ঠিত হয়। দেশ টুকরো টুকরো হয়ে যায়। গৃহযুদ্ধ-অরাজকতার কারণে কখনো কখনো জাতি গোষ্ঠী বিলুপ্ত হয়ে যায়। সুতরাং জাতীয় জীবনে যে কোনো প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের মধ্যে বিভ্রান্তি এমন একটি মহামারি, যা থেকে রক্ষা করার জন্য কেবল একজন রাজনৈতিক নেতার দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা, নেতৃত্বের গুণাবলি, বিশ্বাসযোগ্যতা, সততা-ন্যায়নিষ্ঠ ও ন্যায়বিচারই হতে পারে একমাত্র মহৌষধ। ২০১৯ সালের বিভ্রান্তি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বরং তা ফুলে ফেঁপে ২০২৫ সালে এত বিকট আকার ধারণ করেছে যে পুরো জাতিগোষ্ঠী স্মরণকালের সবচেয়ে বড় এবং ভয়ংকর বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেছি। আমরা জানি না, আগামীকাল দেশের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে। উনি কি টুস করে ঢুকে পড়েবেন- ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ভয়ংকরভাবে ফিরবে, এমন লেখা কেন বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের বিলবোর্ডে হঠাৎ হঠাৎ উদয় হয়। নির্বাচন কবে হবে, কীভাবে হবে। আগামীর প্রধানমন্ত্রী কে, রাষ্ট্রপতি কে এসব যেমন আমরা কেউ জানি না, তদ্রুপ কেউ সাহস করে বলছেন না, আমি আগামীর প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি। এসব বিভ্রান্তির মধ্যে ব্যবসায়ীরা ভেবে পাচ্ছেন না, ব্যবসাপাতি বন্ধ করবেন নাকি চালিয়ে রাখবেন। ধনাঢ্য শ্রেণি সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না যে বাকি জীবন দেশে কাটাবে নাকি ধনসম্পত্তি নিয়ে নিরাপদ কোনো দেশে গিয়ে আশ্রয় নেবে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কোটি কোটি শ্রমজীবী যারা দিন আনেন দিন খান তারা আজ কাজ পেলেন কিন্তু আগামীকাল পাবেন কি না, তা জানেন না। আবার যিনি আজ কাজ না পেয়ে অভুক্ত থাকলেন তিনিও আগামীকাল খেতে পারবেন এমন কোনো স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছেন না।

আমাদের জাতীয় বিভ্রান্তির মূল কারণ নেতৃত্বসংকট। নেতার জন্ম হয় নৈতিক গুণাবলি নিয়ে। কোনো গুন্ডা-বদমাশকে সারা জীবন ধর্মকর্ম শিক্ষা দিয়ে যেমন ধার্মিক বানানো যায় না, তদ্রুপ নেতৃত্বের গুণাবলি নেই এমন কাউকে নেতার আসনে কিয়ামত পর্যন্ত বসিয়ে সারাক্ষণ জি হুজুর জি হুজুর করলেও তার মধ্যে একবিন্দু নেতৃত্বের গুণাবলি ঢোকানো সম্ভব নয়। বরং কোনো অযোগ্য লোক পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের নেতৃত্বে বসলে কী হয় তা বোধ করি বিস্তারিত আলোচনা ছাড়াই সম্মানিত পাঠক বুঝতে পারছেন। অযোগ্য নেতৃত্বের প্রধান দুর্বলতা সে নিজে বুঝতে পারে না, সে কী করছে এবং কী তার করা উচিত। দ্বিতীয়ত নেতার প্রধান গুণ হলো তার হুকুম করার ক্ষমতা ও বিশ্বাস। তার সৌন্দর্য হলো ন্যায়পরায়ণতা। তার ক্ষমতার চাবিকাঠি হলো কঠোরতা ও কোমলতার সমন্বয় করা। তার মর্যাদার প্রতীক হলো তার ন্যায়বিচার করার ক্ষমতা। তার সফলতা হলো স্থান-কাল-পাত্রভেদে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। আর সার্থকতা হলো সাহসিকতা তথা বীরবিক্রমতা।

উল্লিখিত গুণাবলিসম্পন্ন মানুষের হাতে যখন জাতির নেতৃত্বের ভার অর্পিত হয় তখন জাতির মধ্যে কোনো রকম বিভ্রান্তি দেখা দেয় না। এসব নিয়ে ইতিহাসের জনক হিরোটাস যে আলোচনা করেছেন, সেখানে তিনি অসাধারণ একটি ঐতিহাসিক কাহিনি বর্ণনা করেছেন, যা আমি ২০১৯ সালে তারেক রহমানকে শুনিয়েছিলাম এবং আজকের নিবন্ধে আপনাদেরও শোনাব।

পারস্যের কিংবদন্তি সম্রাট দারায়সের মৃত্যুর পর তার সন্তান যার্কসেস ৪৮৬ খ্রি. পূর্বাব্দের অক্টোবর মাসে সিংহাসনে বসেন। ক্ষমতা লাভের ছয় বছর পর তিনি গ্রিস দখলের জন্য যে ঐতিহাসিক যুদ্ধযাত্রা করেন, যা কিনা মহাকালের সবচেয়ে বড় যুদ্ধযাত্রা হিসেবে অভিহিত। প্রায় ৫৩ লাখ সৈন্য এবং যুদ্ধবহরের অন্যান্য সহকারীসহ প্রায় এক কোটি দশ লাখ লোকের সুবিশাল বহর নিয়ে যার্কসেস প্রাচীন হেলিসপন্ট অর্থাৎ দার্দানেলস প্রণালি অতিক্রম করে গ্রিসে উপস্থিত হন। তাঁর যুদ্ধবহরে যে পরিমাণ লোকবল ছিল তার সমপরিমাণ জনসংখ্যা তখন গ্রিসসহ আশপাশের ১০টি রাষ্ট্রেরও ছিল না। ফলে পুরো ইউরোপে ভীতি ছড়িয়ে পড়ল এবং শহর-বন্দর বিরান করে জনগণ পালাতে থাকল। যার্কসেস তাঁবু গেড়ে যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন এবং শত্রুপক্ষের দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব দেখে পুলকিত হয়ে উঠলেন। তিনি মনের আনন্দে যুদ্ধ ময়দানের করণীয় ভুলে গেলেন এবং নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে তার অধীন সেনাপতিদের ওপর দায়িত্ব দিলেন কীভাবে যুদ্ধে অগ্রসর হওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে শক্ত প্রতিপক্ষ না থাকা অথবা প্রতিপক্ষকে অতি দুর্বল বিবেচনা করে সম্রাট যার্কসেসের সেনাপতিরা সিদ্ধান্ত নিতে কালক্ষেপণ করতে করতে পুরো এক বছর পার করে দেন। ইতোমধ্যে গ্রিক সৈন্যরা গেরিলা আক্রমণ শুরু করেন। এ অবস্থায় জনৈক মহিলা সেনাপতি সম্রাটের সামনে হাজির হয়ে বললেন, ‘মহামান্য মালিক! আমরা সবাই আপনার হুকুমের দাসদাসী। আপনি আমাদের যুদ্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন। গত এক বছর চেষ্টা করেও আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি এবং পরবর্তী এক বছর চেষ্টা করলেও তা সম্ভব নয়। কারণ মালিকের সামনে দাসদাসীর মস্তিষ্ক কাজ করে না। আমাদের জন্ম হয়েছে আপনার সেবার জন্য এবং আপনার হুকুম পালন ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য। সুতরাং আপনি আমাদের ওপর যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা ফিরিয়ে নিন এবং নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের হুকুম করুন।’ 

উল্লিখিত মহিলা সেনাপতির কথায় সম্রাট সংবিৎ ফিরে পান এবং কালবিলম্ব না করে যুদ্ধের হুকুম দেন। ইতিহাসে সম্রাট যার্কসেসকে একজন সফল এবং মহান রাষ্ট্রনায়ক বলা হয়। তার বিপুল যুদ্ধ আয়োজন সত্ত্বেও কেবল অতি আত্মবিশ্বাস, সময়ক্ষেপণ, প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবার কারণে তিনি গ্রিসের সেই যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন। তার সময়ক্ষেপণের সুযোগ নিয়ে এথেন্স ও স্পার্টার রাজাদের নেতৃত্বে ১০টি ইউরোপীয় রাষ্ট্র প্রায় ৫ লাখ সৈন্য নিয়ে এগিয়ে আসে এবং তাদের চেয়ে ১০ গুণ বড় আকৃতির সৈন্যবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ইউরোপ থেকে তাড়িয়ে দেয়।  ২০১৯ সালে উল্লিখিত গল্পটি তারেক রহমানকে কেন শুনিয়েছিলাম তা আজ আর মনে নেই। কিন্তু ২০২৫ সালে একই গল্প বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার মাধ্যমে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কেন শোনাতে চাচ্ছি, তা-ও বুঝতে পারছি না। কারণ আমিও যে বাংলার ১৮ কোটি মানুষের মতো বিভ্রান্তির কবলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

উন্নতির নানা রূপ ও ভিতরের কারণ

    সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শেয়ার
উন্নতির নানা রূপ ও ভিতরের কারণ

উন্নতির কাছে আমাদের প্রত্যাশাটা কী? অবশ্যই সুখ। কিন্তু উন্নয়ন কেবল যে নদীর গলা টিপে ধরছে বা বনভূমি উজাড় করে দিচ্ছে শুধু তা-ই নয়, নাগরিকদের সুখও কেড়ে নিচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় গত এক বছরে প্রাণ হারিয়েছে ৬ হাজার ৫২৪ জন। খবর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের।

এ হিসাব সঠিক নয় বলে কেউ কেউ বলেন, তাঁদের বক্তব্য প্রাণহানির সংখ্যা আরও বেশি, সব ঘটনা খবরে আসে না।

আশাবাদী হওয়াটা খুবই দরকার, আশাবাদী হতে যারা আগ্রহী করছে তারা উন্নতির বিষয়ে নিশ্চিন্তবোধ করতে পারেন এটা লক্ষ করে যে, দেশে বড় একটা ভোক্তা শ্রেণির উত্থান ঘটেছে। তাতে বাংলাদেশে পণ্যের চাহিদা বেশ বেড়েছে। আর পণ্যের চাহিদা বাড়া মানেই তো উৎপাদন বাড়া।

কিন্তু তাই কী? দুয়ে দুয়ে চার? নির্ভুল অঙ্ক? যদি তেমনটাই ঘটত তবে আমাদের জন্য আনন্দের অবধি থাকত না। কারণ, উৎপাদন বাড়া মানেই তো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু সেটা কী ঘটছে? বিদেশি পণ্যে কী বাজার ছেয়ে যায়নি? যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলোর উৎপাদক কোম্পানির অনেকগুলোর মালিকানা ইতোমধ্যেই কি বিদেশিদের হাতে চলে যায়নি? অন্যরাও কি যাওয়ার পথে উন্মুখ হয়ে নেই? সর্বোপরি উৎপাদন, এবং ক্রয়-বিক্রয়ের মুনাফাটা যাচ্ছে কোথায়? বড় একটা অংশই তো পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে।

শিল্পোদ্যোক্তাদের একজনকে জানি, ব্যক্তিগতভাবে যিনি অত্যন্ত সজ্জন, পাচারে বিশ্বাসী নন; তিনি একটি বই লিখেছেন, যাতে দেশের যে উন্নতি হচ্ছে তার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রবৃদ্ধির।

একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকের প্রদত্ত তথ্য উদ্ধৃত করে তিনি এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানের হার অতি শিগগিরই ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। হয়তো তাই ঘটবে। কিন্তু এ উত্থানে উৎফুল্ল হব বুকের এমন পাটা কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নেই। কারণ, এ উন্নতির অর্থ দাঁড়াবে একদিকে দেশের সম্পদ পাচার হওয়া অন্যদিকে বেকার ও দরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি। উচ্চবিত্তরা তাদের সম্পদ তো বটেই, এমনকি সন্তানদেরও দেশে রাখছে না; ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে শিক্ষার জন্য বিদেশে গমনার্থীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
একটি পত্রিকা জানাচ্ছে গত ১০ বছরে ওই স্রোত দ্বিগুণ পরিমাণে স্ফীত ও বেগবান হয়েছে। পাশাপাশি এটাও আমাদের জানা আছে যে বাংলাদেশে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আসা ক্রমাগত কমছে।

নির্মম সত্যটা হলো, যতই উন্নতি ঘটছে ততই কমছে দেশপ্রেম। তাই বলে দেশপ্রেম কি একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছে? না, মোটেই নয়। দেশপ্রেম অবশ্যই আছে। বিশেষভাবে আছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে। তারা অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করবে, এমনটা ভাবতেই পারে না। বেশির ভাগই দেশে থাকে। পরিশ্রম করে। এবং তাদের শ্রমের ফলেই দেশের যেটুকু উন্নতি তা সম্ভব হয়েছে। ভোক্তারা নয়, মেহনতিরাই হচ্ছে উন্নতির চাবিকাঠি। ঋণ করে, জায়গাজমি বেচে দিয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের কেউ কেউ বিদেশে যায়; থাকার জন্য নয়, উপার্জন করে টাকা দেশে পাঠাবে বলে। বিদেশে গিয়ে অনেকেই অমানবিক জীবনযাপন করে, ‘অবৈধ’ পথে গিয়ে এবং প্রতারকদের কবলে পড়ে কেউ কেউ জেল পর্যন্ত খাটে। কিন্তু তারা বুক বাঁধে এ আশাতে যে দেশে তাদের আপনজনরা খেয়েপরে বাঁচতে পারবে। বিত্তবানরা যা ছড়ায় তাহলো হতাশা। এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এটাই তাদের স্থির বিশ্বাস। হতাশা কিন্তু তারাই সৃষ্টি করে। বিশেষ করে সম্পদ পাচার উন্নতির কাছে আমাদের প্রত্যাশাটা কী? অবশ্যই সুখ। কিন্তু উন্নয়ন কেবল যে নদীর গলা টিপে ধরছেকরার মধ্য দিয়ে। এই যে দেশে এখন ডলার সংকট চলছে, এবং যার ফলে সবকিছুর দাম বেড়েছে, তার প্রধান কারণ টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটা বিত্তবানদের কাজ। তারাই হতাশা সৃষ্টি করে এবং দেশের ভবিষ্যৎহীনতার বিশ্বাস ক্রমাগত বলীয়ান হতে থাকে। এবং নিজেদের ওই হতাশা তারা যে কেবল নিজেদের মধ্যেই আটকে রাখে তা নয়, অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত করে দেয়। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ হতাশা হচ্ছে একটি রোগ, শুধু রোগ নয়, সংক্রামক রোগ বটে। একাত্তরে যখন আমরা চরমতম বিপদের মধ্যে ছিলাম, মৃত্যুর শঙ্কায় দিবা-রাত সন্ত্রস্ত থাকতাম তখন অমন চরমতম বিপদ ও সীমাহীন অত্যাচারের মুখেও আমরা কিন্তু হতাশ হইনি; কারণ আমরা জানতাম আমরা কেউ একা নই, আমরা সবাই আছি একসঙ্গে এবং লড়ছি একত্র হয়ে। ১৬ ডিসেম্বরেই কিন্তু সেই ঐক্যটা ভাঙার লক্ষণ দেখা দিয়েছে; এবং কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে একেবারে খান খান হয়ে গেছে। সমষ্টি হারিয়ে গেছে, সত্য হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে উন্নতি করা, না পারলে কোনোমতে বেঁচে থাকা।

এমনটা কেন ঘটল? ঘটল এ কারণে যে, উত্থান ঘটল লুণ্ঠনের, জবরদখলের, ব্যক্তিগত সুবিধা বৃদ্ধির। এবং এসবই প্রধান সত্য হয়ে দাঁড়াল। একাত্তরে আমরা সমাজতন্ত্রী হয়েছিলাম, বাহাত্তরে দেখা গেল সমাজতন্ত্র বিদায় নিচ্ছে, পুঁজিবাদ এসে গেছে। এবং পুঁজিবাদেরই অব্যাহত বিকাশ ঘটেছে এ বাংলাদেশে। দেখা গেছে পরের সরকার আগেরটির তুলনায় অধিক মাত্রায় পুঁজিবাদী, এবং একই সরকার যদি টিকে থাকে তবে আগেরবারের তুলনায় পরেরবার পুঁজিবাদের জন্য অধিকতর ছাড় দিচ্ছে। পুঁজিবাদের বিকাশের প্রয়োজনে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার জন্য তো আমরা যুদ্ধ করিনি; পুঁজিবাদের বিকাশ তো পাকিস্তান আমলে বেশ গোছগাছ করেই এগোচ্ছিল। আমরা চেয়েছিলাম সবার মুক্তি; চেয়েছিলাম প্রত্যেকেই যাতে মুক্তি পায়।

দেশের মানুষ বিদেশে শিক্ষার জন্য যেমন যায়, তেমনি যায় চিকিৎসার জন্যও। বাংলাদেশে ভালো চিকিৎসকের কি অভাব আছে? আধুনিক যন্ত্রপাতি কি নেই? আকাল পড়েছে কি চিকিৎসা বিষয়ে জ্ঞানের? না, অভাব এসবের কোনো কিছুরই নয়। অভাব ঘটেছে একটা জিনিসেরই, সেটা হলো আস্থা। রোগী আস্থা রাখতে অসমর্থ হয় দেশি চিকিৎসকের চিকিৎসায়। তাই যাদের সামর্থ্য আছে তারা পারলে সিঙ্গাপুরে বা ব্যাংককে যায়, অত খরচে যারা অপারগ তারা চেষ্টা করে ভারতে যাওয়ার। এবং হতাশা যেমন, অনাস্থাও তেমনি- ভীষণ রকমের সংক্রামক।

আস্থার এ অভাবের কারণটা কী? কারণ হচ্ছে দেশি চিকিৎসকদের অধিকাংশই রোগীকে সময় দিতে পারেন না, পর্যাপ্ত মনোযোগ দানেও ব্যর্থ হন। না দিতে পারার কারণ তাঁদের তাড়া করার জন্য ঘাড়ের ওপর বসে থাকে অর্থোপাজনের নিষ্ঠুর তাগিদ। যত বেশি রোগী দেখবেন তত বেশি আয় হবে। রোগ সারানোর জন্য খ্যাত হওয়ার চেয়ে আগ্রহটা থাকে অপরের তুলনায় অধিক আয় করার দিকে। আমাদের নতুন স্বাস্থ্য উপদেষ্টাও দেখলাম আস্থার এ অভাবের কথাটা স্বীকার করেছেন। কিন্তু আস্থা কীভাবে ফেরত আনা যাবে তা যে তিনি জানেন এমনটা ভরসা করা কঠিন। আর জানলেও তা কার্যকর করার উপায় তাঁর হাতে না থাকারই কথা। কারণ ব্যাপারটা একজন-দুজন চিকিৎসকের নয়, ব্যাপারটা এমনকি চিকিৎসাব্যবস্থাতেও সীমাবদ্ধ নয়, এটি ছড়িয়ে রয়েছে গোটা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থাজুড়ে। সর্বত্রই আস্থাহীনতা বিরাজমান।

ভারতের পরিবর্তে চীনে চিকিৎসাসেবা গ্রহণের আলোচনা চলছে। বণিক চীন নাকি বিত্তবান বাংলাদেশিদের জন্য নিজ দেশে এবং বাংলাদেশেও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দেনদরবার করছে, সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে। অথচ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য একমাত্র চিকিৎসার আশ্রয় সরকারি হাসপাতালগুলোর উন্নয়নে অতীতের সরকারের ন্যায় বর্তমান সরকারও উদাসীন। গরিবের পক্ষে থাকার সরকার দেশবাসী আজও পায়নি, তাই।

শুরুটা কিন্তু দেশের ভবিষ্যতের প্রতি আস্থার অভাব দিয়েই। সুবিধাপ্রাপ্ত লোকেরা মনে করে যে এদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই অন্যত্র বসতি গড়তে পারলে ভালো। সেই চেষ্টাই তারা করতে থাকে। এবং চেষ্টার অংশ হিসেবে বৈধ-অবৈধ যে পথেই সম্ভব টাকাপয়সা যা সংগ্রহ করতে পারে তা পাচার করার পথ খোঁজে। তাদের এ আস্থাহীনতা অন্যদের মধ্যেও অতিসহজেই সংক্রমিত হয়ে যায়। এবং সংক্রমিত হয়ে যাচ্ছেও। কিন্তু আশা জাগানিয়ার পথ ক্রমাগত রুদ্ধ হয়ে পড়েছে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

গণতন্ত্র, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার দুঃশাসন

মো. আবদুর রাজ্জাক
মো. আবদুর রাজ্জাক
শেয়ার
গণতন্ত্র, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার দুঃশাসন
সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে যদি গণতন্ত্রের সুবাতাস প্রবাহিত হয় তাহলে সেখানে মানুষের বাকস্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আর যখন দেশে গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে তখন মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে স্বৈরতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটেছে এবং সেটাকে রোধ করার জন্য একজন মহান ব্যক্তির জন্ম হয়েছে, যার দক্ষ নেতৃত্বে স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটেছে।

তিনি স্বমহিমায় মানুষের হৃদয়পটে বীরের বেশে নেতা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন। যাকে মানুষ বরণ করে নিয়েছে ফুল দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে স্থান করে নিয়েছে মনের গভীরে, যা অম্লান। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র দেশ। এখানেও বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্রের লেবাস পরে দেশ শাসন করেছে স্বৈরশাসকরা।
ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে লড়াই-সংগ্রাম করে যারা স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।

একেবারে গৃহিণী থেকে কালের বিবর্তনে পরিপক্ব রাজনীতিবিদ। যার নামের আগে শোভা পায় দেশনেত্রী, আপসহীন নেত্রী, গণতন্ত্রের মানস কন্যা। যাকে কোনো লোভ-লালসা স্পর্শ করতে পারেনি।

যার হৃদয় কোমল, কিন্তু সিদ্ধান্তে ছিলেন হিমালয়ের মতো অটল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে যার নেতৃত্বে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার অদম্য সাহস, বজ্র কঠিন ভাষণ, দৃঢ় মনোবল, বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত, যা ছাত্রসমাজকে নতুন পথ দেখাতে উজ্জীবিত করেছিল। তার দিকনির্দেশনায় বাঙালি জাতি ফিরে পেয়েছিল গণতান্ত্রিক পরিবেশে গণতন্ত্র চর্চা করার সুযোগ।

বাঙালি জাতিকে হতাশায় ডুবিয়ে কোনো দিকনির্দেশনা না দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছিলেন, তখন বেগম খালেদা জিয়া পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মেজর জিয়াউর রহমানের পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছিলেন। তিনিও স্ত্রী-পুত্রের মায়া না করে দেশকে ভালোবেসে কোনো আপস না করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে সেনাবাহিনীপ্রধান, রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত
করেছিলেন। ওআইসিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হয়েছিলেন সমাদৃত। তিনি ছিলেন একজন নির্লোভ, নিরাহংকার, সদালাপী, পরোপকার, দেশপ্রেমিক একজন খাঁটি মুসলমান। সংবিধানে বিসমিল্লাহ তারই সংযোজন। বেগম খালেদা জিয়া ছায়ার মতো সঙ্গী হয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সব গুণ অর্জন করেছিলেন। যার সবটুকু তিনি দেশের সেবায় মানব কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন। 

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর দলের প্রয়োজনে তাকে দলের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। কখনো সম্মুখ সারিতে, কখনো আত্মগোপনে থেকে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে দেশকে উপহার দিয়েছেন সোনালি সূর্য। এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ যখন সমগ্র বাংলাদেশ অগ্নিগর্ভ তখন তার ব্যক্তিত্ব, উদারতা, মননশীলতা, ধৈর্য, ত্যাগ বজ্রকঠিন সিদ্ধান্ত দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা অন্ধকারে আলোকবর্তিকা হিসেবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পাশে থেকে গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন। পেয়েছেন সফলতা পাহাড়সম সম্মান, মর্যাদা। এরশাদ সরকারের ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে নামের আগে যুক্ত করেছেন আপসহীন নেত্রী অথচ শেখ হাসিনা তার অধীনে নির্বাচন করে খেতাব পেয়েছিলেন জাতীয় বেঈমানের। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। এমনভাবে বই-পুস্তক লেখা হয়েছে যাতে শেখ পরিবারের কথা ছাত্র-ছাত্রীরা মুখস্থ করতে করতে বড় হয়। স্বাধীনতার ঘোষক যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেই কথা প্রমাণসহ আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতার বইয়ের মধ্যে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তার বড় সন্তান তারেক জিয়া, যার শ্বশুর নৌবাহিনীপ্রধান, তার স্ত্রী একজন দেশে এবং বিদেশে স্বনামধন্য চিকিৎসক। তার মেয়ে জায়মা রহমান একজন ব্যারিস্টার। বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান বাংলাদেশ ক্রিকেটের আধুনিক রূপকার। অথচ এই পরিবারকে ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী সহ্য করতে পারতেন না। ঈষান্বিত হয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অশালীন মন্তব্য সব সময় করতেন, যা দেশপ্রেমিক জনগণও সুশীল সমাজের নিকট কাম্য ছিল না। 

বেগম জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেছেন, কী খেলে লিভার সিরোসিস হয়, মরার বয়স হয়েছে এখানো কেন মরে না, অথচ ৫ আগস্ট গণভবন থেকে বের হওয়ার পর অনেক মানুষের হাতে বিদেশি দামি মদের বোতল দেখা গেছে। গণতন্ত্রের অহংকার, স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ, তারুণ্যের অহংকার, কোটি মানুষের নয়নমণি তারেক জিয়াকে কুলাঙ্গার বলেছেন। অথচ তারেক জিয়া একবার গোপালগঞ্জে গেলে শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করেছিলেন। এটা হলো জিয়া পরিবারের পারিবারিক শিক্ষা। ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী বলতেন, দশটা হুন্ডা, বিশটা গুণ্ডা, নির্বাচন ঠাণ্ডা।

ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী বলতেন, ‘আমার শুধু পাওয়ার চাই’। তিনি পাওয়ার নিয়েই ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালে দিনের ভোট রাতে করে গণতন্ত্রকে হত্যা করে স্বৈরশাসক পদবি পেয়েছিলেন। তিনি দেশ এবং দেশের মানুষদের নিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে যা ইচ্ছা, তাই করেছিলেন, কিন্তু মানুষের মন জয় করতে পারেননি। তার আমলে কত মায়ের বুক খালি হয়েছে। হত্যা, খুন, গুম, জেল, জুলুম, আয়নাঘর সবই ফ্যাসিস্ট সরকারের অত্যাচারের জ্বলন্ত উদাহরণ। কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, কত সন্তান বাবা হারিয়েছে, কত মা সন্তান হারিয়েছে, কত স্ত্রী স্বামী হারিয়েছেন। তাদের কান্না ও চোখের পানিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছে। অথচ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার হৃদয় গলেনি।

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের জননী তাকে বিনা দোষে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় যে টাকা তিনি স্পর্শ করেননি তাকে শেখ হাসিনা নাজিম উদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মানবতার সব দিক বিসর্জন দিয়ে, মেরে ফেলার জন্য দিনের পর দিন বিনা চিকিৎসায় কারাগারে ফেলে রেখেছিলেন। আত্মীয়-স্বজন, চিকিৎসক—এমনকি আইনজীবীদের সঙ্গেও দেখা করতে দেননি। ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ছাড়ার সময় এবং কেন্দ্রীয় কারাগারে বেগম জিয়ার চোখের পানি আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছে অথচ শেখ হাসিনার হৃদয় গলেনি মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তার প্রমাণ শেখ হাসিনা নিজেই। কতটুকু হৃদয়হীন হলে শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে বলতে পারেন, মরার বয়স হয়েছে এখনো মরে না কেন, পদ্মায় চুবানোর কথা বলেছেন। আমাদের বাড়িতে গেলে বসার জায়গা পেত না, মোড়ায় বসত। যা ছিল শিষ্টাচারবহির্ভূত। অথচ সর্বকালের সেরা রাষ্ট্রপতি বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন।

বেগম খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার বহু ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। সব ষড়যন্ত্র থেকে তাকে রক্ষা করেছেন আল্লাহ এবং দেশের জনগণের ভালোবাসা। তিনি বলেছিলেন, বিদেশে আমার কোনো বাড়ি-ঘর নেই। এটাই আমার দেশ। তিনি দেশের জনগণকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছেন বলেই তাদের দোয়ায় তিনি বেঁচে আছেন। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন তিনি দেশপ্রেমিক জনগণের মনের মণিকোঠায় অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে গণতন্ত্রের মানস কন্যা হিসেবে ভালোবাসার প্রতীক হয়ে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে যথার্থই বলা যায়—
She is the man of honour, principle, mother of Democracy and humanity in a true sense.

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান সমাজকর্ম বিভাগ, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ, ঢাকা।

মন্তব্য

শিষ্টাচারের রাজনীতি এবং বেগম জিয়া

    অদিতি করিম
শেয়ার
শিষ্টাচারের রাজনীতি এবং বেগম জিয়া
ফাইল ছবি

রাজনীতিতে এখন প্রতিহিংসা, আক্রমণ, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অসহিষ্ণু প্রবণতা বেড়েছে ভীষণ। পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ যেন লোপ পেয়েছে। রাজনীতির মাঠে এখন কুৎসিত নোংরামি এবং কাদা ছোড়াছুড়ির জয়জয়কার। সহনশীলতা শব্দটি যেন আজ বিলুপ্ত।

এক পক্ষ অন্য পক্ষকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করা, এমনকি প্রয়াত ব্যক্তিদের অসম্মান করার একটি রীতি আতঙ্কজনকভাবে বেড়ে গেছে। কিন্তু এটি প্রকৃত রাজনীতি নয়। এটি রাজনীতির শিক্ষাও নয়। রাজনীতি হলো রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল।

রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা সমাজের আদর্শ। তাঁরা সমাজকে পথ দেখান। একটি রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে তার পথনির্দেশ নির্মাণ করেন। কাজেই রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে দেশের জনগণ শিখবে, এটিই সবার প্রত্যাশা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের রাজনীতি এখন যেন প্রতিহিংসার প্রতিযোগিতা, ভিন্নমতকে খতম করাই যেন আজকের রাজনীতির প্রধান কৌশল। বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে মতের অমিল থাকবে, বিরোধ থাকবে, কিন্তু এই বিরোধ সহিংসতার পথে পা বাড়াবে না। রাজনীতিতে শিষ্টাচার, প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা অত্যন্ত জরুরি। ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করা বরেণ্য রাজনীতিবিদরা এই বৈশিষ্ট্যগুলোর চর্চা করেছেন তাঁদের জীবনে। এই বৈশিষ্ট্য একজন রাজনীতিবিদকে পরিণত করে, বড় করে এবং আদর্শবান করে তোলে।

এই রাজনৈতিক শিষ্টাচারের জন্যই তাঁকে জনগণ শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। তাঁরা অনুকরণীয় হন। কিন্তু কিছুদিন ধরে রাজনীতিতে যেমন বিভক্তি দেখা দিচ্ছে, বিভক্তির সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিহিংসা। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে নির্মমভাবে আক্রমণ, সুযোগ পেলেই প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করে দেওয়া এবং যেকোনো ভিন্নমত হলেই তাকে অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ ভাষায় দমন করা, কখনো কখনো পাশবিক শক্তি প্রয়োগের একটা হিংস্র প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনীতিতে হিংস্রতা এবং ভাষাজ্ঞানহীন কথাবার্তার প্রবণতা বাড়ছে। একজন প্রতিপক্ষের রাজনীতিবিদকে কী ভাষায় কথা বলতে হবে, ভিন্নমতের ব্যাপারে কী ধরনের শিষ্টাচার দেখাতে হবে, সেই বোধগুলো আমাদের রাজনীতি থেকে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

এ রকম একটি অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিবেশে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম খালেদা জিয়া। তিনি রাজনীতিতে শিষ্টাচারের এক প্রতীক হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছেন। বিশেষ করে ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর তিনি যখন প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায় মুক্তিলাভ করেন, এর পর থেকে তাঁর প্রতিটি আচরণ এ দেশের মানুষকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে। দল-মত-নির্বিশেষে সবাই তাঁর প্রাজ্ঞ উদারতা, ধৈর্য ও ক্ষমাশীলতায় মুগ্ধ। এই মুহূর্তে রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি খালেদা জিয়া। নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে সব মানুষের হৃদয় জয় করেছেন তিনি। তাঁর পরিমিতিবোধ, ব্যবহার, আচার-আচরণ এবং সংযত কথাবার্তা এ দেশের শান্তিকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। খালেদা জিয়া সেই বিরল রাজনীতিবিদদের একজন, যিনি জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য গৃহবধূ থেকে রাজনীতির মাঠে এসেছিলেন। তাঁর আপসহীন নেতৃত্ব, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অবস্থান এবং জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধের কারণে বারবার নিপীড়িত-নির্যাতিত হয়েও তিনি তাঁর নীতি এবং আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন, কিন্তু সেই সমালোচনা কখনো শিষ্টাচারবহির্ভূত হয়নি। অশালীন নোংরামির পর্যায়ে যায়নি। তিনি কোনো সময় প্রয়াত রাজনীতিবিদদের অসম্মানসূচক, অসত্য, কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করেননি, আক্রমণ করেননি। এই ধারাটি তিনি অব্যাহত রেখেছেন গোটা রাজনৈতিক জীবনে। রাজনীতিতে নিজের অবস্থান আদর্শ থেকে এতটুকু চ্যুত না হয়েও যে একজন রাজনীতিবিদ শিষ্টাচার মেনে চলতে পারেন, নম্র ভদ্রোচিত ভাষায় তীব্র সমালোচনা করতে পারেন, সেই নজির তিনি রেখেছেন তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে। জনগণের প্রয়োজনে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে বৈঠক করতে কার্পণ্য করেননি। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ব্যক্তির চেয়ে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন সব সময়। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময়। সে শিষ্টাচারের রাজনীতি এবং বেগম জিয়াসময় খালেদা জিয়াকে ড. ফখরুদ্দীন সরকার মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে। শুধু তাঁকে নয়, তাঁর দুই পুত্রকেও গ্রেপ্তার করা হয়। চলে চরিত্র হননের চেষ্টা। এই সময় খালেদা জিয়া আপস করেননি। কারাগার থেকে বেরিয়ে যখন তিনি আবার রাজনীতিতে এসেছেন, তখন এক-এগারোর কুশীলবদের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু সেই সমালোচনাটা শালীনতার সীমা কখনো অতিক্রম করেনি। বেগম জিয়া সম্ভবত সাম্প্রতিক সময়ে একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি অশালীন শব্দ প্রয়োগ ছাড়াই বিরোধী পক্ষের কঠোর সমালোচনা করেন। এক-এগারোর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে একটি অসত্য, ভিত্তিহীন মিথ্যা মামলায় তাঁকে প্রহসনের বিচারে নজিরবিহীনভাবে আটকে রাখা হয় কারাগারে। দিনের পর দিন কারা প্রকোষ্ঠে রেখে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। এই অবস্থায় তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকেই মনে করেছিলেন যে খালেদা জিয়া যদি কখনো সুযোগ পান, তাহলে হয়তো ভয়ংকর প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু বেগম জিয়া যেন তাঁর ওপর সব নিপীড়নের বিচারের ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর ওপর নিপীড়নের ব্যাপারে একটি কথাও বলেননি। ৫ আগস্ট মুক্ত হয়ে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে একটি কটূক্তিও করেননি। এমনকি তাঁর নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। নোংরা ভাষায় কথা বলেননি। তিনি শুধু বলেছেন, ‘আল্লাহ বাংলাদেশের জনগণকে এই দিনটি দেখালেন, আলহামদুলিল্লাহ।’ এর বেশি তিনি কোনো কথা বলেননি। অথচ বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে নিপীড়িত-নির্যাতিত ব্যক্তির নাম হলো খালেদা জিয়া। সাবেক সরকারের পাতি নেতারাও বেগম জিয়া সম্পর্কে যে কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন, তা চিন্তা করাও কুরুচির পরিচয় বহন করে। কিন্তু এসব অমার্জনীয় নোংরামির জবাব না দিয়ে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। নীরবতাই তাঁর শক্তি। তাঁর প্রতিবাদহীনতাই যেন মানুষের ভালোবাসা। তাঁর তো সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ করার কথা ছিল, কিন্তু তাঁর পারিবারিক ও রাজনৈতিক এই শিক্ষা তাঁকে সেই স্বীকৃতি দেয়নি। বরং তিনি তাদের শুধু নীতির সমালোচনা করেছেন। তাদের ভোট চুরির সমালোচনা করেছেন। তাদের লুণ্ঠনের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু কোনো ব্যক্তিকে নোংরা, কুৎসিত ভাষায় তিনি আক্রমণ করেননি। খালেদা জিয়ার এই ধরনের রাজনৈতিক শিষ্টাচার আজকের দিনে সবার জন্য অনুকরণীয়।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে খালেদা জিয়ার বাড়ি থেকে তাঁকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, যে বাড়িতে তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বামী শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন। ক্যান্টনমেন্টে শহীদ মইনুল হোসেন সড়কের বাড়িটি কেবল একটি বাড়ি ছিল না, এটি ছিল ইতিহাসের একটি অংশ। সেই বাড়ি থেকে যখন তাঁকে এক কাপড়ে বের করে দেওয়া হয়, তখনো খালেদা জিয়া রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে যাননি। নোংরা, কুৎসিত ভাষায় তিনি কথা বলেননি। এমনকি বাড়ি নিয়ে নজিরবিহীন অপপ্রচারে তিনি জবাব দেননি। খালেদা জিয়া মূলত এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি একজন আদর্শবান, জাতির অভিভাবকের মতোই আচরণ করেন। সবার ঐক্য, দেশের ভালো, দেশের মঙ্গল—এই বিষয়গুলো তাঁর সমস্ত বক্তব্যের মধ্যে উৎসারিত। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর খালেদা জিয়া কারাগার থেকে বেরিয়ে চিকিৎসার জন্য যান লন্ডনে, সেখানে ঈদ করেন তাঁর পুত্রের সঙ্গে। যুক্তরাজ্য থেকে তিনি ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে। সেখানেও তিনি বিভক্তির কথা বলেননি। অনৈক্যের কথা বলেননি, ধ্বংসাত্মক কথাবার্তা বলেননি, উসকানিমূলক বক্তব্য দেননি। এটিই একজন আদর্শ রাজনীতিবিদের বৈশিষ্ট্য। একজন রাজনীতিবিদ যে পরিশীলিত ভাষায় কথা বলেই জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, তাঁর আদর্শের অবস্থানটা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করার জন্য তাঁকে কোনো নোংরা বা অরুচিকর কথাবার্তা বলতে হয় না, তার প্রমাণ খালেদা জিয়া। আর এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন উজ্জ্বল নক্ষত্র বেগম জিয়া। ৮০ বছর হতে চলল তাঁর। কিন্তু এখনো সাধারণ জনগণের মধ্যে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা। বিশেষ করে এই সময় যখন রাজনীতিতে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে নিঃশেষ করে দিতে চায়, এক পক্ষ অন্য পক্ষের চরিত্র হননের জন্য অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করে, সেই সময় খালেদা জিয়া যেন জাতির এক আলোকবর্তিকা। তিনি সব রাজনীতিবিদের জন্য একজন শিক্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। কিভাবে রাজনীতিবিদদের কথা বলতে হয়, সমালোচনা করেও কিভাবে মানুষকে সম্মান জানাতে হয়, সেটির উদাহরণ হলেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া প্রতিশোধপ্রবণ নন। তিনি এক উদার গণতান্ত্রিক চেতনার ধারক-বাহক। এ কারণেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে অন্যায়-অবিচারগুলো করা হয়েছে, সেই অন্যায়-অবিচারগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তিনি দিয়েছেন দেশের আপামর জনগণকে। তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে এ পর্যন্ত কিছু কথা বলেছেন জনগণের উদ্দেশে, কিন্তু একটিবারও নিজের কথা বলেননি। জনগণের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা বলেছেন, নতুন করে দেশ বিনির্মাণের কথা বলেছেন। এটি তাঁর মহত্ত্ব। আমাদের রাজনীতিতে এখন উদারতার বড় অভাব, মহত্ত্বের বড় অভাব। এ রকম অবস্থায় বেগম জিয়ার মতো একজন অনুকরণীয় উদাহরণ বড় প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ রাজনীতিতে প্রতিহিংসা, কুৎসিত আক্রমণ, গালাগালি ইত্যাদি পছন্দ করে না। আর পছন্দ করে না বলেই খালেদা জিয়া এখন অনিবার্যভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। তিনি নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যেখানে দল-মত-নির্বিশেষে সব মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করে। সব মানুষ মনে করে যে এ রকম একজন রাজনীতিবিদই যেন দেশের জন্য প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ মনে করে, এ দেশের হাল ধরার মতো সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হলেন তিনি। তিনিই যেন বাংলাদেশের অভিভাবক। একজন মানুষের জনগণের প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেম এবং পারিবারিক শিক্ষা যে তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে, বেগম জিয়া তার প্রমাণ। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, যিনি প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেন না, বরং জনগণের হাতে তার বিচারের ভার ছেড়ে দেন। জনগণের বিপুল জনপ্রিয়তায় তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন। পেশিশক্তি প্রয়োগ বা কটূক্তি করে নয়, বরং জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন।

 লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক

E-mail : auditekarim@gmail.com

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
দৃষ্টিপাত

সোশ্যাল মিডিয়ার বিকৃত রুচি— শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মনুষ্যত্বের অবক্ষয়

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

শেয়ার
সোশ্যাল মিডিয়ার বিকৃত রুচি— শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মনুষ্যত্বের অবক্ষয়
প্রতীকী ছবি

আজকের ডিজিটাল যুগে সোশ্যাল মিডিয়া শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি হয়ে উঠেছে অর্থোপার্জনের হাতিয়ার, সমাজের রুচির দর্পণ, এমনকি নৈতিকতার মাপকাঠি। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা যখন কেবল অশালীনতা, ভাঁড়ামি আর সস্তা সেন্সেশনের উপর নির্ভর করে, তখন তা সমাজের জন্য এক ভয়াবহ সংকটের ইঙ্গিত দেয়। একজন নারী যখন টাওয়েল বা নাইটি পরে নাচলে লাখো ভিউ পায়, আর একজন গুণী কবি বা জ্ঞানী ব্যক্তির কথায় মানুষ নাক সিঁটকায়, তখন বুঝতে হবে আমাদের সমাজের মূল্যবোধ কোথায় হোঁচট খাচ্ছে।

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো আজ মনিটাইজেশনের লোভে মানুষের নৈতিকতা ও লজ্জাকে পণ্যে পরিণত করেছে।

দেবরকে আজ যা দিলাম!—এমন ক্যাপশনে কৌতূহল জাগিয়ে ভিডিও তৈরি করলে তা ভাইরাল হয়, কিন্তু সমাজসংস্কার, শিক্ষা বা শিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপেক্ষিত থেকে যায়। এখানে কবিতার চেয়ে বক্ষ প্রদর্শন বেশি মূল্য পায়, জ্ঞানের চেয়ে খিস্তির কদর বেশি। যেন মানুষ এখন শুধু চায় উত্তেজনা, চায় অশ্লীলতার মাঝে হারিয়ে যেতে। এমনকি মাঝবয়সী নারীরাও আজ প্রেমের কবিতা পড়ার চেয়ে শারীরিক প্রদর্শনেই বেশি সাড়া পাচ্ছেন।

কমেডির নামে আজ যা চলছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অশ্লীলতা ও খিস্তির মিশেল। পাবলিক হাসছে, কিন্তু সেই হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে আমাদেরই রুচির দৈন্য। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, সমাজের উন্নতি ঘটে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার মাধ্যমে, নাইটি বা শারীরিক প্রদর্শনের মাধ্যমে নয়। যখন একজন মা-বোন স্কুলের পড়া ছেড়ে রিলস বানাতে উৎসাহিত হন শুধু টাকার লোভে, তখন আমাদের ভাবতে হবে—আমরা আসলে কোন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছি?

মনিটাইজেশনের এই উন্মত্ততা আমাদের নতুন প্রজন্মকে কী শিক্ষা দিচ্ছে? তারা শিখছে যে, পড়াশোনা বা সততার চেয়ে সস্তা সেলিব্রিটি হওয়াটাই বড় সাফল্য।

তারা দেখছে, সমাজে সম্মান পেতে হলে বুকের খাঁজ দেখাতে হবে, দেবর-ভাসুর নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কন্টেন্ট বানাতে হবে। এভাবে কি আমরা একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারব? নাকি আমাদের সন্তানদের হাতে তুলে দেব শুধু বিকৃত রুচি আর নৈতিক অধঃপতনের উত্তরাধিকার?

সময় এসেছে জেগে ওঠার। সোশ্যাল মিডিয়ার অপসংস্কৃতি রোধ করতে হবে। প্যারেন্টস, টিচার্স ও ইনফ্লুয়েন্সারদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, পেট চালানোর জন্য নৈতিকতা বিক্রি করা কখনই সমাধান নয়।

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি ফিরে যেতে হবে। নইলে একদিন আমাদের সন্তানরা প্রশ্ন করবে—আপনারা আমাদের জন্য কী রেখে গেলেন? নাইটি নাচ, নাকি জ্ঞানের আলো? উত্তর দিতে পারব কি?

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ