<p>ফরাসি বিজ্ঞানী সাদি কার্নো ১৮২৪ সালে প্রথম সূত্রটা প্রস্তাব করেছিলেন। অবশ্য সেটা তিনি পেয়েছিলেন তাপ ইঞ্জিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে। তিনি বলেছিলেন, এমন কোনো তাপীয় ইঞ্জিন বা যন্ত্র তৈরি সম্ভব নয়, যেটা প্রয়োগ করা তাপ বা শক্তির সবটুকু কাজে পরিণত করতে পারবে। অর্থাৎ কিছু না কিছু তাপ বা শক্তি অপচয় হবেই।</p> <p>একই সূত্রকে লর্ড কেলভিন আর জেমস ক্ল্যার্ক ম্যাক্সওয়েল ব্যাখ্যা করেছিলেন, একটু অন্যভাবে, কোনো বদ্ধ সিস্টেমে বাইরে থেকে কোনো শক্তি প্রয়োগ না করলে, স্বতস্ফূর্তভাবে উচ্চ তাপমাত্রার বস্তু থেকে তুলানামূলক কম তাপমাত্রার বস্তুতে তাপ প্রবাহিত করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ এমন কোনো যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব নয়, যা উচ্চ থেকে নিম্নতাপমাত্রার দিকে তাপ প্রপবাহিত করতে পারে। এটা তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র নামে বিখ্যাত।<br /> কার্নোর এই সূত্র থেকে একটা বিষয় পরিস্কার হয়, কোনো যন্ত্রকেই এক বার চালু করলে অবিরাম কাজ করে যাবে না। একে চালাতে হলে, বাইরে শক্তির জোগান দিয়ে যেতে হবে। আবার আপনি যন্ত্রটা চালানোর জন্য যে পরিমাণ শক্তির জোগান দিচ্ছেন, তার সবটুকুই কাজে পরিণত হবে না। খুব সামন্য হলেও কিছু শক্তি নষ্ট হবে। এ জন্যই পারপেচুয়াল মোশনের কোনো যন্ত্র তৈরি সম্ভব নয়। </p> <p>তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রটাকে একটা সংজ্ঞার ভেতরে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন রুডলফ ক্লসিয়াস। তিনি বলেন, তাপ সব সময়  উষ্ণ বস্তু থেকে শীতল বস্তুতে প্রবাহিত হয়,  স্বতঃস্ফূর্তভাবে কখনোই তাপ শীতল বস্তু থেকে উষ্ণ বস্তুতে প্রবাহিত হয় না। </p> <p>এটা কেন ঘটে?  শীতল বস্তু থেকে উষ্ণ বস্তুর দিকে তাপ প্রবাহিত  হতে বাধা কোথায়? শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি কী বলে? </p> <p>আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়  শীতল বস্তু থেকে উষ্ণ বস্তুতে তাপ প্রবাহিত হতে অন্তত শক্তির সংরক্ষণশীলতার পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই।</p> <p>কিন্তু ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? প্রাকৃতিকভাবে,  অর্থাৎ বাইরে থেকে আলাদাভাবে শক্তি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন হয় না, এরকম একটা ব্যবস্থা। রেফ্রিজারেটর বা হিমাগারে  শীতল বস্তু থেকে উষ্ণ বস্তুর দিকে তাপ প্রবাহের ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। রেফ্রিজারেটরের তাপমাত্রা অনেক কম।  কিন্তুে এটা যেখানে রাখা হয়, সেখানে আশপাশের সব বস্তু উষ্ণ। যদিও রেফ্রিজারেটর একেবারে বদ্ধ একটা প্রক্রিয়া। বায়ু ও তাপরোধী দেয়াল দিয়ে ঘেরা। তারপরেও এর ভেতর থেকে তাপ বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। অর্থাৎ ফ্রিজের ভেতরের শীতল স্থান থেকেও তাপ বের করে দেওয়া হয় তুলনামুলক উষ্ণ বায়ুমণ্ডলে। এর জন্য ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ শক্তির সাহায্যে অনেকটা জোর করেই রেফ্রিজারেটরের ভেতর থেকে তাপ বাইরে বের দেয়া হয়। ফলে রেফ্রিজারেটর ভেতরটা সবসময় ঠান্ডা থাকে।  কিন্তু এ ব্যবস্থা স্বতঃস্ফূর্ত নয়।  এখানে রীতিমতো শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে।</p> <p>তারপরেও প্রশ্ন একটা থেকে যায়, কেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিম্ন তাপমাত্রা থেকে উচ্চ তাপমাত্রার দিকে তাপ প্রবাহিত হয় না? শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি কি বাধা দেয়? ওই নীতিতে তো এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু লেখা নেই?</p> <p>তাহলে বাধাটা কোথায়?</p> <p>একটা গরম লোহার পাত কে কোথাও ফেলে রাখুন, কিছুক্ষণ পর ঠান্ডা হয়ে যাবে।  পরিবেশের তাপমাত্রায় না আসা পর্যন্ত গরম লোহা থেকে তাপ বাতাসে বা পরিবেশে প্রবাহিত হবে। কখনোই গরম বস্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে আরও গরম হবে না।  সংরক্ষণশীলতার নীতির বাধা নেই, তাহলে বাধাটা কোথায়? সেই ব্যাপারটাই আবিষ্কার করেন ক্লসিয়াস।  তিনি এর নাম দেন এনট্রপি। এনট্রপির সরল বাংলা আসলে বিশৃঙ্খলা।  সিস্টেমে বা কোন যন্ত্রে এই বিশৃঙ্খলা সব সময় বাড়তেই থাকে। কখনোই এনট্রপি কমে না। এজন্যই আপনি একটা গ্লাস হাত থেকে পড়ে ভেঙে যেতে দেখবেন। কখনোই ভাঙা গ্লাসকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জোড়া লাগতে দেখবেন না। এটাই আসলে এনট্রপি।  ইঞ্জিনে, ঘরে-বাইরে, পৃথিবীতে, গ্যালাক্সিতে অর্থাৎ গোটা  মহাবিশ্বেই এনট্রপি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।<br /> কিন্তু এনট্রপি বাড়ার কারণ  কি?</p> <p>ওই  যে কার্নো বলেছিলেন, কোন বস্তু থেকেই শতভাগ কাজ আদায় করা সম্ভব নয়, শক্তির খানিকটা অপচয় হবেই। এই অপচয়ই আসলে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। এটাকে রোধ করার কোন উপায় নেই। এই যে শক্তিটা অপচয় হচ্ছে,  এটাই আসলে বিশৃঙ্খলা তৈরির জন্য দায়ী। এই বিশৃঙ্খলা এমন একটা জিনিস যেটা সব সময় একমুখী।  কখনো বিপরীতমুখে হবে না।</p> <p><strong><span style="background-color:#2c3e50;">২.</span></strong><br /> কোনো ঘটনার সঙ্গে এনট্রপির সম্পর্ক সমান্তরাল। অর্থাৎ ধ্রুবক। ঘটনা বা কাজ যত সামনে এগোয় এনট্রপি তত বাড়ে। ধরা যাক, ঘটনাটা বা কাজটা একটা সময় শেষ হয়ে গেল। থেমে গেল এনট্রপিও। কিন্তু কাজের শুরুতে এনট্রপি যতটুকু ছিল কাজের শেষে তারচেয়ে বেশি। এখন কাজটা যদি আবার পেছন দিকে ঘটতে দেওয়া হয় তবে কাজের এনট্রপিও কমবে। পুরো ব্যাবস্থাটিকে যদি পিছন দেকে ঘটিয়ে শুরুর অবস্থা নেওয়া যায়, তবে এনট্রপিও আগের জায়গায় ফিরে যাবে। <br /> এটা শুধু  তত্ত্বেই সম্ভব। বাস্তবে কি কোনো কাজ পেছন দিকে ঘটানো সম্ভব? সম্ভব নয়। সময় পেছন দিকে ফেরে না কখনো। তাই কোনো কাজকেই উল্টোদিকে প্রবাহিত করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ধরা যাক, একটা কাচের গ্লাস আপনার হাত থেকে পড়ে গেল। এই ঘটনাকে কি পেছন দিকে ফেরানো সম্ভব? </p> <p>সম্ভব নয়। তাই এই ঘটনার সাথে সাথে এনট্রপি বেড়ে গেলো, সেটাও আর কমিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। অর্থাৎ মহাবিশ্বের এনট্রপি বেড়েই চলেছে ক্রমাগত। একে আর পেছনে ফেরানো সম্ভব নয়। এক কথায় বলতে গেলে এনট্রপি হলো মহাজাগতিক তাপীয় বিশৃংখলা। মহাবিশ্বের প্রতিটা ঘটনার সাথে সাথে এটা বেড়ে চলে এবং চলবে অনন্তকাল। </p> <p>এনট্রপি নিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীরা তো মহা ঝামেলায় পড়ে যান। অনেকই ভাবতে শুরু করেন, এনট্রপি হয়তো শক্তির সংরক্ষণ নীতি লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু এনট্রপির সামাধান বের করতে পারেননি কোনো বিজ্ঞানী। অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞান লুডভিক বোলজম্যান আত্মহত্যাই করে বসেন, এনট্রপির ব্যাপারটা মেনে নিতে না পেরে। বোলজম্যান যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন না, সবসময় এনট্রপি কেন বেড়েই চলে। এনট্রপি যদি এখন এত বেশি হয়, বেড়েই চলে, তাহলে অতীতে কেন কম ছিল? এই প্রশ্নের জবাব দিনের পর দিন না পেয়ে তিনি বিষণ্ণতায় ভোগেন। ক্রমে ক্রমে মানসিক রোগিতে পরিণত হন। শেষমেষ আত্মহত্যা করে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি খোঁজেন।</p> <p>কিন্তু নিউটনীয় গতিবিদ্যায় এনট্রপি কমা সম্ভব। আপনার হাত থেকে পড়া কাচের গ্লাসটি উল্টো দিকে গিয়ে জোড়া লাগতে পারে। সেজন্য টুকরো টুকরো হওয়া গ্লাসটি একত্রিত হয়ে জোড়া লাগবে। আবার ধীরে ধীরে ওপর দিকে উঠে আপনার হাতে এসে ঠায় নেবে। তাত্ত্বিকভাবে এটা ঘটা সম্ভব। অবশ্য সে জন্য সময়কেও পিছিয়ে বর্তমান থেকে অতীতের দিকে পিছিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কখনোই এমন ঘটনা ঘটতে দেখি না।</p> <p>তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র বলে, আপনার হাতে যে আস্ত গ্ল্যাসটি আছে, তার তুলনায় মাটিতে ভেঙে পড়া গ্ল্যাসটির বিশৃংখলা বেশি। তারমানে এনট্রপিও বেশি। তাই মহাবিশ্বের এনট্রপি দিন দিন বেড়েই চলেছে। </p> <p>এনট্রপি কমাতে হলো সময়ের উল্টোস্রোতে গিয়ে আগের কাজটিকেই উল্টোদিকে প্রক্রিয়ায় করতে হবে।  </p> <p>আরো নির্দিষ্ট করে এনট্রপির বিষয়টা বোঝা যেতে পারে। ধরা যাক, একটা একটা গ্লাস ভরা আছে। পাত্রটি আছে নির্দিষ্ট একটা তাপমাত্রা ও চাপে। আপনি তাপমাত্রা ও চাপকে পরিবর্তন করতে পারবেন না। এই অবস্থায় গ্যাসের অণুগুলিকে ঠিক কতরকমভাবে সাজাতে পারবেন। সেটা লগারিদম করে একটা মান পাবেন। সেটাই ওই বাক্সের এনট্রপি বলে। আসলে একই তাপমাত্রা আর চাপে একই বাক্সের ভেতর নানা দশায় থাকতে পারে। সেই দশাগুলিই হলো এনট্রপি। এখন আরেকটা গ্যাস ভর্তি বাক্স যদি এই বাক্সের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। তারপর দুই বাক্সের বিভাজক দেয়াল সরিয়ে নিন। এতে এক বাক্সের অণু অন্য বাক্সে সহজেই যাতায়াত করতে পারবে। জোড়া দেওয়ার পর দুই বাক্সের মিলিত অণুর সংখ্যা প্রথম বাক্সটির চেয়ে অনেক বেশি। তাই মিলিত বাক্সের অণুগুলি দশার সংখ্যাও বেড়ে যাবে। তাই বেড়ে যাবে এনট্রপি। আর এই এতগুলো দশার যে হিসাব, সাধারণ বীজগণিতের নিয়মে তা গোণা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার পরিসংখ্যান আর সম্ভাবনা তত্ত্বের। আর এই কাজটিই প্রথম করেন বোলজম্যান।</p> <p><span style="color:#2c3e50;"><strong>৩.</strong></span><br /> পরমাণু জিনিসটা কী তা নিয়েই ধোঁয়াশা ছিল, যতদিন না আইনস্টাইন ব্রাউনীয় গতির ব্যাখ্যা দিয়ে পরমাণুর অকাট্য প্রমাণ হাজির করছেন। পরমাণু ধারণা মানতে হতো বিজ্ঞানীদের, নইলে রসায়ন যে অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু রসায়নের স্বার্থে পরমাণুবাদের সঙ্গে আপোষ করলেও সেটাতে বিশ্বাসী লোকের বড্ড অভাব ছিল। বোলজম্যান ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। পরমাণুর ওপর আস্থা রেখেই তিনি তাপগতিবিদ্যার সূত্র কিংবা এনট্রপির মতো জটিল ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। পরমাণু দিয়েই তিনি প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন।</p> <p>তাপ কী- এটা নিয়েও সন্দেহ ছিল বিজ্ঞানীদের মধ্যে। তাপ কীভাবে উৎপন্ন হয়- এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা তখনকার বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিল না। তাঁরা মনে করতেন, তাপ প্রকৃতির সম্পূর্ণ সতন্ত্র একটা ঘটনা। কিন্তু বোলজম্যান বলেন, তাপ উৎপন্ন হয়৷ বস্তুর ভেতরে থাকে পরমাণুগুলোর এলোমেলো গতির কারণে।</p> <p>পরমাণুতেই যখন বিজ্ঞানীদের অবিশ্বাস, সেখানে পরমাণুদের এলোমেলো গতির কথা মানবেন কেন! সেটা মানেনওনি। </p> <p>তাপের মতো এনট্রপির ব্যাখ্যা দিতেও বোলৎজম্যান হাত বাড়ালেন ‘অপ্রমাণীত’ পরমাণু তত্ত্বের দিকে। বললেন, একটা বস্তুতে যে পরিমাণ পরামাণু আছে, তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে সাজান বা বিন্যস্ত করুণ। কগুলো সংখ্যা পাবেন। পরমাণুর পরিমাণ যত কম হবে, তাদের তত কম উপায়ে বিন্যাস্ত করতে পারবেন। কিন্তু পরমাণুর সংখ্যা যত বেশি হবে, তাদের তত বেশি উপায়ে বিন্যাস্ত করতে পারবেন। বিন্যস্তের সংখ্যা যত, বস্তুটির এনট্রপির মানও তত। </p> <p>ধরা যাক, আপনার কাছে খুব ছোট একটা বস্তু আছে। তাতে পরমাণু আছে মোট ৩ টি। সেগুলোর একটা করে নাম দিন- A, B ও C। এই পরমাণুগুলো কত ভাবে সাজাতে পারবেন দেখা যাক- ABC, ACB, BAC, BCA, CAB ও CBA। মোট ছয়টি উপায়ে সাজাতে পারছেন। ধরা যাক, আরেকটি পরমাণু যোগ হলো বস্তুটিতে, সেটা D। তাহালে এবার দেখা সজ্জাটা কেমন হয়- ABCD, ABDC, ACBD, ACDB, ADBC, ADCB, BACD, BADC, BCAD, BCDA, BDAC, BDCA, CABD, CADB, CBAD, CBDA, DABC, DACB, DBAC, DBCA, DCAB, DCBA। মাত্র ৪টি পরমাণুর জন্য আমরা ২০ টি সজ্জা পাচ্ছি। অথচ ৩টির জন্য পেয়েছিলাম ছয়টি। একটা পরমাণু বেড়ে যাওয়ায় এক ধাক্কায় পরমাণুর সজ্জা বা বিন্যস বেড়ে গেছে ১৪টি। এখন যদি আরেকটি পরমাণু যোগ করা হয়, তাহলে এই কয়টি সজ্জা বেশি পাব সে হিসাব কষতে গেলে মাথা ঘুরে যাবে। অর্থাৎ কোনো বস্তু বা সিস্টেমে পরমাণুর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেই সিস্টেমের পরমাণুগুলোর বিন্যাস বেড়ে যায় জ্যামিতিক হারে। সাধারণ একটা র-এর ফোঁটায় দশ লাখ কার্বন পরমাণু থাকে! তাহলে একটা গ্লাস বা আইসক্রিমে কী পরিমাণ পরমাণু থাকে ভাবুন। এবং সেগুলোকে কত উপায়ে সাজাতে পারবেন, সে হিসাব বের করতে হলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে! আর এই জিনিসটাকেই বোলৎজম্যান বললেন এনট্রপি।</p> <p>সেকালের বিজ্ঞানীরা পরমাণুতত্ত্বেই বিশ্বাসী ছিলেন না। তারওপর সেগুলোর এই ভৌতিক সজ্জা- মানবেন কেন তাঁরা! সুতরাং চারপাশ থেকে বোলৎজম্যানের দিকে ধেঁয়ে এলো সমালোচনার তীর। শুধু কী সমালোচনা, তাঁকে নিয়ে হাসি-মসকরাও শুরু হলো বৈজ্ঞানিক সমাজে। বেচারা বোলৎজম্যান, নিজের থিওরির গ্যাঁড়াকলে  নিজেই পড়ে গেলেন। অকাট্য সত্য অস্বীকরাও করতে পারছেন না আবার সেগুলো বৈজ্ঞানিক সমাজে প্রতিষ্ঠিতও করতে পারছেন না। ব্যর্থতার হতাশা তাঁর জীবনীশক্তি তীলে তীলে শুষে নিতে থাকে। অবশেষে ১৯০৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার মাধ্যমেই হতাশা থেকে চিরমুক্ত হন।</p> <p>একটা বস্তু যখন স্থিতিশীল থাকে, সেখানে মাত্র একটি মাত্র সজ্জায় থাকে পরমাণুগুলো। যেমন ধরা যাক,  একটা বস্তুতে তে ABCওD চারটি পরমাণু আছে। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ‍এদের সজ্জা মাত্র একটি। ধরা যাক সেটা ABCD। এখন বস্তুটিতে তাপ প্রয়োগ করলেন। ফলে তাপমাত্রা বাড়ল বস্তুটির। তারমানে বস্তুটির মধ্যে পরামাণুগুলো কম্পন বা গতিশক্তিও বাড়ল। ধরা যাক, এর ফলে B ও D পরমাণু নিজেদের মধ্যে অবস্থান পরিবর্তন করল। এখন সজ্জাটা দাঁড়াল ADCB। তাপমাত্রা বাড়লে একবারে ABCD থেকে ADCBতে যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ওপরের বিশটা উপায়ের যেকোনো একটি সজ্জায় এদের পাওয়ার সম্ভবনা আছে। কঠিন পদার্থের পরমাণুগুলো একটা নির্দিষ্ট সংখ্যায় থাকে। তাই যতক্ষণ এরা কঠিন, তাপ প্রয়োগ করে আলাদা করে না ফেল হচ্ছে ততক্ষণ এদের এনট্রপির মান ১। ধরা যাক, ABCD কঠিন বস্তু। এর একটাই সজ্জা। সেটা হলো ABCD এবং এনট্রপি ১। </p> <p>এখন বস্তুটিকে ভেঙে ফেলুন। ধরা যাক, বস্তুটি দুটুকরো হলো- AB ও CD সজ্জায়। তাহলে আমরা এনট্রপি পেলাম ২। যদি তিন টুকরো হতো তাহলে সজ্জাটা ধরা যাক এমন হলো- A, BC ও D। দুক্ষেত্রেই আমরা দেখছি প্রাথমিক অবস্থার চেয়ে এনট্রপি বেশি। </p> <p>এখন কথা হচ্ছে, উল্টোটাও তো হতে পারে। তিনটি ভাঙা বস্তু জোড়া লেগে তৈরি হতে পারে একটা কঠিন বস্তু। সেটা হয় না কেন? এখানেও সংখ্যার মারপ্যাঁচ। এনট্রপি সবসময় বেড়েই চলে, কমার সুযোগ নেই।</p> <p>কেন?</p> <p>কারণ উপায় যত বেশি, ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা তত বেশি। ধরা, যাক একটা, একটা তেজস্ক্রিয় বস্তু নিলেন, ধরা যাক, সেটার অর্ধায়ু ৫ সেকেন্ড। তেজস্ক্রিয় পরমাণুতে কখন কোন পরমাণুটিতে ভাঙন ধরবে আপনি বলতে পারেন না। কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে পারেন, একটা নির্দিষ্ট সময়ে কয়টি পরমাণু ভাঙবে। ৫ সেকেন্ড অর্ধায়ুর ওই বস্তুটি আপনি নিলেন ওর তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা করার জন্য। কিন্তু আপনি নিলেন ৪টি পরমাণু। তাহলে কী নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন ১ সেকেন্ডের মধ্যে আপনি একটা পরমাণুর ভেঙে যাওয়া দেখতে পারবেন? </p> <p>পারবেন না। কারণ, ও সম্ভাবনা তত্ত্ব এখানে প্রবল। অর্ধায়ু ৫ সেকেন্ড। মানে প্রতি ৫ সেকেন্ড বস্তুটির অর্ধেক পরমাণু ভেঙে যেতে দেখবেন। তােই ৪টি পরমাণু নিলে প্রথম সেকেন্ডেই একটা পরমাণু নাও ভাঙতে পারে। কারণ তখন ওটার হিসাব হলো ৫ সেকেন্ডের মধ্যে ২টি পরমাণু ভাঙবে। কিন্তু আপনি যদি পরমাণুর সংখ্যা বাড়িয়ে দশ করেন। তাহলে ৫ সেকেন্ডে ৫টি পরমাণু ভাঙবেই। সেক্ষেত্রে প্রথম সেকেন্ডে ১টি পরামাণুর ভেঙে যাওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি। পরমাণু বাড়িয়ে যদি ১০০ টা করেন। তাহলে ৫ সেকেন্ডে ৫০ পরামাণুকে ভাঙতে দেখবেন। তারমানে প্রতি সেকেন্ডে অন্তত ১০টি করে পরমাণুকে ভাঙতে দেখবেন। সেক্ষেত্রে প্রথম সেকেন্ডে পরমাণুর ভাঙন দেখার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাচ্ছে।</p> <p><strong><span style="color:#2c3e50;">৪.</span></strong><br /> এনট্রপির পেছনে ভূমিকা রাখছে বস্তুর অভ্যান্তরীণ তাপশক্তি। একটা কঠিন বস্তুর জন্য তরলে পরিণত হওয়া যতটা সহজ, তরল থেকে কঠিনে পরিণত হওয়া অতটা সহজ নয়। বরফ আর পানির কথাই ধরা যাক, বরফ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ভেঙে পানিতে পরিণত হয়। কিন্তু পানি ভেঙে তরলে পরিণত হয় না। বরফের অণুগুলো তরলে পরিণত হলে অনেক বেশি উপয়ে সজ্জিত হওয়ার সুযোগ পায়। অর্থাৎ তাদের মধ্যে তাপশক্তি বিনিময়ের জন্য সম্ভাব্য অনেকগুলো উপায় তৈরি হয়। অর্থাৎ পাণির অণুগুলো, তাপের কারণে সহজেই চলাচল করতে পারে, অনেকগুলো প্রতিবেশী অণুর মধ্যে শক্তি বিনিময় করতে পারে। কিন্তু পানিকে যদি বরফে পরিণত হতে হয়, তাহলে মাত্র একটা উপায়েই পরমাণুগুলো সঙ্গে বন্ধন তৈরি করতে হবে।</p> <p>ABCD বস্তুটির কথায় ধরুন। এটা কঠিন অবস্থায় আছে। প্রতিটা পরমাণুর এক অথবা দুইটা পথ আছে শক্তি বিনিময়ের। এখানে A শুধ B-এর সঙ্গে শক্তি বিনিয়ম করতে পারছে। কিন্তু মাঝ খানে থাকায় B পরমাণু  A ও C উভয়ের সঙ্গে শক্তি বিনিময় করছে। তেমনি C পরমাণু B ও D উভয়ের সঙ্গে শক্তি বিনিময় করতে পারছে। আবার D শুধু C এর সঙ্গে শক্তি বিনিময় করছে। অন্যদিকে ABCD যদি তরল হতো, তাহলে প্রতেকটা পরমাণু প্রতিটার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে শক্তি বিনিয়ম করতে পারত। এদের সজ্জাও তত এলোমেলো হয়। এনট্রপির মানও তত বাড়ে। আর বস্তু বা সিস্টেম সব সময়ই বেশি এনট্রপিই পছন্দ করে। এ কারণে সব সময় উষ্ণ বস্তু থেকে শীতল বস্তুর দিকেই তাপ সঞ্চালিত হয়। উল্টোটা কখনো হয় না। কিন্তু কেন হয় না, প্রশ্নের ব্যাখ্যা বোলজম্যান দিতে পারেননি। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যে এর সমাধান হয়েছে, তা কিন্তু নয়। বিজ্ঞানীরা এর সঙ্গে সময়ের জোগসাজস খুঁজে পেয়েছেন। সময় সব সময় সামনের দিকে চলে, এজন্য এনট্রপিও সামনের দিকে চলে, বলছেন অনেকে। কিন্তু কেন- এর উত্তর নেই। অনেকে আবার মাল্টিভার্স, শিশু মহাবিশ্ব, কোয়ান্টাম গ্রাভিটি কিংবা স্ট্রিং থিওরির লেজ ধরে টানছেন এনট্রপি রহস্যের সমাধান করার জন্য। কিন্তু সবগুলোই এখন শুধুই হাইপোথিসিস।</p>