<p>প্রকৃতি এমন এক অদ্ভুত জগৎ, যেখানে মৌমাছিরা তাদের নিজেদের জীবনের জন্য নয়, বরং পুরো উপনিবেশের টিকে থাকার জন্য কাজ করে। বিশেষত পুরুষ মৌমাছিদের জীবন এক রহস্যময়, যা মৌমাছির জীবনচক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পুরুষ মৌমাছিরা একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে জন্মায়—রাণী মৌমাছির সাথে মিলিত হওয়া। পুরুষ মৌমাছিরা জানে যে এই মিলনের পর তাদের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তবুও, তারা এই মহৎ দায়িত্ব পালনে পিছপা হয় না। কেন এমনটি ঘটে? কেন তারা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়, এমনকি তাদের সামনে আর কোনো পথ না থাকলেও?</p> <p>মৌমাছিদের এই মিলন কোন সাধারণ ঘটনা নয়। মৌমাছির উপনিবেশে একটি মাত্র রাণী থাকে, যাকে মৌমাছি উপনিবেশ সাধারণত একটি রাণী, অসংখ্য কর্মী এবং কিছু পুরুষ মৌমাছি নিয়ে গঠিত হয়। রানি মৌমাছির প্রধান কাজ হলো ডিম পাড়া। কর্মী মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে, চাক তৈরি করে, এবং উপনিবেশের রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করে। কিন্তু পুরুষ মৌমাছির জীবন একদম আলাদা। তাদের কোনো শ্রম দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, এমনকি তাদের খাবারও কর্মী মৌমাছিরা মুখে তুলে দেয়।</p> <p>তবে পুরুষ মৌমাছিদের একমাত্র কাজ হলো রাণী মৌমাছির সাথে মিলন করা। এই মিলনের সময় ঘটে যায় তাদের জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং মর্মান্তিক ঘটনা—মিলনের সাথে সাথেই তাদের মৃত্যু। এই ঘটনাকে বলা হয় ‘দি ড্রামাটিক সেক্সুয়াল সুইসাইড’।<br /> পুরুষ মৌমাছিদের জীবনচক্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ‘পুরুষ ধর্মসভা’। এটি এমন একটি স্থান, যেখানে প্রচুর পুরুষ মৌমাছি একত্রিত হয়। অপেক্ষা করে রানি মৌমাছির আগমনের জন্য। প্রতিদিন দুপুরবেলা এই ধর্মসভা শুরু হয়। ঠিক একই সময়ে, রাণী মৌমাছি চাক থেকে বের হয়ে আসে, একে বলা হয় ‘দ্য মেটিং ফ্লাইট’। রানি মৌমাছি উড়ন্ত অবস্থায় পুরুষ মৌমাছিদের কাছে পৌঁছায় এবং এক বিশেষ গন্ধ ছড়িয়ে দেয়, যা পুরুষ মৌমাছিদের উত্তেজিত করে।</p> <p>রানি মৌমাছি সাধারণত ১৮-২০টি পুরুষ মৌমাছির সাথে মিলিত হতে পারে। প্রতিটি মিলনের সাথে সাথেই পুরুষ মৌমাছির যৌনাঙ্গ ভেঙে যায় এবং তখনই তাদের মৃত্যু ঘটে। এই আত্মঘাতী মিলনের মাধ্যমে রাণী মৌমাছির ডিমে পুরুষ মৌমাছির শুক্রাণু প্রবেশ করে এবং নতুন কর্মী মৌমাছি ও রাণীর জন্মের পথ প্রশস্ত হয়। এই প্রক্রিয়া উপনিবেশের টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।</p> <p>কেন পুরুষ মৌমাছিরা আত্মঘাতী? </p> <p>এই ঘটনাটি প্রকৃতির এক অদ্ভুত রহস্য। কেন পুরুষ মৌমাছিরা জীবন উৎসর্গ করে, শুধু রাণীর সাথে মিলনের জন্য? এর উত্তর লুকিয়ে আছে মৌমাছির জীবনের ধারা এবং উপনিবেশের টিকে থাকার নীতিতে। মৌমাছির উপনিবেশে প্রত্যেক মৌমাছির জীবনের মূল্য নির্ধারিত হয় তাদের কাজের ওপর ভিত্তি করে। পুরুষ মৌমাছিদের কাজই হলো প্রজনন। তাদের জীবন অন্য কোনো কাজে ব্যয় না করে শুধু এই এক কাজে নিবেদিত থাকে।</p> <p>মিলনের পর তাদের মৃত্যু হওয়া প্রকৃতির এক অদ্ভুত প্রক্রিয়। যা নিশ্চিত করে যে, মিলন পরবর্তী শুক্রাণু প্রবেশের কোনো বাধা থাকবে না। পুরুষ মৌমাছির যৌনাঙ্গ রানি মৌমাছির শরীরে আটকে যায়, ফলে শুক্রাণু প্রবেশ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে সফল হয়। যা উপনিবেশের ভবিষ্যত নির্ধারণ করে।</p> <p>পুরুষ মৌমাছির মৃত্যুর পর, রানি মৌমাছি ডিম পাড়া শুরু করে এবং নতুন মৌমাছির জন্ম হয়। কর্মী মৌমাছিরা এই নতুন মৌমাছিদের যত্ন নেয় এবং উপনিবেশের সেবা করে। পুরুষ মৌমাছিরা একবার মারা গেলে, তাদের ভূমিকা শেষ হয়ে যায়। তবে তাদের আত্মত্যাগ উপনিবেশের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য।</p> <p>পুরুষ মৌমাছির মিলন ও আত্মহত্যা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। যুক্তরাষ্টের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টমাস সিলি মৌমাছির সামাজিক আচরণ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে মৌমাছির উপনিবেশ পরিচালনার পেছনে বিশাল সমন্বয় কাজ করে। উপনিবেশেরে স্বার্থের বিনিময়ে ব্যক্তিগত জীবনের কোনো মূল্য নেই। পুরুষ মৌমাছির মিলনকালে মৃত্যুকে তিনি আত্মত্যাগী আচরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। এর মাধ্যমে তারা উপনিবেশের প্রজনন প্রক্রিয়া সুনিশ্চিত করে।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রবার্ট পেইজ মৌমাছির প্রজনন ও জেনেটিকস নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে যে পুরুষ মৌমাছির আত্মহত্যা মূলত প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটি ধাপ। পুরুষ মৌমাছির মিলনের সময় তাদের যৌনাঙ্গের ভেঙে যাওয়া রাণীর প্রজনন সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কারণেই প্রাকৃতিকভাবে এটি স্থায়ী হয়ে আছে, যেহেতু এটি উপনিবেশের বংশবিস্তারের জন্য অপরিহার্য।</p> <p>আরেক মার্কিন মৌমাছি গবেষক হিলারি কিচনার মনে করেন, পুরুষ মৌমাছির আত্মহত্যা আসলে প্রজনন প্রক্রিয়ার একটি অংশ। তাদের জীবন ছোট হলেও তারা একবারের মিলনে পুরো উপনিবেশের ভবিষ্যত নিশ্চিত করে। </p> <p>অর্থাৎ পুরুষ মৌমাছির মিলন এবং পরবর্তী আত্মহত্যা প্রকৃতির এক অদ্ভুত ঘটনাচক্র। এই মিলন শুধু রানি মৌমাছির প্রজনন সক্ষমতা নিশ্চিত করে না, এটি পুরো উপনিবেশের টিকে থাকার জন্য একটি অপরিহার্য ধাপ। পুরুষ মৌমাছিরা জীবনের শেষে মৃত্যুর সম্মুখীন হলেও, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে কোনো দ্বিধা করে না। </p> <p>সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি<br />  </p>