<p>আশির দশকে ঢাকার সবাই যখন টিভিতে বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপের ধারণ করা অংশ দেখে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাসি স্বাদে সন্তুষ্ট, তখন ভারতীয় সম্প্রচার মাধ্যম দূরদর্শনে দাপিয়ে ‘লাইভ’ ক্রিকেট দেখত রাজশাহীর সব বয়সী দর্শক। এর প্রভাব দেখা যেত পাড়ায় মহল্লায়—মৌসুমের প্রতিটি দিনই অসংখ্য ম্যাচ হতো উত্তরবঙ্গের এই শহরে। সেসব ম্যাচে পাড়ার আম্পায়ারদের কর্তৃত্বও ছিল চোখে পড়ার মতো, সে তিনি যে বয়সেরই হন না কেন। সে সময়ে অবহেলিত এই জনপদে ক্রিকেট সংস্কৃতির এমন বিস্তার বিরল বটে।</p> <p>এর এক দশক পর রাজশাহী থেকে খালেদ মাসুদ পাইলটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খ্যাতি অর্জন করাও যেমন বিশেষ কিছু। মাসুদের বেলায় আরো চমৎকারিত্ব আছে। তাঁর বাবা প্রয়াত শামসুল ইসলাম মোল্লা, যাঁকে দেশের ফুটবল ইতিহাস মনে রেখেছে ‘শামসু ভাই’ নামে। খ্যাতিমান ফুটবলারের সন্তান হয়েও মাসুদ ক্রিকেটে ঝুঁকেছেন।</p> <p>সে সময়কার রাজশাহীর ক্রিকেট সংস্কৃতিই তৈরি করে দেয় বাংলাদেশ দলের ভবিষ্যৎ অধিনায়ককে।<br /> একুশ শতকের রাজশাহী আধুনিক, ঝকঝকে। আশির দশকে রাজশাহীর যে দর্শনার্থীর কাছে এই পরিবর্তন অবিশ্বাস্য মনে হবে। আবার মন খারাপও হবে।</p> <p>পাড়া-মহল্লার ম্যাচ খেলার বেশির ভাগ জায়গা গিলে খেয়েছে আধুনিকতা। যখন-তখন ব্যাট-বল হাতে বন্ধুদের নিয়ে ক্রিকেট মাঠে ছোটার দিন আর নেই। রাজশাহী বিভাগীয় মাঠ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অধীনে। তাই এখানে খেলার কিংবা প্র্যাকটিসের সুযোগ পান শুধু বিসিবির অধীন ক্রিকেটাররা। পাড়ার ক্রিকেট থেকে মাসুদের মতো উঠে আসার সুযোগ তাই সংকুচিত।</p> <p>তবু ভালো যে নিজেরাই জঞ্জাল সাফসুতরা করে ক্রিকেট অবকাঠামো বানিয়েছে আকিজ গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন ক্লেমন, রাজশাহীতে আছে বাংলা ট্র্যাকের মতো গোছানো একাডেমি। তাতে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে আবার দাপট বেড়েছে রাজশাহীর।<br /> লড়াইটা অবশ্য সহজ ছিল না। তবে প্রবল ইচ্ছা আর চিন্তাশক্তি দিয়ে সেটি সহজ করেছেন খালেদ মাসুদ। গতকাল রাজশাহী বিভাগীয় স্টেডিয়ামে রাজশাহী বনাম রংপুরের মধ্যকার জাতীয় লিগ ম্যাচের মধ্যাহ্ন বিরতির সময় তাগাদা দেন তিনি, ‘চলুন, আপনাকে একটা মাঠ দেখিয়ে আনি।’ ভরদুপুরে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের সেই মাঠে দেখা যায় ক্লেমনের লোগোসংবলিত জার্সি গায়ে দুটি দল ম্যাচ খেলছে। মাঠের এক প্রান্তে দুটি করে কংক্রিট আর টার্ফের উইকেট। রাজশাহী বিভাগীয় স্টেডিয়ামের পাশাপাশি এখানেও চলে ক্লেমন একাডেমির কার্যক্রম।</p> <p>- এই মাঠের ভাড়া দেন কত করে?</p> <p>প্রশ্ন শুনে মাসুদ হাসেন, ‘এক টাকাও না। আমরা শুধু মাঠটা তৈরি রাখি। সকালে প্র্যাকটিসের পর ছেলেরা (ক্লেমন একাডেমির) ম্যাচ খেলে। তবে বিকেলে এলে দেখবেন অনেকে খেলছে, মেডিক্যালের স্টুডেন্টরাও খেলে।’ পাশ থেকে খেলা ছেড়ে কোচিংয়ে নাম লেখানো হাবিবুর রহমান জনি বলেন, ‘দিনে দুই আড়াই শ ক্রিকেটার এখানে খেলে।’ এই সংখ্যার বেশির ভাগই আশপাশের কিশোর-তরুণ কিংবা রাজশাহী মেডিক্যালের শিক্ষার্থীরা।</p> <p>কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানের মাঠ বিনা ভাড়ায় ব্যবহারের অনুমতি কী করে পেলেন মাসুদ? ‘মেডিক্যালের প্রিন্সিপাল স্যারকে বিশেষ ধন্যবাদ দিতে হবে। উনি রাজি না হলে এটা সম্ভব ছিল না। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, এই মাঠ তৈরি করতে আমাদের খুব সামান্য অর্থ খরচ হয়েছে। সেই খরচও জুগিয়েছেন শহরের ক্রিকেটপ্রেমী ব্যবসায়ীরা। এই যে দুটি উইকেট দেখছেন, সেগুলোতে যে খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে, তা আসলে বিল্ডারদের কাছ থেকে পাওয়া বিনা মূল্যে পাওয়া ঢালাইয়ের ফেলে দেওয়া ইট-সিমেন্টের টুকরা। তবু দেখেন, উইকেট কত ভালো। আসেন, আসেন...’ বলে একরকম জোর করে ম্যাচের মধ্যেই উইকেটের কাছে নিয়ে গেলেন মাসুদ। শিক্ষানবিশদের জন্য এমন উইকেট ভালো বন্দোবস্ত। বিশাল মাঠ পরিপাটি রোল করা, যে মাঠটি একসময় প্রায় পরিত্যক্ত ছিল। ‘বড় বড় গর্ত ছিল। প্রচুর মাটি ফেলতে হয়েছে। সেই টাকাও স্থানীয় লোকজন দিয়েছে। আমি শুধু প্রিন্সিপাল স্যারকে বুঝিয়েছি যে এই মাঠটি তৈরি করলে আপনার ছাত্ররাও ভালো একটা খেলার জায়গা পাবে।’ দূরের একটা সুন্দর ছাউনি দেওয়া স্থাপনা দেখিয়ে মাসুদ বলেন, ‘ওটা একটা গোডাউন ছিল। স্যারের অনুমতি নিয়ে ওটাকে জিম বানিয়েছি। আমার একাডেমির পাশাপাশি মেডিক্যালের স্টুডেন্টরাও চাইলে জিম করতে পারে।’</p> <p>মোটকথা, প্রায় বিনা ব্যয়ে দারুণ একটি ‘বিজনেস মডেল’ দাঁড় করিয়েছেন খালেদ মাসুদ। এই ব্যবসার নকশা শুধু আর্থিক লাভের জন্য নয়, ছোট একটি জনপদও পেয়ে গেছে খেলার মাঠ। শিরোনামটা মাসুদের কাছ থেকেই ধার করা, ‘সত্যি বলতে কি, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় এ রকম একটা করে মাঠ তৈরি করা সম্ভব। আসলে তৈরি আছে। আপনাকে শুধু সদিচ্ছা দিয়ে সেটাকে সাজাতে হবে।’</p>