নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন থাকে এবং নামাজ পড়ার পর মুসলিমরা কোলাকুলি করে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গে ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে হাজারো মুসল্লি অংশ নেয়। মুসলিমপ্রধান প্রজাতন্ত্র যেমন তাতারস্তান, বাশকোর্তোস্তান, চেচনিয়া, দাগেস্তান ও ইনগুশেতিয়াতে ঈদ অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপন করা হয়।
ঈদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ঐতিহ্যবাহী রুশ-মুসলিম খাবার। "চাক-চাক" (মিষ্টি ময়দার খাবার), "বেলিশ" (মাংস ও আলুর রুটি), "শুরপা" (মাংসের স্যুপ) ইত্যাদি রাশিয়ার মুসলিমদের ঈদের বিশেষ খাবার। দাগেস্তান ও চেচনিয়ায় জনপ্রিয় খাবার হলো "খিঙ্কাল" (গরু বা ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি একটি রুটি)। চায়ের সঙ্গে "বাকলাভা" ও "সামসা" পরিবেশন করা হয়।
চেচনিয়া ও দাগেস্তানে ঈদের দিনে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। রাশিয়ায় ঈদুল ফিতরকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এটি জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত না হলেও মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলোতে সরকারি ছুটি দেওয়া হয়।
চীন
মুসলমানদের জন্য ঈদুল ফিতর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব, এবং চীনের মুসলিমরা এ দিনটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে উদযাপন করে। তবে, চীনের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সরকারি নীতির কারণে মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা কিছুটা সীমিত। চীনের মুসলিম সম্প্রদায় প্রায় ২ কোটির বেশি, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.৫%। চীনের মুসলিমরা ঐতিহ্যগতভাবে ঈদুল ফিতর উদযাপন করে আসছে। তবে তাদের উদযাপনের ধরণ অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে।
চীনের বিভিন্ন মসজিদে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়, বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে যেমন শিনজিয়াং, নিংশিয়া, গানসু ও ইউন্নান। বেইজিং, শানজি ও হেনানেও মুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট মসজিদে ঈদের জামাত হয়। নামাজ শেষে মুসলিমরা একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করে।
চীনা মুসলমানরা ঈদের দিন বিশেষ খাবার প্রস্তুত করে। "ল্যাম্ব কাবাব", "পোলাও", "নুডলস", "সুইট রাইস" ও বিভিন্ন ধরনের "হালুয়া" এদিনের জনপ্রিয় খাবার। "স্যানঝি" (তেলে ভাজা মিষ্টি খাবার) ও "ইয়োগুর্ট" হুই মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়। শিনজিয়াং অঞ্চলে "লাগমেন" (এক ধরনের নুডলস) ও "নাং" (রুটি) ব্যাপকভাবে খাওয়া হয়।
বড় শহরগুলোতে ঈদের দিন মুসলিম পরিবারগুলো একে অপরের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বিভিন্ন বাজার ও বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে মুসলমানরা নতুন পোশাক, খাবার ও উপহার কেনাকাটা করে। সাংস্কৃতিকভাবে ঈদের দিনে হুই মুসলিমরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এবং শিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমরা ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গান পরিবেশন করে।
কানাডা
কানাডায় মুসলিম সম্প্রদায় ঈদের দিন নামাজ আদায় করে এবং বিশেষ পার্টি ও খাবারের আয়োজন করে। এখানে বিভিন্ন ইসলামিক সোসাইটি ও মসজিদ ঈদের আয়োজন করে। বৃহৎ শহরগুলোতে যেমন টরন্টো, মন্ট্রিয়াল ও ভ্যাঙ্কুভারে ঈদের বড় জমায়েত হয়। মুসলমানরা সাধারণত ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায়। এছাড়া ক্যালগেরিতে আকরাম জুম্মা মসজিদে প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে স্থানীয় মুসলিমরা অংশ নেন। বাংলাদেশ কমিউনিটির মসজিদ বিএমআইসিসিতেও একাধিক জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈদের দিনটি কর্মদিবস হওয়ায় অনেকেই নামাজ আদায় করে কর্মস্থলে যোগ দেন।
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যে মুসলমানরা ঈদ অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপন করে। লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টারসহ বড় শহরগুলোতে ঈদের নামাজের জন্য বড় মাঠ বা পার্ক ব্যবহার করা হয়। এছাড়া লন্ডনের রিজেন্ট পার্ক সেন্ট্রাল মসজিদে বৃহৎ জামাত অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সকাল ৭টা থেকে এক ঘণ্টা পর পর ছয়টি জামাত হয়। বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও ব্রিকলেন মসজিদেও চারটি করে জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা পৃথক বার্তা প্রদান করেন। ঈদের দিন রাস্তায় বিশেষ খাবারের দোকান বসে এবং পারিবারিক মিলনমেলা হয়। ব্রিটিশ মুসলমানরা তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন বিরিয়ানি, কাবাব, শির খুরমা ইত্যাদি উপভোগ করেন।
ফ্রান্স
ফ্রান্সে প্রায় ৫৫ লাখেরও বেশি মুসলমান বসবাস করেন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮.৮ শতাংশ। এখানে মুসলিম সম্প্রদায় ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে ঈদুল ফিতর উদযাপন করে। প্যারিসের বিভিন্ন মসজিদে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিপুল সংখ্যক মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন। সাধারণত সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে মিল রেখে ফ্রান্সে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। এখানকার মুসলমানরা ঈদের দিন নামাজ আদায়ের পর পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে একত্রিত হয় এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।
অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ায় ঈদুল ফিতর বেশ বড় পরিসরে উদযাপিত হয়। ঈদের দিন সকালে মুসলমানরা স্থানীয় মসজিদ বা খোলা স্থানে সমবেত হয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেন। নামাজের পর পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও সম্প্রদায়ের সদস্যরা একত্রিত হয়ে খাবার ভাগাভাগি করেন এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি মুসলিমরা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিল রেখে ঈদ উদযাপন করেন। তারা স্থানীয় মসজিদে নামাজ আদায়ের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, যেখানে ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন করা হয় এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
নিউজিল্যান্ড
নিউজিল্যান্ডের মুসলিম জনসংখ্যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সম্প্রদায়টি বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে গঠিত, যা তাদের উদযাপনে বৈচিত্র্য নিয়ে আসে।
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারগুলো বিশেষ নামাজের আয়োজন করে। উদাহরণস্বরূপ, ক্রাইস্টচার্চের মসজিদ আল-নূর এবং অকল্যান্ডের পনসনবি মসজিদে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা একত্রিত হয়ে প্রার্থনা করেন এবং আনন্দ ভাগাভাগি করেন। ঈদের সময় মুসলিম পরিবারগুলো ঐতিহ্যবাহী খাবার প্রস্তুত করে এবং বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সঙ্গে তা উপভোগ করে। এছাড়াও, বিভিন্ন ইসলামিক সংগঠন ও কমিউনিটি সেন্টারগুলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি করে।
জার্মানি
জার্মানিতে মুসলিম সম্প্রদায় সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিল রেখে ঈদুল ফিতর উদযাপন করে। রাজধানী বার্লিনসহ বিভিন্ন শহরে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা অংশগ্রহণ করেন। জার্মানিতে বসবাসরত মুসলমানরা ঈদের দিন ছুটি না পেলেও তারা সকালে নামাজ আদায় করে এবং রাতে পার্টির আয়োজন করে। অনেক জায়গায় স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টারে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়।
জাপান
জাপানে মুসলিম সম্প্রদায় খুবই ছোট, তবে তারা মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারে একত্রিত হয়ে ঈদ উদযাপন করে। টোকিও, ওসাকা ও নাগোয়ার মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজ আদায় করা হয় এবং পরে খাবার ভাগ করে নেওয়া হয়।
দক্ষিণ কোরিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ায় মুসলমানদের সংখ্যা কম, তবে সিউলে কেন্দ্রীয় মসজিদে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ শেষে কমিউনিটি ফেস্টিভাল ও খাবার বিতরণের আয়োজন করা হয়।
ব্রাজিল
ব্রাজিলে মুসলমানরা ঈদের নামাজের পর একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায় এবং বিশেষ খাবার রান্না করে। সাও পাওলো ও রিও ডি জেনেইরোর মুসলিম কমিউনিটিগুলোতে ঈদ উদযাপন চোখে পড়ার মতো।
অমুসলিম দেশগুলোতে ঈদুল ফিতরের উদযাপন সাধারণত স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়। যদিও এসব দেশে সরকারি ছুটি থাকে না, তবে মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। ঈদুল ফিতর শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক।