তবে তিনিও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অবসরে যাবেন।
মাউশির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রায় তিন মাস মহাপরিচালকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়মিত কেউ না থাকায় থমকে ছিল বদলি-পদায়ন। ফলে সরকারি অনেক স্কুলেই প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। এ ছাড়া দেড় শতাধিক উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার পদও শূন্য। যদিও সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা দায়িত্বে আছেন। কিন্তু চলতি দায়িত্ব বা পদোন্নতি না হওয়ায় মাঠ পর্যায়ের কাজকর্মে গতি আসছে না। স্কুল-কলেজের মনিটরিং ব্যবস্থা অনেকটাই অকার্যকর। মাউশি অধিদপ্তরে এখনো অনেক আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা বহাল তবিয়তে আছেন। এ নিয়েও শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মাউশি মহাপরিচালকের পদটি গ্রেড-১ (সচিব) পদমর্যাদার। এটি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ। এই পদে নিয়োগে সরকারপ্রধানের অনুমোদন প্রয়োজন। মাউশি মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পেতে আগ্রহীদের দৌড়ঝাঁপ তিন মাস ধরেই চলছে। এ পদের জন্য এখন চলছে ব্যাপক লবিং। রাজনৈতিক আনুকূল্য পেতেও চলছে বিভিন্ন পর্যায়ে দেনদরবার। কেউ কেউ ছাত্রজীবনে ছাত্রদল সমর্থক রাজনীতির অভিজ্ঞতার প্রমাণ ও পারিবারিক সংশ্লিষ্টতাও তুলে ধরছেন সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে।
সূত্র জানায়, মাউশির মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পেতে আলোচনায় আছেন মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের ইসলামী শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুস সবুর, মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দীন আল মাহমুদ সোহেল, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. তৌহিদ আহম্মেদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রুহুল কাদীর প্রমুখ। তাঁরা সবাই ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে এই তালিকার একজনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তিনি অন্য তিনজনের চেয়ে জুনিয়র। আবার একজন সিনিয়র—যিনি জোরালোভাবে তদবির করছেন, তাঁর বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ লেখার অভিযোগ রয়েছে। ফলে এই তালিকার বাইরে থেকে নতুন কেউ ডিজি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা চাই শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে জ্যেষ্ঠ ও যোগ্য কর্মকর্তারা আসুক। এ ছাড়া বদলি-পদায়নের ক্ষেত্রে নীতিমালার বাস্তবায়নও আমরা চাই। কেউ রাজধানীতে একই পদে দীর্ঘদিন থাকবেন, আবার কেউ মফস্বলে দিনের পর দিন পড়ে থাকবেন, তা কাম্য নয়। এত দিন মন্ত্রণালয় হয়তো তা চায়নি। তবে এখন যেন নীতিমালার বাস্তবায়ন হয়, সেটা আমাদের চাওয়া। এ জন্য আমরা চাই, শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা থাকুক।’
শিক্ষা প্রশাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। তারা সারা বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে থাকে। এই দপ্তরের পরিচালক হয়ে এসেছিলেন অধ্যাপক কাজী মো. আবু কাইয়ুম শিশির। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় সম্প্রতি তাঁকে বদলি করা হয়েছে। এই দপ্তরের যুগ্ম পরিচালক মো. আবুয়াল কায়সারের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি তাঁর একটি অডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তিনি একজন অধ্যাপককে হুমকি দিচ্ছেন। এ ছাড়া এই দপ্তরের পরিদর্শকদের বেশির ভাগই টাকা আয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি একজন সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক কক্সবাজারের একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছে ঘুষ চেয়ে মারধরেরও শিকার হন।
শিক্ষা ভবনেই অবস্থিত শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি)। যারা সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে থাকে। গত ৫ আগস্টের পর ইইডির প্রধান প্রকৌশলী পদত্যাগ করেন। এরপর প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব পান বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের অন্যতম নেতা মো. রায়হান বাদশা। তবে তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় গত ২১ নভেম্বর তাঁকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় মো. জালাল উদ্দিন চৌধুরীকে। কিন্তু নিয়মিত প্রধান প্রকৌশলী না থাকায় বদলি-পদায়নসহ বড় ধরনের ব্যয়ের কাজ থমকে আছে।
পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব ১১ শিক্ষা বোর্ডের। আর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান সব বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এই বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকারও এ মাসেই অবসরে যাচ্ছেন। চেয়ারম্যান হতে একাধিক অধ্যাপক জোরালোভাবে তদবির করছেন। শিক্ষা প্রশাসনের আরো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়ন চান অনেকেই। যা নিয়েও অস্থিরতা বিরাজ করছে।
শিক্ষার একাধিক প্রকল্প পরিচালক জানান, তাঁদের প্রকল্পের সব ধরনের কেনাকাটা আটকে গেছে। এতে প্রকল্পের কাছে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলে আবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হবে। এতে বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে হবে। এ ছাড়া অনেক স্কুল-কলেজে দীর্ঘদিন নির্মাণকাজ চলায় পড়াশোনার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) নতুন কর্মকর্তারা দায়িত্ব নিলেও বই ছাপা নিয়ে মহাসংকটের সৃষ্টি হয়েছে। ফেব্রুয়ারি-মার্চের আগে শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই যাবে না। এতে পদায়নকৃত কর্মকর্তাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া এনসিটিবিতে সচিব হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন শাহ মুহাম্মদ ফিরোজ আল ফেরদৌস। তিনি গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ আমলের অন্যতম সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। দীর্ঘদিন ধরেই এনসিটিবিতে রয়েছেন। অথচ আওয়ামী সরকার পতনের পর তাঁকে আরো উচ্চ পদে পদায়ন করা হয়েছে। এতে এনসিটিবিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বই ছাপার কাজও ব্যাহত হচ্ছে।
জানা যায়, শিক্ষা প্রশাসনের নানা সমস্যার মধ্যে নতুন অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে জনপ্রশাসন সংক্রান্ত কমিশনের সুপারিশ। শিক্ষা ক্যাডারকে ক্যাডারবহির্ভূত রাখার সুপারিশ করেছে কমিশন, যা নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা। এরই মধ্যে তাঁরা ওই সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছেন। একই সঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করে ১৫ দফা দাবি জানিয়েছেন। দাবির ব্যাপারে সুস্পষ্ট অগ্রগতি না এলে আগামী ৩১ ডিসেম্বর তাঁরা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।
শিক্ষা ক্যাডারের ১৫ দফা দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—বিসিএস সাধারণ শিক্ষাকে ক্যাডারবহির্ভূত করার পরিকল্পনা ও উদ্যোগ থেকে সরে আসার সুস্পষ্ট ঘোষণা; সকল প্রকার কোটা-বৈষম্য তুলে দিয়ে মেধার ভিত্তিতে সরকারের উপসচিব পদে যোগদান নিশ্চিত করা; মন্ত্রণালয়সহ ক্যাডার সংশ্লিষ্ট সকল পদে নিজ নিজ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন; শিক্ষা ক্যাডারে ছয় স্তরের পদসোপান প্রতিষ্ঠা; অধ্যাপক পদকে তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত ও আনুপাতিক হারে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেডের পদ সৃষ্টি; অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষদের প্রাধিকারের ভিত্তিতে গাড়ি প্রদান; ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে শিক্ষা ক্যাডারের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করা।
অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এরই মধ্যে শিক্ষার অনেক দপ্তর আমাদের ক্যাডারের হাতছাড়া হয়ে গেছে। আমরা ১৫ দফা দাবি জানিয়েছি। সেগুলোর বাস্তবায়ন না হলে ৩১ জানুয়ারি আমরা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করব।’