একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, দুর্নীতি ঢুকছে—এসব কোনোটা এক মাসে যাবে, কোনোটা ১২ মাস, কোনোটা এক বছর ও ১০ বছরও সময় লাগবে। সুতরাং সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা সংস্কার চাই। কিন্তু সংস্কারের জন্য তো নির্বাচন থেমে থাকতে পারে না। শুধু সংস্কার সংস্কার শব্দ, এই জারি গান নিয়ে ব্যস্ত থাকা যাবে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা দরকার। বাকি সংস্কার নির্বাচিত সরকার করবে।
প্রশ্ন : নির্বাচনের রোডম্যাপ কবে হবে তা তো স্পষ্ট নয়। নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও বলেছেন, বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নির্বাচন সম্ভব নয়। সরকার যদি এই বছর নির্বাচন না দেয় তাহলে কী করবেন?
উত্তর : সরকার অরাজনৈতিক, এটি অন্তর্বর্তী সরকার, আমরা তো এখন বিরোধী দলে নই। এখন আমি নিরপেক্ষ সরকারের বিরুদ্ধে কী সমালোচনা করব? আমরাও তো তাদের আস্থায় নিয়ে সহযোগিতা করছি। আমার কাজটা হচ্ছে নির্বাচনটা আদায় করা। সেটা রাজপথের মাধ্যমে হতে পারে, আবার আলোচনার মাধ্যমে হতে পারে। এখনো আমরা তো ধৈর্য ধরছি। কিন্তু অনন্তকাল তো ধৈর্য ধরব না।
প্রশ্ন : আপনারা বলছেন, সরকার নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি করছে, আবার বলছেন, তাদের ওপর আস্থা রাখছেন।
উত্তর : সরকার কী চায় সরকার নিজেও সেটা বুঝে কি না আমি বুঝি না। তার পরও আমাকে তো ধৈর্য একটু ধরতেই হবে।
প্রশ্ন : আপনারা বারবার ওয়ান-ইলেভেনের মতো ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন কেন?
উত্তর : ওয়ান-ইলেভেনের যারা কুশীলব ছিল তারাই তো এখনো ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন পদে আছে। তারাই তো সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে। কেউ যদি ওয়ান-ইলেভেনের ধারাবাহিকতাকেই কার্যকর করতে চায়, তাহলে আমাকে যেকোনো অবস্থাতেই আন্দোলনে নামতে হবে।
প্রশ্ন : সরকারের বিরুদ্ধে আপনাদের নেতা-কর্মীদের এত অভিযোগ কেন?
উত্তর : অন্তর্বর্তী সরকারসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আমাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনায় বলেন, দেশে নাকি ঘুষ-দুর্নীতি কমেনি; বরং অনেক জায়গায় বেড়েছে। তাহলে সংস্কারটা কোথায় হচ্ছে? ঘৃণিত এক দুর্নীতিবাজ সরকার হটানোর পরও যদি দুর্নীতি চলমান থাকে, তাহলে আমরা পাপীকে ঘৃণা করলাম, পাপকে ঘৃণা করলাম না। এই কথাগুলো কানে আসছে।
প্রশ্ন : নির্বাচনের দাবিতে জেলায় জেলায় সমাবেশ করেছে বিএনপি। এই আন্দোলন কী আরো হবে?
উত্তর : ১৭ বছরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আমি মরিনি। কিন্তু অনেকে মারা গেছেন। আমার অনেক ভাই-বোন নিখোঁজ হয়েছেন, গুম হয়েছেন। ১৭ বছরের মূল দাবিটা ছিল একটা সুষ্ঠু নির্বাচন। এই দাবি থেকে সরে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমার মাথায় ২৮টি সেলাই আছে। অনেকে বলেন, টুপি পরেন কেন? যার মাথায় ২৮টি সেলাই থাকে, তার মাথায় কি চুল থাকে? আমি রক্ত দিয়েছি নির্বাচনের জন্য। সে নির্বাচনে আমরা বিজয়ী হতে পারি, না-ও পারি। কিন্তু আমরা একটা অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। আর নির্বাচনের দাবিতে এই সরকারের আমলের না, এই দাবি এই সরকার জন্মানোরও আগে। আমরা এ থেকে সরে যাব কেন? রোজার আগে আমরা কতগুলো কর্মসূচি করলাম। দ্রবমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারকে বলছি। যথাসম্ভব শিগগিরই নির্বাচন চেয়েছি। আমরা কিন্তু বলিনি আজকের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে, আলটিমেটামও দিইনি। এ কথাও বলছি যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার করা দরকার ততটুকু করেন। তাই নির্বাচনের দাবি রোজার পরও করব। এখন তো আমি অফিস ঘেরাও কর্মসূচি দিইনি। আমি তো এখনো প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা দিইনি। আমরা তো সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। নির্বাচন যতই দেরি হবে ততই জটিলতা বাড়বে। ষড়যন্ত্রকারীরা তত শক্তিশালী হবে। সেই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার ক্ষমতা সরকারের আছে কি না?
প্রশ্ন : জাতীয় নাগরিক পার্টিকে নিয়ে বিএনপি নানা সমালোচনা করছে, কিন্তু কেন? নতুন দলের পেছনে কোনো শক্তি আছে বলে কী মনে করছেন?
উত্তর : নতুন দলের শক্তি সরকারের মধ্যেই লুকায়িত আছে। সরকার নতুন দলের জন্য অনেক কিছু করছে, অনেক কিছু করার চেষ্টা করছে। এই চেষ্টার কারণে সরকার নিরপেক্ষতা হারাচ্ছে। ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন এ রকম দল তৈরি করেছিল। বিভিন্ন দলের নেতাদের সংস্কারবাদী বানিয়েছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনেক নেতাকে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু ফাইনালি ফেল করেছে। ওয়ান-ইলেভেনের আগে সিঙ্গাপুরের একটা পত্রিকা বাংলাদেশের অর্থনীতি ইমাজিং টাইগার বলেছিল। তখন অর্থনীতির অবস্থা ভালো ছিল। ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে ২০ টাকার চাল ৪০ টাকা করল। সেটি তারা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। এখন তো আর অর্থনীতিটা ছুটন্ত বাঘ না। অর্থনীতি এখন ঘুমন্ত বাঘ। সুতরাং ওয়ান-ইলেভেনের এই খেলা, কিংস পার্টি বানানো এবং দল বানিয়ে টিকে থাকা খুব কঠিন।
প্রশ্ন : সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক করেছেন। কেন তাঁর এই সতর্কবাণী?
উত্তর : ফ্যাসিবাদের অবসান ঘটাতে সেনাপ্রধানের ভূমিকা আছে। তিনি বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন। উনি বারবার বলেছেন, আপনারা নিজেরা নিজেরা কাদা ছোড়াছুড়ি করে পরিবেশ বিনষ্ট করবেন না। তিনি তো নির্বাচনের বিপক্ষে বলেননি। নিজেদের মতো রেষারেষি থাকলে কী হতে পারে সেই সতর্কবার্তা দিয়েছেন। এটা থেকে অনেক কিছু বোঝার আছে। যার বোঝার তারা বুঝবেন।
প্রশ্ন : তাহলে নির্বাচন নিয়ে আপনাদের চূড়ান্ত অবস্থান কী?
উত্তর : আমরা যখন ১৭ বছর ধৈর্য ধরতে পেরেছি, আর কয়টা দিন করতে পারব না? এ জন্য যে অনন্তকাল বসে থাকব তাও তো না। আমি বলতে না চাইলেও নির্বাচন দিতে হবে—এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে। আমার ইচ্ছা না থাকলেও আমাকে আন্দোলন করতে হতে পারে। তারা যদি ওয়ান-ইলেভেনের মতো মাইনাস করতে চায়, কেউ যদি মনে করে, একজন বিদেশে চলে গেছেন। আর কাউকে যদি মাইনাস করা যায়, এ রকম মনোভাব যদি থাকে তাহলে কী আন্দোলন হবে না? কারণ তারা কে আমাকে মাইনাস করার?
প্রশ্ন : আপনারা কী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে?
উত্তর : আমি আওয়ামী লীগ বুঝি না। কোনো দলই নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমি নই। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করবে জনগণ। দেশে কত ধরনের রাজনৈতিক দল আছে। তাদের নামধাম কিছু আছে। তারা তো একসময় অনেক বড় দল ছিল। তাদের সমাবেশে ২০০ লোকও হয় না। কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের প্রাচীন দল। ১৯২১ সালে জন্ম নিয়েছে। তার মানে বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের জনগণের থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিলীন হয়ে গেছে। বাংলাদেশে মুসলিম লীগকে কি এখন খুঁজে পাওয়া যায়? ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সেটা কি নিষিদ্ধ হয়েছে? কিন্তু তারা কোথায়? ইউনাইটেড পিপলস পার্টি অনেক বড় দল ছিল। জাসদ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে।
প্রশ্ন : আওয়ামী লীগের পরিণতি কী হতে পারে?
উত্তর : এখন আওয়ামী লীগের ‘এ’ গ্রেডের নেতা দেশে নেই। কিন্তু ‘বি’ কিংবা ‘সি’ গ্রেডের নেতা তো আছে। তাদেরও তো কোনো নড়াচাড়া নেই। আর শেখ হাসিনা তো দেশে আসবেই না। সাহস থাকলে তিনি আসুক দেশে। আমরা তো দাবিই করছি তাকে দেশে এনে বিচার করতে হবে।
প্রশ্ন : জামায়াত ও ছাত্রদের সঙ্গে বিএনপির কী জোট হতে পারে?
উত্তর : সম্ভাবনা কম। জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের জোট হতে পারে। অতীতেও হয়েছিল। দেশের ক্রান্তিকালে জামায়াত জনগণের বিরুদ্ধে ছিল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে যদি জামায়াত না যেত তখন এরশাদের পতন হয়। ১৯৯৬ সালে তাদের অবস্থানও জনগণ জানে।
প্রশ্ন : ভারতের সঙ্গে এখন আপনাদের সম্পর্ক কেমন?
উত্তর : আগে যা ছিল এখনো তাই আছে। দেশের বাইরে আমাদের বন্ধু আছে, প্রভু নেই। এটা আমাদের দলের বিদেশনীতি। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তো কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকতেই হবে। এখন আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নেই। পরবর্তী সময়ে কারা ক্ষমতায় আসবে তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ভারতকেই করতে হবে। ভারতের মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশের মানুষ যাদের পছন্দ করত না, তাদের সঙ্গে তারা সম্পর্ক তৈরি করেছিল। অর্থাত্ বাংলাদেশের জনগণের প্রতি ভারতকে সম্মান রাখতে হবে। দেখতে হবে জনগণ কী চায়।
প্রশ্ন : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরতে পারেন?
উত্তর : যেকোনো সময় আসতে পারেন। তারেক রহমান তো সব কিছু বিবেচনা করেই দেশে ফিরবেন।