সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ এক দিনে তৈরি হয়নি। একসময় ছাপার অক্ষরে যা দেখত, মানুষ তা-ই বিশ্বাস করত। গ্রামে-গঞ্জে ও শহরেও দেখেছি সাংবাদিকদের মানুষ খুব বিশ্বাস করত। ভাবত যে আমার হয়ে সাংবাদিক কথাগুলো বলবে।
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ এক দিনে তৈরি হয়নি। একসময় ছাপার অক্ষরে যা দেখত, মানুষ তা-ই বিশ্বাস করত। গ্রামে-গঞ্জে ও শহরেও দেখেছি সাংবাদিকদের মানুষ খুব বিশ্বাস করত। ভাবত যে আমার হয়ে সাংবাদিক কথাগুলো বলবে।
দীর্ঘ ১৫-১৬ বছরে সাংবাদিকরা তাঁদের নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেছেন। এ কারণে যখনই ৫ আগস্টের পর পরিবর্তন এলো, তখনো আমি দেখলাম, যারা স্বৈরাচারের দোসর, যারা ফ্যাসিবাদের দোসর, সেইসব সংবাদপত্রের মালিকানায় কিন্তু অনেক সাংবাদিক ঢুকে গেলেন। পত্রিকায় ও টেলিভিশনগুলোতে তাঁরা কিন্তু নতুন করে পুনর্বাসিত হয়ে গেলেন। বললেন, আমরা বঞ্চিত ছিলাম, গত ১৬ বছর আমরা আমাদের কাজগুলো করতে পারিনি। অথবা কোনো কোনো সাংবাদিক আছেন, বর্তমান যে অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের পক্ষেই সাফাই গাইছেন। সাংবাদিকতা হচ্ছে না। সব টেলিভিশন, পত্রিকা দেখলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, এই সরকারের একটি প্রপাগান্ডা মেশিন। তাদের পক্ষে তাদের সাফাই গাইছে। নো, সাংবাদিকতার প্রথম লাইন হচ্ছে—পৃথিবীর সব সরকার মিথ্যা বলে। সাংবাদিকতা বইয়ের প্রথম লাইন হচ্ছে, পৃথিবীর সব সরকার জনগণের কাছ থেকে তথ্য লুকায়। এটা আওয়ামী লীগ লুকায়, বিএনপি লুকায় এবং অন্তর্বর্তী সরকারও লুকায়। সাংবাদিকের দায়িত্ব হচ্ছে সেই মিথ্যার জায়গায় সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা। যেটা সরকার লুকিয়ে রাখে সেটা প্রকাশ করা। কিন্তু আমাদের সাংবাদিকতা? বর্তমানে টেলিভিশনগুলোতে আগে আওয়ামী লীগের প্রপাগান্ডা প্রচারণা হতো, এখন মনে হয় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচারণা প্রপাগান্ডা হচ্ছে। অথবা বিএনপির প্রপাগান্ডা প্রচার করছে। কারণ ধরে নিয়েছে, হয়তো বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। কাজেই এখনো আসল সাংবাদিকতা হচ্ছে না। এটা হচ্ছে সাংবাদিকের এত দিনের চর্চার ফলে একটা সেলফ সেন্সরশিপ তৈরি হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের সময় সমালোচনা করে আমি তো জেলে গেছি। আমার তো কারাগারে যেতে হয়েছে। আমার জরিমানা হয়েছে। এবারও অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললে আমাকে আবার মামলা দেয় কি না। হত্যা মামলা দেয় কি না। কারাগারে দেয় কি না। কিংবা বিএনপির সমালোচনা করব, বিএনপি সামনে আবার আসবে। এসে আমাকে আবার জেলে ঢোকায় কি না। কারাগারে ঢোকায় কি না। জামায়াত তো সামনে আসবে। তারা আমাকে বিপদে ফেলে কি না। কাজেই আসল সাংবাদিকতা, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা এখনো হচ্ছে না বাংলাদেশে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এবং পরবর্তী সরকারের এটা বোঝা উচিত যে সাংবাদিকরা সরকারের শত্রু না। তাঁরা সরকারের সমালোচনা করবেন, সরকারের ভুলত্রুটি দেখিয়ে দেবেন। এটি তাঁদের ট্রেনিং। এটি তাঁদের কাজ। তাঁদের শত্রু হিসেবে দেখলে চলবে না, যেটা আওয়ামী লীগ দেখত। তাহলে কী করতে হবে? যখন কোনো সাংবাদিক সরকারের কোনো ভুলত্রুটি, রাস্তার সমস্যা, এখানে দুর্নীতি হচ্ছে, ব্যাংকের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বলবেন, তখন সরকারের উচিত সেই জায়গাটা মেরামত করা। টাকাপাচার ঠেকানো, রাস্তা ঠিক করা। কাজেই সাংবাদিকের এই সমালোচনাগুলোকে বন্ধু হিসেবে দেখতে হবে, ভালো হিসেবে দেখতে হবে। তাঁকে শত্রু ভাবা চলবে না। এই বার্তাটা কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার জোরালোভাবে দিতে পারেনি। বিএনপির পক্ষ থেকেও জোরালোভাবে আসেনি। আমি দেখেছি দু-একজন বলেছেন, তারেক জিয়া বলেছেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন; কিন্তু জোরালোভাবে এই বার্তাটি আসেনি বিএনপির পক্ষ থেকেও। জেলা-উপজেলায় এখনো সাংবাদিকরা ভয়ে থাকেন, বিএনপির বিপক্ষে লিখলে আমার আওয়ামী লীগের সময় যে বিপদ হতো একই বিপদ আবার ঘটে কি না। কাজেই সত্যিকারের সাংবাদিকতা থেকে এখনো আমরা অনেক দূরে রয়ে গেছি।
গত তিন মাসে সাংবাদিকতা আমার কাছে খুব ইতিবাচক মনে হয়নি। মনে হয়েছে, এপিঠ আর ওপিঠ। আগে আওয়ামী লীগের চামচামি করত, বিএনপির চামচামি করত; এখন অন্তর্বর্তী সরকারের চামচামি করে। মানে এক মুঠ চিনি, একচিমটি গুড় আর আধালিটার পানি দিয়ে একটা ঘুঁটা, একটা ঘুঁটা—সাংবাদিকতা এখানে চলছে। সত্যিকারের যে বাইট সাংবাদিকতা, মানে ছোবল দেবে, সরকারের ভুলগুলো তুলে ধরবে, বিএনপি যে দখলটখল করছে দেশব্যাপী, তুলে ধরবে। আওয়ামী লীগ যে হত্যাগুলো চালিয়েছে, দুর্নীতি করেছে, পাচার করেছে, সেগুলো হয়তো কিছুটা তুলে ধরেছে, কিন্তু এদিকের বিএনপি কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারের যে ভুলগুলো, সেগুলো কিন্তু আসছে না।
সাংবাদিকতার তিনটি বড় শর্ত হচ্ছে সততা, নির্ভুলতা, পক্ষপাতহীনতা। সততা মানে সততার সঙ্গে সব সাংবাদিকতার চর্চা করতে হবে। নির্ভুলতা মানে যে তথ্য দিচ্ছেন সেটি সঠিক হতে হবে। ন্যায্যতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পক্ষপাতমুক্ত হতে হবে। আপনি আগে আওয়ামী লীগের পক্ষপাতী ছিলেন, এখন বিএনপির পক্ষপাতে এলেন কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষপাতে এলেন, তাহলে কিন্তু ন্যায্যতা হলো না। এই তিনটি সাংবাদিকতার ফান্ডামেন্টাল প্রিন্সিপল। এই তিনটির চর্চা কিন্তু সাংবাদিকতায় ফেরত আসতে হবে। এখনো কিন্তু আসেনি। আমি শুধু সাংবাদিকতা বলব না, বাংলাদেশের গত ১৫-২০ বছরে চিকিৎসক বলেন, শিক্ষক বলেন, আইনজীবী বলেন, বিচারক বলেন, প্রতিটি পেশা আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। কাজেই আমাদের প্রত্যেকের উচিত সেই পেশাগুলোর যে মর্যাদা, সেগুলো ফিরিয়ে আনা। মানে সেগুলো পুনরায় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। এবং সাংবাদিকতা পেশাও এর বাইরে না আসলে। সমস্ত পেশাকে নষ্ট করা হয়েছে। একজন বিচারক বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন না, আমি এই পেশায় সম্মানিত। দুজন প্রধান বিচারপতিকে বের করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক আমি, বলতে পারছি না। কারণ নীল দল, সাদা দল দেখেছি কিভাবে দলীয় স্তাবকতা করে। ডাক্তার দেখেন—স্বাচিপ ও ড্যাপ। কিভাবে চামচামি করে। ইঞ্জিনিয়ারদের দল আপনি দেখেন। হেন জায়গা নেই, যেখানে দলীয়করণ ও দলদাস হয়নি। ফলে প্রতিটি পেশার মর্যাদা—ব্যবসায়ী বলেন, রাজনীতিবিদ বলেন—সব পেশার মর্যাদা বাংলাদেশে ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেছে। এগুলো ফিরিয়ে আনা খুব জরুরি।
সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি—সততা, নির্ভুলতা, পক্ষপাতহীনতা বা ন্যায্যতা—এগুলো হৃদয়ে ধারণ করে যদি সাংবাদিকতা করা যায় এবং তরণদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় সাংবাদিকতার নীতি নিয়ে, কী লেখা যাবে, কী লেখা যাবে না, কার ছবি দেওয়া যাবে, কার ছবি দেওয়া যাবে না, যিনি অপরাধী বা অপরাধে অভিযুক্ত তাঁর বক্তব্য যে দিতে হবে, একজন নারী ধর্ষিত হলে তার ছবি দেওয়া যাবে না, একটা শিশু আঠারোর নিচে হলে তার ছবি যে দেওয়া যাবে না—এই যে অনেক নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ড আছে, এগুলোতে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা অনেক পিছিয়ে আছে। নৈতিক সাংবাদিকতা চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের সাংবাদিকতা বৈশ্বিক সাংবাদিকতা থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। কাজেই আমাদের নৈতিক ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা চর্চা এখন সময়ের দাবি।
অনেকগুলো কালো আইন আছে, যেটা সাংবাদিকতার পথগুলো রুদ্ধ করে। সাইবার নিরাপত্তা আইন বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন বা দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন, সেটা কিন্তু এখনো বহাল আছে। ১৯৭৪ সালের স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট এখনো বহাল। আমাদের সংবিধানে এখনো যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। সেটা কিন্তু এখনো বহাল আছে। এগুলো পরিবর্তন করতে হবে। এগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে।
সাংবাদিকতা পেশার যদি নিশ্চয়তা একজন সাংবাদিক পায়, মালিকের পক্ষ থেকে সে যদি নিয়মিত বেতন-ভাতা পায়, পেনশন পায়, গ্র্যাচুইটি পায়, প্রভিডেন্ট ফান্ড পায়, সরকারের পক্ষ থেকে তার যদি জেল-জরিমানা করা না হয়, গ্রেপ্তার করা না হয়, মন খুলে সে যদি লিখতে পারে, বিজ্ঞাপনদাতাদের সেন্সরশিপ বা চাপ যদি কম থাকে এবং তার নিজস্ব সেন্সরশিপ, সেটাও যদি সে কাটিয়ে উঠতে পারে, তাহলেই আমার মনে হয়, বাংলাদেশে তরুণ মেধাবী যারা সাংবাদিকতায় আসতে চায়, তাদের জন্য একটি বড় জায়গা তৈরি হতে পারে। কিন্তু খুব বেশি আশা আমি আসলে দেখি না। এটি মালিকের তরফেও না, সরকারের তরফেও না; অন্যদিক থেকেও সেটা আমি দেখছি না আসলে।
অনুলিখন : মানজুর হোছাঈন মাহি
সম্পর্কিত খবর
পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান বাংলাদেশের—এই তিনটি জেলার অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে গেলে দেখা যায়, ভৌগোলিক কারণে এখানকার জীবন ও জীবিকা সমতলের চেয়ে কঠিন ও কষ্টসাধ্য। উল্লেখ্য, দেশভাগের পর থেকে এ অঞ্চলের প্রেক্ষাপট পাল্টাতে শুরু করে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের অবস্থা ছিল এক রকম।
পর্যটন সম্ভাবনা
কৃষির পাশাপাশি এ অঞ্চলে পর্যটনশিল্পের অভূতপূর্ব সম্ভাবনা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে পর্যটনের ব্যবসা বেশ সরব ছিল; যদিও বা পর্যটনশিল্পের সঙ্গে এলাকার সাধারণ আদিবাসীদের সংযুক্তি খুব বেশি একটা চোখে পড়ার মতো নয়।
পরিবেশ ও ভৌগোলিক অবস্থা
সম্প্রতি পাহাড়ে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, পানিসংকটসহ উৎপন্ন পণ্য বাজারজাতকরণের অভাবে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে পাহাড়ে, বিশেষ করে বান্দরবানের কয়েকটি উপজেলায় কয়েক বছর ধরে ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ার কারণে পানিসংকট বাড়ছে। ফলে ফসল উৎপাদন এবং সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। পাহাড়ে ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে যে নীরব ঘাতকরা কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে কখনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ঝিরি-ঝরনা ও পানির উৎসস্থলগুলোতে বন সংরক্ষণ করা না হলে এ অঞ্চলে পানিসংকট আরো তীব্র হবে। অর্থনৈতিক মুক্তি বিকল্প কর্মসংস্থান এবং সচেতনতার মাধ্যমে অংশীদারির ভিত্তিতে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে এখানকার আদিবাসী সমাজকে সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।
রাজনীতি
এ অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার নিয়ে বহুদিন ধরে কথা বলে এলেও সাধারণ মানুষ এখনো ভূমিহীন হয়ে আছে। বিশেষ করে পাহাড়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষগুলোর নিজস্ব কোনো ভূমি নেই বললেই চলে। এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ আগে থেকেই প্রথাগত আইনের ওপর নির্ভরশীল। প্রথাগত আইনে ভূমির মূল মালিক রাজা। এ অঞ্চলের মানুষ ভূমির ক্ষেত্রে রাজার ওপর নির্ভরশীল এবং বিশ্বাস করে। ফলে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক জটিলতা, বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে এই সমস্যা শুরু হয় এবং পরে ১৯৭১ সালের পরে আরো নতুন মাত্রায় রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও আজ পর্যন্ত চুক্তির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখানকার মানুষের ভূমি অধিকার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা
পাহাড়ের মানুষগুলো এখনো পাহাড় সমান জীবনসংগ্রামের কষ্ট, বাধা-বিপত্তি, আর্থিক দৈন্য, নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চার অভাবসহ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে। পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন ঘটে চলেছে। আদিবাসীদের শিক্ষাদীক্ষা ও সচেতনতার অভাবে জাতীয় পর্যায়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকাণ্ড থেকে পিছিয়ে আছে। কিছু সম্প্রদায় শিক্ষিত হলেও এখনো অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ পিছিয়ে রয়েছে। ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস সমতলের মানুষের চেয়ে আলাদা হওয়ার কারণে আদিবাসী সমাজ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। এ ব্যাপারে পাঠ্যপুস্তকে সঠিক ধারণার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মিডিয়াকে এগিয়ে আসতে হবে।
পাহাড়ের জুমচাষ থেকে শুরু করে কৃষি ও পর্যটনশিল্প এখন ধসের মুখে। ৫ আগস্টের পর এ অঞ্চলের মানুষ রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি জাতিগত উসকানিমূলক দাঙ্গার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাহাড়ে উসকানিমূলক জাতিগত দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও সম্প্রতি মিডিয়ার নীরব এবং অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষামূলক ভূমিকার কারণে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ নিপীড়িত ও নিগৃহীত হয়েছে। সাধারণ মানুষ সব কিছু মিলিয়ে আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এখনো পর্যটনকেন্দ্র সবগুলো খুলে দেওয়া হয়নি।
সব কিছু মিলিয়ে পাহাড়ের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অবস্থানে ও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা—সব কিছু মিলিয়ে এর থেকে উত্তরণের জন্য জনগণ ও সরকারের সমন্বিত প্রয়াস ও উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ঐশ্বর্যমণ্ডিত অপার সম্ভাবনার একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। ভূমি অধিকার, জাতিগত উত্তেজনা, অনুন্নয়ন এবং পরিবেশগত অবক্ষয় সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার মাধ্যমে এ অঞ্চলের উন্নয়ন সম্ভব। কার্যকর শাসন ও আদিবাসী অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে এ অঞ্চলের সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করা সম্ভব।
এ অঞ্চলের মানুষ বিচ্ছিন্নতায় নয়, জাতীয় সম্পৃক্ততায় বিশ্বাস করে। শান্তি, স্থিতিশীলতা, উন্নত অবকাঠামো, কমিউনিটি, ইনক্লুসিভ ট্যুরিজম এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পাবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে প্রতিদিনের খবরের কাগজে বিচারব্যবস্থা সংস্কার অসংখ্য মানুষের আলোচনা-সমালোচনা ও আকাঙ্ক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঙ্ক্ষিত এই সংস্কার কি শুধু প্রক্রিয়ার সংস্কারে অর্জন সম্ভব, নাকি আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও সংস্কার প্রয়োজন?
প্রথমে আমরা এটা মেনে নিই যে বিচারব্যবস্থায় আস্থাহীনতা এই অঞ্চলে নতুন কিছু নয়। অবিভক্ত ভারতবর্ষে আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই বিচারব্যবস্থার সূচনা হলেও তৎকালীন বিচারব্যবস্থা গভীরভাবে সামাজিক শ্রেণি প্রথা দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং বিচারকার্য রাজতন্ত্রের সঙ্গে একীভূত ছিল। ন্যায়বিচারের আলোকবর্তিকার প্রভাব তখনো নিষ্কণ্টকভাবে সমাজে প্রতিফলিত হয়নি।
সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের সংকীর্ণ মনোভাব অনেকাংশে আমাদের জাতীয় বিচারব্যবস্থায় ফাটল ধরিয়েছে। এই ফাটল নিরাময়ে নতুন বছরে যেমন সুদৃঢ় বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিতে হবে, তেমনি সমান্তরালে সামাজিক ন্যায়বিচারও সুপ্রতিষ্ঠা করার নব উদ্যোগ নিতে হবে।
সহজ কথায়, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মূল স্লোগান হলো বৈষম্য দূরীকরণ—তা সে যেভাবেই হোক।
এটি এখন স্পষ্ট যে আমাদের জাতিগত দীর্ঘমেয়াদি উন্নতিতে সামাজিক ন্যায়বিচারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সামাজিক ন্যায়বিচারের মূল্যবোধ বাদ দিয়ে টেকসই বিচারব্যবস্থা প্রণয়ন অবাস্তব।
বিচারব্যবস্থা বলতে শুধু আদালত পরিচালনার প্রক্রিয়াকে বোঝায় না, বিচারব্যবস্থা একটা মাইন্ডসেট। বিচারব্যবস্থাকে দৃঢ় করতে হলে সবাইকে বিচারব্যবস্থাকে সম্মান করার ও স্বাধীন করার মাইন্ডসেট তৈরি করতে হবে, প্রয়োজন হবে জনগণ ও বিচারব্যবস্থার কোয়ালিশন।
তৃতীয়ত, ব্রিটিশ আমল থেকে বয়ে চলা শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব বিচার বিভাগ থেকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে নিতে হবে। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করা এখন সবচেয়ে জরুরি। কেননা শাসকের আইন নয়, বরং আইনের শাসন নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের সর্বপ্রথম দায়িত্ব। ভারতবর্ষে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক্করণের সর্বপ্রথম ধারণা দেন লর্ড কর্নওয়ালিস, ১৭৯৩ সালে। প্রস্তাব করেন নির্বাহী ও বিচার বিভাগকে আলাদা করার, যা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে অনুমোদিত হয়নি। বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালে বিখ্যাত ‘মাসদার হোসেন মামলা’ বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন করার এক যুগান্তকারী মাইলফলক রায় নিয়ে এসেছিল। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথকও করা হয়েছিল ২০০৭ সালে। তবে কার্যত বাস্তবতা ভিন্ন; সেই মামলার বাদী সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন কিছুদিন আগেও এক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়ন হলে আমাকে এত কথা বলতে হতো না।’ তার মানে হচ্ছে, আমরা এখনো স্বাধীন বিচারব্যবস্থা বুঝে পাইনি। বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। তবে একই সঙ্গে বিচারকদেরও জবাবদিহির নিয়মতান্ত্রিক জায়গায় আনতে হবে, যেন বিচারকরা স্বৈরতন্ত্র চর্চা করতে না পারেন।
বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে আইনজীবীদের গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের উচিত আইনজীবীদের মান ও ইথিক্স নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করে আইনজীবীদের কাজের মানের ওপর প্রতিবছর প্রতিবেদন তৈরি করা, আইনজীবীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং আইনজীবীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাহলে আইনজীবী, বিচারক ও বিচারপ্রার্থীর মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নির্ণয় হবে।
গত ৩ অক্টোবর ২০২৪ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার অনুমোদনক্রমে বিচার বিভাগকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করার লক্ষ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। আমি মনে করি, একটি প্রগতিশীল বিচারব্যবস্থার জন্য আমাদের একটি স্বাধীন ও স্থায়ী বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন দরকার, যারা সময়ে সময়ে বিচারব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার প্রস্তাব দেবে, বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও অস্বচ্ছতা তুলে ধরবে, বিচারপ্রার্থীর সুবিধা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় লিগ্যাল এইড ও আইনজীবীদের পারফরম্যান্স তুলে ধরবে এবং বিচার বিভাগকেও জবাবদিহির আওতায় আনবে, যাতে দেশের জনগণ বিচারব্যবস্থার ওপর বলিষ্ঠ আস্থা আনতে পারে।
বিচারব্যবস্থা সংস্কার একটি বিস্তর বিষয়, তবে আমরা বিশ্বাস করি, জনসাধারণের বিচারিক প্রক্রিয়া সংস্কারের সঠিক মনোভাব তৈরি হলে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হলে নির্ভরযোগ্য বিচার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে বিচারব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যেন বিচারপ্রার্থীদের শেষ ভরসার জায়গা অন্তত আদালত প্রাঙ্গণ হয়। আমরা খুবই আশাবাদী, কেননা নতুন তরুণসমাজ আজকে সচেতন, শিক্ষিত এবং সাম্যবাদী অধিকার নিশ্চিতে উদ্যমী। তাই রাষ্ট্রের সব কার্যনির্বাহী ও নীতিনির্ধারকসহ সব স্তরের মানুষের কাছে একটি শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা বিনির্মাণে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণের আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
শাসন বদলায়, ব্যবস্থাপত্র বদলায় না। দুই যুগেরও বেশি সময়ের পেশাদার সাংবাদিকতার নির্যাস এটুকু। দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর লেখার শুরুটা এমন মন খারাপ করা হবে ভাবিনি। কালের কণ্ঠের প্রথম কপি পাঠকের হাতে যাওয়ার আগের প্রস্তুতি পর্ব থেকে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।
খেলাধুলা বিনোদনের অংশ। এর দিগন্তজুড়ে আনন্দ আর উৎসব। প্রিয় দলের হারের বেদনাও অবশ্য আছে।
এই খেলোয়াড়ি মনোভাবটাই আমাদের তৈরি হয়নি। ম্যাচ জিতে উঠে আসা খেলোয়াড়কে সীমাহীন তেজোদ্দীপ্ত দেখায়।
পর পাকিস্তানকে কি বাংলাদেশ বলেকয়ে হারাবে? নাকি ভারত অজেয়? কোনোটিই চূড়ান্ত নয়, ভারতের বিপক্ষেও জিতেছে বাংলাদেশ। ভারত কেন, নির্দিষ্ট দিনে যেকোনো দলকেই হারাতে পারে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
এটা বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বেলায়ও প্রযোজ্য। ট্রফি জেতা দল পরের ম্যাচেই হারতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কিংবা ওপরের সারির দলের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য আছে। চ্যাম্পিয়নরা বেশির ভাগ সময় হাসিমুখে মাঠ ছাড়ে। আর বাংলাদেশের বেলায় অপেক্ষায় থাকতে হয় সেই বিশেষ দিনটির জন্য। মোদ্দাকথা, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখনো শীর্ষ সারির দল হয়ে উঠতে পারেনি। এই না পারার পেছনে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের স্টেকহোল্ডারদের কমবেশি দায় আছে।
ক্রিকেটকেই উদাহরণ ধরছি। ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে ২০১৯ সালের আসর পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বর্ণসময় বলা যায়। যদিও ওই চার বছরে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ আর কিছু দ্বিপক্ষীয় সিরিজ ছাড়া কিছু জেতেনি বাংলাদেশ। তবে একটা বিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, বুঝি উন্নতির সিঁড়ি খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ। আদতে সে রকম কিছু ঘটেনি কারণ, মিরপুরের প্রতিটি জয়ে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস করেছে সবাই। কেউ এটা ভাবেনি যে এমন উইকেট বিশ্বের আর কোথাও মিলবে না। শীর্ষে পৌঁছতে হলে বিশ্বের সব প্রান্তে খেলার প্রস্তুতি নিতে হয়। সেসব হয়নি। বরং মিরপুরের সহায়ক উইকেটে পাওয়া জয়ে উটপাখির মতো মুখ গুঁজে ছিল সবাই। ফল যা হওয়ার তা-ই, অনভ্যস্ত কন্ডিশনে হঠাৎ বৃষ্টিতে চড়া মেকআপে মাখামাখি অবস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেটের! এমন পরিস্থিতিতেও তৎকালীন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান কোষাগারে হাজার কোটি টাকা আমানত থাকা নিয়ে যে বাগাড়ম্বর করতেন, তা সহ্য করা কঠিন ছিল।
ক্রিকেটের কথা বেশি বলছি কারণ, দেশের এই একটি ফেডারেশনেই খেলার মানোন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থকড়ি ছিল এবং আছে। দ্বিতীয় ধনী ফেডারেশন ফুটবল। তবে ক্রিকেটের সঙ্গে ব্যবধান বিস্তর। ফিফা, এএফসি কিংবা বিভিন্ন টুর্নামেন্ট থেকে পৃষ্ঠপোষকতা বাবদ যে অর্থাগম ঘটে, তা দিয়ে সাফ অঞ্চলের সীমানা ডিঙানো স্রেফ অসম্ভব। বাকি ফেডারেশনগুলোর অর্থব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা না করাই তাদের জন্য অপেক্ষাকৃত সম্মানজনক!
সবচেয়ে মজার ব্যাপার, নিদারুণ অর্থকষ্টে ভোগা সেইসব ফেডারেশনের চেয়ারে বসতে আগ্রহীর সংখ্যা কখনো কমেনি। অসীম আগ্রহ সত্ত্বেও ফেডারেশনে অর্থাগম ঘটাতে পারেননি তাঁরা। তবে ফেডারেশনের পদ ব্যবহার করে রাজনীতি কিংবা ব্যবসার মাঠে জয়ী হয়েছেন। মাঝখান থেকে হারিয়ে গেছেন সত্যিকারের সংগঠকরা, যাঁরা স্রেফ ভালোবাসার সুতায় বাঁধা পড়েছিলেন খেলার মাঠে। তাঁরা হারিয়ে গেছেন, সঙ্গে নিয়ে গেছেন খেলার মাঠের নিখাদ আনন্দ। হার-জিত ঘিরে তাই উগ্রতার ব্যারোমিটার ঊর্ধ্বমুখী।
এই সমস্যার সমাধান কী? চট করে উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে এটুকু বুঝি, ক্রীড়াঙ্গনে মানসিকতার সংস্কার অতি জরুরি।
এই সংস্কারের শুরুটা হতে হবে শীর্ষ থেকে। জুলাই-আগস্ট উত্তাল আন্দোলনের আগে ‘আমিত্ব’ গ্রাস করেছিল পুরো দেশকে। ক্রীড়াঙ্গন থেকে এই আমিত্বকে প্রথমে বিসর্জন দিতে হবে। বাংলাদেশ জিতলেই প্রেসিডেন্ট বক্সে বসে বিশেষ কারোর আত্মতুষ্টির হাসি দেখানো বন্ধ করতে হবে। আপনার এই হাসির চেয়ে পূর্ব গ্যালারির রোদে পোড়া দর্শকের উচ্ছ্বাস অনেক বেশি অর্থবহ। আপনার কোষাগারে কোটি টাকা লুটোপুটি খায় রোদে পুড়ে খেলা দেখা দর্শকের কল্যাণেই। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নবনির্বাচিত সভাপতি তাবিথ আউয়াল এখন পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর অদ্যাবধি তীব্র প্রচারমুখী মনে হয়নি তাঁকে। সযতনে তিনি এড়িয়ে চলেন সংবাদমাধ্যমকে। একজন মুখপাত্রকে দায়িত্ব দিয়েছেন, যিনি নিয়ম করে বাফুফের হাল-হকিকত জানান মিডিয়াকে। অবশ্য বাংলাদেশের জল-হাওয়ায় এই ধারা তিনি কত দিন ধরে রাখতে পারেন, সেটি সময়ই বলবে।
পরিবর্তন এসেছে ক্রিকেট বোর্ডেও। এই প্রথমবার জাতীয় দলের সাবেক কোনো অধিনায়ক বিসিবির শীর্ষাসনে বসেছেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) বিধি-নিষেধের কারণে পূর্বতন বোর্ড ভেঙে দিতে পারেননি ফারুক আহমেদ। তবে পরিচালনা পর্ষদের সভায় টানা অনুপস্থিত থাকায় গঠনতন্ত্র মেনে অনেককে বাদ দিয়েছেন তিনি। আগের বোর্ডের যাঁরা এখনো আছেন, তাঁরা খুব স্বস্তিতে নেই বলেই খবর। মোটামুটি ‘ওয়ান ম্যান শো’ ফারুক আহমেদের বর্তমান বোর্ড। সেই একমেবাদ্বিতীয়ম স্বয়ং বোর্ড সভাপতি। একা হাতে একের পর এক পৃষ্ঠপোষক এনেছেন ফারুক, যা প্রশংসনীয়। তবে চলমান বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে নেবে বলে মনে হচ্ছে।
বিপিএলের ‘গা গরম’ করা থেকেই সেই পরীক্ষা শুরু ফারুকের। জমকালো আসরের প্রতিশ্রুতি দিতে যে কনসার্টের আয়োজন করেছেন, তা নিয়ে গম্ভীর আলোচনা হচ্ছে। এক ঢাকার আয়োজনের পেছনেই খরচ হয়েছে ছয় কোটি টাকারও বেশি। আমজনতা এরই মধ্যে অঙ্ক করে বলছে, যে টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন দলের অর্থ পুরস্কার দুই কোটি, সেই টুর্নামেন্টের পদধ্বনি শোনাতে এত ব্যয় কেন?
অবশ্য এবারের বিপিএল আদৌ লাভজনক হয় কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। এবারের ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি, এমনকি পুরনো বকেয়া টুর্নামেন্ট শুরুর আগেও বুঝে পায়নি বিসিবি। বরং দুশ্চিন্তা আছে ভবিষ্যতে সেই বকেয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে। কারণ বেশ কটি ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেয় না। নিয়মানুযায়ী সেটি বুঝিয়ে দিতে হয় বিসিবিকে। এবারের বিপিএল পূর্বাভাস বলছে, খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক পরিশোধ নিশ্চিত করতে স্থায়ী আমানতের অংশবিশেষ ভাঙাতে হবে বিসিবিকে।
এই ব্যাপারগুলো আমিত্বের পথে প্রারম্ভিক যাত্রা। দীর্ঘ পেশাগত জীবনে ধুঁকে ধুঁকে এখন অন্তত এটুকু ‘অ্যান্টিসিপেট’ করতে শিখেছি। এসবের পরিবর্তন না হলে সংস্কারের যাবতীয় চেষ্টা বৃথা যাবে।
এখন প্রশ্ন একটাই—রক্ত দিয়ে পাওয়া সংস্কারের এই সুযোগ কি আমরা হেলায় হারাব?