ইসলামে যেভাবে রোজার প্রবর্তন হয়

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা
ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা
শেয়ার
ইসলামে যেভাবে রোজার প্রবর্তন হয়
ছবি : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি

আরবি সাওম ও সিয়াম শব্দের অনুবাদ হিসেবে রোজা ব্যবহার হয়ে থাকে। রোজা ফারসি থেকে বাংলায় এসেছে। পবিত্র কোরআনে সাওম শব্দটি এক জায়গায় (সুরা : মারইয়াম, আয়াত : ২৬) আর সিয়াম শব্দটি ৯ জায়গায়

[সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৩, ১৮৭ (দুইবার), ১৯৬ (দুইবার); সুরা : নিসা, আয়াত : ৯২; সুরা : মায়িদা,

আয়াত : ৮৯, ৯৫; সুরা : মুজাদালা, আয়াত : ৪] ব্যবহার হয়েছে। বিভিন্ন হাদিসে শব্দ দুটির প্রচুর ব্যবহার রয়েছে।

সাওম ও সিয়ামের মূল অক্ষর একই।

ইসলামী পরিভাষায় সাওম বা সিয়াম হলো, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকা। যুগে যুগে রোজার বিধান ছিল এবং ইসলামেও এ বিধান প্রবর্তন হয়েছে।    

ইসলাম-পূর্ব যুগে রোজা : ইসলাম-পূর্ব সব যুগেই রোজার বিধান ছিল।

আলী (রা.) ও হাসান বসরি (রহ.) থেকে বর্ণিত আছে যে আদম (আ.)-এর যুগ থেকে শুরু করে সব উম্মতের ওপরই রোজা ফরজ ছিল।

(ইজুহুল মিশকাত, দ্বিতীয়-খণ্ড,  পৃষ্ঠা-৬৫৬)

মুুসা (আ.)-এর রোজা প্রসঙ্গে কোরআন মজিদে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, স্মরণ করো, মুসার জন্য আমি ৩০ রাত নির্ধারিত করি এবং আরো ১০ দ্বারা তা পূর্ণ করি, এভাবে তার প্রতিপালকের  নির্ধারিত সময় ৪০ রাতে পূর্ণ হয়।

(সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৪২)

মুুসা (আ.) তাওরাতপ্রাপ্তির জন্য প্রথমে ৩০ দিন, পরে আরো ১০ দিন বাড়িয়ে মোট ৪০ দিন রোজাসহ ইতিকাফ অবস্থায় ধ্যানমগ্ন থেকে ছিলেন।

ইহুদিদের আশুরার রোজা প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করে দেখলেন যে ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করে। তিনি তাদের এদিনের রোজার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বলল, এদিনে মুসা (আ.) ফেরাউনের ওপর বিজয় লাভ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা (মুসলমানরা) মুসা (আ.)-এর অধিক নিকটবর্তী।
কাজেই তোমরাও রোজা পালন করো। (সুনান আদ-দারিমি, হাদিস : ১৭৫৯)

দাউদ (আ.)-এর রোজা সম্পর্কে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আল-আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেন, তুমি কি সব সময় রোজা রাখো আর রাতভর নামাজ আদায় করে থাকো? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বলেন, এরূপ করলে তোমার চোখ বসে যাবে এবং শরীর দুর্বল হয়ে যাবে। যে বছরজুড়ে রোজা রাখল সে যেন রোজাই রাখল না। আর তুমি প্রতি মাসে তিন দিন করে রোজা রাখো, তাই বছরজুড়ে রোজা রাখা বা বছরজুড়ে রোজা রাখার মতো। তিনি বলেন, আমি এর চেয়ে বেশি সামর্থ্য রাখি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তাহলে তুমি দাউদ (আ.)-এর রোজা রাখো। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন আর এক দিন রোজা ছেড়ে দিতেন। তিনি শত্রুর সম্মুখীন হলে পালায়ন করতেন না।

(বুখারি, হাদিস : ১৮৭৮)

ইসলাম-পূর্ব যুগের সামগ্রিক রোজা বিষয়ে আল্লাহ বলেন, হে মুমিনরা! তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো। (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৩)

ইসলামে রোজার প্রবর্তন : ইসলাম-পূর্ব সব যুগে রোজার বিধান থাকলেও সেসব শর্ত, প্রকৃতি ও ধারাবাহিকতায় ইসলামে রোজা ফরজ হয়নি; বরং ইসলামে রোজা স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। আত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণের আধার। রহমত, বরকত ও মাগফিরাত দ্বারা সমৃদ্ধ। স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যে ভরপুর মাসব্যাপী এই রোজা দ্বিতীয় হিজরিতে ফরজ করা হয়। রাসুল (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার দ্বিতীয় বছরে শাবান মাসের শেষ দশকে রমজানের রোজা আদায়ের নির্দেশনা সংবলিত সুরা বাকারার ১৮৩-১৮৫ আয়াত অবতীর্ণ হয়। অবশ্য রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা (১০ মহররম) এবং আইয়ামে বিজ তথা চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর সেসব রোজার বিধান নফলে পরিণত হয়েছে। মুয়াজ ইবন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নামাজ তিন ধাপে পরিবর্তিত হয়েছে এবং রোজাও তিন ধাপে পরিবর্তিত হয়েছে। রোজার তিন ধাপের তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

প্রথম ধাপ : রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি মাসে তিন দিন (আইয়ামে বিজ তথা চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা) এবং আশুরার রোজা (১০ মহররম) পালন করতেন।

দ্বিতীয় ধাপ : এরপর অবতীর্ণ হয়(হে মুমিনরা! তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো। রোজা নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পুরো করে নিতে হবে। তা যাদের অতিশয় কষ্ট দেয় তাদের কর্তব্য, এর পরিবর্তে ফিদয়াএকজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সত্ কাজ করে তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর রোজা পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণপ্রসূ যদি তোমরা জানতে)।

(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৩-১৮৪)

তখন যে চায় রোজা রাখে আর যে চায় রোজা না রেখে এর পরিবর্তে ফিদয়াএকজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করে। এভাবে এক বছর যায়।

তৃতীয় ধাপ : এর পর অবতীর্ণ হয়, রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সত্ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে রোজা পালন করে। আর কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পুরো করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য ক্লেশকর তা চান না। এ জন্য যে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদের সত্ পথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো। (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৫)

তার পর থেকে রমজান মাস উপস্থিত হলে রোজার আবশ্যকতা প্রমাণিত হয়। আর মুসাফিরদের জন্য কাজা আদায় এবং রোজা আদায়ের সামর্থ্য নেইএমন বৃদ্ধদের জন্য ফিদয়া প্রদানের সুযোগ অব্যাহত থাকে। (আবু দাউদ,  হাদিস : ৫০৭)

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক

আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা

    পর্ব, ৭২০
শেয়ার
কোরআন থেকে শিক্ষা

আয়াতের অর্থ : ‘যারা এই অপবাদ রচনা করেছে তারা তোমাদেরই একটি দল। এটাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে কোরো না, বরং এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর; তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে তাদের কৃত পাপকর্মের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তার জন্য আছে মহাশাস্তি। ...তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সে কারণে তারা আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী।’

(সুরা : নুর, আয়াত : ১১-১৩)

আয়াতগুলোতে উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.)-এর পবিত্রতা ঘোষণা করা হয়েছে।

শিক্ষা ও বিধান

১. ‘অপবাদ রটনাকারীরা একটি দল’ বাক্য দ্বারা প্রমাণিত হয় ইসলাম সম্পর্কে বিরূপ চিন্তা লালনকারীরা মুসলিম পরিচয় ধারণ করলেও তারা ভিন্নই, তারা মুসলমানের অন্তর্ভুক্ত।

২. আয়াতগুলো আয়েশা (রা.)-এর মর্যাদা প্রমাণ করে। কেননা স্বয়ং আল্লাহ তাঁর পবিত্রতার সাক্ষ্য দিয়েছেন।

৩. অপবাদ ছড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার ভূমিকা অনুসারে পরকালে শাস্তি ভোগ করবে।

সবচেয়ে বেশি শাস্তি ভোগ করবে অপবাদ রচনাকারী, তারপর প্রচারকারী; অতঃপর সমর্থনকারী।

৪. কারো ব্যাপারে অপবাদ দেওয়া হারাম। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মুসলমানের প্রতি সুধারণা পোষণ করা ওয়াজিব।

৫. অপবাদ দেওয়ার পর চারজন সাক্ষী হাজির করতে না পারলে ব্যক্তি শাস্তি ভোগ করবে।

(বুরহানুল কুরআন : ২/৫৬৮)

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
পর্ব : ১৩

তারাবিতে কোরআনের বার্তা

শেয়ার
তারাবিতে কোরআনের বার্তা

সুরা কাহফ

সুরা কাহফের গোড়ার দিকে কোরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে, এতে কোনো বক্রতা নেই। কোরআন এসেছে মানুষকে সুসংবাদ দেওয়া ও সতর্ক করার জন্য। এর পরই পৃথিবীর বিভিন্ন সৌন্দর্য ও আশ্চর্য ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, যেগুলো মহান আল্লাহর মহাশক্তির প্রমাণ বহন করে। এই সুরায় প্রধানত তিনটি অতি বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।

তাহলোএক. আসহাবে কাহফ বা গুহা অধিবাসীদের ঘটনা, দুই. মুসা (আ.) ও খিজির (আ.)-এর ঘটনা, তিন. জুলকারনাইনের ঘটনা। এই তিনটি ঘটনার পাশাপাশি আরো কয়েকটি ঘটনার দিকে ইঙ্গিত রয়েছে এই সুরায়। ঘটনাগুলো বর্ণনার পাশাপাশি এর শিক্ষণীয় দিকগুলোও তুলে ধরা হয়েছে। বিপদ ও দুর্দশার সময় করণীয় সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

 

আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত

১. সাপ, বিচ্ছু ও হিংস্র প্রাণীও পৃথিবীর জন্য সৌন্দর্যস্বরূপ। কারণ সমাগ্রিক বিচারে এগুলোও কল্যাণকর। (আয়াত : ৭)

২. হিদায়াত বৃদ্ধির অর্থ হলো, ঈমানের ওপর অটল থাকা, নেক আমলের তাওফিক দেওয়া, আল্লাহর জন্য পার্থিব মোহ ও সম্পর্ক ত্যাগ করা। (আয়াত : ১৩)

৩. কোরআনের ঘটনা বর্ণনার পদ্ধতি হলো, এর শব্দ-বাক্য হবে সংক্ষিপ্ত, মর্ম হবে বিস্তৃত।

(আয়াত : ১৩)

৪. সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্যের মাপকাঠি নয়। কেননা কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভুলের ওপর এবং স্বল্পসংখ্যক মানুষ সত্যের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। (আয়াত : ১৬)

৫. মানুষ যখন দ্বিধা কাটিয়ে আল্লাহর পথে চলে তখন আল্লাহর রহমত তার সঙ্গী হয়। (আয়াত : ১৬)

৬. শিকার ও সম্পদ পাহারার মতো প্রয়োজন ছাড়া ইসলামে কুকুর পালন নিষিদ্ধ। (আয়াত : ১৮)

৭. ক্রয়-বিক্রয়সহ বিভিন্ন কাজে উকিল বা প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া জায়েজ আছে।

(আয়াত : ১৯)

৮. শরিকানার ভিত্তিতে কাজ করা বৈধ। (আয়াত : ১৯)

৯. মুমিন অপরিচিত স্থানে খাবার গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করবে। সে হালাল, পরিচ্ছন্ন ও উপাদেয় খাবার গ্রহণ করবে। (আয়াত : ১৯)

১০. ঈমান ও ইসলাম রক্ষা এবং নিরাপত্তার স্বার্থে নিজের পরিচয় গোপন করা বৈধ। (আয়াত : ১৯)

১১. শরিয়তে কবরে সৌধ নির্মাণ করা, এমনকি তা পাকা করা বৈধ নয়। (আয়াত : ২১)

১২. মানুষের স্মরণে মসজিদ নির্মাণ করা জায়েজ। (আয়াত : ২১)

১৩. বৈধ কোনো কথা ও কাজের ইচ্ছা করলে বা অঙ্গীকার করলে ইনশাআল্লাহ বলা মুস্তাহাব। গুনাহের কাজে ইনশাআল্লাহ বলা নিষিদ্ধ। (আয়াত : ২৩)

১৪. পুরুষের জন্য রেশমি কাপড় ও সব ধরনের স্বর্ণের অলংকার নিষিদ্ধ। (আয়াত : ৩১)

১৫. মুমিন ধনীর সামনে অবনত হয়ে যাবে না, বরং তাদেরকে ঈমান, ইসলাম ও নৈতিকতার পথে আহ্বান জানাবে। (আয়াত : ৩৭)

১৬. ঘরে প্রবেশের সময় এই দোয়া পড়া উচিতমাশাআল্লাহ লা হাওলা ওলা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ। (আয়াত : ৩৯)

১৭. সত্যবিমুখতা নিজের প্রতি সবচেয়ে বড় জুলুম। (আয়াত : ৫৭)

১৮. সফরসঙ্গী ও সেবক হিসেবে যুবক ও সামর্থ্যবান লোক নিয়োগ দেওয়া উত্তম। (আয়াত : ৬০)

১৯. ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে শিক্ষার্থীর দৃঢ় সংকল্প আবশ্যক। যেন দীর্ঘ সফর ও তার কষ্ট সহ্য করতে পারে। (আয়াত : ৬০)

২০. নিজের দৃঢ় ইচ্ছা ও পরিকল্পনা থাকার পরও মুমিন নিজের কাজ আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করে। (আয়াত : ৬৯)

২১. বড়রাও ভুল স্বীকার ও অক্ষমতা প্রকাশ করতে পারে। এতে মর্যাদার হানি হয় না। (আয়াত : ৭৩)

২২. শরিয়তে তিনটি অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড : ক. নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, খ. ঈমান আনার পর কুফরি করা, গ. বিয়ের পর ব্যভিচার করা। (আয়াত : ৭৪)

২৩. চলাচলের সময় সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। (আয়াত : ৮২)

২৪. শাসকের দায়িত্ব হলো দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করা।

(আয়াত : ৮৭)

২৫. আল্লাহর ওলি তারাই, যারা তাঁর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসার পথ অনুসরণ করে এবং যারা তাঁর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির পথ পরিহার করে। (আয়াত : ১০২)

গ্রন্থনা : মুফতি আতাউর রহমান

 

 

মন্তব্য
খাদিজা আরসালান খাতুন

অসংখ্য মানুষকে ইফতার করাতেন যে রাজকন্যা

আলেমা হাবিবা আক্তার
আলেমা হাবিবা আক্তার
শেয়ার
অসংখ্য মানুষকে ইফতার করাতেন যে রাজকন্যা

সেলজুক রাজকন্যা খাদিজা আরসালান খাতুন ছিলেন একজন অতি দানশীল নারী। আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে বহু কল্যাণমূলক কাজ করিয়েছেন। তিনি বাগদাদ ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক মাদরাসা, মসজিদ, খানকা ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি সারা বছর মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন।

মাহে রমজানে তাঁর দানের পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি পেত।

তাঁর পুরো নাম খাদিজা বিনতে দাউদ বিন মিকাইল বিন সেলজুক। তিনি আরসালান খাতুন নামেই অধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন সেলজুক সালতানাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জুগরি বেগের কন্যা এবং সুলতান উলুপ আরসালানের বোন।

সুলতান মালিক শাহের ফুফি। সেলজুক রাজবংশে তাঁর অনন্য মর্যাদা ও প্রভাব ছিল।

১০৫৬ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা কায়িম বিআমরিল্লাহর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর বিয়ের মহর ছিল এক লাখ দিনার।

এই বিয়ের মাধ্যমে উভয় রাজবংশের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সে সময় দুর্বল আব্বাসীয় খেলাফতের অবস্থা ছিল নিভুনিভু। তাই এই বিয়ের মাধ্যমে আব্বাসীয় খলিফা মূলত সেলজুকদের সহযোগিতা কামনা করেছিলেন। সেটা বাস্তবেও রূপ নিয়েছিল। ৪৫০ হিজরিতে ফাতেমিরা বাগদাদ দখল করে নেয় এবং খলিফা কায়িম বিআমরিল্লাহকে নির্বাসনে পাঠায়।
তখন সুলতান তুগরল বেগ তাঁকে ও তাঁর রাজত্ব উদ্ধার করেন। খলিফা কায়িম বিআমরিল্লাহ ৪২২ থেকে ৪৬৭ হিজরি পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ৪৬৭ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। খাদিজা আরসালান খাতুনের ছেলে মুহাম্মদ জাখিরাতুদ্দিন এবং নাতি আবদুল্লাহ আল মুক্তাদি বিআমরিল্লাহও পরবর্তী সময়ে খলিফা হন। অবশ্য প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করেছিলেন।

খালিফা কায়িম বিআমরিল্লাহ ছিলেন একজন দ্বিনদার গুণী শাসক। আল্লামা ইবনুল আসির তাঁর সম্পর্কে লেখেন, তিনি ছিলেন সুন্দর চেহারা ও অবয়বের অধিকারী। তিনি একজন আল্লাহভীরু, ন্যায়পরায়ণ, দ্বিনদার, ইবাদতগুজার শাসক ছিলেন। তিনি সারা বছর নিয়মিত রোজা রাখতেন। আল্লাহর প্রতি তাঁর আস্থা ও বিশ্বাস ছিল অগাধ। তিনি অধিক পরিমাণ দান করতেন। তিনি শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সুন্দর হস্তলিপির অধিকারী ছিলেন। তাঁর কাছে চেয়ে কেউ খালি হাতে ফিরে যায়নি। ৪৫১ হিজরিতে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পর তিনি কখনো রাতে ঘুমাননি। সারা রাত তিনি নামাজ ও সিজদায় কাটাতেন। ঐতিহাসিকরা লেখেন, খাদিজা আরসালান খাতুন স্বামীর এসব গুণ নিজের ভেতর ধারণ করেছিলেন। স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতা তাঁর জনকল্যাণমূলক কাজের পরিধি বিস্তৃত হয়েছিল।

খাদিজা আরসালান খাতুন বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করেছিলেন। মসজিদ, মাদরাসা, খানকা ও হাসপাতালের বাইরে তিনি রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য কূপ খনন করে মানুষের পানির কষ্ট দূর করেন। আধুনিক ইরানের ইয়াজদ অঞ্চলের দারায় এখনো তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি মসজিদ ও মিনার টিকে আছে।

তাঁর একটি জনকল্যাণমূলক কাজ ছিল মানুষকে নিয়মিত খাবার খাওয়ানো। তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে আলেম-ওলামা ও জ্ঞানীদের আমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। পাশাপাশি দরিদ্র অসহায় মানুষের ভেতরও খাবার পরিবেশন করতেন, বিশেষত রমজানে খাদিজা আরসালানের দানশীলতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেত। তিনি রমজান মাসে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে ইফতার করাতেন, আলেমদের সম্মানে বিশেষ মেহমানদারির আয়োজন করতেন। অসহায় ও দুস্থ মানুষকে দুই হাতে দান করতেন। ঈদুল ফিতরের দিন তিনি শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষকে নগদ অর্থ, খাবার ও পোশাক বিতরণ করতেন।

এই মহীয়সী নারীর মৃত্যু সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা যায়, আধুনিক ইরানেই তাঁর মৃত্যু হয় এবং এখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। আল্লাহ তাঁর কবরকে শীতল করুন। আমিন।

তথ্যসূত্র : আল বিদায়া ওয়ান

নিহায়া : ১৫/৭৩৪; আল কামিল ফিত

তারিখ : ৮/১৩৪; তারিখে ইবনে

খালদুন : ৩/৫৬৯; আল ওয়াফি বিলওয়াফিয়্যাত : ১৩/১৮৩।

 

মন্তব্য

নারীদের সুবিধার্থে ইসলামী বিধানের সহজীকরণ

শরিফ আহমাদ
শরিফ আহমাদ
শেয়ার
নারীদের সুবিধার্থে ইসলামী বিধানের সহজীকরণ

নামাজ ও রোজা গুরুত্বপূর্ণ দুটি ইবাদত। এই ইবাদত নারী-পুরুষ সবার ওপর ফরজ। তবে শারীরিক গঠন ও নারীত্বসুলভ স্বাভাবিক পার্থক্যের কারণে নারীদের জন্য কিছু ক্ষেত্রে নামাজ ও রোজা পালন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে শিথিলতা ও সহজীকরণ করে দেওয়া হয়েছে।

এটি তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে করুণা ও রহমত।

 

নামাজ ও রোজা নিষিদ্ধ

মাসিক (হায়েজ) হওয়া নারীদেহের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রতি মাসে সঠিক সময়ে মাসিক শুরু হওয়ার মাধ্যমে নারীদের শারীরিক সুস্থতা ও সন্তান ধারণে সক্ষমতা নিশ্চিত হয়। একজন নারীর মাসিকের সর্বনিম্ন সময় তিন দিন আর সর্বোচ্চ সময় ১০ দিন।

তিন দিন থেকে ১০ দিন পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদে মাসিক চলাকালে নামাজ ও রোজার বিধান স্থগিত রাখা হয়েছে। (বুখারি, হাদিস : ১৮২৭)

 

রোজার কাজা আদায় করা

মাসিকের দিনগুলোতে এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সর্বোচ্চ ৪০ দিন পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা নারীদের জন্য নামাজকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতি দিয়েছেন। তবে যদি এর আগেই কেউ পবিত্র হয়ে যায় তাহলে পবিত্রতার বিধান শুরু হয়ে যায়। কিন্তু রোজা স্থায়ীভাবে মাফ হয় না।

হায়েজ বা নিফাস শেষে আবার রোজার কাজা আদায় করতে হয়। মুআজা (রহ.) থেকে বর্ণিত, এক মহিলা আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করল, আমাদের কেউ কি তার হায়েজের দিনগুলোর নামাজ কাজা করবে? আয়েশা (রা.) বললেন, তুমি কি হারুরিয়্যা (খারেজি)? রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে আমাদের কারো হায়েজ হলে পরে তাকে (নামাজ) কাজা করার নির্দেশ দেওয়া হতো না।

(মুসলিম, হাদিস : ৬৫৪)

 

নারীদের জন্য শিথিল বিধান

আল্লাহ তাআলা গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীর জন্য রোজার হুকুম শিথিল করে দিয়েছেন। দুগ্ধদানকারী নারী রোজা রাখলে যদি সন্তান দুধ না পায় আর ওই সন্তান অন্য কোনো খাবারেও অভ্যস্ত না হয়, তাহলে সন্তানের মৃত্যু বা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা দেখা দিলে তিনি রোজা ভাঙতে পারবেন এবং পরে কাজা আদায় করবেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা মুসাফির থেকে অর্ধেক নামাজ ও রোজা কমিয়ে দিয়েছেন আর গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণী মহিলাদের জন্য রোজা পালন মাফ করে দিয়েছেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৭১৫)

 

মাসিক চলাকালীন তাওয়াফ

হজ পালনকালে ঋতুস্রাব হলে তাওয়াফ ছাড়া অন্য আমলগুলো করা যাবে। তবে ফরজ তাওয়াফ পরে পবিত্র হয়ে আদায় করতে হবে। (বুখারি, হাদিস : ৫১৫০)

 

ইস্তেহাজা অবস্থায় নামাজ ও রোজা

স্ত্রীলোকের বিশেষ অঙ্গ থেকে হায়েজের সর্বনিম্ন সময় তিন দিন থেকে কম অথবা অভ্যাসের অতিরিক্ত ১০ দিনের চেয়ে বেশি যে রক্তস্রাব হয় শরিয়তের বিধানে সেটা হলো ইস্তেহাজা। ইস্তেহাজার কারণে নামাজ ও রোজা মাফ হয় না। অতএব, ইস্তেহাজার কারণে নামাজ ও রোজা কাজা করতে পারবে না। প্রত্যেক ওয়াক্তে নতুন করে অজু করে নামাজ আদায় করতে হবে। আয়েশা (রা.) বলেন, ফাতিমা বিনতে আবু হুবায়শ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) -এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার ইস্তেহাজা হয়েছে (সব সময়ই রক্ত ঝরে), কখনো আমি পবিত্র হই না। আমি কি নামাজ ছেড়ে দেব? তিনি বললেন, না, ওটা শিরার (ধমনি) রক্ত, হায়েজ নয়। যখন হায়েজ আসবে তখন নামাজ ছেড়ে দেবে আর যখন তা চলে যাবে তখন তোমার শরীর থেকে রক্ত ধুয়ে ফেলবে এবং নামাজ আদায় করবে।

(মুসলিম, হাদিস : ৬৪৬)

 

হায়েজ-নেফাস অবস্থায় আমল

হায়েজ ও নেফাস অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াত করা নিষেধ। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, হায়েজ বিশিষ্ট মহিলা এবং যাদের ওপর গোসল ফরজ তারা কোরআনের কিছু তিলাওয়াত করবে না। (তিরমিজি, হাদিস : ১৩১)

তবে ওই সময় নারীদের আল্লাহর জিকির, দোয়া, দরুদ ও নেক কাজের সুযোগ আছে। তাই এই সময়টাতে ইবাদতের পরিকল্পনা এবং দ্বিন শেখার মাধ্যমে কাজে লাগানো উচিত। আল্লাহ সবাইকে তাওফিক দান করুন।

 

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ