২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট একটি রায়ে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা (লিভিং এনটিটি)’ বলে আদেশ জারি করেন। এর অর্থ মানুষের মতো নদীরও সুস্থ-সুন্দর থাকার অধিকার রয়েছে। রায়ে রাষ্ট্রকে এই অধিকার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। নদী দখল, দূষণ ও ভরাটের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সেই নির্দেশনা কার্যকর হয়নি। এরপর ২০১৯ ও ২০২০ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রায় ৬৬ হাজার নদী দখলদারকে চিহ্নিত করে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলেও সেই উচ্ছেদ সফল হয়নি। ফলে জীবন্ত সত্তা নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে।
এ অবস্থায় আজ শুক্রবার আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস পালিত হচ্ছে।
দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘আমাদের নদী, আমাদের জীবন’। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে সারা দেশে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনসহ ২০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে নদ-নদী ও খাল দখল-দূষণ মুক্ত করার’ দাবিতে মানববন্ধন এবং বুড়িগঙ্গা নদী সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সকাল ১০টায় সদরঘাট থেকে এই কর্মসূচি শুরু হবে। এ উপলক্ষে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর উদ্যোগে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘বাংলাদেশের নদ-নদীর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা থেকে নদ-নদী বাঁচাতে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে নদ-নদীর সংখ্যা এক হাজার আটটি। এসব নদ-নদীর উপনদী ও শাখা নদী রয়েছে। উপনদী, শাখা নদীসহ দেশের নদীর মোট দৈর্ঘ্য হলো প্রায় ২২ হাজার ১৫৫ কিলোমিটার।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নদ-নদীর নতুন তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এক হাজার ১৫৬টি নদ-নদীর খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। আগামী পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হওয়ার কথা জানিয়েছেন পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি জানান, নদ-নদীর খসড়া তালিকা যাচাই-বাছাই চলছে। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়কেও যুক্ত করা হবে। নদীকে দুষণমুক্ত করার কাজ চলছে বলেও তিনি জানান।
নদ-নদীর দূষণ নিয়ে ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ’-এ প্রকাশিত গবেষণা তথ্যে বলা হয়েছে, ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের নদীর পানিতে ১০টি ভারী ধাতুর (এএস, পিবি, সিডি, সিআর, এফই, এমএন, সিইউ, সিইউ, সিও, এনআই, জেডএন) অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ২০০১-২০১০ সালে যে পরিমাণ দূষণ হয়েছিল, সেই তুলনায় গত দশকের (২০১১-২০২০) দূষণের মাত্রা অনেক বেশি ছিল। সেখানে সবচেয়ে দূষিত নদী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা। এই নদীতে ট্যানারি, টেক্সটাইল ও ইলেকটোপ্লেটিং কারখানাসহ শিল্প-কারখানার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে দূষিত হয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, এখনো দখলদারদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশ করা হয়নি। ২০১৯ ও ২০২০ সালে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ৬৬ হাজার দখলদারের তথ্য সংগ্রহ করা হয় এবং তা ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস বলেন, দেশের বেশির ভাগ নদীই দূষণ ও দখলের শিকার। কারণ ঘরোয়া ও শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলার অপসংস্কৃতি বহুকাল থেকেই চলে আসছে। ছোট-বড় শিল্প-কারখানাগুলো ভারী ধাতুর অপরিশোধিত বর্জ্যগুলো সরাসরি নদীতে ফেলছে। এতে নদী দূষিত ও ভরাট হচ্ছে। একই সঙ্গে দখল চলছে, যা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে এবং জীবন-জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সচেতনতা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি।