অনেকটা দায়সারাভাবে চলছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগের সাত বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় বই পড়ানো হচ্ছে না শ্রেণিকক্ষে। খাগড়াছড়ির প্রায় ছয় শ বিদ্যালয়ে এই অবস্থা চলছে।
পার্বত্য চুক্তি, আইএলও কনভেনশনসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইনের তাগাদা এবং দীর্ঘদিন ধরে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সাল থেকে সরকার প্রাক-প্রাথমিকে তাদের জন্য পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তন করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদ্রি ও গারো শিশুরা নিজেদের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক পায়। ১৭ সালে প্রাক-প্রাথমিক এবং পর্যায়ক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তাদের বইগুলো নিজ নিজ মাতৃভাষায় ছাপা হয়। কিন্তু তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৩৮ হাজার শিক্ষার্থী হাতে বই পেলেও পড়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা মাতৃভাষা শিক্ষার কার্যক্রম পুরোদমে চালুর জন্য পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোকে বিশেষভাবে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন।
তাঁরা আগামীতে শিক্ষক নিয়োগে ভাষাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ এবং এখনই শ্রেণি রুটিনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বই অন্তর্ভুক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (পিটিআই) মডিউলেও নৃগোষ্ঠীর ভাষার ওপর প্রশিক্ষণের বিষয়টি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
রঞ্জনমনিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ধনা চন্দ্র সেন বলেন, ‘পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষার বইও শিশুদের বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় ক্লাসে পড়ানো যাচ্ছে না।
আপাতত শিক্ষকদের স্বল্প মেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে হলেও মাতৃভাষার বই পড়ানো উচিত।’
ঠাকুরছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনক ত্রিপুরা বলেন, ‘চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষার বর্ণমালা সম্পর্কে খোদ শিক্ষকরাই কিছু জানেন না। তাই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।’
ভাষা গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা জানান, হাতেগোনা দু-চারজন শিক্ষক ছাড়া বাকিদেরও নিজ মাতৃভাষার বর্ণমালা সম্পর্কে ধারণা নেই। সুতরাং তাঁরা কিভাবে এসব বই ক্লাসে পড়াবেন? অথচ মাল্টি লিংগুয়াল এডুকেশন বা ‘এমএলই’ ধারণা থেকেই পাহাড়ি শিশুদের মাতৃভাষার শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল।
প্রাথমিকেই ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনতে উদ্যোগটি বেশ প্রশংসিতও হয়েছিল।’
ভাষা নিয়ে লেখালেখি করা ঞোহ্লামং মারমা বলেন, ‘মাতৃভাষার শিক্ষা কাগজে থাকলেও বাস্তবে নেই। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণ প্রশ্নের সঙ্গে অন্তত ২০/২৫ নম্বরের প্রশ্ন নিজ নিজ মাতৃভাষায় প্রবর্তন করা হলে আগামীতে শিক্ষক প্রার্থীদেরও মাতৃভাষা শেখার আগ্রহ তৈরি হবে।’
এই বিষয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের আহ্বায়ক ও জেলা পরিষদ সদস্য নিলোৎপল খীসা জানান, শিক্ষকদের নিজ নিজ ভাষার প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং রুটিনে মাতৃভাষার বই অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে।
সহকারী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মুহাম্মদ মোছাদ্দেক হোসেন বলেন, এরই মধ্যে শ্রেণি রুটিনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বই অন্তর্ভুক্ত করতে প্রধান শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যেই শিক্ষক প্রশিক্ষণও শুরু হতে পারে।