চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। শেখ হাসিনার আমলে অন্যতম আলোচিত নাম এটি। অনেকের কাছেই মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম জিয়াউল। জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। শেখ হাসিনার আমলে অন্যতম আলোচিত নাম এটি। অনেকের কাছেই মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম জিয়াউল। জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ফোনে আড়ি পেতে কল রেকর্ড ফাঁস, অপহরণ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড- জিয়াউলের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ সবাই জানে। তবে এই সাবেক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অজানা আরো অনেক তথ্য জানিয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভুঁইয়া (আইকেবি)।
তিনি তার ফেসবুক পেজে ‘বিজিবি, র্যাব, এসএসএফ ও আনসার নিয়ে আমার যত অভিজ্ঞতা’ শিরোনামে ছয় পর্বের লেখায় জিয়াউল আহসান সম্পর্কে অজানা অনেক তথ্য তুলে ধরেছেন।
আইকেবি আরো জানান, তিনি জিয়াউল আহসানকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ‘ক্রসফায়ার’ বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকা সেনানিবাসের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জিয়াউলকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন তিনি।
জিয়াউলের বিস্ময়কর উত্থান
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দীর্ঘদিন র্যাবে কর্মরত ছিলেন জিয়াউল আহসান। ২০০৯ সালে র্যাব-২-এর টুআইসি হিসেবে যোগদান করেন।
জিয়াউল আহসানের এই বিস্ময়কর উত্থান পর্বের মধ্যেই জেনারেল ( অব.) ইকবাল করিম ভুঁইয়া (আইকেবি) ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
যার মস্তিষ্ক পাথর বা ইটের টুকরা দিয়ে ঠাসা
জিয়াউল সম্পর্কে আইকেবি লিখেছেন, (সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার) কয়েক দিন পর আমি কর্নেল (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও ডিজি এসএসএফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন) মুজিবকে যিনি তখন র্যাবের এডিজি ছিলেন, ডেকে বলি যেন তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন এবং আর যেন কোনো ‘ক্রসফায়ার’ না ঘটে। কর্নেল মুজিব এ ব্যাপারে আমাকে কথা দেন এবং বিদায় নেওয়ার সময় তাঁকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হয়। পরের কয়েক দিন পত্রপত্রিকায় লক্ষ করলাম, নতুন কোনো ক্রসফায়ারের খবর নেই। এতে মানসিকভাবে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। এরপর কর্নেল মুজিব একাধিকবার আমাকে এসে জানিয়েছিলেন, সত্যিই ক্রসফায়ারের ঘটনা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পর আমি বুঝতে পারি, ঘটনা ঠিকই ঘটছে; কিন্তু সেগুলোর খবর চাপা দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে, যখন কর্নেল মুজিব র্যাব ছেড়ে অন্যত্র বদলি হয়ে যান; আর কর্নেল জিয়া, যিনি আগে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার দায়িত্বে ছিলেন; নতুন ডিজি বেনজীর আসার সঙ্গে সঙ্গেই এডিজি র্যাব হিসেবে দায়িত্ব নেন।
এরপর আর্মি নিরাপত্তা ইউনিট (এএসইউ) সূত্রে খবর পাই যে কর্নেল জিয়া নিজের আবাসিক টাওয়ারে একজন গার্ড রেখেছেন, বাসায় অস্ত্র রাখছেন এবং পুরো ফ্ল্যাটে সিসিটিভি বসিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বলা হয় গার্ড সরিয়ে নিতে, ক্যামেরাগুলো খুলে ফেলতে, বাসায় অস্ত্র রাখা থেকে বিরত থাকতে এবং অফিশিয়াল কোয়ার্টারে যে সামরিক নিয়ম-কানুন আছে, সেগুলো মেনে চলতে। পরবর্তী সময়ে তাঁর আচরণ আরো উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে। ডাইরেক্টর মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স (ডিএমআই) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জগলুল তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন; কিন্তু তাতে কর্নেল জিয়া কোনো কর্ণপাত করেননি। পরে আর্মি নিরাপত্তা ইউনিটের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজল তাঁকে আলাপের জন্য ডাকেন। পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজল আমাকে জানান, জিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে হয়েছে যেন তিনি এমন একজনের সঙ্গে কথা বলছেন, যার মস্তিষ্ক পাথর বা ইটের টুকরা দিয়ে ঠাসা, বোঝানোর কোনো উপায় নেই।’
ঢাকা সেনানিবাসের একাংশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা
জিয়াউল আহসানকে সেনানিবাসের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা সম্পর্কে আইকেবি লিখেছেন, ‘একপর্যায়ে, নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল তারেক সিদ্দিকী, এমএসপিএম (প্রধানমন্ত্রীর মিলিটারি সেক্রেটারি) আর তাঁর কোর্সমেট এএমএসপিএম কর্নেল মাহবুবের ঘনিষ্ঠতার সুবাদে কর্নেল জিয়া আমার নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করা শুরু করেন। আমার আর কোনো উপায় ছিল না। আমি তাঁকে রেললাইনের পশ্চিম পাশের ক্যান্টনমেন্টে ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ (পিএনজি) বা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করি। তবে পূর্ব পাশের আবাসনটিতে ওনাকে থাকতে দিয়েছিলাম। লজিস্টিকস এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মিজানকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে বলি। যার ফলস্বরূপ আগে জানানো হয়নি বলে তাঁকেও নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিরাগভাজন হতে হয়েছিল।
কর্নেল জিয়া পরিস্থিতির গুরুত্ব তখনই পুরোপুরি বুঝলেন, যখন মিলিটারি পুলিশ তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে সেনানিবাসের ভেতরে সিএমএইচে যাওয়ার পথে চেকপোস্টে আটকে দেয়। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই এমএসপিএম আমাকে ফোন করে জানতে চাইলেন, একজন চাকরিরত অফিসারকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে কি না, না এটা বিশেষ কোনো পদক্ষেপ। আমি বললাম, ‘এটা ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা। যদি তুমিও চিফের আদেশ অমান্য করো, তাহলে তোমাকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হবে।’ পরের দিন তিনি আবার ফোন করে জিয়ার ওপর থেকে এই বিধি তুলে নেওয়ার অনুরোধ করলেন। এ ঘটনার পর কর্নেল জিয়া কিছুটা নিয়মের মধ্যে আসেন। বুঝতে পারেন তিনি এখনো সেনাবাহিনীর অধীনে আছেন। তবু আমি তাঁকে আমার অফিসে ঢুকতে দিইনি। কারণ জানতাম, তিনি শুধু এসে নিজের কাজের সপক্ষে ব্যাখ্যা দিয়ে আমার সময় নষ্ট করবেন।’
হত্যায় উৎসাহ দিতেন জিয়া
সাবেক সেনাপ্রধান আইকেবি আরো লিখেছেন, (র্যাবে) নতুনভাবে বদলি পাওয়া অফিসারদের আমি যথাসাধ্য বোঝানোর চেষ্টা করতাম, যেন তারা অমানবিক অপরাধে না জড়ায়।... কারো হাত-পা বেঁধে তাকে হত্যা করাটা চরম কাপুরুষতা। সত্যিকারের সাহসিকতা হলো শত্রুর হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে সামনাসামনি মোকাবেলা করা। কিন্তু কয়েক দিন পর ডিএমআই জানালেন, আমাদের এই চেষ্টা কোনো কাজে আসছে না। অফিসাররা র্যাবে নতুন কর্মস্থলে আসামাত্র জিয়া নাকি তাদের ‘হত্যা করতে’ উৎসাহ দিচ্ছেন।
তবে এর মধ্যে ব্যতিক্রম যে ছিল না, তা-ও নয়। দুজন অফিসার র্যাবে যোগ দেওয়ার প্রথম রাতেই হত্যার নির্দেশ পেয়ে তা অস্বীকার করেন এবং আদেশ না মেনে এমপি (মিলিটারি পুলিশ) চেকপোস্টে চলে আসেন। ডিএমআই বিষয়টি জানালে আমি তাঁদের সেনাবাহিনীতে সম্মানের সঙ্গে পুনর্বাসিত করি। একজন মেজর, যিনি আমি এসআইঅ্যান্ডটিতে কমান্ড্যান্ট থাকাকালে স্পেশাল ওয়ারফেয়ার উইংয়ে প্রশিক্ষক ছিলেন, র্যাবে যোগ দেওয়ার পর সেনা ভবনে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। জানতে পারি, তিনি রেডিসন হোটেলের এক কর্মীকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে সন্দেহভাজনদের ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে’ জড়িয়ে পড়েছেন। আমি তাঁকে সাবধান করে দিই, যেন তিনি নিজ হাতে ‘বিচার’ তুলে না নেন। তিনি বললেন, আর করবেন না। কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখি, তিনি নিজেই ফেসবুকে একটা ছবি পোস্ট করেছেন। সেখানে তিনি শাপলা চত্বরের ধোঁয়াটে পটভূমিতে জিয়ার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন।’
র্যাব, ডিজিএফআই এবং বিজিবিতে অফিসার না পাঠানোর সিদ্ধান্ত
সাবেক সেনাপ্রধান আইকেবি তাঁর লেখায় র্যাব, ডিজিএফআই এবং বিজিবিতে আর কাউকে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জানিয়ে বলেন, ‘ডিজি বিজিবি মেজর জেনারেল আজিজ (পরে জেনারেল) ও সেনাপ্রধান এবং কর্নেল জিয়া প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে অভিযোগ করেন এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেন। ডিজি ডিজিএফআই মেজর জেনারেল আকবর বারবার অনুরোধ করলে শেষ পর্যন্ত আমি নিজে একটি ১০-১২ জনের অফিসার দলের তালিকা তৈরি করে তাঁকে দিই। এদিকে কর্নেল জিয়া আরো ‘লবিং’ চালিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা, এমএসপিএম আর নিজের কোর্সমেট এএমএসপিএমের সহায়তায় আমার ডিএমআইকে অপসারণ করেন। কারণ তিনি ভাবতেন, ডিএমআই-ই আমাকে তাঁর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলছে। স্বাভাবিক নিয়মে সেনাপ্রধানই ডিএমআই আর সিও এএসইউ নিয়োগ দেন। কিন্তু আমার আপত্তি সত্ত্বেও ডিএমআইকে সরিয়ে দেওয়া হয়, যা আমাকে যথেষ্ট অপমানিত করে। তবে সিও এএসইউ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলকে (বর্তমানে নির্বাচন কমিশনার) আমার তীব্র বিরোধিতার মুখে সরাতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে মিস্টার বেনজীর স্বয়ং আমার কাছে আসেন এবং র্যাব চালাতে আমার সহায়তা চান। কিন্তু আমি তাঁকে অফিসার দেওয়ার কোনো নিশ্চয়তা দিইনি। এমএসপিএম আমাকে কয়েকবার ফোন করে জানান যে প্রধানমন্ত্রী র্যাব, বিজিবি আর ডিজিএফআইতে আরো অফিসার চাচ্ছেন। আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় থাকি। চট্টগ্রামের হোটেল রেডিসন উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে আমাকে ডেকে র্যাবে আরো জুনিয়র অফিসার বদলি দিতে বলেন। আমি বুঝিয়ে বলি, পিজিআর, এসএসএফ, ডিজিএফআই, বিজিবি সবখানেই ইতিমধ্যে এত অফিসার দেওয়া হয়েছে যে এ মুহূর্তে অতিরিক্ত অফিসার দেওয়ার মতো অবস্থা সেনাবাহিনীর নেই। তিনি জোরাজুরি করলেও আমি আমার অবস্থানে শেষ পর্যন্ত অটল থাকি।’
সাবেক সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য বিষয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাম-উদ-দৌলা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তিনি সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য এবং সাবেক সেনাপ্রধান। তিনি যা লিখেছেন তা তাঁর ব্যক্তিগত মতামত। এ বিষয়ে আইএসপিআরের কোনো মন্তব্য নেই।’
সম্পর্কিত খবর
ক্রিকেটার সেজে মালয়েশিয়ায় প্রবেশকালে কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৫ বাংলাদেশি আটক হয়েছেন। সোমবার (১৭ মার্চ) তাদের আটক করে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা সংস্থা বিভাগ।
মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) একেপিএস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ক্রিকেট দলের ছদ্মবেশে ১৫ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টাকালে তাদের আটক করা হয়। একেপিএস জানিয়েছে, ১৫ জনের দলটি ক্রিকেট পোশাক পরে এবং টুর্নামেন্টের আমন্ত্রণপত্র উপস্থাপন করে কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল।
চিঠিতে ২১-২৩ মার্চ টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা থাকলেও, একেপিএস বলেছে, ২১ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত কোনো ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা ছিল না। এ ছাড়া সন্দেহজনকভাবে, তারা একজন ‘স্পন্সর’কে জামিনদার হিসেবে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে উপস্থিত ওই ব্যক্তি স্বীকার করেছেন, তার কাছে টুর্নামেন্ট সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না এবং তিনি কেবল একটি কম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছিলেন।
তদন্তে আরো দেখা গেছে, তারা পেশাদার ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিল এমন কোনো দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, তারা খেলোয়াড়দের ছদ্মবেশে অন্য উদ্দেশে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের জন্য একটি সিন্ডিকেটের অংশ ছিল। একেপিএস তাদের সবার বিরুদ্ধে নট টু ল্যান্ড (এনটিএল) ব্যবস্থা নিয়েছে এবং অভিবাসন বিধি অনুসারে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একেপিএস সতর্ক করে দিয়েছে যে, যেকোনো ব্যক্তি বা সিন্ডিকেট অবৈধ কাজ বা মানবপাচারের মতো অন্যান্য উদ্দেশে ক্রীড়া ভিসার অপব্যবহারের চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কার কর্মসূচিতে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে উপসাগরীয় রাষ্ট্র কাতার।
মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কাতারের রাষ্ট্রদূত সেরায়া আলি আল-কাহতানি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার সরকারের বার্তা পৌঁছে দেন।
রাষ্ট্রদূত প্রধান উপদেষ্টাকে বলেন, ‘বাংলাদেশকে সব ধরনের সহায়তা দিতে কাতার আগ্রহী।’
বাংলাদেশের সংস্কার কর্মসূচিতে কাতারের পূর্ণ সমর্থনকে চমৎকার অভিহিত করে অধ্যাপক ইউনূস দেশটির আমিরকে ধন্যবাদ জানান।
প্রধান উপদেষ্টা কাতারের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক আরো গভীর করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি কাতারের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ এবং দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে তাদের কারখানা স্থানান্তর করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ এখন ব্যবসার জন্য প্রস্তুত উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা চাই কাতারের ব্যবসায়ীরা এখানে সম্ভাবনা অন্বেষণ করুক।
রাষ্ট্রদূত বিনিয়োগ আমন্ত্রণের প্রশংসা করে বলেন, কাতারের আরো বেশি ব্যবসায়ী খুব শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে বলে তিনি আশা করছেন।
সাক্ষাৎকালে অধ্যাপক ইউনূস তার সরকারের সংস্কার কর্মসূচি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের জন্য গঠিত ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম তুলে ধরেন।
ড. ইউনূস জানান, আগামী মাসে তিনি কাতার সফরে যাবেন, সেখানে গ্যাসসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশটিতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেবেন।
দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে দুই কার্গো এলএনজি কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে এই এলএনজি আমদানির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সরকার যুক্তরাজ্যের মেসার্স টোটালএনার্জিস গ্যাস অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড থেকে আন্তর্জাতিক কোটেশন সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় স্পট মার্কেট হতে প্রায় ৬৯৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকায় এক কার্গো এলএনজি ক্রয় করবে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের আরেক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যুক্তরাজ্যের মেসার্স টোটালএনার্জিস গ্যাস অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড থেকে আন্তর্জাতিক কোটেশন সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় স্পট মার্কেট হতে প্রায় ৬৮২ কোটি টাকায় এক কার্গো এলএনজি ক্রয় করবে। প্রতি একক এলএনজির দাম হবে ১৪ দশমিক ২২ মার্কিন ডলার।
২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন সরকার আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির জন্য আগ্রহী বিক্রেতা বা সরবরাহকারীদের তালিকা চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
তবে আইনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার (ভেটিং) পর অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি পেট্রোবাংলার সঙ্গে এমএসপিএ স্বাক্ষরের অনুমোদন দেওয়া হয় ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে। পরে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অবশ্য ২৩টিতে উন্নীত হয়।
সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ ভুল তথ্য ছড়ানো নিয়ে মার্কিন সিনেটর গ্যারি পিটার্সের সহায়তা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মার্কিন সিনেটর গ্যারি পিটার্স সাক্ষাৎ করতে এলে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন। ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে দুই নেতা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো গভীর করার উপায় নিয়ে আলোচনা করেন।
সিনেটর পিটার্স বলেন, ডেট্রয়েট শহরসহ মিশিগানে তার নির্বাচনী এলাকায় অনেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বসবাস করেন।
তিনি বলেন, সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়েও ব্যাপক ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এই ভুল তথ্যের কিছু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে, যা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে।
এ বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘ধর্ম-বর্ণ, জাতি-লিঙ্গ-নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে তার সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ।
তিনি বলেন, ‘গত বছরের আগস্টে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংখ্যালঘুদের, বিশেষত হিন্দুদের ওপর আক্রমণগুলো রাজনৈতিক ছিল, ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল না, তবে তার সরকার দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে।’
প্রফেসর ইউনূস মার্কিন সিনেটরকে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর পরিদর্শন এবং অন্যান্য মার্কিন রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক ও কর্মীদের বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
তিনি বলেন, ‘আপনাদের সাহায্য আমাদের দরকার। আপনার সহকর্মীদের বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে বলুন।
মার্কিন সিনেটর পিটার্স অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার উদ্যোগ, মূল কমিশনগুলোর প্রতিবেদন এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন।
এ সময় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো কম সংস্কারে সম্মত হলে চলতি ডিসেম্বরে নির্বাচন। তবে দলগুলো যদি সরকারের কাছ থেকে সংস্কারের আরো বড় প্যাকেজ চায় তবে কয়েক মাস পরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
তিনি বলেন, ‘উৎসবমুখর পরিবেশে আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।
ড. ইউনূস বলেন, ‘কমিশনগুলোর প্রস্তাবিত সংস্কারের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে তারা জুলাই সনদে সই করবে।’ এই জুলাই সনদ দেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করবে বলেও জানান তিনি।
সিনেটর পিটার্স সরকারের সংস্কার এজেন্ডার প্রশংসা করে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি মসৃণ গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রত্যাশা করছে।’
বৈঠকে দুই নেতা সামাজিক ব্যবসা, দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ নিয়েও আলোচনা করেন।