শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম সঠিকভাবে বুঝেছিলেন এই অঞ্চলের নাগরিকদের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার বা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার জায়গায়টা কোথায়। তার ওপর দীর্ঘ নিবিড় চর্চা ও বিচক্ষণতায় সততার সঙ্গে রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। তাই স্বল্প সময়ে অর্থাৎ মাত্র ৩৯ বছর বয়সে রাষ্ট্রপতি হয়ে চার বছরের কিছু বেশি সময়ে সবার জন্য শিশু একাডেমি থেকে শুরু করে যুব কমপ্লেক্স ও প্রবীণ নিবাস প্রতিষ্ঠা করেছেন।
অর্থনৈতিক মৌলিক মডেল দিলে তৈরি পোশাক রপ্তানি শিল্প আর প্রবাসী শ্রমের কর্মসংস্থান, যাঁর বিপরীতে আজ ৫০ বছরের বেশি বয়সে বাংলাদেশে এখনো কেউ করতে পারেননি। কতটা দূরদর্শিতার রণকৌশলী হলে একজন মেজর হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। প্রথম ব্রিগেড ‘জেড ফোর্স’-এর অধিনায়ক। প্রথম ৫০০ বর্গমাইল এলাকা স্বাধীন ঘোষণা করে বেসরকারি প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে প্রথম শহীদ সৈনিকদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ কুমিল্লা সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতা ও একুশে পদক এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্থাপন—এগুলো কি আপনারা গুণগত, নাকি মৌলিক বলবেন? এর বিপরীতে নতুন কী কী প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর-উত্তমের কর্মকাণ্ড একটি লেখার মধ্যে শেষ করা সম্ভব নয় এবং তা ভাবনায় নেওয়া ঠিক হবে না।
এবার যে লক্ষ্য রেখে এই লেখা, তার মধ্যে মনোযোগ দিতে চাই—গত প্রায় ১৭টি বছর এ দেশে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীসহ সাধারণ নাগরিক চরম নিপীড়ন-নির্যাতন, হামলা, লাখ লাখ মামলা, গুম, গণহত্যার শিকার হয়েছে। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে ব্যাপক নির্যাতিত ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয়।
নতুন প্রজন্ম নিজের নিকট অভিজ্ঞতায় জেনেছে যে রাজনীতির অপব্যবহার করে আওয়ামী লীগ কিভাবে রাজনীতিকে নিছক ক্ষমতা ও বিত্তের বিনিয়োগে পরিণত করেছিল। তাই তারা ওয়েবসাইট তৈরি করে ইস্যুভিত্তিক ও রাজনৈতিক মতামত-নির্বিশেষে প্রধান বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে একটি ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরম গড়ে ওঠে।
সেই অরাজনৈতিক নানা বর্ণের প্ল্যাটফরম থেকে উদ্ভূত আন্দোলনই আজ অনেক মূল্যের বিনিময়ে ধাপে ধাপে বিকশিত হয়ে স্বৈরাচার উত্খাত করে বিশাল এক প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। এই প্রাথমিক বিজয়ই ‘রাষ্ট্রক্ষমতা’ অর্থাৎ স্বৈরাচারের বিদায়ের পর কে সেখানে বসবে, সে প্রশ্ন তুলে ধরেছে জাতির সামনে। এই প্রশ্ন কি অতি গুরুত্বপূর্ণ? আন্দোলনের সমন্বয়করা এবার রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ ঘোষণা করলেন। তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করে দলটির আহ্বায়ক হয়েছেন। অন্য ছাত্রনেতারা ভিন্ন ভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
তাঁদের বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশদরদি তারেক রহমান অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, এই সময়ে এসে আবারও তাই প্রমাণিত হয়েছে। এত আত্মত্যাগের পর যদি কোনো নতুন সাম্রাজ্যবাদ বা মৌলবাদের আদর্শপুষ্ট ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক শক্তি বা আরো বৈষম্যপূর্ণ কোনো গোষ্ঠী এসে শূন্যস্থানে বসে, তাহলে ছাত্রসমাজ ও জনগণের এই গৌরবময় আন্দোলন ব্যর্থ হবে না? সেটিও নিশ্চয়ই ছাত্র-জনতা চাইবে না?
তাই রাজনৈতিক প্রশ্নটিকে এখন এই মুহূর্তে ছাত্রদের তৈরি করা রাজনৈতিক দলের নেতাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা বিবেচনায় না নিয়ে উপায় নেই। এখন পর্যন্ত তাঁদের দাবিগুলো তাঁদের ভাষায় ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা’কে তাড়িয়ে ‘ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা’র বিলোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিলোপ বা যেকোনো উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন, মৌলবাদী ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদ বা রাষ্ট্রধর্ম মতবাদ অথবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিপীড়ন ইত্যাদি প্রবণতার রয়েছে মৌলিক বৈরিতামূলক বিরোধ।
কিন্তু এরই মধ্যে এসব প্রবণতা দেশের ভেতরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে; এ ব্যাপারে কি তাঁরা সচেতন? যদি এ ব্যাপারে তাঁরা সচেতন হন, তাহলে তাঁদের ও তাঁদের দলের উচিত হবে এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার মধ্যে কী নীতি প্রতিষ্ঠা করবেন। তা করার জন্য নতুনের মধ্যে ‘মৌলিকত্ব’ দরকার হবে। তাঁদের রাজনীতিতে কী মৌলিকত্ব আছে, নাগরিকরা নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করেই গ্রহণ করবে।
বেশির ভাগ তরুণই তাই যে যে দলই অতীতে করুন না কেন বা যে দলের প্রতি যে আশায়ই সমবেত হোন না কেন, বাস্তবে সমস্যা সমাধানের একটি সুনির্দিষ্ট
রূপকল্প কিন্তু তাঁদের কাছে থাকতে হবে। একটি বৈষম্যহীন সমাজে প্রত্যেকের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার জন্য কী ধরনের মৌলিক রূপান্তরের প্রয়োজন হবে, তা নিয়ে তরুণদের ও প্রতিযোগী দলগুলোর ধারণা স্পষ্ট হতে হবে।
লক্ষণীয় বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আলোচিত উজ্জীবিত রাজনৈতিক দলের নাম ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক নীতির ওপর ভিত্তি করে জাসদ। আজ তাদের সংগঠনের অবস্থা কী? আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে কত বড় বড় নেতা রাজনৈতিক দল তৈরি করলেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব বিকল্প রাজনীতির কথা বলে বিকল্পধারা নামে দল করলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৯ বছর রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিয়ে স্বৈরাচার তকমা নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে বিদায় নিলেন। তাঁর দল একই নামে কয়টি ভাগ হয়েছে বলা মুশকিল।
বাম ভাবধারা ও ইসলামী ভাবধারার রাজনৈতিক দলগুলোর কথা আর না বললাম। জাঁকজমকভাবে পাঁচতারা হোটেলে জন্ম নেওয়া ইনসাফ পার্টি কোথায়? বিশেষ করে আরো বলা প্রয়োজন, ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উচ্চাভিলাষী ভাবনায় আমি-ডামি নির্বাচনের নামে রাতারাতি নতুন দল ও নিবন্ধন দেওয়ার কী পরিণতি! এগুলো নাগরিকদের সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট ও উজ্জ্বল হয়ে আছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সম্ভাবনাময় ছাত্রনেতারা আশু উপলব্ধিকে দীর্ঘমেয়াদি দায়িত্বে যদি রূপান্তর করতে চান, তাহলে আশা করি এই বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেবেন। এতে তাঁদের ও দলের এবং দেশের কল্যাণ হবে।
লেখক : বিএনপি মিডিয়া সেল সদস্য এবং
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী