ঢাকা, বুধবার ০৫ মার্চ ২০২৫
১৯ ফাল্গুন ১৪৩১, ০৪ রমজান ১৪৪৬

ঢাকা, বুধবার ০৫ মার্চ ২০২৫
১৯ ফাল্গুন ১৪৩১, ০৪ রমজান ১৪৪৬

অস্তিত্ব সংকটে পাবনার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী

  • ড. এম আবদুল আলীম
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
অস্তিত্ব সংকটে পাবনার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী

পাবনা জেলার প্রত্যন্ত পল্লীতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। এদের মধ্যে পাহাড়িয়া, মাহাতো, মুণ্ডা, সিং, রাজবংশী, বাগদি, পাহান, রবিদাস, বুনো, ওঁরাও প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা নিজেদের আদিবাসী বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও পাবনা জেলা এদের সবার আদি নিবাস নয়। এদের আদি নিবাস ভারতের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে।

আদিকাল থেকে বসবাসের কারণে নয়, এদের আচার-আচরণ, অনুষ্ঠানাদি এবং জীবনধারণ পদ্ধতির অনেক কিছুই আদিম রীতিতে পরিচালিত হয় বলে এরা আদিবাসী হিসেবে অভিহিত। সরকার এদের পরিচয় নির্দেশ করেছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে। 

পাবনার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে পাহাড়িয়ারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। পূর্বপুরুষরা পাহাড়ে বসবাস করত বলে এরা নিজেদের ‘পাহাড়িয়া’ নামে পরিচিত।

ঔপনিবেশিক শাসনামলে জীবিকার অন্বেষণে তারা ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পূর্ববঙ্গের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং বসতি স্থাপন করে। ইংরেজ নীলকররা নীলচাষের জন্য উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ভারতের বিহার রাজ্যের দুমকা জেলার রাজমহল পাহাড় থেকে পাহাড়িয়াদের এ অঞ্চলে এনেছিলেন। একসময় এদের পারিবারিক পদবি ছিল সরদার, পাহাড়িয়া, প্রামাণিক প্রভৃতি। পরবর্তীকালে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের পর সবাই বিশ্বাস পদবি গ্রহণ করে।
পাবনা পাহাড়িয়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা-পদ্ধতি, সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড—সবই বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং স্বকীয়তামণ্ডিত। ১৮৭২ সালের আদমশুমারিতে মি. রিভারলি মুণ্ডাদের সঙ্গে এই আদিবাসীদের সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এরা প্রচণ্ড শক্তিশালী, পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু। পাবনা জেলার বিভিন্ন এলাকার জঙ্গল ও ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে নীলচাষের জন্য তাদের এ অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে পাবনা জেলায় ১০৫টি পরিবারে প্রায় ৬০০ পাহাড়িয়া বসবাস করে।
এর মধ্যে ঈশ্বরদী উপজেলার মাড়মী গ্রামে ৫৮টি পরিবার, কলকলিতে ১৩টি পরিবার, চকসিরামপুরে ১৫টি পরিবার, লক্ষ্মীকোলায় ১২টি পরিবার এবং নওদাপাড়ায় রয়েছে সাতটি পরিবার।

ঈশ্বরদী উপজেলার আটঘরিয়া, গোয়ালবাথান প্রভৃতি গ্রাম এবং আটঘরিয়া উপজেলার বিভিন্ন গুচ্ছগ্রামে মুণ্ডাদের বসবাস রয়েছে। বর্তমানে এদের ৬০টি পরিবারে মোট ৩০০ মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। এরা অস্ট্রালয়েড রেসের মানুষ এবং তাদের ভাষাও এই ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। মুণ্ডারা একসময় গাঙ্গেয় উপত্যকায় যাযাবর জীবন যাপন করত। এরা বরেন্দ্র অঞ্চলে এসে বহু শতাব্দী ধরে অরণ্য-জলাশয়চারী জীবন যাপন করতে থাকে। পাবনা জেলার চলনবিলসংলগ্ন ঝোপজঙ্গলে খাবারের সন্ধানে এসে মুণ্ডারা ধীরে ধীরে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। এ অঞ্চলের উর্বর মাটিতে কৃষিকাজের সূচনাকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুণ্ডাদের স্থান অগ্রগণ্য। এদের চুল কালো ও কোঁকড়ানো, চোখ ছোট, গায়ের রং তামাটে, উচ্চতা মাঝারি। নিজস্ব ভাষা থাকলেও বর্তমানে তা হারাতে বসেছে। নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে জীবিকার তাগিদে মাঠে কাজ করে। এরা সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারী।        

পাবনা জেলায় মাহাতো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস রয়েছে। আটঘরিয়া উপজেলার রামনগর গ্রামে ৩৫টি পরিবারে ১৫০ জন এবং চাটমোহরের হাণ্ডিয়াল, বাঘলবাড়ি, চণ্ডীপুর, বাঘলবাড়ি কৈ, কেশবপুর, বৃরাইনগর প্রভৃতি গ্রামে ১৫০টি পরিবারে প্রায় ৬০০ জন মাহাতো বসবাস করে। এ জেলায় আটঘরিয়ার ধলেশ্বরে রয়েছে সিং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পল্লী। লোকালয় থেকে দূরে ফাঁকা মাঠের মধ্যে মাত্র দেড় বিঘা জমির ওপর ২৬টি পরিবারে ১০৬ জন (৫৭ জন পুরুষ ও ৪৯ জন নারী) সিং এখানে বাস করে। ইংরেজ নীলকর ও এ দেশীয় জমিদাররা তাঁদের নীলচাষের প্রয়োজনে ভারত থেকে এই আদিবাসীদের পাবনায় এনেছিলেন। প্রথমে তারা সিরাজগঞ্জ মহকুমার তাড়াশ এবং পরে পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার ধলেশ্বরে আসে। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু ছাড়া এদের কোনো জমিজমা নেই। ফলে নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে অন্যের জমিতে কাজ করে আয়-রোজগার করে। যখন কাজ থাকে তখন কোনো রকমে জীবন চললেও কাজ না থাকলে তারা বিপদে পড়ে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও মজুরি ঠিকমতো জোটে না। নারী শ্রমিকরা নানাভাবে বঞ্চিত হয়। অনেক সময় ধর্ষিতও হয়। একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বলতে যা বোঝায় সিংরা তা-ই। জীবনাচার, জন্ম, মৃত্যু, আচার-বিশ্বাস-সংস্কার—সব কিছুতেই এদের স্বকীয়তা রয়েছে। তবে হারিয়ে ফেলেছে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনেক কিছু। শিক্ষার হার খুবই নগণ্য। সরকার এদের বয়স্কভাতা দেয়। শীতে দেয় কম্বল। তবু তাদের জীবন-সংগ্রাম কিছুতেই থামে না। বলা চলে মোটা ভাত আর কাপড়ের জন্য বেঁচে থাকাটাই এদের জন্য বড় এক সংগ্রাম।

পাবনা সদর উপজেলার কুচিয়ামোড়া গ্রামে ১৪টি পরিবারে ৫৪ জন বাগদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ বাস করে। এ ছাড়া ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়ন; দাশুড়িয়া ইউনিয়নের খয়েরবাড়ি, পাতিরাজপুর, ফরিদপুর; আটঘরিয়ার মাজপাড়া, খিদিরপুর এবং চাটমোহরের হরিপুর গ্রামে এক হাজার পরিবারে প্রায় পাঁচ হাজার ৩০০ বাগদি বাস করে। রাজবংশী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোক বাস করে ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী রেলস্টেশনের পাশে গুড়িপাড়া ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজসংলগ্ন সাঁরা এলাকায়। এখানে ৮৭টি পরিবারে প্রায় ৫০০ রাজবংশী বাস করে। রেললাইনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রথমে সিলেটের চা বাগান বলে দৃষ্টিবিভ্রম হয়, একটু এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে ভূমি থেকে বেশ উঁচু রেললাইনের গায়ের প্রাণজুড়ানো প্রকৃতি। একটু পথ অতিক্রম করলেই চোখে পড়ে শৃঙ্খলিত পদ্মার ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতু। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাদদেশে উত্তর পাশে একেবারে বিচ্ছিন্ন একটি পাড়ায় বাস করে রাজবংশীদের ৪৮টি পরিবার। এখানে রয়েছে ১২১ জন নারী, ১০৮ জন পুরুষ। সাঁরায় রয়েছে ২৯টি পরিবারে মোট ৮৩ জন নারী, ৬৫ জন পুরুষ। পারিবারিক পদবি সাহানি। দু-ঘর পাহান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষও রয়েছে এখানে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের সময় ইংরেজ সরকার অনেকের সঙ্গে এদের পূর্বপুরুষদেরও ভারতের বিহার অঞ্চল থেকে এখানে এনেছিল, তারপর মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল এখানে। ব্রিটিশ সরকারের দান করা সেই সাড়ে তিন একর জমিই এই ৪৮ পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই। নারীরা অন্যের বাড়িতে কাজ করলেও পুরুষরা দিনরাত পড়ে থাকে পদ্মার বুকে। পদ্মার মাছই এদের জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন। ভোজপুরিয়া ভাষা ব্যতীত পূর্বপুরুষদের জীবন ও সংস্কৃতির কোনো কিছুই আর তারা ধরে রাখতে পারেনি। আদিবাসী বলে এদের চিহ্নিত করার উপায় নেই। তাদের খাবার, জীবনাচার সবই সাধারণ বাঙালির মতো। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এই মানুষগুলোর পাশে গেলে মনে পড়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের জেলেদের কথা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুবের, গণেশ, রাসু, মালা আর কপিলারা যেন এসে হাজির হয়েছে মদন, বুধন, কার্তিক, প্রতিমা, মায়া কিংবা সুরজুর বেশে। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে কয়েক হাজার রবিদাস, ঈশ্বরদীর খয়েরবাড়িয়া গ্রামে বাস করে ১২ ঘর বুনো, ভাঙ্গুড়ার খানমরিচ ইউনিয়নের সুলতানপুরে রয়েছে কয়েক ঘর ওঁরাও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস।   

পাবনা জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকেরা বর্তমানে নানা দিক থেকে বঞ্চিত। এদের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। জীবনসংগ্রামে পর্যুদস্ত এই মানুষগুলো বর্তমানে তাদের নিজস্ব ভাষা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং জীবনযাত্রা প্রণালীর অনেক কিছুই হারাতে বসেছে। এমনকি নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে না পেরে তারা দিন দিন বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এদের সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। দেশীয় মদ, গাঁজাসহ নানা নেশা আর অভাবের কবলে তারা তিলে তিলে নিঃশ্বেষ হয়ে যাচ্ছে। সভ্যতার চরম উৎকর্ষের যুগে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পল্লীতে ঢুকলে মনে হয় তারা যেন আদিম যুগেই রয়ে গেছে। তাদের মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের বন্দোবস্ত নেই বললেই চলে। সরকারি অনুদান যা কিছু আসে তা পুরোপুরিভাবে তাদের কাছে পৌঁছে না। সরকার ও সমাজের নিয়ন্ত্রকদের কাছে আহ্বান, এই মানুষগুলোর দিকে তাকান। তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কাজ করুন।

লেখক: গবেষক-প্রাবন্ধিক; শিক্ষক

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়  

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

বিশেষ লেখা

নতুন দল, নতুন স্বপ্ন এবং তারুণ্যের দ্রোহ

শেয়ার
নতুন দল, নতুন স্বপ্ন এবং তারুণ্যের দ্রোহ

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে বিবেচিত হবে। ওই দিন প্রধান দুটি রাজনৈতিক ধারার বাইরে বাংলাদেশে তারুণ্যের শক্তিতে নির্ভর একটি নতুন রাজনৈতিক দল  আত্মপ্রকাশ করেছে। এত বিপুল জনপ্রিয়তা ও আবেগ, ভালোবাসা নিয়ে এর আগে কোনো রাজনৈতিক দলের এমন বর্ণাঢ্য আত্মপ্রকাশের ঘটনা বিরল। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই দলটির উত্থান যেমন ছিল অনিবার্য, তেমনি গণ-আকাঙ্ক্ষার স্বতঃস্ফূর্ত বহিপ্রকাশ।

প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে একটি নতুন স্বপ্ন এবং নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে নতুন দলটির ঘোষণাপত্রে।  জাতীয় নাগরিক পার্টি কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়, বরং তারুণ্যের  আকাঙ্ক্ষার স্ফুরণ। তরুণরা বাংলাদেশকে যেভাবে দেখতে চায়, সে রকম একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণের দায়িত্ব তাঁরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এ দায়িত্ব তাঁরা অন্য কারো ওপর দিয়ে নিরাপদ বোধ করছেন না।
যে কারণে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ছিল অনিবার্য।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জুলাই বিপ্লব যেমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যেখানে মূলধারার রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাইরে গিয়ে কিছু উদ্যমী অকুতোভয়, সাহসী তরুণ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। অবশেষে স্বৈরাচারের নিগঢ় থেকে শত শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশ মুক্ত হয়। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর তরুণরা যখন দেখলেন তাঁদের প্রত্যাশা এবং স্বপ্নগুলো আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে যাচ্ছে, তাঁরা যে ধরনের বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন, সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ ক্রমশ পথ হারাচ্ছে।

তখন তাঁরা নিজেরাই দায়িত্ব তুলে নিলেন। এটি যতটা না রাজনৈতিক দল তার চেয়ে বেশি তরুণদের আকাঙ্ক্ষার প্ল্যাটফরম। এটি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশের সব কিছুর অর্জন তারুণ্যের হাত ধরে।

আমাদের ভাষা আন্দোলন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সবশেষে জুলাই বিপ্লবসব কিছু অকুতোভয় তারুণ্যের দ্রোহের বিজয়।

কিন্তু অদ্ভুত একটি ব্যাপার হলো, গত শতকের আশির দশক থেকে আমাদের তরুণরা ক্রমশ নিজেদের রাজনীতি বিমুখ করে ফেলেছিলেন। ষাট বা সত্তরের দশকে আমরা যেমন লক্ষ করেছি, সব মেধাবী শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্ররাজনীতির চর্চাকেন্দ্র, আগামীর রাজনীতিবিদ তৈরি হওয়ার সূতিকাগার, সেখানে আশির দশকে এসে অবস্থা পাল্টে যেতে শুরু করে। বিশেষ করে তরুণরা লেখাপড়া, ভালো চাকরি, ব্যবসা, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়া বা বিদেশে গিয়ে চাকরি-বাকরি করে স্থিতু হওয়াএ রকম একটি সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে পড়েন। এর ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় বাংলাদেশের। বন্ধ হয়ে যায় নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাইপলাইন। অযোগ্যরা রাজনীতিতে জড়ো হতে থাকে এবং তারাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। ফলে রাজনীতি হয়ে পড়ে মেধাহীন, মেধাশূন্য, দুর্নীতি, চাটুকারদের আখড়া।

আবার এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আশির দশকে জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে তরুণ মেধাবীদের নিয়ে আসার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনি তরুণ মেধাবীদের একসঙ্গে জড়ো করেছিলেন। হিজবুল বাহার জাহাজে তাঁদের বাংলাদেশ এবং আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য উদ্দীপ্ত করেছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সেই ধারা ব্যাহত হয়। নতুন রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্ররাজনীতিতে শক্তি, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লিপ্ত হন। ফলে ছাত্ররাজনীতি হয়ে ওঠে পেশিশক্তি নির্ভর। ছাত্ররাজনীতির নামে মেধাহীন ছাত্রদের হল দখল, ক্যাম্পাস দখলের নোংরা খেলায় ব্যবহার করা হয়। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ও এক ধরনের বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। এ রকম অবস্থায় বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের হাতে আগামীর নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ ক্ষীণ হতে হতে প্রায় বিলীন হয়ে যায়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, চাটুকার, মোসাহেব এবং অযোগ্যদের প্রাধান্য বাড়তে থাকে। কিন্তু এ অবস্থার পরিবর্তন আমরা লক্ষ করি ২০১৪ সালের পর থেকে। প্রথমে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের প্রকাশ ঘটান। হারিয়ে যাওয়া তারুণ্যের এক ঝলক দ্রোহ আমরা প্রত্যক্ষ করি। নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য তারা রাজপথে। কোটা আন্দোলন বাংলাদেশে ছাত্রদের শক্তি এবং তারুণ্যের দ্রোহকে নতুনভাবে প্রস্ফুটিত করে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে তরুণরা তাঁদের অধিকার আদায় এবং অব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে শুরু করেন। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মাধ্যমে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকারের চেতনা সঞ্চালিত হয় নতুন করে। এটিও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের আরেকটি নতুন মাইলফলক। যেখানে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁদের দাবি আদায় করেছিলেন। আর এভাবেই ধীরে ধীরে তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়তে থাকে। তাঁরা নতুন চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন এবং তাঁদের মধ্যে এক নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার দর্শন লক্ষ করা যায়। এই দর্শনটিই আসলে জুলাই বিপ্লবের মূল প্রেরণা।

অনেকে মনে করতে পারেন, জুলাই বিপ্লব একটি ক্ষণিকের আবেগ। কোটা সংস্কারের দাবি মেনে না নিয়ে সরকারের একগুঁয়েমির ফলে ছাত্রদের যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের একটি অনিবার্য পরিণতি। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলন কেবল কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ছিল না। বরং একটি বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা থেকেই তরুণরা সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন এবং এই সংঘবদ্ধ শক্তি এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল। যে বাংলাদেশে বৈষম্য থাকবে না, পরিবারতন্ত্র থাকবে না, দুর্নীতি থাকবে না। যোগ্যতা এবং মেধার প্রকৃত মর্যাদা হবে। এ রকম একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা থেকেই তরুণদের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারের পতন ঘটায়। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর আমরা লক্ষ করি, তরুণদের সেই স্বপ্নগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সেই পুরনো আমলাতান্ত্রিক ধারা, সেই পুরনো ব্যবস্থাপনাতেই একটি রাষ্ট্র এগিয়ে চলছে। ফলে সর্বত্র থাকা ফ্যাসিবাদের নানা রকম সুবিধাভোগীরা বাংলাদেশের তরুণদের স্বপ্নকে প্রায় ছিনতাই করতে যাচ্ছিল। এ রকম পরিস্থিতিতে তরুণরা আবার নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করেন। তাঁরা অনুধাবন করেন, একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি প্রতিষ্ঠা করা না যায় তাহলে তাঁদের যে আকাঙ্ক্ষার সে আকাঙ্ক্ষার কখনো বাস্তবায়িত হবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সনাতন পদ্ধতির বদলে একটি নতুন বিপ্লবের ডাক দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। এই নাগরিক পার্টি সাফল্য অর্জন করতে পারবে কি পারবে না, সেটি ভবিষ্যৎ বলে দেবে। কিন্তু তরুণরা যে রাষ্ট্র বিনির্মাণে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত তার একটি বার্তা এই রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে সুস্পষ্ট হলো।

বিশ্বজুড়েই নেতৃত্বের একটি সংকট চলছে। তরুণ নেতৃত্ব সামনে এগিয়ে আসতে পারছে না। বাংলাদেশের তরুণরা জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠনের মাধ্যমে গোটা বিশ্বকে যেন জানান দিলেন, তরুণদের শক্তি এবং তরুণদের আকাঙ্ক্ষার পূরণে বৈশ্বিক লড়াইয়ে বাংলাদেশ এখন পথ দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন নেতৃত্বের আসনে।

আমরা জানি, একটি রাজনৈতিক দল গঠন, তাকে বিকশিত করা, সারা দেশে সেই রাজনৈতিক দলকে প্রতিষ্ঠিত করা অত্যন্ত কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ একটি কাজ। বিশেষ করে বর্তমানে রাজনীতিতে যেভাবে কালো টাকা এবং পেশিশক্তি প্রবেশ করেছে, সেখানে একটি সুস্থ ধারার রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ এবং বিকাশ খুব কঠিন ব্যাপার। কিন্তু আমরা আশাবাদী হতে চাই। কারণ তরুণরা নতুন করে ভাবছেন এবং আগামীর বাংলাদেশ তাঁদেরই। এই বাংলাদেশকে তাঁদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। কাজেই তাঁদের সামনে অনেক পথ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তরুণরা জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁরা পারেন। এ কারণে ২৮ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া এভিনিউতে দেখা গেল জনস্রোত। শুরুতেই জনগণ তাদের ওপর আস্থা রেখেছে। জনগণ পরিবর্তন চায়। জনগণ এই আশাহীন, স্বপ্নহীন দেশকে এক জাগরণের বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চায়। আর এ কারণে তরুণদের ওপর তাদের আস্থা আছে, যার প্রমাণ ২৮ ফেব্রুয়ারি। কারণ তরুণরা এরই মধ্যে তাঁদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। ১৫ বছর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা যে স্বৈরাচারকে কেউ হটাতে পারেনি, তরুণরা তাঁদের সরিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁদের ঐক্যের শক্তি কত সমৃদ্ধ। আর এ কারণেই জনগণ আশা নিয়ে বুক বেঁধে আছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ মানুষকে আশান্বিত করেছে। চারদিকে যখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সবদিকে যখন ব্যর্থতা, হতাশার ছায়া, ঠিক তখন এই রাজনৈতিক দলটি মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।

তবে মনে রাখতে হবে, চটজলদি রাজনীতিতে কিছু অর্জিত হয় না। আত্মপ্রকাশের পর তাঁদের নিয়ে সমালোচনা হবে। তাঁদের নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হবে। অনেকে তাঁদের কর্মসূচি, নীতি এবং বক্তব্যের সমালোচনা করবেন। এই সমালোচনা সহ্য করার সক্ষমতা নতুন দলের থাকতে হবে। আর দলের কাজে থাকতে হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। মানুষ যেন বিশ্বাস করে এই দলটি অন্য রাজনৈতিক দলের মতো না। এসব যদি করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সত্যিকারের গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে জাতীয় নাগরিক পার্টি।

জাতীয় নাগরিক পার্টি ক্ষমতায় আসবে কি না সেটি জনগণ নির্ধারণ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান যে গতিধারা তা যে তারা বদলে দেবে সেটা হলফ করে বলা যায়।

 

 

মন্তব্য

সেনাপ্রধানের সময়োপযোগী বক্তব্য

    মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)
শেয়ার
সেনাপ্রধানের সময়োপযোগী বক্তব্য

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের এক বক্তব্য নিয়ে তোড়পাড় শুরু হয়েছে। তিনি দেশের বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। দায়িত্বশীল পদে থেকে তাঁর কথা বলেছেন। তাঁর কথার সারাংশ হচ্ছে, তিনি নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে ফিরে যেতে চান।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার সেই দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাঁর প্রত্যাশা ফেয়ার ইনক্লুসিভ নির্বাচন। হয়তো আগামী ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচন হবে। তাঁর আর কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।
তিনি বলেছেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণ আছে। নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি করে বিভেদ সৃষ্টি করে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে। তিনি ন্যায্য কথাই বলেছেন। ৫ আগস্টের আগে-পরে সংস্কার করে এক নতুন দেশ গড়ার লক্ষ্যে যে অটুট ঐক্য ছিল, এখন সে প্রত্যাশা অনেকটাই ম্লান।
রাজনৈতিক দলের মধ্যে জলদি ক্ষমতায় পা রাখার লড়াই আমরা দেখছি। সংস্কারের আগে নির্বাচন জরুরি বলে অনেক রাজনৈতিক দল মনে করছে। তাদের দাবি, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে তারা সংস্কার করবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ চায় আগে সংস্কার হোক, তারপর নির্বাচন করে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে প্রয়োজন হলে আরো সংস্কার করবে। ক্ষমতাপ্রত্যাশী দল অপেক্ষা করতে চাইছে না।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ৮ আগস্ট ড. ইউনূস দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রথম থেকেই তিনি সংস্কারের ওপর জোর দেন।

সেনাবাহিনী জাতির শেষ ভরসাস্থল। সেখানেও বিভেদ সৃষ্টি করে ফাটল ধরানো, মনোবল ভাঙার চেষ্টা চলছে। যারা কুটনামি করছে, তারা জাতির ক্ষতি করছে। বোধগম্য কারণেই জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রে। তিনি স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণ রাজনীতিতে বিভেদ। জাতীয় শহীদ সেনা দিবস উপলক্ষে এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, বিশৃঙ্খলা-সংঘর্ষ বন্ধ না হলে, কাদা ছোড়াছুড়ি করলে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।

সেনাপ্রধানের সময়োপযোগী বক্তব্যদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন আরেকজনের বিষোদগারে ব্যস্ত। দেশের রাজনীতিতে এটাই এখন দৃশ্যমান। স্বাভাবিকভাবেই সেনাপ্রধান সতর্ক করেছেন, নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ করতে না পারলে আমরা বিপদে পড়তে পারি। একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর প্রধান হিসেবে তিনি তাঁর অবস্থান থেকে সঠিক কথাই তো বলেছেন। একজন সাহসী ও মানবিক কর্মকর্তা হিসেবে দেশকে সত্যিকার অর্থেই ভালোবেসে তিনি দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। শুধু নির্বাচন হলে সমাধান মিলবে না। গত দেড় যুগে এ দেশে ঘটে যাওয়া অবিচার, দুর্নীতি, অপশাসন থেকে মুক্তির জন্য কঠিন ও সাহসী ভূমিকাও রাখতে হবে। তা না হলে মুক্তি মিলবে না।

সেনাপ্রধান বলেছেন, কোনো সংস্থার নামে দুর্নাম ছড়ানো ঠিক না। পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, ডিজিএফআই, এনএসআই, প্রশাসনসব প্রতিষ্ঠানের মনোবল ভেঙে গেলে দেশ চলবে কী করে? কাজেই কোনো বাহিনীর নামে পাইকারি হারে বদনাম, বিরামহীন অপপ্রচার দেশের জন্য ক্ষতি। তারা অনেক ভালো কাজ করেছে। বাংলাদেশের গৌরব বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পরিস্থিতি উন্নয়ন না করে সেনাবাহিনী সেনানিবাসে ফিরে গেলে দেশে অরাজকতা আরো বেড়ে যাবে।

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বর্তমান দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছেন। সেনাপ্রধানের কথাগুলো অপ্রিয় সত্য। যে জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকে, সেই জাতিকে কোনো শক্তি পরাজিত করতে পারে না। সেনাপ্রধান দেশের গর্বিত ইতিহাস হয়ে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে। দেশের ক্রান্তিলগ্নে সেনাবাহিনী অনেক পরিশ্রম করে যাচ্ছে। সামনে আরো অনেক কাজ বাকি। অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান সময়োযোগী বক্তব্য দিয়েছেন। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সবার মনের কথা বলে দিয়েছেন। সবার আগে দেশ, সবাইকে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। নষ্ট রাজনীতির ফাঁদে যেন পা না পড়ে।

গঠনমূলক উপদেশ, তা-ও হুমকি বলে চালাচ্ছে। এসব গুরুত্বহীন কথা সেনাবাহিনীর অবিচল পথচলা রুখতে পারবে না।

সেনাপ্রধানের সঙ্গে আছে দেশের মানুষ। তিনি হাত খুলে দেশের সেবা করুন।

 

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

Zillu65@hotmail.com

মন্তব্য

নতুনের সমারোহ

    শায়রুল কবির খান
শেয়ার
নতুনের সমারোহ

নতুনের মধ্যে মৌলিকত্ব ও পুরনোতে গুণগত পরিবর্তন অপরিহার্য। তবেই সমাজে, রাষ্ট্রে তা গ্রহণযোগ্যতা পায়। আর নতুনের মধ্যে মৌলিকত্ব, পুরনোতে গুণগত পরিবর্তন না থাকলে সাময়িক আলোচনার সূত্রপাত কিংবা উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয় বটে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার মোহটা হারিয়ে যায়।

মৌলিক ও গুণগত পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

স্বাধীনতার উষালগ্নেই নাগরিকদের মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের বিপরীতে জনশক্তি ও জন-আকাঙ্ক্ষা হতাশায় নিমজ্জিত ছিল।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম রাষ্ট্রের নেতৃত্বে এসে জন-আকাঙ্ক্ষাভিত্তিক সঠিক দুটি পদক্ষেপ নেলেন। একটি সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ

একটি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রিন্সিপাল, অন্যটি ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতি শ্রদ্ধা। তিনি কতটা নিখুঁত আর্কিটেক্ট ৫৬ হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন-সার্বভৌমের ভূখণ্ডে নানা ভাষাগোষ্ঠীর নাগরিকদের বিশ্বদরবারে জাতি রাষ্ট্রের পরিচয় দিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তাঁর প্রধান রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে।

ইসলাম ধর্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র না করে সব ধর্মের নাগরিকদের সমমর্যাদা রেখে একটি ঝুড়িতে অলংকৃত হলো। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ-এর ভিত অনেক মজবুত ও কঠিন।

তাঁর বিপরীতে আগে ও পরে কেউ এমন জায়গা নিতে পারেননি, আর পারার সম্ভাবনাও নেই। এর একটি যৌক্তিক কারণও আছে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে দুটি ইস্যু স্থায়ী জায়গায় নিয়েছেন। প্রথমটি ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ। দ্বিতীয়টি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর-উত্তমের হাত ধরে তাঁর নীতির ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের পরিচয় সত্তা, যা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ

নতুনের সমারোহশহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম সঠিকভাবে বুঝেছিলেন এই অঞ্চলের নাগরিকদের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার বা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার জায়গায়টা কোথায়। তার ওপর দীর্ঘ নিবিড় চর্চা ও বিচক্ষণতায় সততার সঙ্গে রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। তাই স্বল্প সময়ে অর্থাৎ মাত্র ৩৯ বছর বয়সে রাষ্ট্রপতি হয়ে চার বছরের কিছু বেশি সময়ে সবার জন্য শিশু একাডেমি থেকে শুরু করে যুব কমপ্লেক্স ও প্রবীণ নিবাস প্রতিষ্ঠা করেছেন।

অর্থনৈতিক মৌলিক মডেল দিলে তৈরি পোশাক রপ্তানি শিল্প আর প্রবাসী শ্রমের কর্মসংস্থান, যাঁর বিপরীতে আজ ৫০ বছরের বেশি বয়সে বাংলাদেশে এখনো কেউ করতে পারেননি। কতটা দূরদর্শিতার রণকৌশলী হলে একজন মেজর হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। প্রথম ব্রিগেড জেড ফোর্স-এর অধিনায়ক। প্রথম ৫০০ বর্গমাইল এলাকা স্বাধীন ঘোষণা করে বেসরকারি প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে প্রথম শহীদ সৈনিকদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ কুমিল্লা সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতা ও একুশে পদক এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্থাপনএগুলো কি আপনারা গুণগত, নাকি মৌলিক বলবেন? এর বিপরীতে নতুন কী কী প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর-উত্তমের কর্মকাণ্ড একটি লেখার মধ্যে শেষ করা সম্ভব নয় এবং তা ভাবনায় নেওয়া ঠিক হবে না।

এবার যে লক্ষ্য রেখে এই লেখা, তার মধ্যে মনোযোগ দিতে চাইগত প্রায় ১৭টি বছর এ দেশে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীসহ সাধারণ নাগরিক চরম নিপীড়ন-নির্যাতন, হামলা, লাখ লাখ মামলা, গুম, গণহত্যার শিকার হয়েছে। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে ব্যাপক নির্যাতিত ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয়।

নতুন প্রজন্ম নিজের নিকট অভিজ্ঞতায় জেনেছে যে রাজনীতির অপব্যবহার করে আওয়ামী লীগ কিভাবে রাজনীতিকে নিছক ক্ষমতা ও বিত্তের বিনিয়োগে পরিণত করেছিল। তাই তারা ওয়েবসাইট তৈরি করে ইস্যুভিত্তিক ও রাজনৈতিক মতামত-নির্বিশেষে প্রধান বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে একটি ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরম গড়ে ওঠে।

সেই অরাজনৈতিক নানা বর্ণের প্ল্যাটফরম থেকে উদ্ভূত আন্দোলনই আজ অনেক মূল্যের বিনিময়ে ধাপে ধাপে বিকশিত হয়ে স্বৈরাচার উত্খাত করে বিশাল এক প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। এই প্রাথমিক বিজয়ই রাষ্ট্রক্ষমতা অর্থাৎ স্বৈরাচারের বিদায়ের পর কে সেখানে বসবে, সে প্রশ্ন তুলে ধরেছে জাতির সামনে। এই প্রশ্ন কি অতি গুরুত্বপূর্ণ? আন্দোলনের সমন্বয়করা এবার রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি ঘোষণা করলেন। তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করে দলটির আহ্বায়ক হয়েছেন। অন্য ছাত্রনেতারা ভিন্ন ভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।

তাঁদের বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশদরদি তারেক রহমান অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, এই সময়ে এসে আবারও তাই প্রমাণিত হয়েছে। এত আত্মত্যাগের পর যদি কোনো নতুন সাম্রাজ্যবাদ বা মৌলবাদের আদর্শপুষ্ট ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক শক্তি বা আরো বৈষম্যপূর্ণ কোনো গোষ্ঠী এসে শূন্যস্থানে বসে, তাহলে ছাত্রসমাজ ও জনগণের এই গৌরবময় আন্দোলন ব্যর্থ হবে না? সেটিও নিশ্চয়ই ছাত্র-জনতা চাইবে না?

তাই রাজনৈতিক প্রশ্নটিকে এখন এই মুহূর্তে ছাত্রদের তৈরি করা রাজনৈতিক দলের নেতাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা বিবেচনায় না নিয়ে উপায় নেই। এখন পর্যন্ত তাঁদের দাবিগুলো তাঁদের ভাষায় ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে তাড়িয়ে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিলোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিলোপ বা যেকোনো উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন, মৌলবাদী ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদ বা রাষ্ট্রধর্ম মতবাদ অথবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিপীড়ন ইত্যাদি প্রবণতার রয়েছে মৌলিক বৈরিতামূলক বিরোধ।

কিন্তু এরই মধ্যে এসব প্রবণতা দেশের ভেতরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে; এ ব্যাপারে কি তাঁরা সচেতন? যদি এ ব্যাপারে তাঁরা সচেতন হন, তাহলে তাঁদের ও তাঁদের দলের উচিত হবে এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার মধ্যে কী নীতি প্রতিষ্ঠা করবেন। তা করার জন্য নতুনের মধ্যে মৌলিকত্ব দরকার হবে। তাঁদের রাজনীতিতে কী মৌলিকত্ব আছে, নাগরিকরা নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করেই গ্রহণ করবে।

বেশির ভাগ তরুণই তাই যে যে দলই অতীতে করুন না কেন বা যে দলের প্রতি যে আশায়ই সমবেত হোন না কেন, বাস্তবে সমস্যা সমাধানের একটি সুনির্দিষ্ট

রূপকল্প কিন্তু তাঁদের কাছে থাকতে হবে। একটি বৈষম্যহীন সমাজে প্রত্যেকের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার জন্য কী ধরনের মৌলিক রূপান্তরের প্রয়োজন হবে, তা নিয়ে তরুণদের ও প্রতিযোগী দলগুলোর ধারণা স্পষ্ট হতে হবে।

লক্ষণীয় বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আলোচিত উজ্জীবিত রাজনৈতিক দলের নাম ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক নীতির ওপর ভিত্তি করে জাসদ। আজ তাদের সংগঠনের অবস্থা কী? আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে কত বড় বড় নেতা রাজনৈতিক দল তৈরি করলেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব বিকল্প রাজনীতির কথা বলে বিকল্পধারা নামে দল করলেন।  হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৯ বছর রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিয়ে স্বৈরাচার তকমা নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে বিদায় নিলেন। তাঁর দল একই নামে কয়টি ভাগ হয়েছে বলা মুশকিল।

বাম ভাবধারা ও ইসলামী ভাবধারার রাজনৈতিক দলগুলোর কথা আর না বললাম। জাঁকজমকভাবে পাঁচতারা হোটেলে জন্ম নেওয়া ইনসাফ পার্টি কোথায়? বিশেষ করে আরো বলা প্রয়োজন, ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উচ্চাভিলাষী ভাবনায় আমি-ডামি নির্বাচনের নামে রাতারাতি নতুন দল ও নিবন্ধন দেওয়ার কী পরিণতি! এগুলো নাগরিকদের সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট ও উজ্জ্বল হয়ে আছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সম্ভাবনাময় ছাত্রনেতারা আশু উপলব্ধিকে দীর্ঘমেয়াদি দায়িত্বে যদি রূপান্তর করতে চান, তাহলে আশা করি এই বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেবেন। এতে তাঁদের ও দলের এবং দেশের কল্যাণ হবে।

লেখক : বিএনপি মিডিয়া সেল সদস্য এবং

রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী

মন্তব্য

দেশের ক্রিকেট নিয়ে হঠকারিতার সুযোগ নেই

    ইকরামউজ্জমান
শেয়ার
দেশের ক্রিকেট নিয়ে হঠকারিতার সুযোগ নেই

বৃষ্টি বাংলাদেশকে এক পয়েন্ট পুরস্কার দিয়েছে। খেলা হলে কী হতো, ক্রিকেটে তো সেটা আগাম বলা যায় না। মাঠের লড়াইয়ে না নেমে মুফতে এক পয়েন্ট লাভ। শূন্য হাতে ফিরে আসতে হয়নিএটাও এক ধরনের সান্ত্বনা! আরেকজন সাংবাদিক লিখেছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা বড় চালাক।

তাঁরা একা ডোবেননি, বড় ভাইকে নিয়ে ডুবেছেন। এখন বড় ভাইদের একই চিন্তা কী করব, কী করব! আগের অবদান এবং ভূমিকা তো এখন অতীত। এটা তো আর বিক্রি করার সুযোগ নেই! খেলোয়াড়দের কাছ থেকে পারফরম্যান্স একমাত্র প্রত্যাশা। মাঠে কে কী করেছেন, কিভাবে খেলেছেন সব কিছুই সবাই দেখেছে।
 

মাছ দিয়ে শাক ঢাকার চেষ্টা এবার পাবলিককে খাওয়ানো সম্ভব হয়নি। ভারত ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠের লড়াইয়ে আমরা অনেকক্ষণ ক্রিজে ছিলাম। ব্যাটিং ব্যর্থতা—‘ডট বল রোগ থেকে বের হতে হবে। খেলোয়াড়দের আরো দায়িত্বশীলতার সঙ্গে খেলতে হবে।

শূন্যস্থানগুলো যত সম্ভব অল্প সময়ের মধ্যে পূরণ করতে হবে। নতুন করে টিম ম্যানেজমেন্ট, কোচ এবং খেলোয়াড়দের পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে! পুরনো একই গান বারবার শুনতে মানুষ বিরক্ত। তারা ক্রিকেট ম্যানেজমেন্ট এবং খেলোয়াড়দের কাছ থেকে নতুন কিছু প্রত্যাশা করে। আর এই প্রত্যাশা হলো আত্মবিশ্বাসী, সাহসী এবং দায়িত্বশীল ক্রিকেট।
মানুষের প্রত্যাশা হলো মাঠে এবং মাঠের বাইরে ক্রিকেটে পরিবর্তন। ক্রিকেটে প্রয়োজন বাস্তবধর্মী সংস্কার সাধন। প্রতারণা, ফাঁকিবাজি আর আত্মতৃপ্তি থেকে ক্রিকেট বোর্ড এবং ম্যানেজমেন্ট বেরিয়ে আসুক। বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় পেশাদারি মনোভাব গুরুত্ব পাক। দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হোক। কোয়ালিটি ক্রিকেটার নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পিত কাজ করা হোক। সময় যত গড়াচ্ছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ততই কম্পিটিটিভ হচ্ছে। টিকে থাকতে হলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতেই হবে। বারবার দেশকে হেয় করার সুযোগ কেন দেওয়া হবে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/02-03-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgবাংলাদেশ আইসিসি ক্রিকেটে পিছিয়ে পড়ছে। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সেমিফাইনালে খেলেছিল আর এবার ভাগ্যের কৃপায় এক পয়েন্ট। পিছিয়ে যাওয়া তো শুরু হয়েছে সেই ২০২৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে। ২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের পাঁচালি তো কারো অজানা নয়। অথচ ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল চমৎকার ক্রিকেট উপহার দিয়েছে। সবাই এগিয়ে চলেছে। আফগানিস্তানের দিকে তাকালে অবাক হতে হয়। ওরা ক্রিকেটের অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চলেছে। আমরা সেখানে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।

আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়, অধিনায়ক, টিম পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা সব সময় বিজ্ঞ অধ্যাপকদের মতো কথা বলেই চলেছেন। কাজের কাজগুলো সম্মিলিতভাবে সময়মতো যা করার কথা, সেটি করেন না। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য কথা বলা তো নিজের সঙ্গে প্রতারণা করা। এখন বলা হচ্ছে বিপিএল যদি আরো আগে শুরু করে শেষ করা যেততাহলে হাতে সময় থাকত, তখন প্রস্তুতি নিয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে অংশ নেওয়া সম্ভব হতো। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি তো অনেক আগের থেকেই নির্ধারিত করা আছে। তাহলে আগে কেন এই চিন্তাগুলো মাথায় আনা হয়নি। সবাই দ্বিপক্ষীয় এবং ত্রিদেশীয় ক্রিকেট খেলেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কেন আগে থেকে এই প্রয়োজনীয় বিষয়টি নিয়ে ভাবেনি। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বোর্ডের দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন সভাপতি, ক্রিকেট অপারেশনের দায়িত্বে যিনি, তিনিও বোর্ডে নতুন। আগে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা তো ক্রিকেটকেই সার্ভ করতে বোর্ডে এসেছেন। তাঁদের তো এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা উচিত ছিল। আসলে ক্রিকেট বোর্ডে সমন্বয়নের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ কখনো করা হয় না। যখন গায়ের ওপর এসে পড়ে, তখন শুরু হয়ে যায় হৈচৈ! যেটি অর্থহীনলোক-দেখানোর জন্য।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটি দুর্বল দিক হলো সব সময় কিছু না কিছু ইস্যু তৈরি করে আত্মতৃপ্তিতে ভোগা। ব্যাটাররা সেঞ্চুরি করবেন, বোলাররা উইকেট নেবেনএটি তো স্বাভাবিক। ক্রিকেট তো বদলে যাচ্ছে। এখন তো ওয়ানডেতে ৩০০ রানের ঘরে পৌঁছানোটা কোনো বিষয় নয়। আমরা সেখানে কোথায় খাবি খাচ্ছি বারবার। বোলাররা যখন ভালো করেন, তখন দেখি ব্যাটাররা তাঁদের ব্যর্থতার মিছিলকে লম্বা করে দলকে বিপদে ফেলে দেন। বোলিং-ব্যাটিং সমান সমান না হলে লড়াইয়ের মাঠে পিছিয়ে পড়তেই হবে। মুখে বললে তো হবে নাচ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরে আসব। আত্মবিশ্বাস ভালো। স্বপ্ন দেখাও ভালো, তবে অবাস্তব কিছু ভাবা মানে খেলাটির ক্ষেত্রে বড় হতাশা এবং ক্ষোভের জন্ম দেওয়া। ক্রিকেট বিশ্বে অন্যদের কাছে বাংলাদেশকে হেয় করা। এবারকার চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশ দল যেভাবে মাঠে পারফরম করেছেএটি লক্ষ করে ক্রিকেট বিশ্লেষকদের সবাই হতাশ। অনেকেই ক্রিকেটের সার্বিক অবস্থা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংশয় প্রকাশ করেছেন। যেখানে সবাই এগিয়ে চলেছে, সেখানে বাংলাদেশ পিছিয়ে যাচ্ছে। যেভাবে ক্রিকেট খেলা উচিত, সেভাবে খেলতে পারছে না। সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। ক্রিকেট নিয়ে যেভাবে ভাবা উচিত, সেটি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ক্রিকেট পারছে না একটি ভালো অভ্যাস ক্রিকেট বিশ্বকে দিতে। বাংলাদেশ সেই সামর্থ্য দেখাতে পারছেন না, যেটি প্রতিপক্ষের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভালো খেললে কিন্তু হতো। ভারতীয় একজন ক্রিকেটার বলেছেন, যখনই বাংলাদেশের সঙ্গে প্রথম ম্যাচ খেলিএর পর থেকে আমরা পরবর্তী ম্যাচগুলোতে দারুণ ক্রিকেট খেলি। ওদের সঙ্গে জয় আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বড় সমস্যা হলো মুখে এক রকম, ভেতরে আরেক রকম। তাই আসল অবস্থাটা বোঝা যায় না। ২০২৩ সালে চার-পাঁচটি উইকেট হারানোর পর মাঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হয়েছে। এবারও সেই একই অবস্থা। ভয় এবং মানসিক দুর্বলতা নিয়ে ক্রিকেট খেলা যায় না। তা ছাড়া দু-তিনজন পারফরম করবেন আর সবাই সাক্ষীগোপালএভাবে ক্রিকেট চলতে পারে না। ক্রিকেট পুরোপুরি দলীয় খেলা। এখানে সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে এবং সেই অনুযায়ী খেলতে হবে। দল পুনর্গঠন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের শেষ নেই। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি যেমন নিতে হবে, তেমনি আবার অ্যাডভেঞ্চার করার সুযোগ নেই। বুঝতে হবে সময়ের সংকেত। ক্রিকেটে দলাদলি আর গ্রুপিং ক্ষতিকর। দেশের ক্রিকেট নিয়ে হঠকারিতার কোনো সুযোগ নেই। সচেতনতা বাড়ছে। মানুষ কমবেশি বুঝতে পারছে দুর্বলতাগুলো কী কী। বেলা অনেক হয়েছে। অনেক কৈফিয়ত এখন আর হালে পানি পাবে না।

 

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ