ইংরেজি বিভাগের কাছে ঋণ

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শেয়ার
ইংরেজি বিভাগের কাছে ঋণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে আমি অনেক কিছু পেয়েছি, বিশেষভাবে যা পেয়েছি তা হলো যুক্ত হওয়ার প্রেরণা। সাহিত্যপাঠ মানুষকে বড় জগতে নিয়ে যায়, মহৎ মানুষ ও তাঁদের সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত করে দেয়, আমাকেও দিয়েছে; আর ওই দেওয়াটাকেই আমি বিশেষ রকমের প্রাপ্তি বলে জেনেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি আসি ১৯৫২-তে। সেটা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময়।

একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমতলায় আমিও ছিলাম। সেটাও ছিল একটা বড় জগতে যাওয়া। তার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যুক্ত হয়েছি সহপাঠীদের সঙ্গে। গুনে দেখলাম আমরা মাত্র ষোলোজন ছিলাম।
তখনকার সেন্ট গ্রেগরীজ কলেজ থেকে (পরে নাম হয়েছে নটর ডেম) আমরা এসেছিলাম চারজন। তাদের সঙ্গেও নতুনভাবে যুক্ত হলাম। সঙ্গী জুটল নতুন কয়েকজন। এদের প্রায় সবাই দেখছি একে একে চলে গেছে; তবু তারা আছে, আমার সাথি হয়েই।

ইংরেজি বিভাগের কাছে ঋণ

লীলা নাগ

আমাদের ক্লাসে ছাত্রী ছিল একজনই। অবাঙালি, গুজরাটি। ছিল সে নিতান্ত অনাত্মসচেতন। তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ছিল স্বাভাবিক বন্ধুত্বের; কিন্তু একজন ভেবে বসল মেয়েটি—মেহেরুননেসা আবদুল্লাহ মেহেরভাই নাম—তার প্রেমে পড়ে গেছে। সেই ভাবনায় এতই অস্থির ও কাতর হয়ে পড়ল আমাদের এই সহপাঠী যে অমনোযোগী হয়ে গেল পড়াশোনায়, এবং অনার্স পরীক্ষায় শামিল হতে পারল না আমাদের সঙ্গে।

মুনীর চৌধুরীপ্রেমিক ছিল আরো একজন; তবে অন্য বিভাগের এক মেয়ের। খালেদা ফ্যান্সি খানম পড়ত দর্শন বিভাগে, ওই সময়েই খ্যাতি পেয়েছিল রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে; আর তার গান শুনেই প্রেমে পতিত হয়ে গেল আমাদের এই সহপাঠী। সে সময় বেতার ভবনটি ছিল নাজিমউদ্দিন রোডে, কলা ভবনের কাছেই; খালেদার গান গাওয়া থাকলে আমাদের ওই বন্ধুটি গিয়ে বেতার ভবনের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকত; একঝলক দেখবে বলে। এই কাতরতায় তার পড়াশোনাটাই মাটি হলো। ব্যর্থতার বোঝা নিয়ে বিভাগ ছেড়ে চলে গেল সে রাজশাহীতে; সেখানে গিয়ে পড়েছে ইসলামের ইতিহাস। অধ্যাপকও হয়েছিল। অনেক বছর হলো বন্ধুটি চলে গেছে। আবিদ হোসেন ছিল ভীষণ চটপটে। সে থাকল না; লন্ডনে পাড়ি দিল। দ্বিতীয় বর্ষ পার করে সাবসিডিয়ারি শেষ করে এবং বিএ ডিগ্রি নিয়ে। ঠিক করেছে ব্যারিস্টার হবে। হয়েছিলও। তারপর দেশে ফিরে এসেছে, অনেক বছর পরে; ভেবেছিল থাকবে, কিন্তু পারল না। একাত্তরের ২৫শে মার্চের পরে দ্রুত চলে গেল লন্ডনে। যুদ্ধে যোগ দেবে। সেটা আর সম্ভব হয়নি। হার্ট ফেইলিউরে মারা গেছে অল্প কিছুদিন পরেই। মৃত্যু দমিয়েছে, নইলে আবিদকে দমানো ছিল খুবই কঠিন। ওর বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ‘বুদ্ধির মুক্তি’ খ্যাত আবুল হোসেন; আবিদ তার বাবার সান্নিধ্য বেশিদিন পায়নি; অকালেই তাঁর মৃত্যু ঘটে; কিন্তু আবিদ পিতার উত্তরাধিকার ঠিকই পেয়েছিল। বাবা ঢাকা শহরের গোঁড়া হর্তাকর্তাদের জ্বালাতনে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়, যোগ দিয়েছিলেন আইন পেশায়; আবিদও চেয়েছিল দক্ষ ব্যারিস্টার হবে, গেছিল তাই লন্ডনে। আমাদের শিক্ষক ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ক্লাসে একদিন আবিদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন; ‘আর ইউ সৈয়দ আবুল হুসেনস সান?’ চটপটে আবিদের জবাবটা ছিল, ‘ইয়েস স্যার, আই অ্যাম, বাট আই ডু নট কল মাইসেলফ সৈয়দ, বিকজ মাই ফাদার ডিডন্ট।’ ছেলেটির সাহস ছিল দুর্দান্ত। মুজিবুল হক সাহেব আমাদের ক্লাস নিয়েছেন কিছুদিন, সিএসপি হয়ে চলে যাওয়ার আগে। ব্লেকের কবিতা পড়াতেন তিনি। বলেছিলেন, ‘দিজ পোয়েমস আর সিম্পল লাইক জসীমউদ্দীনস, বাট ইনডিড ভেরি কমপ্লেক্স।’ পেছন বেঞ্চ থেকে আবিদ মন্তব্য করেছিল, ‘না বোঝাতেও কিন্তু আনন্দ আছে, স্যার।’ আবিদের টিউটরিয়াল ছিল প্রফেসর আই এইচ জুবেরীর সঙ্গে। তিনি তখন ডিন ও বিভাগীয় প্রধান; চলে যাবেন রাজশাহীতে, ভাইস চ্যান্সেলর হয়ে; সেই প্রস্তুতিতে মানসিকভাবে ব্যস্ত। আবিদকে বলেছিলেন টিউটরিয়াল লিখে নিয়ে আসতে। আবিদ সে কাজ করেছিল। প্রফেসর জুবেরী তার খাতায় নানা জায়গায় লাল কালিতে দাগ দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু নম্বর দিয়েছিলেন ভালোই, এ মাইনাস; তবে নিচে একটা মন্তব্য জুড়ে দিয়েছিলেন : ‘ইজ দিস ইওর ওউন?’ মধুর দোকানে ফেরত এসে আবিদ শিক্ষকের মন্তব্যের পিঠে লিখেছিল, ‘নাথিং ইজ মাই ওউন, স্যার, একসেপ্ট দ্য মিসটেকস।’ আমাদের ওই সময়টায় দাপট ছিল বামপন্থার; আবিদ একটি মার্ক্সবাদী আজান উদ্ভাবন করেছিল। উঠে দাঁড়িয়ে দুই কানে হাত লাগিয়ে উঁচু গলায় শুরু করত তিনবার মার্ক্স মহান বলে; শেষও করত তিনবার ওই ধ্বনি দিয়ে। মাঝখানে বলত, আগামীকাল মিটিং হবে, মিটিং হবে, বিকেল পাঁচটায়, পুঁথিপত্রে।

অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী

অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী

মুনীর চৌধুরীব্যারিস্টার হয়েছিল আরো একজন, রশীদুজ্জামান। পার্টিশনের আগে কলকাতায় আমরা একই স্কুলে পড়েছি, পরে দেখি ঢাকায় আমরা আইএ পড়ছি একই কলেজে। ওর বাবা ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের জজ। রশীদ বিলেত গেছে অনার্স পরীক্ষা দিয়েই। সেও মারা গেছে অনেক দিন হলো। লতিফুর রহমান চলে গেছে ক’বছর হলো। আবিদের মতোই সেও যশোরের; তার বাবাও আইনজীবী ছিলেন। যশোর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন দুবার। পার্টিশনের সময় সদস্য ছিলেন আইন পরিষদের। লতিফুরের ডাকনাম ছিল শান্তি; খুবই জনপ্রিয় ছিল সে বন্ধুমহলে। নিয়মিত টেনিস খেলত হলের টেনিস কোর্টে। শান্তিও গেছিল আইন পেশায়ই, হাইকোর্টের জজ হয়েছে, আরো পরে চিফ জাস্টিস, এবং অবসর-পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তো ছিলই, পরবর্তী সময়ে আমরা পরস্পরের আত্মীয়ও হয়ে গিয়েছিলাম, বৈবাহিক সূত্রে।

মুনীর চৌধুরী

মুনীর চৌধুরী

পাস করে বিভাগেই শিক্ষক হয়েছিলাম আমরা তিনজন— আহসানুল হক, এনামুল হক ও আমি। ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে এনামুল হক আমেরিকায় গিয়েছিল পড়তে; আর ফেরেনি। বছর কয়েক হলো সে মারা গেছে। মুনীর চৌধুরীআহসানুল হক ও আমি বিভাগের শিক্ষক ছিলাম দীর্ঘদিন। আহসানুল হক গিয়েছিল ব্রিস্টলে। সেখানে তার গবেষণার বিষয় ছিল মিডল ইংলিশ লিটারেচার ড্রিম পোয়েট্রি। সেটি বই হিসেবে বের হয়েছে। পরে গবেষণা করেছে এলিয়টর বক্তব্যের আলোকে এলিয়টের নিজের কবিতা নিয়ে। আহসানুল হক অত্যন্ত সচেতন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে। সত্তর-একাত্তরে সে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক; হানাদার পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটক করে রেখেছিল বেশ কয়েক মাস। সেও তো চলে গেল। মোহাম্মদ আলী এসেছিল চট্টগ্রাম থেকে। মেধাবী ও মনোযোগী ছাত্র; সবাই বলত জেনুইন স্কলার। মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে আমার একটি অঘোষিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল; পরীক্ষায় সে একবার প্রথম হতো তো পরেরবার আমি। রাষ্ট্রীয় বৃত্তি নিয়ে মোহাম্মদ আলী গেছিল অক্সফোর্ডে, সেখান থেকে অনার্স করে এসে যোগ দেয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান সে। পরে উপাচার্যও হয়েছিল। আরো পরে ইউজিসির সদস্য। মোহাম্মদ আলীও তো চলে গেল ক’বছর হলো। মোহাম্মদ মোশতাকের পেশা দাঁড়িয়েছিল সাংবাদিকতা। প্রথমে পত্রিকায়, পরে রেডিওতে। অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ছিল সে। চলে গেছে বেশ আগেই। চোখে ভারী চশমাওয়ালা আনওয়ার  হোসেন ছিল খুবই শান্ত স্বভাবের। পড়াশোনা শেষে কাজ নিয়েছিল ব্যাংকে। সেও আর নেই। আনওয়ারকে আমার মনে আছে বিশেষ এক কারণে। ওর এক ভাই থাকতেন লন্ডনে। তখন নামকরা পত্রিকা ছিল ত্রৈমাসিক ‘এনকাউন্টার’; সম্পাদক কবি স্টিফেন স্পেন্ডার। ছোট ভাইয়ের কাজে লাগবে জেনে আনওয়ারের ভাই পত্রিকার ছয়টি সংখ্যার একটি করে কপি পাঠিয়েছিলেন ডাকযোগে। আনওয়ার সেগুলো দেখেটেখে আমাকে দিয়ে একগাল হেসে বলেছিল, ‘তোমার  প্রয়োজন আমার চেয়ে বেশি।’ তা, আমার কাজে লেগেছিল বৈকি। আমি অত্যন্ত কৌতূহল নিয়ে সব কটি সংখ্যা পড়েছি। বিশেষভাবে মনে পড়ে নীরদ সি চৌধুরীর একটি লেখা, যাতে তিনি ই এম ফরস্টারের ‘এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’ পাঠে রুষ্ট এক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। মোতাহার হোসেন এসেছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। ভালো ছাত্র, কিন্তু একেবারেই নতুন ও অপরিচিত পরিবেশে তাকে ভারি নিঃসঙ্গ ঠেকত। পড়াশোনা শেষ করে অধ্যাপনা করেছে কলেজে। কয়েক বছর আগে তার  মৃত্যুসংবাদ পড়েছি খবরের কাগজে। মাহবুবুর রহমানও কলেজে গিয়েছিল, অধ্যাপক হিসেবে; তার পরে আর খবর পাইনি।

আমার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল দুজনের সঙ্গে—বারি ও ফারুক। আবদুল বারি ও ফারুক চৌধুরী। দুজনই অনার্স শেষ করেই পরীক্ষা দিয়েছে সিভিল সার্ভিসে; এবং দুজনই ফরেন সার্ভিস পেয়ে একসঙ্গে আমেরিকায় চলে গিয়েছিল ট্রেনিংয়ের জন্য। তারা নাম করেছিল রাষ্ট্রদূত হিসেবে। ফারুক লিখতও। লেখক হিসেবে ফারুক চৌধুরী ভালো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বারি ছিল কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের। ফরেন সার্ভিস থেকে অবসর নেওয়ার পর কিছুদিনের জন্য নিজেদের সম্প্রদায়ের মুখপাত্র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছে সে; তাদের জন্য পরিস্থিতিটা তখন ছিল সংকটের। বারির সাহসী অবস্থানের খবর দেখেছি কাগজে। বারি ও ফারুক দুজনের কেউই এখন আর নেই; বারি চলে গেছে বেশ আগেই; ফারুক গেল তা-ও ক’বছর হয়ে গেছে। এস এম সোলায়মান থাকত পুরান ঢাকায়। সে প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসক হয়েছিল। তার মৃত্যুসংবাদও আমাকে শুনতে হয়েছে। তালেহউদ্দিন খানের কথা তো না বললেই নয়। থাকত পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জে। পৈতৃক নিবাসে। তার শখ ছিল পুস্তক সংগ্রহ। এত বড় ও ভালো সংগ্রহ সে সময় আমাদের কারোই ছিল না। তালেহউদ্দিনের ছিল চমৎকার বাগবৈদগ্ধ। অন্যমনস্ক অবস্থায় প্রশ্ন করায় কে একজন একবার তাকে বলেছিল, ‘আকেলমন্দ কি লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়’; সঙ্গে সঙ্গে তালেহউদ্দিনদের প্রত্যুত্তর এসেছিল, ‘কভি কভি বেআক্কেল ভি ইশারা করতি হ্যায়।’ বই, জ্ঞান ও বাগবৈদগ্ধ সঙ্গে নিয়ে তালেহউদ্দিন গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, কলেজে পড়াবে। জমিয়ে বসেছিল সে ওই শহরে; অনেক অনুরাগী জুটেছিল তার, বিশেষ করে অধ্যাপক মহলে। কিন্তু একবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকায় ফেরার পথে স্কুটার উল্টে সেই যে হাত ভাঙল, সে হাত আর জোড়া লাগেনি। তার পরও সাংবাদিকতা করেছে, টিকে যাওয়া ডান হাতটি দিয়ে; কিন্তু কত দিন আর পারা যায়, একসময় অবসর নিতে হয়েছে। খুবই অন্তরঙ্গতা ছিল আমার এস এম শামসুজ্জামানের সঙ্গে। কলেজে একসঙ্গে পড়েছি। তখনো দেখতাম জামান কেমন যেন বিষণ্ন থাকত; বিশ্ববিদ্যালয়েও বিষণ্নতা তার পিছু ছাড়েনি। অবসর নিয়েছে ইনকাম ট্যাক্সের কমিশনার হিসেবে। একবার উদ্যোগ নিয়েছিল একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। সফল হওয়া সম্ভব ছিল না, হয়ওনি। সস্ত্রীক কানাডায় গিয়েছিল, ছেলেদের সঙ্গে থাকবে বলে। অনেক দিন খবর পাই না। এতই শোকসংবাদ চারদিকে যে অবাক হব না যদি শুনি সে নেই। অবাঙালি হাসিবুর রহমানও ছিল আমার কলেজের সহপাঠী এবং ইংরেজি বিভাগেও। ওদের ছিল আইসক্রিম ফ্যাক্টরি। নিশ্চয়ই চলে গেছে একাত্তরের আগে, কিংবা পরে।

এই যে আমার সহপাঠীদের কথা বললাম, স্মরণ করতে গেলে ভারী হয়ে আসে মন, ঝাপসা হয়ে ওঠে চোখ, এদের সবার সঙ্গে যে আমার এক রকমের সম্পর্ক ছিল তা অবশ্যই নয়, কিন্তু সবার সঙ্গেই যে আমি যুক্ত ছিলাম, সেটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। ১৯৫২-৫৬-র ওই সময়টাতে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আমরা সবাই ছিলাম উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তান; আমাদের এগিয়ে যাওয়া ওই শ্রেণির অগ্রসরমাণতারই প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্র তখন গঠিত হচ্ছে, গঠনের সময় আমরা সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু রাষ্ট্র যে মিত্র হবে না সেটাও টের পাচ্ছিলাম নানাভাবে। বিশেষত বোধ করি সাহিত্য পড়েছি বলে। ইংরেজি বিভাগের কাছে আমরা সবাই ঋণী, নানাভাবে; আমার জন্য বিশেষ ঋণ, ওই যে বললাম যুক্ত হওয়ার তাগিদটাকে প্রাণিত করার ক্ষেত্রে।

 

দুই

বিভাগে আমার ভর্তি হওয়াটা ঘটেছিল ছোটখাটো একটা গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি পড়ি অর্থনীতি, যাতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেওয়ায় সুবিধা হয়। সেকালে ওটাই হতো প্রথম নির্বাচন, ব্যর্থ হলে অন্য পথ খোঁজা। কিন্তু আমার পক্ষপাত তো সাহিত্যের দিকে। অনড় দুই পক্ষে শেষ পর্যন্ত একটা সমঝোতা হয়েছিল এই মর্মে যে আমি বাংলা নয়, ইংরেজি সাহিত্য পড়ব, সাবসিডিয়ারি হবে পলিটিক্যাল সায়েন্স ও ইকোনমিকস, যাতে সিভিল সার্ভিসের জন্য প্রস্তুতিটা চলতে থাকে। সাহিত্যের ব্যাপারে আমার আগ্রহটা ছিল, পরে বুঝেছি, ওই যুক্ত হওয়ার তাড়নায়ই।

জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা

জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা

তা, ভর্তি হয়েই আমি নানাভাবে যুক্ত হয়ে গেলাম। অল্প পরেই সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে গেছি, দেখতে পেলাম; এবং জিতলামও। পরের তিন বছরও হল সংসদ নির্বাচনে আমি তুমুলভাবেই অংশ নিয়েছি। আবাসিক ছাত্র ছিলাম না, কিন্তু ঘোরাফেরা ছিল ছাত্রাবাসেই। আর নির্বাচন এলে তো আমাকে যুক্ত হতেই হতো। সেকালে প্রার্থীদের পরিচয়পত্র লেখা হতো ইংরেজিতে, আমার ওপর দায়িত্ব বর্তাত প্রেস জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাথেকে সম্মিলিত পরিচয়পত্র ছাপিয়ে আনার। একবার তো আমার সারা রাতই কেটেছে প্রেসে। খুব সকালে ছাপানো বুকলেট প্যাকেটে করে নিয়ে হলে গেছি; তাতে অন্যরা কতটা উত্ফুল্ল হয়েছে জানা হয়নি, কিন্তু আমি যে গৌরব অনুভব করেছি তাতে সন্দেহ নেই। নির্বাচনের দিন মাইক্রোফোনে প্রবল প্রচারণা চলত, তাতেও আমার সক্রিয় অংশগ্রহণে কোনো ত্রুটি ছিল না।

প্রতিটি আবাসিক হলেরই একটা সাংস্কৃতিক জীবন ছিল। প্রতিবছর প্রতিযোগিতা হতো আবৃত্তি, বক্তৃতা, গান ইত্যাদির। আমি গান বাদ দিয়ে অন্যগুলোতে অংশ নিতাম। হল বার্ষিকী বেরোত, তাতে আমি লিখেছি। বার্ষিকী সম্পাদনায়ও একবার যুক্ত হয়েছিলাম।

ওই লেখার ও সম্পাদনার কাজটাতে ছিল আমার বিশেষ আগ্রহ। ভালো-মন্দ যা-ই হোক আমি লিখতাম। এবং হাতে লেখা পত্রিকা, দেয়ালপত্রিকা, ছাপা পত্রিকা—অনেক কিছুই সম্পাদনার দায়িত্ব নিজ থেকেই নিয়ে নিয়েছি। আসলে এর ভেতরেও ছিল অন্যদের সঙ্গে সংলগ্ন থাকার আগ্রহ। আমি লিখছি, অন্যরা দেখছে, হয়তো পড়ছেও, এটা একটা ভরসার ব্যাপার ছিল। কেননা ভেতরে ভয় ছিল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার। একাকী থাকতে যে আমার ভীষণ রকম অপছন্দ ছিল তা নয়, কখনো কখনো ভালোই লাগত; কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব এটা ছিল রীতিমতো একটা আতঙ্ক। দুঃস্বপ্নের মতো। যেন হারিয়ে যাব। আর ওই যে পত্রিকা সম্পাদনার কর্ম, ওতে দেখতাম আমি অনেকের সঙ্গে আছি। একসঙ্গে কাজ করছি, পত্রিকা বের করে তা বিতরণ করছি, দল বেঁধে বের হয়েছি বিজ্ঞাপন জোগাড়ে, প্রুফ দেখছি প্রেসে বসে; সবটাতেই সংযোগ ঘটছে অন্যদের সঙ্গে। ঠাট্টা করে আমার বন্ধু আবদুল বারি তো আমাকে ‘দি এডিটর’ বলেই ডাকত।

হাতে লেখা পত্রিকায়ও আনন্দ ছিল। ‘রাঙা প্রভাত’ নামে একটা হাতে লেখা পত্রিকা বের করতেন ঢাকা কলেজের সাবেক কয়েকজন ছাত্র মিলে; সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আবদুল কাদির; আমাদের দুই বছরের সিনিয়র এবং প্রতিবেশী। তিনিই আমাকে দায়িত্ব দিলেন দ্বিতীয় সংখ্যাটি বের করার জন্য। অনেকগুলো রচনা তিনিই এনে দিয়েছিলেন, যার মধ্যে ছিল মুনীর চৌধুরীর গল্প ও শামসুর রাহমানের কবিতা। সহায়তা করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। পাড়ায় তখন আর্ট কলেজের কয়েকজন ছাত্র থাকতেন; তাঁদের দুজন—জুনাবুল ইসলাম ও হুমায়ুন কাদির—অলংকরণ করে এবং প্রচ্ছদ ছবি এঁকে দিয়েছিলেন।

ওদিকে সবেগে চলছিল ছাত্রসংঘের কাজ। আমরা ছেলেরা ছাত্রসংঘ গড়েছি পাড়ায়, পাঠাগার খুলেছি, ছেপে পত্রিকা বের করেছি কষ্টেসৃষ্টে। পাঠাগারে সাহিত্যসভা বসত প্রতি সপ্তাহে। মঞ্চ তৈরি করে তাতে নাটক, বিচিত্রানুষ্ঠান, ছায়ানাটক—এসব করেছি। লিখছিও। আমি দেখতে পাই যে লেখা নিয়ে যাচ্ছি তখনকার প্রধান মাসিক পত্রিকা ‘মাহে নও’ অফিসে। লিখে কিছু আয়ও হচ্ছে। অংশ নিচ্ছি রেডিও প্রোগ্রামে।

রেডিওর একজন প্রযোজকের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে ইবসেনের ‘ওয়াইল্ড ডাক’-এর একটি রূপান্তরও দাঁড় করে ফেলেছি, সেটা প্রচারও হয়েছে। রেডিওতে অনুষ্ঠান করলে নগদানগদি একটা চেক পাওয়া যেত, কিন্তু সেটা ভাঙানোর জন্য ছুটতে হতো সদরঘাটে, সেখানে তখন রয়েছে স্টেট ব্যাংক।

কিন্তু আমার প্রধান বিনোদন ছিল পড়া। যা পাই তা-ই পড়ি। পড়া আমাকে হাতে ধরে নিয়ে পার করে দিয়েছে বিচ্ছিন্নতার সীমান্ত থেকে। আমার জন্য মস্ত বড় আকর্ষণের জায়গা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট গ্রন্থাগারটি; সেলফের কাছে যেতে পারি না, স্লিপ দিয়ে বই আনতে হয়, গ্রন্থাগারের ভেতরের জগত্টাকে মনে হয় রহস্যময়। দ্বিতীয় বর্ষেই যখন আমার চশমা নেওয়ার দরকার পড়ল, আমার বাবা বললেন, পেঙ্গুইনের ছোট ছোট অক্ষরের বই পড়তে গিয়ে ছেলেটার এই দশা। নিতান্ত ভুল বলেননি। পেঙ্গুইনে তখন গুরুত্বপূর্ণ সব বই-ই পাওয়া যেত, আর দামও ছিল খুব কম। বৃত্তির টাকা পেলেই প্রথমে ছুটতাম বইয়ের দোকানে। এখন যেখানে শহীদ মিনার, তার উল্টো দিকে বিক্ষিপ্ত কয়েকটি বইয়ের দোকান ছিল। মালিকরা জানতেন কোন বই চলবে, কোনটা চলবে না; সে অনুযায়ী পেঙ্গুইনের বই বেশ আনতেন। কিন্তু প্রচুর নয়। মনে পড়ে টি এস এলিয়টের ‘সিলেক্টেড এসেজ’ এসেছে শুনে প্রায় দৌড়ে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি দুই কপি মাত্র আছে, আমি দ্রুত এক কপি হস্তগত করে আবিষ্কার করি শামসুর রাহমানও এসে গেছেন, তিনি আমাদের তিন ক্লাস ওপরে পড়তেন, ইংরেজি বিভাগেই, তাঁরও লক্ষ্যবস্তু এলিয়টের ওই বই। দ্বিতীয় কপিটি তিনি নিয়েছিলেন। আমাদের তখনকার মফস্বল শহরে বই পাওয়াটা মোটেই সহজ ছিল না।

 

তিন

অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, সাহিত্য পাঠদানের দুটি ধারা আছে। পরস্পরবিরোধী নয়, তবে পৃথক বটে। একটি ধারা পাঠের আনন্দকে শিক্ষার্থীদের ভেতর সংক্রমিত করার; অন্যটি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সাহায্যে রচনার সৌন্দর্য ও তাৎপর্য পরিষ্কারভাবে তুলে ধরার। আনন্দ দুটিতেই প্রাপ্য; তবে দুই ধরনের। এটা আমি পরিষ্কারভাবে বুঝেছি শিক্ষকতায় ইংরেজি বিভাগে যোগ দেওয়ার অল্প পরেই। লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে। লিডসের ইংরেজি বিভাগে তখন বেশ কয়েকজন জাঁদরেল অধ্যাপক ছিলেন। দুজনের কথা আলাদা করে বলা দরকার—একজন প্রফেসর উলসন নাইট, অন্যজন প্রফেসর আর্নল্ড কেটল। উলসন নাইট ছিলেন অসাধারণ পণ্ডিত; এবং সাহিত্যগত প্রাণ। অকৃতকার। বেশির ভাগ সময় কাটান ক্যাম্পাসে। আমাদের সময় পড়াতেন ব্রিটিশ ড্রামা; ক্লাসরুমের শিক্ষার্থীদের নিয়ে যেতেন একেবারে নাটকের প্রাণকেন্দ্রে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাব একবার মঞ্চায়ন করেছিল ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’; উলসন নাইট নেমেছিলেন সাইলকের ভূমিকায়। দেখলাম তিনি কেবল কুশলতার সঙ্গে নয়, আনন্দ নিয়ে সাইলককে—মানুষটির বেদনা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, যন্ত্রণা, সবকিছুকে—কেমন মূর্ত করে তুলেছেন। আইডিয়ালিস্ট উইলসন নাইটের ঠিক বিপরীতে ছিলেন মার্ক্সবাদী প্রফেসর কেটল। দুই খণ্ডে তিনি বই লিখেছেন ইংরেজি উপন্যাসের ওপর। সেখানে তিনি তাঁর আলোচ্য উপন্যাসগুলোর পটভূমির ইতিহাস, অর্থনীতি, লেখকের শ্রেণিগত অবস্থান, মতাদর্শ এমন পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন, যাতে রচনার অর্থ গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে। পাণ্ডিত্য দুজনেরই ছিল, কিন্তু দুই ধরনের। আনন্দ এঁরা উভয়েই পেছনের, কিন্তু দুইভাবে। একজন বলছেন হৃদয় ও বুদ্ধিকে একত্র করে যুক্ত হও। অন্যজনের শিক্ষাটাও যুক্ত হওয়ারই, কিন্তু বার্তাটা এই যে যুক্ত হবে বুঝেশুনে, যত বুঝবে ততই গভীর ও নিবিড় হবে তোমার সংযুক্তি।

লতিফুর রহমান

লতিফুর রহমান

আমাদের নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা ক্লাসে খুবই যত্ন নিয়ে পড়াতেন; কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন ব্যাখ্যাবাদী। সাহিত্যপাঠে তাঁদের আনন্দ ছিল, কিন্তু সে আনন্দ শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে তেমন লতিফুর রহমান একটা অভ্যস্ত ছিলেন না। ব্যতিক্রম ছিলেন দুজন—জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও মুনীর চৌধুরী। এটা হয়তো নিতান্ত কাকতালীয় নয় যে তাঁরা দুজনেই আলবদর বাহিনীর দ্বারা শহীদ হয়েছেন একাত্তরে। আমাদের সময়ে ছাত্রাবাসের ছেলেরা যখন নাটক করার উদ্যোগ নিত তখন গুহঠাকুরতা স্যারের শরণাপন্ন হতো। ক্লাসরুমে আমাদের তিনি পড়িয়েছেন ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’। দেখতাম তিনি জীবন্ত করে তুলতেন নাটকটি। একবার তিনি সুইনবর্নের ‘অ্যাটালান্টা ইন ক্যালিডন’ নাট্যকাব্য পড়াতে গিয়ে ইংরেজ কবির অ্যাফ্রোডাইটির উপস্থাপনার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’র। দুটি টেক্সটই পাঠ করে শুনিয়েছেন। তিনি বলে দেননি, কিন্তু আমাদের পক্ষে বুঝতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি যে রবীন্দ্রনাথ কতটা উঁচু মানের কবি ছিলেন অন্যদের তুলনায়।

মুনীর চৌধুরীকে আমরা বেশিদিন পাইনি। আমরা যখন এসেছি, তখন তিনি জেলে; রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে। জেলখানাকে অনেক রাজনৈতিক বন্দিই বিশ্ববিদ্যালয় করে তোলেন, মুনীর চৌধুরীও তা-ই করেছেন, বন্দি অবস্থায়ই তিনি বাংলায় এমএ পরীক্ষা দিয়ে এবং খুব ভালো ফল করে বেরিয়ে এসেছেন। পরবর্তী অধ্যায়ে বাংলা সাহিত্যেরই অধ্যাপনা করবেন বলে ঠিক করে ফেলেছিলেন। ফলে জেল থেকে বেরিয়ে এসে তিনি দীর্ঘ সময় আমাদের বিভাগে থাকেননি, তবে ওই অল্প সময়েই আমরা তাঁর ক্লাস করার সুযোগে টের পেয়েছি যে সাহিত্যপাঠের আনন্দকে অত্যন্ত প্রাণবন্ত করে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে চাইতেন, এবং জানতেন। মুনীর চৌধুরী যে নিজে নাটক লিখতেন এবং মঞ্চে অভিনয়ও করেছেন সেটা তো এমনি এমনি নয়।

মুনীর চৌধুরীর সহপাঠী ছিলেন সৈয়দ আলী আশরাফ। উভয়েই যোগ দিয়েছিলেন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে, তবে আশরাফ স্যার যখন গেছেন কেমব্রিজে, মুনীর স্যার তখন গেছেন কারাগারে। ভিন্ন যাত্রা, কিন্তু ফল অভিন্ন; দুজনেই উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফিরেছেন। কেমব্রিজে তখন টেক্সুয়াল ক্রিটিসিজমের যুগ। আশরাফ স্যার সেই শিক্ষাটা নিয়ে এসেছিলেন। ফলে ক্লাসরুমে তাঁর কবিতার ব্যাখ্যা দাঁড়াত আমাদের জন্য অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর। তবে মুনীর স্যার আর আশরাফ স্যারের ধরনটা ছিল পৃথকই। দুজনই অত্যন্ত উঁচু মানের শিক্ষক, তবে একজন ছিলেন আনন্দবাদী, অন্যজন বোদ্ধাবাদী। আনন্দ সংক্রমণে যাঁরা আগ্রহী তাঁরা যে পাঠ্য টেক্সটের অর্থের গভীরে যেতে চান না তা মোটেই নয়, তাঁরাও গবেষণা করেন, ব্যাখ্যা করেন; কিন্তু সেখানেই থেমে যান না। জ্ঞান তাঁদের আনন্দকে বাড়িয়ে দেয়। উইলসন নাইটের পাণ্ডিত্যে ও বিশ্লেষণক্ষমতায় সন্দেহ করবে কে; কিন্তু তিনি সাহিত্যকে শুকনো থাকতে দিতে নারাজ, সাহিত্যকে তিনি প্রাণবন্ত না করে রেহাই দেবেন না। উইলসন নাইটের মতাদর্শিক রক্ষণশীলতাটা কেউ কেউ হয়তো পছন্দ করেন না, কিন্তু সাহিত্য পাঠদানের তাঁর ধারাটি শিক্ষার্থীদের ভেতরে যুক্ত হওয়ার শক্তিটাকে যে বাড়িয়ে দেয় তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই।

প্রফেসর এ জি স্টককে আমরা পাইনি। আমাদের আসার আগেই তিনি চলে গেছেন। ঢাকায় মুসলিম লীগ সরকারের তৈরি রাজনৈতিক তাপ তাঁর কাছে স্বস্তিকর ঠেকছিল না। সাহিত্য শিক্ষাদানে তিনি তাঁর নিজের আনন্দকে অন্যদের পৌঁছে দিতেন বলে তাঁর সময়ের ছাত্রদের কাছে শুনেছি। আমাদের অনার্স পরীক্ষার সময় তিনি কলকাতা থেকে এসেছিলেন ভাইভা নিতে। তাঁর প্রশ্ন ও মন্তব্য শুনে টের পেতে বিলম্ব ঘটেনি যে সাহিত্যপাঠ তাঁর জন্য উপভোগের বিষয় ছিল। স্বাধীনতার পরে তিনি পুনরায় এসেছিলেন, ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে; তখন তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় দেখেছি সাহিত্য তাঁর কাছে কেমন জীবন্ত ছিল।

আমাদের শিক্ষকদের একজন ছিলেন বি সি রায়। অকৃতদার, এবং পরিপূর্ণরূপে সাহিত্যমনস্ক। মনে হতো সর্বক্ষণ পড়ছেন। অনার্স পরীক্ষার আগে কিছুদিনের জন্য তাঁর সঙ্গে আমার একটা নীরব প্রতিযোগিতা চলেছিল। কে আগে গ্রন্থাগারে প্রবেশ করতে পারে। আমি আসতাম আগে না এলে বই অন্যের দখলে চলে যাবে এই শঙ্কায়। স্যার আসতেন ভেতরের তাগিদে। প্রায়ই দেখতাম আমি হেরে যাচ্ছি তাঁর কাছে। এই পর্যন্ত লিখে হঠাৎ আমার মনে হলো, আমাদের ওই শিক্ষক কি আরেকজন উইলসন নাইট হতে পারতেন? উইলসন নাইটের মতোই তিনিও তো সাহিত্যকেই আপন ভুবন হিসেবে মানতেন। না; এক রকমের হওয়া সম্ভব ছিল না। মেধা ও সুযোগের কথা বাদ থাক, তাঁদের অন্তর্গত তাগিদটাই ছিল দুই ধরনের। শিক্ষা এবং সংস্কৃতিও।

শিক্ষাদানের ওই দুই ধারার একটি যে অন্যটিকে নাকচ করে তা মোটেই নয়; তারা সহ-অবস্থান করে, এবং করাটাই ভালো, তাতে উভয় ধারারই সমৃদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে; এবং জীবন, সভ্যতা ও প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার যে প্রেরণা ও শিক্ষা সাহিত্য জোগায় সেটা আরো বিস্তৃত ও ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে।

 

চার

ভালো কথা, আমাদের ওই কালে আমরা যে কেবল শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং বই-পুস্তক প্রাপ্তির সুযোগ-সুবিধার দিক থেকেই সীমিত ছিলাম তা কিন্তু নয়; আমাদের পাঠ্যসূচিও ছিল বেশ দরিদ্র, কিছুটা মফস্বলীয়। অনার্সে আমরা পুরো একটা পেপার অ্যাংলো-স্যাক্সন লিটারেচার পড়েছি, সেখানে প্রাচীন ভাষাও পড়তে হয়েছে, যা খুব কাজে লেগেছে বলে মনে হয় না। আবার এমএতে ছিল ১০০ নম্বর মিডল ইংলিশ। এই দুইকে এক করে খালি জায়গায় যদি শেকসপিয়ার পড়ানো হতো একটি স্বতন্ত্র পেপার হিসেবে তাহলে আমরা অধিক উপকৃত হতাম। আমরা এইটিনথ সেঞ্চুরি লিটারেচার পড়েছি, কিন্তু ‘টম জোনস’ পড়িনি। সবচেয়ে দুর্বল ছিল মডার্ন পেপার। সেখানে ঔপন্যাসিক হিসেবে অলডাস হাক্সলি ও সমারসেট মম ছিলেন, ছিলেন না জোসেফ কনরাড, ই এম ফরস্টার কিংবা ডি এইচ লরেন্স। তিনজনের একজনও না।

 

পাঁচ

শেষ করি এই কথাটা বলে যে গত শতবর্ষের পূর্বেকার ইংরেজি বিভাগ থেকে অনেক যশস্বী ব্যক্তি বের হয়েছেন; তাঁদের স্মরণ করা হয়; স্মরণ করাটা দরকারও। কিন্তু আমরা যেন না ভুলি লীলা নাগকে; যিনি কেবল ইংরেজি বিভাগেরই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রথম ছাত্রী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সময়ের প্রথম ও একমাত্র মহিলা পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট তিনি। ভর্তি হয়েছিলেন অনিচ্ছুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্রীশূন্য অবস্থায় যাত্রা শুরুর লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে। পরে তিনি জনমুক্তির সঙ্গে       পরিপূর্ণরূপে যুক্ত হয়েছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতি করেছেন, রাজবন্দি ছিলেন দীর্ঘকাল; নারীশিক্ষার প্রসারের জন্য ঢাকা শহরে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সম্পাদনা করতেন মাসিক পত্রিকা। বিভাগে তাঁর সহপাঠী অনিল রায়ও ছিলেন রাজনীতিমনস্ক। দুজনেই সুভাষ বসুর ফরওয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন; এবং স্বামী-স্ত্রী ছিলেন তাঁরা ব্যক্তিগত জীবনে।

স্মরণ করা দরকার আরো দুজন শিক্ষককে। অমলেন্দু বসু ও অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় বিভাগীয় শিক্ষক অমলেন্দু বসু ডক্টরেট করছিলেন অক্সফোর্ডে। তিনি আর ঢাকায় ফেরেননি। অমলেন্দু বসু ছিলেন পূর্ববঙ্গেরই মানুষ। অভিয়ভূষণ চক্রবর্তী দেশভাগের পরও কিছুদিন ছিলেন। তিনিও পূর্ববঙ্গীয়। স্থায়ীভাবে থাকবেন এমন ভাবনা নিশ্চয়ই তাঁর ছিল; কিন্তু পারলেন না, কারণ তাঁর যোগ ছিল গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে; ঢাকায় থাকলে হয়তো সাহিত্যের বস্তুবাদী ধারার ব্যাখ্যা চালু রাখতে পারতেন, আর্নল্ড কেটল যেমনটা রেখেছিলেন, লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে।

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শীত বিকেল

    শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
শেয়ার
শীত বিকেল
অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’

কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।

যে শহরে তার নিজেরই ঠিকানার ঠিক নেই, সেখানে আবার কাক!

মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।

‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’

প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।

‘দেখান তো ভাই।’

র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।

লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।

দুজনই মোবাইল নিয়ে রাতভর পড়ে থাকে। ফেসবুক, টিকটক—আরো কত কী দেখে! ফাঁক পেলেই এসব নিয়ে কথা বলে দুজন। ফেসবুক অবশ্য মাশুকও দেখে। রাতে ঘুম না এলে ফেসবুকের ভিডিওগুলো দেখে।

অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’

নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।

মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!

লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’

লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!

তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?

পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।

‘কী করছ, বাবা?’

‘এইতো—দোকানে বসছি।’

‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’

‘কেন?’

‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’

‘খুব দরকার?’

‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’

‘দেখি।’

‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’

লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।

মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’

বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।

এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।

দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।

মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।

এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।

‘তুমি!’

যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।

মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’

‘আসো।’

দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’

নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’

‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’

‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’

‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’

‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’

নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।

মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’

নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’

মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’

নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’

‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’

নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’

এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’

নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।

নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।

নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’

নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’

এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।

নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’

হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা  মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’

মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’

‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’

‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’

নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।

বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’

‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’

‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’

মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!

নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’

মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’

নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’

নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।

 

 

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

একটি পুরনো গল্প

    ইউসুফ শরীফ
শেয়ার
একটি পুরনো গল্প
অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

বেশ ক’দিন ধরে এই রিনঝিন চাপা সুবাস ছড়ানো হাসির ঢেউ ঠিক এখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আছড়ে পড়ে।

সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।

হাসি মানবীয় সম্পর্কের এক আদি নির্ভরযোগ্য সেতু। এটা আদৌ যদি তত্ত্বকথা হয়, তাহলে ভাবতে পেরে ইলিয়াস মুচকি হাসল—অতৃপ্ত মানুষের তৃপ্তির হাসি।

স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।

তবে আমি কথা দিচ্ছি, দু-একটা ভালো টিউশনি আপনাকে জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!

হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।

তার হাত যদি তেমন হতো তাহলে হয়তো এই হাসির খনিকটা উপড়ে নিয়ে আসতে পারত! তবু হাসিটাকে সে ঠিক চিনে ফেলেছে—এই হাসি অদৃশ্য হাতের আঙুল হয়ে হৃদয়ের গোপন দরজায় টুকটুক করে কড়া নাড়ে।

গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!

মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।

ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।

রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!

রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।

ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?

রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।

ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?

রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!

ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!

রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!

ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।

রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।

ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—

রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।

লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।

খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।

ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।

তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?

রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।

ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?

রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—

ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?

রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!

ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?

রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!

ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।

অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?

ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।

রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!

রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?

রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?

ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!

রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?

ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...

রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!

ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!

রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।

ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না! 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

ঈদে অভিজাত সাজ

    ঈদে গরম থাকবে, তাই স্টাইলের সঙ্গে সাজে আরামের দিকটাও খেয়াল রাখুন। ঈদের সাজ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন রেড বিউটি স্যালনের রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। লিখেছেন মোনালিসা মেহরিন
শেয়ার
ঈদে অভিজাত সাজ

ঈদের দিনের অনুভূতিই অন্য রকম। এদিন সাজে সুন্দর ও সাবলীল থাকা চাই। ঈদ সকালটা শুরু হয় কাজের ব্যস্ততা দিয়ে। দুপুরে অতিথি আপ্যায়নে সময় কাটে।

বিকেল আর রাতে নিজের জন্য একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি, আড্ডা কিংবা দাওয়াতে যাওয়া হয়। এ জন্য তিন বেলায় চাই তিন রকম সাজ।

সকালে হালকা সাজ

সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।

সকালে যেহেতু কাজের ব্যস্ততা থাকে তাই সাজ-পোশাক আরামদায়ক হওয়া চাই। শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী শোভন সাহা বললেন, ‘ঈদের দিন ব্যস্ততায় তিনবার লুক বদলানো বেশ ঝামেলার কাজ। সকালের সাজ দিয়েই দুপুর ও রাতের সাজটা সেরে ফেলতে পারেন। সকালে হালকা ফাউন্ডেশন দিন।
ঠোঁটে এ সময় ন্যুড রঙের লিপস্টিক দিতে পারেন। চোখ সাজাতে হালকা আইশ্যাডো দিলে সুন্দর লাগবে।’

সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।

কম বয়সীরা কপালের দুই পাশে একটু স্টাইলিশ বেণি করে নিলে সুন্দর দেখাবে।

 

ঈদে অভিজাত সাজ

দুপুরে চাই আরাম

গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’

 

ঈদে অভিজাত সাজ

রাতে জমকালো

রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’

যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
ফ্যাশন

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

    ঈদের দিন পাঞ্জাবি না পরলে ছেলেদের ফ্যাশন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। প্রতিবছর নতুন নকশা, থিম ও প্যাটার্নের পাঞ্জাবি নিয়ে আসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে এবারকার ঈদের পাঞ্জাবির খোঁজ জানাচ্ছেন আতিফ আতাউর
শেয়ার
ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।

লাল, নীল, সাদা, কালো, খয়েরিসহ বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে পাঞ্জাবিতে। গলা ও হাতায় রয়েছে আলাদা নকশা ও কাজ। ঐতিহ্যবাহী কাঁথা স্টিচ, মোগল শৈলী, উইভিং মোটিফের অনুপ্রেরণা ছাড়াও গুজরাটি, ইক্কত, কলকা আর্ট, জামদানি, ফ্লোরাল, ট্র্যাডিশনাল, টার্কিশ আর্ট ও ইসলামিক মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে আরামদায়ক কাপড়ের ব্যবহার।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘পাঞ্জাবির গলা, বুক ও হাতার পাশাপাশি কাঁধেও নতুন নকশা করা হয়েছে। কটন, ডিজাইন কটন, হ্যান্ডলুম কটন, লিনেন, জর্জেট, সিল্ক, হাফসিল্ক, টিস্যু ও সাটিনের মতো আরামদায়ক কাপড় বেছে নেওয়া হয়েছে। যেন গরমে স্বস্তি পাওয়া যায়। হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ও ব্লক প্রিন্ট, কারচুপি ও টাইডাইয়ের সাহায্যে পাঞ্জাবির নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।

একই সঙ্গে মোটিফেও থাকছে ইসলামিক, ফ্লোরাল, ফুল, লতাপাতা ও মোগল কারুকার্য।’

 

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

প্রিন্টে পরিপাটি

প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।

 

কাটছাঁটে নতুন কী

গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’

একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।

 

কখন কেমন পাঞ্জাবি

ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।

 

কোথায় পাবেন, কেমন দাম

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ