আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। সেই সুবাদে আমার বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকার সুযোগ হয়েছে। আমি মেট্রিক পাস করেছি সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় থেকে। তখন আমরা মগবাজারে থাকতাম।
আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। সেই সুবাদে আমার বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকার সুযোগ হয়েছে। আমি মেট্রিক পাস করেছি সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় থেকে। তখন আমরা মগবাজারে থাকতাম।
সফিউদ্দীন আহমেদ
আমার স্পষ্ট মনে আছে, গিয়াস স্যার (কাজী গিয়াস) ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। আমাদের রুমটার দায়িত্বে স্যার ছিলেন। স্যার কয়েকবার এসে আমার ড্রয়িং করাটা দেখেছিলেন। আমি ভয়ে ভয়ে স্যারকে দেখিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছে, স্যারের এক্সপ্রেশনটা ভালো ছিল। চারুকলায় ভর্তিতে মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চেয়ে প্রতিযোগিতা কম নয়। সেই সময় সারা বাংলাদেশে একটাই চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় ছিল। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগ খোলা হয়েছে। কিন্তু সবারই নজর ছিল ঢাকা চারুকলার দিকে। তখন ৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হতো। এই ৪০ জনকে একটা গ্র্যান্ট দেওয়া হতো, মাসে ৪০ টাকা করে। সেটা আমরা পাঁচ-ছয় মাস পর পেতাম। এটা পেত বলে চারুকলার শিক্ষার্থীরা ম্যাটেরিয়াল কেনার সুযোগ পেত। আমাদের প্রথম ক্লাসের দিন চারুকলা ও শিল্পকলার সম্ভাবনার পথে উৎসাহ দেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। সেদিনই তাঁকে আমার ভালো করে দেখার সুযোগ হয়েছিল। কারণ এর কিছুদিন পরই স্যার অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমাদের ৪০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১০ থেকে ১১ জন মেয়ে ছিলাম। তাদের মধ্যে একজন ভাস্কর আইভি জামান। হামিদুজ্জামান খানের সহধর্মিণী। এখনো নিয়মিত কাজ করে চলেছেন।
মোহাম্মদ কিবরিয়া
এখনো চারুকলা একটা পরিবারের মতো। একটা পরিবারের মতো না হলে এখানে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং শিক্ষা দেওয়া দুটিই কঠিন। এখানে শিক্ষকদের অনেক কাছে যেতে হয়। এটা গুরু-শিষ্য পরম্পরা শিক্ষা। এটা ওপরে ওপরে শিক্ষা নয়। শিক্ষকরা আমাদের অনেক কিছু জানতেন। জানার চেষ্টা করতেন, মন খারাপ কি না, কাজ করছি না, আজকে কি মুড নাই। শিক্ষার্থীরাও অনেক কিছু শেয়ার করত, পারিবারিক-নিজের সমস্যা, ম্যাটেরিয়াল কিনতে পারছে না। সে কারণে চারুকলায় একটা পারিবারিক আন্তরিক পরিবেশ আছে। তা ছাড়া এ ধরনের শিক্ষা সম্ভব নয়। এটা অনেকে বুঝতে পারে না। চারুকলার পুরো কম্পাউন্ড, বাগান, বিল্ডিংয়ের কোণসহ সবকিছু মিলে একটা ক্লাসরুম। ছাত্র-ছাত্রীরা সব জায়গায় বসে স্টাডি করে। একটা ছোট পাতা, একটা পিপড়া, একটা প্রজাপতি, একটা পাখি—যেকোনো কিছু। ছোট ছোট পাথর বা ইট ভাঙা, সেটাও আমাদের নজরে আসে। আমি ছাত্র-ছাত্রীদের বলি, পর্যবেক্ষণশক্তি বাড়াতে হবে। শিল্পী হতে হলে তীক্ষ একটা পর্যবেক্ষণশক্তি থাকা দরকার। যাদের থাকে, তারা ভাগ্যবান। আমি একটু আনমনা, অনেক কিছু দেখি না। আবার কিছু জিনিস আছে, খুব সূক্ষ্মভাবে দেখি। চারুকলায় পারিবারিক একটা পরিবেশ। সবাই এখানে একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে। এটা আমাদের সময়ও ছিল, এখনো আছে। এখন একটু দর্শনীয় ব্যাপার হয়েছে। বাইরে থেকে অনেক মানুষ ভেতরে আসে, ঘুরে বেড়ায়। তাদের কারণে অনেক সময় কাজের বিঘ্নও ঘটে। কেউ চাইবে না তার অন্দরমহলে এসে কেউ বিরক্ত করুক। একজন হয়তো চারুকলার কোনায় বসে একটা পাতার শিরা-উপশিরা স্টাডি করছে। হঠাৎ দেখল পেছনে অনেকগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, কমেন্ট করছে। আর এই যে স্যোশাল মিডিয়া, ছবি তুলে, ভিডিও করে ছেড়ে দিচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক সময় আমাদের কাছে কমপ্লেইন করে, কান্না করে। বলে, ম্যাডাম, আমি কাজ করছিলাম, আমার স্কেচ খাতা নিয়ে ছবি তুলেছে। তার পরও চারুকলায় এখনো পারিবারিক পরিবেশ আছে। আগে আরো বেশি ছিল। সবাই সবার খোঁজখবর রাখত। আমার মনে আছে, এস এম সুলতান আসতেন। আমাদের ওখানে এল শেপের একটা আর্কিটেকচারাল প্যাটার্ন আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম, সামনের দিক থেকে তিনি হেঁটে হেঁটে চারুকলায় ঢুকছেন। তাঁর কোঁকড়া লম্বা চুল। আমি ক্লাসরুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। এখনো ভাবলে শিহরণ জাগে, ও রকম একজন প্রবাদপ্রতিম শিল্পীকে আমি দেখেছি। এই যে অনেককে দেখতে পাওয়া, অনেকের সঙ্গে মিশতে পারা—এটা আন্তরিক পরিবেশের কারণেই হয়েছে।
ম্যাডোনা। শিল্পী : রোকেয়া সুলতানা
আমার পরম সৌভাগ্য যে আমি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ দুজন ছাপচিত্রশিল্পীকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। তাঁরা শিল্পী হিসেবেও অগ্রগণ্য। একজন হচ্ছেন সফিউদ্দীন আহমেদ, তিনি বাংলাদেশে ছাপচিত্রের জনক। কলকাতা আর্ট কলেজে পড়েছিলেন। দেশ বিভাগের আগেই ভারববর্ষে অনেক গোল্ড মেডেল পেয়েছেন এবং খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। স্যার শৈল্পিক বোধের শিক্ষাটা দিয়েছেন। তিনি নিয়মানুবর্তী একজন মানুষ ছিলেন। ডিসিপ্লিন আসলে একজন শিল্পীর জন্য খুবই ইমপর্ট্যান্ট। স্যার ধরে ধরে আমাদের সে ডিসিপ্লিনটা শিখিয়েছেন, তাতে আমি দেশে, দেশের বাইরে—সব জায়গায় অনেক অ্যাডভান্টেজ পেয়েছি। সেখানে ওরা আমাকে দেখে অবাক হয়েছে প্লেট তৈরির সময় ধরে ধরে কাজ করতে দেখে। স্যার আমাদের একটা কাজ বারবার করাতেন। স্যারকে স্যাটিসফাই করা খুবই কঠিন ছিল। আমি ছিলাম ছাপচিত্র বিভাগের প্রথম শিক্ষার্থী। আমাদের ব্যাচের প্রথম পাঁচজন (একজন বাদ দিয়ে) এই বিভাগে ভর্তি হই।
এই বিভাগের আরেকজন মহান শিক্ষক আমার গুরু—মোহাম্মদ কিবরিয়া। তিনি সরাসরি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছাত্র ছিলেন। সফিউদ্দীন স্যার ও কিবরিয়া স্যারের শিক্ষা পদ্ধতি ছিল আলাদা। কিবরিয়া স্যার আরেকটা স্পিরিচুয়াল জায়গা ধরিয়ে দিতেন। ফিল করতাম, তবে পুরাটা ধরতে পারতাম কি না জানি না। স্যার খুব ভাবুক গোছের ছিলেন। অল্প কথা বলতেন। কিন্তু দুজনই খুব বিনয়ী। আমি ভাবলে এখনো মাথা নত হয়ে আসে এই দুজন মহান শিল্পী, মহান শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। তাঁদের প্রশংসা পেয়েছি। আসলে একজন শিক্ষক যে হাতে-কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন, সেটাই শেষ না। আমার কাছে তাঁদের যে জীবনযাপন, কথা, রুচিবোধ—সবই শিক্ষার অংশ। অন্যদের কি জানি না, তাঁদের জীবনযাপনের ধরন জানার কারণে আমি সেখান থেকে অনেক শিখেছি। সেটা আমার চলার পাথেয় হয়ে আছে।
কিবরিয়া স্যার সব সময় বলতেন, সত্যের পথে থাকো। স্যার মৃত্যুর কথা বলেছেন, এটা চিরসত্য। সাদা ও কালো, ভালো ও খারাপ, দিন ও রাত—এর সবটাই ছবির মধ্যে থাকতে হবে। মাত্রাবোধ থাকতেই হবে। আমি সলিড বিষয়গুলো বলছি। কোথায় থামতে হবে, কখন থামতে হবে, অনেকেরই এই বুদ্ধিটা থাকে না। এটা কিন্তু একজন শিল্পীর জন্য বিশাল ব্যাপার। এটা কিছুটা জন্মগত থাকে, কিছুটা দেখে দেখে অর্জন করে।
আমার এই বিভাগে ভর্তি হওয়ার আগে শহিদ কবীর স্যারের একটা ভূমিকা আছে, আমাদের পাঁচজনকে এই বিভাগে নিয়ে আসার ব্যাপারে। স্যার খুবই ছাত্র-ছাত্রীবান্ধব একজন শিক্ষক ছিলেন। খুবই ইন্সপায়ার করতে পারতেন। দেখা গেছে, সারাক্ষণই স্যার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন, গল্প করছেন। বলতেন, চলো এইটা করি, এই রকম করে ছবি আঁকি। ওর ছবিটা ভালো হয়েছে। আমাদের সঙ্গে খুবই বন্ধুবৎসল একটা সময় কাটিয়েছেন। কিবরিয়া স্যার যখন বারান্দা দিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে আসতেন, আমরা দূর থেকে শ্রদ্ধাভরে ভয়ে ভয়ে দেখতাম। এখন শিক্ষার্থীদের সে রকম হয় কি না জানি না। একদিন শহিদ কবীর স্যার আমার একটা স্কেচ দেখে বললেন, তোমার এই কাজটা ভালো হয়েছে, এটা নিয়ে তুমি কিবরিয়া স্যারকে দেখাবে। পরের দিন এই সময় তোমাকে স্যারের কাছে নিয়ে যাব। সেদিন বারোটা-একটার দিকে গেলাম। গিয়ে দেখি, প্রিন্ট ডিপার্টমেন্টের সামনে রেলিংয়ের ওখানে কিবরিয়া স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। আমি গুটি গুটি পায়ে স্কেচটা নিয়ে স্যারের সামনে দাঁড়ালাম।
আমার সিনিয়র ছিলেন জাকিয়া আপা। কিছুদিন আগে এসেছিলেন বাংলাদেশে একটা শো করার জন্য। জাকিয়া আপা অনেক উৎসাহ দিতেন। ডলি আপার কথা আগেই বলেছি। আমার অ্যাডমিশন টেস্টে হেল্প করেছিলেন। কুহু আপা ছিলেন। দীপা হক ছিলেন। দীপা হক কিছুদিন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তারপর আবার এসে শুরু করলেন। ফরিদা জামান, নাইমা হক, সাধনা ইসলাম, শামীম সিকদার—উনাদের আমি স্টুডেন্ট হিসেবে পাইনি। ফরিদা আপা, নাইমা আপা তখন পাস করে গেছেন। উনাদের পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চারুকলায় আসতেন। কেউ কেউ আবার হোস্টেলে থাকতেন। শামীম সিকদারকে দুই বছর পেয়েছিলাম। কারণ তিনি ফাইনাল ইয়ারে ছিলেন। আমাদের সময় দুজন শামীম ছিলেন। আরেকজনকে বলতাম ছোট শামীম। তন্দ্রা আপা ছিলেন। মাহমুদা আপা, প্রমীলা আপা ছিলেন। আরেকজন ছিলেন কৃষ্ণা। তিনি ছিলেন চাকমা এবং খুব দুরন্ত ছিলেন। পড়াশোনা চলাকালেই উনার প্রয়াণ ঘটে। এই ব্যাচটা আমার এক বছরের সিনিয়র ছিল। আমরা উনাদের সঙ্গে আউটডোরে যেতাম। আউটডোর স্টাডিতে যেতে হতো শহরের বাইরে। শহরের বাইরে বলতে সদরঘাটে নৌকা পার হয়ে ওপারে। সেখানে সঙ্গে আমাদের সিনিয়র আপারা যেতেন। মাহমুদা আপা, নাসরীন আপা। মাহমুদা আপা বিসিকে গিয়ে ভালো কাজ করেছেন। আমি এখানে নাসরীন আপার কথা বলতে চাই। তিনি ওরিয়েন্টাল ডিপার্টমেন্টে ছিলেন। অসাধারণ কাজ করতেন। আমি টেম্পরা মাধ্যমে কাজ করি। সেখানে ওরিয়েন্টাল কাজের একটা প্রভাব আছে। মনে আছে, আমি উনাদের ক্লাসে গিয়ে দেখতাম। কী করে ওয়াশটা ধরে ধরে নামিয়ে নিয়ে চলে আসে। তারপর ড্রয়িং দিয়ে বের করে। আমার খুব ভালো লাগত। নাসরীন আপা স্টুডেন্ট লাইফে ভালো কাজ করতেন, এখনো ভালো কাজ করেন। নাইমা আপার ওয়াটার কালার দেখে খুব ভালো লাগত। একবার মনে আছে, নাইমা আপা তাঁর কতগুলো ওয়াটার কালার দিয়েছিলেন। মোরগ-মুরগির কতগুলো ওয়াশ। দীপা আপার কিছু কাজ আমাদের ক্লাসরুমে লাগানো ছিল। সেগুলো পেনসিল স্কেচ। সেগুলো ছিল স্টাডি। স্টাডি হলেও সেগুলো থেকে অনেক শেখার ছিল। দীপা আপার অসাধারণ কবুতর স্টাডি। আমাদের অনেক এনিম্যাল স্টাডি করানো হতো। বার্ড স্টাডি করা হতো। একটা কবুতরের কাজ ছিল পেনসিলে করা। অসাধারণ একটা কাজ। তখন চারুকলার ভেতরে ছোট্ট একটা চিড়িয়াখানা ছিল। তখন অনেক এনিম্যাল ছিল না। হরিণ ছিল। আমরা আসলে যেতাম পাবলিক লাইব্রেরি। যেটা ভেঙে আবার নতুন করছে। মিউজিয়ামটা ওখানে ছিল না আমাদের সময়। এই জায়গাটা একটা গ্রামের মতো ছিল। গরু ছিল, কতগুলো খড়ের গাদা ছিল। কৃষক টাইপের কিছু মানুষ ছিল সেখানে। একটা মন্দির ছিল, আর একটা বড় শিমুলগাছ। মন্দিরটা ছিল মিউজিয়াম-কাটাবনের দিকটায়। মাঝে মাঝে আমরা ওটার ওপর উঠে বসে এলাকাটা স্কেচ করতাম। পাবলিক লাইব্রেরির ওখানটায় গরু পালত, সেখানে আমরা অনেক সময় গরুর স্টাডি করতাম।
আমি ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম। শিক্ষক হিসেবে আলাদা হওয়া, সেই শিক্ষক আমি কখনো হইনি। আমার শিক্ষকরাও না। আমি সফিউদ্দীন স্যার, কিবরিয়া স্যারের কাছ থেকে শিখেছি। উনারা জীবনের সঙ্গে আমাদের জড়িয়ে নিয়েছিলেন। উনারা কী গান ভালোবাসেন, সেটা নিয়ে আলোচনা করতেন। এটা ছাড়া চারুকলা শিক্ষা পরিপূর্ণতা লাভ করে না। কার গান শুনতে হবে, কেমন গান শুনতে হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা করতেন। সফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া—দুজনই গান ভালোবাসতেন। ক্লাসিক্যাল থেকে শুরু করে সব গানেরই খোঁজ রাখতেন। তখন এমটিভিটা শুরু হয়েছে। মাইকেল জ্যাকসন। পৃথিবীর সব সংগীতের সঙ্গে উনাদের পরিচয় ছিল। কারণ একজন শিল্পীকে বর্তমান সময়কেও জানতে হবে। আমি যখন একজন স্টুডেন্টকে একটা লাইন, একটা ফর্ম সম্পর্কে বলব, একটা ফুল, একটা বোতলের ড্রয়িং বা কিছু বলব, তখন সেই বোধের জায়গায় বর্তমান সময়টাও কিন্তু আসবে তার কাজের মধ্যে। সে জন্য আমাদের এই শিক্ষায় অনেকগুলো মাত্রা, অনেকগুলো লেয়ার থাকতে হয়। একটু আর্কিটেকচারাল জ্ঞান থাকতে হবে, অ্যানথ্রোপলজি জ্ঞান থাকতে হবে, হিস্ট্রি জানতে হবে। আমি মনে করি, রূপকথার ড্রিমি ইমাজিনারি একটা ওয়ার্ল্ডে বাস করা দরকার। এগুলো আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে বের করে আনার চেষ্টা করি।
আমি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে শিল্পকলাচর্চায় নিয়মিত আছি। আমার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর একুশে পদক পেলাম। আমি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশ সরকারকে, যারা আমাকে একুশে পদকে সম্মানিত করেছে। ধন্যবাদ জানাই সেই শ্রদ্ধাভাজনদের, যাঁরা আমাকে মনোনীত করেছেন। এই প্রাপ্তির মুহূর্তে আমি আমার মা মোহসেনা খাতুন ও বাবা চৌধুরী আবদুল গাফফারকে গভীরভাবে স্মরণ করছি। শিল্পের প্রতি আমার যে নিবিড় টান, তার বীজ তাঁরাই বুনেছিলেন। সব প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা আমাকে এই পথচলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আমার স্বামী ও কন্যাকে ধন্যবাদ জানাই, যাঁরা আমার পাশে থেকেছেন, আমাকে সামাজিক শক্তি জুগিয়েছেন। বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই ঢাকা চারুকলা ও শান্তিনিকেতনের আমার মহান শিক্ষকদের প্রতি। আমার হৃদয়ে এক বিশেষ জায়গা জুড়ে আছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সরাসরি ছাত্র মোহাম্মদ কিবরিয়া স্যার, যিনি শুধু শিক্ষকই নন, ছিলেন পিতৃসম। তিনি একসময় এই একই পদকে ভূষিত হয়েছিলেন।
শিল্পকলা আমার কাছে একটি অনুপ্রেরণা, একটি আয়না, একটি সেতু। এই আয়নায় আমি দেখি বাংলাদেশকে, এ দেশের মানুষ, এ দেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ, ভাষা-সংস্কৃতি ও বিচিত্র প্রকৃতি। এই আয়নায় দেখি আমার পূর্বসূরি বেগম রোকেয়া, বেগম শামসুন্নাহার, সুফিয়া কামালের মতো শক্তিমান নারীদের। আমি দেখি পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের। বাংলাদেশে নারীরা অনেক দূর এসেছে, কিন্তু সামনে যেতে হবে আরো বহুদূর।
শ্রুতলিখন : মোহাম্মদ আসাদ
সম্পর্কিত খবর
বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’
কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।
মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।
‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’
প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।
‘দেখান তো ভাই।’
র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।
লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।
‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’
নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।
মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!
লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’
লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!
তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?
পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।
‘কী করছ, বাবা?’
‘এইতো—দোকানে বসছি।’
‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’
‘কেন?’
‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’
‘খুব দরকার?’
‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’
‘দেখি।’
‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’
লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।
মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’
বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।
এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।
দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।
মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।
এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।
‘তুমি!’
যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।
মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’
‘আসো।’
দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’
নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’
‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’
‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’
‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’
‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’
নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।
মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’
নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’
মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’
নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’
‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’
নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’
এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’
নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।
নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।
নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’
নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’
এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।
নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’
হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’
মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’
‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’
‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’
নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।
বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’
‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’
‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’
মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!
নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’
মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’
নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’
নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।
পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।
ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।
সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।
স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।
মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!
হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।
গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!
মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।
ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।
রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!
রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।
ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?
রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।
ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?
রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!
ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!
রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!
ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।
রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।
ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—
রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।
লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।
খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।
ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।
তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?
রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।
ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?
রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—
ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?
রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!
ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?
রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!
ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।
অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?
ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।
রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!
রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?
রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?
ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!
রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?
ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...
রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!
ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!
রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।
ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না!
সকালে হালকা সাজ
সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।
সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।
দুপুরে চাই আরাম
গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’
রাতে জমকালো
রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’
যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।
পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।
বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।
প্রিন্টে পরিপাটি
প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।
কাটছাঁটে নতুন কী
গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’
একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।
কখন কেমন পাঞ্জাবি
ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।
কোথায় পাবেন, কেমন দাম
বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।