অথবা দুটি গণমাধ্যমের (টেলিভিশন ও পত্রিকা) সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একীভূত করে আরো শক্তিশালী ও বড় আকারে একটি গণমাধ্যম (টেলিভিশন অথবা পত্রিকা) পরিচালনা করতে পারে।
কমিশনের সুপারিশে আরো বলা হয়েছে—একক মালিকানায় একই ভাষায় একাধিক দৈনিক পত্রিকা বা একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করে। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমের যে প্রভাবক ক্ষমতা, তা নিজ স্বার্থে কেন্দ্রীভূত করে। সে কারণে এই ব্যবস্থার অবসান হওয়া দরকার। বিদ্যমান এই ব্যবস্থার দ্রুত সমাধান করতে হবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, একই সাবান একাধিক মোড়কে বাজারজাত করা যেমন বাজারের প্রতিযোগিতাকে নষ্ট করে, একই মালিকানায়, একই ভাষায় একাধিক দৈনিক পত্রিকাও গণমাধ্যমের প্রতিযোগিতা নষ্ট করে এবং পাঠক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ জন্য ‘এক উদ্যোক্তার একটি গণমাধ্যম’ (ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া) নীতি কার্যকর করাই গণমাধ্যমের কেন্দ্রীকরণ প্রতিরোধের সেরা উপায় বলে মনে করে কমিশন।
গণমাধ্যম কমিশনের প্রতিবেদনে সুপারিশ করা এই বিষয়গুলো পড়ার পর মনে খটকা লাগে। বুঝতে মোটেও কষ্ট হয় না, প্রতিবেদনটি অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। মুহূর্তে ‘এক গামলা দুধের মধ্যে এক ফোঁটা গোমূত্র পড়ার’ চিত্রকল্প ভেসে ওঠে চোখের সামনে। বুঝতে বাকি থাকে না প্রতিবেদনটি পক্ষপাতদুষ্ট। দেশ ও জনগণ, গণমাধ্যম বা গণমাধ্যমকর্মীদের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা নয়, বরং এই প্রতিবেদনে গতানুগতিক অপরাজনীতি ও গোষ্ঠীস্বার্থ কাজ করেছে; যে ‘গোষ্ঠীস্বার্থ’ নিতান্তই ‘ব্যাবসায়িক বিদ্বেষতাড়িত’। বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসা থেকেই কমিশন এই ‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়ার’ সুপারিশ করেছে এবং এর জন্য ‘ক্রস-ওনারশিপ’-এর প্রসঙ্গ টেনেছে।
বিদ্বেষ দিয়ে কখনো সর্বজনীন ভালো কিছু হয় না। ফলে কমিশনের এই প্রতিবেদন গণমাধ্যমকে ইতিবাচক নতুন কিছু দেওয়ার পরিবর্তে বরং আরো অস্থির ও অস্থিতিশীল করে তুলবে। অসংখ্য ক্ষত বয়ে চলা নাজুক গণমাধ্যমকর্মীদের জীবনে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ বা ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ দেওয়ার প্রেসক্রিপশন দিয়েছে গণমাধ্যম কমিশন।
কোন প্রতিষ্ঠান কয়টি পত্রিকা বা টেলিভিশন চালু করতে পারবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করার কোনো বৈধ যুক্তি নেই। বৈধ অর্থে গণমাধ্যম কেন চালু করা যাবে না? কোনো একটি শিল্পগোষ্ঠীকে মাথায় রেখে এই সুপারিশমালা সামনে আনা হলে মূল উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক।
কারণ এর বিপরীত চিত্রটাই বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান। চোখের সামনে এর অনেক উদাহরণও রয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকা গ্রুপের কথাই ধরুন। তাদের অনেক পত্রিকা রয়েছে। ভারত সরকার কি এ ব্যাপারে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে?
রয়েছেন মিডিয়া মোগল রুপার্ট মার্ডক। তাঁর কম্পানি নিউজ করপোরেশন। তিনি বিশ্বজুড়ে শত শত স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহুমুখী প্রকাশনা ও সম্প্র্রচার প্রতিষ্ঠানের মালিক। এই একই প্রতিষ্ঠানের অধীনে যুক্তরাজ্যে রয়েছে দ্য সান ও দ্য টাইমস, অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, হেরাল্ড সান ও দ্য অস্ট্রেলিয়ান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও নিউইয়র্ক পোস্ট। এ ছাড়াও তিনি টেলিভিশন চ্যানেল স্কাই নিউজ অস্ট্রেলিয়া ও ফক্স নিউজ (ফক্স করপোরেশনের মাধ্যমে), টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরিস ফক্স এবং নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের (বর্তমানে বিলুপ্ত) মালিকও ছিলেন।
আছেন জন কার্ল মেলোন। এই আমেরিকান মিডিয়া মোগল লিবার্টি মিডিয়ার চেয়ারম্যান। তিনি ‘কেবল কাউবয়’ নামেও পরিচিত। তিনি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া, টেলিযোগাযোগ ও বিনোদন প্রতিষ্ঠানের মালিক।
জন কার্ল মেলোন ১৯৯২ সালে ‘ফাইভ হান্ড্রেড চ্যানেল ইউনিভার্স’ ধারণাটি ব্যবহার করেন ভবিষ্যতের মিডিয়ার পরিবেশ-পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য, যেখানে বিপুলসংখ্যক টিভি চ্যানেলের প্রয়োজনীয়তাকে ইঙ্গিত করেন। তাঁর ডিসকভারি কমিউনিকেশনস, যা এখন ডিসকভারি ইনকরপোরেটেড—এই এক প্রতিষ্ঠানের অধীনে রয়েছে ডিসকভারি চ্যানেল, টিএলসি (দ্য লার্নিং চ্যানেল), এনিম্যাল প্লানেট, এইচজিটিভি (হোম অ্যান্ড গার্ডেন টেলিভিশন), ফুড নেটওয়ার্ক, ওডব্লিউএন (অপরাহ উইনফ্রে নেটওয়ার্ক), ইউরোস্পোর্ট (ইউরোপীয় স্পোর্টস চ্যানেল নেটওয়ার্ক), কিউভিসি (গুণ-মান, মূল্য, সুবিধা, যা একটি হোম শপিং নেটওয়ার্ক, যা সৌন্দর্য, ইলেকট্রনিকস, ফ্যাশন এবং আরো অনেক কিছু বিপণন ও পণ্য সরবরাহ করে লাইভ শো সম্প্রচার করে। কিউভিসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ একাধিক অঞ্চলে কাজ করে)।
লিবার্টি গ্লোবালের অধীনে রয়েছে ভার্জিন মিডিয়া, যা যুক্তরাজ্যের একটি প্রধান টেলিযোগাযোগ এবং মিডিয়া কম্পানি, কেবল টেলিভিশন, ইন্টারনেট পরিষেবা এবং মোবাইল যোগাযোগ প্রদান করে। ইউনাইটেড প্যান-ইউরোপ কমিউনিকেশনস (ইউপিসি), রয়েছে টেলিনেট, যা বেলজিয়ামের একটি শীর্ষস্থানীয় টেলিযোগাযোগ প্রদানকারী, প্রাথমিকভাবে ইন্টারনেট, টেলিভিশন এবং টেলিফোন পরিষেবা প্রদানকারী।
রয়েছে লিবার্টি লাতিন আমেরিকা, সিরিয়াসএক্সএম, ফর্মুলা ওয়ান, লাইভ নেশন, জিসিআই (জেনারেল কমিউনিকেশন, ইনকরপোরেটেড) এবং লায়ন্সগেটসহ আরো অনেক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম।
শুধু রুপার্ট মার্ডক বা জন কার্ল মেলোন নন, এ রকম এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অধীনে অনেক মিডিয়া থাকা প্রতিষ্ঠানের তালিকা অনেক দীর্ঘ। এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজনের নাম আমরা উল্লেখ করেছি, যাঁদের সব প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করলে এই লেখার আকার অনেক বড় হয়ে যাবে। এ কারণে আমরা শুধু ব্যক্তি বা তাঁর মূল প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করলাম। আগ্রহী পাঠক-পাঠিকারা চাইলে হাতের মুঠোয় পৃথিবীর সুবিধা নিয়ে মুহূর্তেই সেসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন।
ধরুন, সামনার রেডস্টোন, ভায়াকমসিবিএস, যা বর্তমানে প্যারামাউন্ট গ্লোবাল; টেড টার্নার, টার্নার ব্রডকাস্টিং সিস্টেম (টিবিএস) ও সিএনএন; জেফ বেজোস অ্যামাজন, দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক; ওয়াল্ট ডিজনি, দ্য ওয়াল্ট ডিজনি কম্পানি, ডিজনি মিডিয়া নেটওয়ার্ক; ডেভিড গেফেন, গেফেন রেকর্ডস, ড্রিমওয়ার্কস এসকেজি; মাইকেল ব্লুমবার্গ, ব্লুমবার্গ এলপি, ব্লুমবার্গ নিউজের; ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন, গুগল, বর্তমানে যা অ্যালফাবেট, ইউটিউব এবং গুগল নিউজ ইত্যাদি।
প্রতিবেশী দেশে রয়েছেন সুভাষ চন্দ্র। তাঁর জি এন্টারটেইনমেন্ট এন্টারপ্রাইজেস, জিটিভি; কালানিথি মরনের সান গ্রুপ, সান টিভি নেটওয়ার্ক, রেডিও ও চলচ্চিত্র; রাঘব বাহলের নেটওয়ার্ক১৮ গ্রুপ, সিএনবিসি-টিভি১৮, সিএনএন-নিউজ১৮-এর মতো মিডিয়া আউটলেট রয়েছে। আবার বিভিন্ন ডিজিটাল ও টেলিভিশন সম্পত্তির মালিক; এম কে আলাগিরি দ্য হিন্দু গ্রুপ, ভারতের অন্যতম ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য হিন্দু এবং অন্যান্য প্রকাশনার মালিকানার সঙ্গে জড়িত। টাইমস অব ইন্ডিয়া, বেনেট, কোলম্যান অ্যান্ড কোং, আগরওয়াল পরিবারের নেতৃত্বে টাইমস গ্রুপ ভারতের বৃহত্তম মিডিয়া গ্রুপগুলোর মধ্যে একটি, যারা টাইমস অব ইন্ডিয়ার মতো প্রধান সংবাদপত্র প্রকাশ করে এবং জুমের মতো টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মালিক। রজত শর্মা ইন্ডিয়া টিভি, হিন্দি ভাষার সংবাদ চ্যানেল ইন্ডিয়া টিভির প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতের মিডিয়াশিল্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। এন আর নারায়ণ মূর্তি, ইনফোসিস, যদিও প্রাথমিকভাবে একজন প্রযুক্তিসম্রাট; মূর্তির বিনিয়োগ মিডিয়া ও বিনোদনেও বিস্তৃত। বিজয় মালিয়া, কিংফিশার, ইউবি গ্রুপ এবং মিডিয়া ভেঞ্চারস। কিংফিশার এয়ারলাইনসের জন্য পরিচিত; মালিয়ার কিংফিশার টিভি এবং অন্যান্য বিনোদন উদ্যোগসহ মিডিয়া কম্পানিগুলোতেও অংশীদারি ছিল। শিব নাদার এইচসিএল এবং মিডিয়া ইনভেস্টমেন্টস, এইচসিএলের প্রতিষ্ঠাতা। নীতা আম্বানি রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, নেটওয়ার্ক১৮, টিভি১৮, জিও প্ল্যাটফর্মের মালিক।
ডিজিটাল যুগে গণমাধ্যম এমনিতেই কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী ছাপা পত্রিকা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে। অনেক স্বনামখ্যাত বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনোটি বন্ধ হওয়ার পথে, কোনোটি রূপান্তরের মাধ্যমে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।
তাই ‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া’ চিন্তার পেছনে জনহিতকর, গঠনমূলক বা ইতিবাচক কিছু নয়, বরং রয়েছে প্রতিহিংসাপরায়ণ চিন্তা ও কূটকৌশল। এতে লাথি মারা হবে অসংখ্য মিডিয়াকর্মীর পেটে। তাতে বেকারত্বের সংখ্যা আরো বাড়বে, নানামুখী অসন্তোষ, সীমাহীন হতাশা আরো ভারী হবে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক