<p>বিপুল অঙ্কের ঋণের চাপে পড়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। সরকারি ঋণ এরই মধ্যে রেকর্ড ৩৪ ট্রিলিয়ন ডলার (৩৪ লাখ কোটি ডলার) ছাড়িয়েছে। এই ঋণ প্রতি ১০০ দিনে এক ট্রিলিয়ন ডলার করে বাড়ছে, যা শুধু তাদের জন্য নয়, বিশ্ব অর্থনীতির জন্যও মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে।</p> <p>বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৩ সালে দেশটির জাতীয় ঋণসীমা বৃদ্ধি নিয়ে রীতিমতো অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সেখান থেকে তারা আপাতত মুক্তি পেলেও বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির ঋণ করা ও তার পরিণাম কী, সেটা নিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ ও ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণ বিশ্বজুড়ে ঋণ নেওয়ার খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে, একই সঙ্গে বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন করছে।</p> <p>মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঋণ ব্যাপক হারে বাড়ছে। প্রায় প্রতি ১০০ দিনে এই ঋণ প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার করে বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ঋণ ৩৪ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঋণ ছিল ৩৩ ট্রিলিয়ন ডলার, একই বছরের ১৫ জুন ছিল ৩২ ট্রিলিয়ন ডলার, তার আট মাস আগে ছিল ৩১ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এ বছর দেখা গেছে, ১০০ দিনেই ঋণ এক ট্রিলিয়ন বা এক লাখ কোটি ডলার করে বাড়ছে। বর্তমানে এই ঋণ ৩৪.৪ ট্রিলিয়ন ডলারে উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার তার খরচ বহনের জন্য যে অর্থ ধার করে।</p> <p>ব্যাংক অব আমেরিকার বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ মিখায়েল হার্টনেট মনে করেন ১০০ দিনের এই রীতিতেই ঋণ ৩৫ ট্রিলিয়ন ডলার হবে। ঋণমান সংস্থা মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচকে নিয়েছে। সংস্থাটির মতে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব সক্ষমতায় ঝুঁকি বাড়ছে। এই অবস্থায় সরকারি ব্যয় কমানোর পরামর্শ দিয়ে মুডিস বলেছে, তা না হলে রাজস্ব ঘাটতি ব্যাপকভাবে বাড়বে। এতে দেশটির ঋণ সামর্থ্য উল্লেখযোগ্য হারে দুর্বল হবে।</p> <p>দেশটিতে এত ঋণের বোঝা বাড়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, কভিড-১৯ মহামারিতে সরকারি ঋণের পরিমাণ ঊর্ধ্বমুখী হয়। কভিডজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতি পুনরুদ্ধারে বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা বিতরণ করে ওয়াশিংটন। ফলে ঋণের পরিমাণও বাড়তে থাকে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ ব্যয় যে হারে করছে, তাতে দেশটির ঋণ আরো বাড়বে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে বড় অঙ্কের সহায়তা দিচ্ছে তারা, যদিও ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের জের এখনো টানছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয়েছে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ। এই যুদ্ধেও বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলকে বিপুল সমরাস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।</p> <p>আইএমএফ বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ ও ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণ বিশ্বজুড়ে ঋণ নেওয়ার খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে, একই সঙ্গে বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন করছে। সংস্থাটি বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণ এবং উচ্চ সুদহার দেশটির ট্রেজারি ইল্ড (বন্ড বিনিয়োগকারীর প্রাপ্ত আয় বা সুদ) বাড়াচ্ছে। এতে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সুদহার বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ছে।</p> <p>বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে বন্ডের ইল্ড বাড়লে অন্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকারি বন্ডের ইল্ডও একইভাবে বাড়ে। এতে ওই দেশগুলোর মুদ্রাবাজার অস্থির হয়ে ওঠে। ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটে, যা সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে। আইএমএফের রাজস্ববিষয়ক বিভাগের পরিচালক ভিটর গ্যাসপার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শিথিল রাজস্বনীতি বিশ্বজুড়ে সুদহার ও ডলারের ঊর্ধ্বমুখী চাপ তৈরি করে। এতে বিশ্বের অন্যান্য দেশে তহবিল ব্যয় বেড়ে যায়। এতে বিদ্যমান ভঙ্গুরতা বা ঝুঁকিগুলো আরো বেড়ে যায়।’</p> <p>মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ দুই বছরে টানা ১৮ দফা সুদের হার বাড়িয়েছে। এর ফলে ২০২৩ সালে দেশটিতে মন্দার আশঙ্কা করা হলেও কোনোভাবে দেশটি উতরে যায়। তবে ব্যাংক খাতের সংকট এড়াতে পারেনি। আইএমএফ বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ সুদহারের ফলে পারিবারিক খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণের খরচ বেড়ে যায়। এতে অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে। এতে ব্যাংক এবং অন্যান্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা প্রকারান্তরে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে দেয়। আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়েরে-ওলিভার গৌরিনকাস বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন সরকারি ঋণের ঝুঁকির প্রিমিয়াম বেড়েছে এবং এ ঝুঁকি উচ্চমাত্রায় থাকবে, কারণ ঋণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল ব্যয় ও ঋণের কারণে দেশটির অর্থনীতি যে বিপর্যয়ের মুখে, এমন শঙ্কার কথা জানিয়ে ২০২৩ সালে ফক্সনিউজ ডিজিটালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশটির অর্থনীতিবিদ হেরি ডেন্ট বলেছিলেন, ‘২০০৯ সাল থেকেই অর্থনীতি শতভাগ কৃত্রিমভাবে চলছে। নজিরবিহীন অর্থ প্রিন্ট করা হয়েছে এবং ঘাটতি ১৫ বছরে ২৭ ট্রিলিয়ন ডলারে উঠেছে। ফলে আমরা একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আছি। ২০২৪ সালেই অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে।’ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে যেকোনো বিপর্যয়ে তার পুরো প্রভাব পড়বে মুদ্রা ডলারে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।</p> <p>সূত্র : সিএনএন বিজনেস, সিএনবিসি</p> <p>রয়টার্স, ফক্স নিউজ</p> <p> </p> <p> </p>