এগন খালি রক্ত শুগায়। কগন ঝড় উডে, কগন শীল হয়। আকাশে কালো মেঘ দেগলেই বুক ধক কইর্যা উডে।
— দাদা, তুমি মনটাই খারাপ করে দিলে। তবে চলো, মেলায় গেলে মন ভালো হবেনি। পান্তা ইলিশ খাওয়াবনি।
— ঐ পন্দা হামি দৈনিক খাই। আর ইলিশ মারওজেন, না? ইলিশ হামি খাই না।
— খাও না, নাকি পাও না?
— আবার কিন্তুক হামাক রাগ ধরাওজু মামুন। তুর মাস্টারির ট্যাকার গরম দ্যাগাওজু, তাই লয়?
— তুমিও কিন্তুক খোঁচা দিলে, দাদা। প্রাইমারির মাস্টারের আবার ইলিশ! শোনো, গেল চার বছর আমি কোনো ইলিশ কিনিনি। কয়েকবার কিনতে গিয়ে দামদর করে ফিরে এসেছি।
— বলিস কিরে। তুদের ইলিশ খাবার জন্য টাকা তো দেয় সরকার?
— তা তো দেয়। শুনো দাদা, দশ হাত শরীরের নয় হাত কাপড়ে খানতি থাকেই। সে জরি বসানো কাপড় হোক আর মণিমুক্তা বসানোই হোক। এক দিকে টানলে আরেক দিক খাটো পড়ে।
— তুর ছেলেমেয়ে বায়না ধরে না?
— ধরে তো। তবে তারা ছোট। সিলভরকার্প আর ইলিশের পার্থক্য এখনো বুঝতে শিখেনি।
— শিগেনি, না শিগাসনি?। তুই মাস্টার হয়্যা নিষ্পাপ বাচ্চাদের সঙ্গে প্রতারণা করিজু কিন্তুক। অন্যায় করিজু ভাই।
— তা জানি দাদা। ও পাপ আল্লা মাফ করবেন। এখন অনেক কিছুই এদিক-ওদিক করতে হয় দাদা। ছেলেদের জন্যে যে দুধ নিতাম, তাও দু’বছর হলো বাদ দিয়েছি। রাখো ওসব কথা। চলো, না হয় সিলভর দিয়েই পান্তা খাওয়াবনি।
— তুই এগনো মেলা লিয়াই পড়্যা আছিস ছোঁড়া। হামার বাড়িত এগনো দৈনিক পন্দাতে বলক উডে। তুর বলক উডে না তুই যা।
— তুমি শালা এখনো বজ্জাতই থেকে গেলা। রস এখনো কমেনি। আমি তো মনে করেছিলাম তোমার এখন সবই কড়কড়া। হাজার মাখালেও খটমটে। রস আসে না।
— ওরে শালা বজ্জাত। শুনেক মামুন, কড়কড়ার মজা তুরা বুঝবু না। কড়কড়া শুকনা মরিচ দিয়া মাগালে বেশ রং ধরে। জোয়ান মরদেরও লালা ঝরে। পন্দার মজা পন্দায় আর কড়কড়ার মজা কড়কড়ায়। ও তুই বুঝবু না। কিরে ছোঁড়া, এমুন হাঁ কর্যা তাকায়া আছিত ক্যান?
— দাদা, তুমি একটা মাল গো। সাহিত্যিকের মতো কথা বলো। কত সুন্দর করে কথা বলো! মনটা তোমার রং-সাগর। মনের বয়স আঠারো। আচ্ছা দাদা, তুমি তো একসময় ভালো লেঠেল ছিলা, লাঠি খেলাতে তোমাকে নাকি হায়ার করে নিয়ে যেত দূর দূর থেকে।
— সে তো যেতই। সেই দিনগুলোন বড় রঙিন ছিল রে ভাই। মুনে হলে বুকের মদ্যে গুড়কা বাধে।
— লাঠিখেলা কি পহেলা বৈশাখেই হতো?
— নারে ভাই। এগনকার মুতন বৈশাখের উৎসব হামারে সুময় হতো না। তগন এই এলাকাতে মেলা পার্বণ বুলতে ছিল কালীপূজার মেলা, মহরমের মেলা. দুর্গাপূজার মেলা, বাসন্তী মেলা, বারনই মেলা। তগনকার দিনে হেন্দু-মসুলমান এক হয়্যা মেলায় যাতুন। জামাই-বেটি, কুটুম-সাখ্যাত বাড়ি ভর্যা উটতো।
— লাঠিখেলা কখন হতো?
— সেটা হতো মহরমের সুময়। আশুরার দিন হাজার হাজার কাসিদে ভর্যা থাকত মাঠঘাট। লাল শালুকের পোশাক পরা দলে দলে কাসিদ দেগা মুনে হতো, চারদিগে আগুন আর আগুন। সেদিন কাসিদের আইন বড় আইন। খৈলানে খৈলানে মহরমের জারি হতো। বউ-বেটিরা বুক ভাসাত জারি শুনে।
— তাহলে কি আশুরার দিনই লাঠিখেলা হতো?
— আসলে খেলা শুরু হতো মহরম মাসের প্রথম দিন থাক্যা। বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে হামরা লাঠি খেলে বেড়াতুন। আর লড়াই হতো মঞ্জিলের দিন, মানে আশুরার দিন। দশ পনেরো দলে খেলা। সোনাতন মুণ্ডলের দল, খিতাব মুণ্ডলের দল, নাদেরের দল আর এদিকে হামার দল। হামার বড় ফাইট হতো সোনাতনের দলের সঙ্গে। একবার তারা জিতলে পরেরবার হামরা। তবে মেডেল পতিবছর হামার বান্ধা। হামার লাঠির প্যাঁচ কেউ ধরতে পারতক না। আখড়াতে হামার গলা আর লাঠি সবার আগে।
— দাদা, তুমি একালের রূপাই। তুমি রূপাইকে চিনো? কী হলো, হাসছ কেন?
— তুর কি মুনে হয়? হামরা চাষাভুষারা পড়ি না। হামি বাষট্টি সালে মেট্টিক পাস। হামার বাড়িত যাস, এগনো জসীমউদ্দীনের কয়েকটা বই আজে।
— দাদা তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। তুমি নক্সী কাঁথার মাঠের রূপাইয়ের কথা জানো? তোমার আখড়া দেখতে ইচ্ছা করছে।
— ‘আখড়াতে তার বাঁশের লাঠি অনেক মানে মানী/খেলার দলে তারে নিয়েই সবার টানাটানি।’ জসীম সত্যিই গ্রামবাংলার হৃদয়ের কবি রে ভাই।
— বাহ, এখনো তোমার মনে আছে লাইনগুলো! তোমাকে আমি রূপাই বলেই ডাকব। ‘যদিও রূপা নয়কো রূপাই, রূপার চেয়ে দামী/এক কালেতে ওরই নামে সব গাঁ হবে দামী।’
— আর কাল! হামার সব কাল এগন এক কালে ঠেকিজে, ভাই। স্বপন আর দেগাস না।
— এমন ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা হঠাৎ বন্ধ হলো কেন, দাদা?
— হঠাৎ হয়নি, দাদু। দিনে দিনে হলো। হঠাৎ কিজু বুজদার মানুষ জুট্যা গেল। তারা বিরোধিতা করল লাঠিখেলার। হামারেও সেই জোশ আস্তে আস্তে হারায়া গেল।
— আচ্ছা দাদা, আবার যদি তোমার হাতে লাঠি তুলে দিই, তাহলে খেলতে পারবে?
— পারব না ক্যান? কিন্তুক হামার লাঠি ধরার মানুষ কই? তুরে মুতন দশজনকে এগনো হামি একলাই লিয়া লিমু।
— দাদা, তুমার লাঠির প্যাঁচ দেখতে খুব ইচ্ছা হয়। তুমি আবার দল গড়ো। আমি তোমার সঙ্গে আছি।
— নিবতে বসা আগুনে ফুঁ দিস না ভাই। সে আর হোবে না।
— অবশ্যই হবে, দাদা। তোমার মধ্যে সেই আগুন আছে। এই বৈশাখে হলো না, আগামী বৈশাখী মেলায় অবশ্যই তোমার লাঠিখেলা দেখব। সারা এলাকার মানুষ দেখবে। দুনিয়া দেখবে। দল গড়ো। ঢোল নতুন করে ছেয়ে নাও। ও দাদু, হঠাৎ কী হলো তোমার? আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছ কেন? তোমার চোখে আগুন।
— না দাদু, হামার লয়। তুর ভিতরে কিসের যেন আগুন দেগতে পাওজি। ঐ আগুন হামার নিবে যাওয়া সলতেতে ঘষা দেয়। তুই চল্যা যা।
— হ্যাঁ দাদু, যাব। তবে তুমি কথা দাও, খেলবে। তোমার লাঠি তো আছেই, এবার আমিও লাঠি বানাব। তোমার সঙ্গে খেলব।
— না, হামার লাঠি নাই। তুর দাদি ফেলা দিজে।
— তবে বাঁশঝাড়ে যাও। নতুন করে লাঠি কাটো। খেলা হবেই।
— না, হোবে না। তুই মেলাত যা। হামার কাম আজে। আল থাক্যা ধানগুলান সরায়্যা দিই।
— দাদু গেলাম, তবে আগামী বছর এলাকা জুড়ে মাইকিং করে লাঠিখেলা হবে। আরো দল আসবে। তোমার গলায় আবার মেডেল উঠবে।
— আচ্ছা দেগা যাবে পরে, এগন যা।
— ঠিক আছে দাদু, গেলাম। তবে খেলা হবে।
— এই মামুন, অত জুরে হাঁটিস ক্যান? খাড়া। লাঠি কিন্তুক আজক্যাই কাটমু। তেল মালিশ শুরু হোবে আজক্যা থাক্যাই। লাঠির রং ফিরাতে সুময় লাগবে।
— ঠিক আছে দাদু, আমিও কাটব লাঠি।
— খেলা না হলে কিন্তু ঐ লাঠি দিয়াই তুদের মেলা ভাঙমু। কুনো সমুন্দি বাধা দিলে মাদা ফাটামু। তুই আইসলে তুরও।
— আগে লাঠি তো কাটো। হয় খেলা হবে, না হয় ভাঙা হবে। কিছু তো হবেই।
— মুনে থাকে যেন। খেলা মানে খেলাই। ঢোল কাঁসর সবই আজে। ঢোলে নতুন চামড়া দিলেই গগন ফাটপে।
— না দাদু, গগন নয়, মানুষের মন ফাটবে।
— ফাটপে তো বটেই...