এর পর চূড়ান্ত ধাপে বিনিয়োগে আসবে। এসব প্রক্রিয়া করে সাধারণত একটি বিনিয়োগ আলোর মুখ দেখতে ১৮ থেকে ২৪ মাস লাগে। এই সময়ের আলোকে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের নিয়ে একটি সুস্পষ্ট পথনকশা তৈরি করা হবে। সম্মেলনে বিদেশিদের বিনিয়োগের যে আগ্রহ পাওয়া গেছে, একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। তাঁদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না জানতে চাওয়া হবে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগের আগ্রহকে প্রকৃত বিনিয়োগে রূপ দেওয়া যাবে।
তিনি আরো জানান, আগের বছরের সম্মেলন ও এবারের সম্মেলনের পার্থক্য হলো, এবার রেজিস্ট্রেশনের পর ফলোআপ করা হবে। বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিনিয়োগকারীদের পরবর্তী সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা বলা হবে। আগে সম্মেলনের পর এমন ফলোআপ করা হয়নি। এবার সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন কম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতিসহ তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সেই তালিকা অনুযায়ী তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে বিনিয়োগ করানো সম্ভব হবে।
বিনিয়োগকারীরা এবার বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে কোনো সমস্যার কথা বলেছেন কি না—জানতে চাইলে নাহিয়ান রহমান বলেন, এবার সে ধরনের সুযোগ ছিল না। আগে ৬০ থেকে ৬৫ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বিনিয়োগ সম্পর্কিত কাজগুলো সম্পাদন করতে তাঁদের দপ্তরে দীর্ঘ সময় ঘুরতে হতো। এখন সেসব সমস্যা নেই, দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিনিয়োগের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হবে।
নাহিয়ান রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি আমরা কী ধরনের বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছি সে জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছি সেগুলোই পুরো বিনিয়োগ সম্মেলনে বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে।’
বিনিয়োগ সম্মেলনের শেষ দিন চারটি ব্রেক আউট সেশন করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—হেলথকেয়ার, ডিজিটাল ইকোনমি, সেমিকন্ডাক্টর ও টেক্সটাইল। এসব সেশনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের তিনটি বিষয়ে বোঝাতে চেয়েছি। এসব খাতে বিনিয়োগের কী ধরনের সম্ভাবনা আছে সেটি জানানো হয়েছে। এসব খাতের দেশীয় বা স্থানীয় বিনিয়োগ ইকো সিস্টেমে যাঁরা আছেন অর্থাৎ দেশীয় বিনিয়োগকারী যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে। এসব খাতে বিনিয়োগের জন্য একটি পাইপলাইন তৈরির জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের পরিবর্তন হলেও বিনিয়োগকারীদের কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। আগের অবস্থাই বহাল থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবে—এমন সম্ভাব্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
বিডার নির্বাহী সদস্য শাহ মো. মাহবুব জানান, সেমিকন্ডাক্টর খাতে ডিজাইন বা নকশার পর্যায় থেকে টেস্টিং পর্যায়ে যেতে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় তৈরি পোশাক খাতে আন্ত সীমান্ত বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত করা ও পোর্ট সুবিধা বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া দেশে এপিআই ও নতুন ভ্যাকসিন তৈরি খাতে বিনিয়োগ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক যে জটিলতার কথা বলা হয়, এর অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াগুলো আগের তুলনায় সহজ ও কেন্দ্রীভূত হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা সম্মেলন উপলক্ষে দেশে এসে বিষয়টি নিজেরাই দেখছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোন জায়গা থেকে কত বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছি, সেটি মুখ্য না। এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের নিয়ে একটি পাইপলাইন (তালিকা) তৈরি করা, যাতে তাঁদের ট্র্যাক করে পরে এসব বিনিয়োগ নিশ্চিত করা যায়। গত বিনিয়োগ সম্মেলনেও আমরা অনেক প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলাম, যা পরে বাস্তবায়ন হয়নি। সুতরাং পাইপলাইন তৈরি করে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে।’
জানা যায়, সম্মেলনে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও তিনটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের মিথস্ক্রিয়ার জন্য পৃথক ব্যবস্থা ছিল। এতে করে বিনিয়োগকারীরা এসব সংস্থা ও দলের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের অবস্থান তাত্ক্ষণিকভাবে জানতে পেরেছেন। সম্মেলনে বিভিন্ন আয়োজনে যোগ দিয়েছেন প্রায় ৫০০ বিদেশি বিনিয়োগকারীর মধ্যে বিডার পক্ষ থেকে প্রায় ২০০ জনের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যাপারে বিডা বদ্ধপরিকর। তাই বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করার জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিডা।
বিনিয়োগ পরিকল্পনায় বহুজাতিক কম্পানিসহ বহু প্রতিষ্ঠান : বাংলাদেশে ২.২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে হাসপাতাল বানাচ্ছে মার্কিন কম্পানি বাংলা ইউএস এলএলসি। আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিকমানের এই হাসপাতালটির নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলা ইউএস এলএলসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মুমতাজুর রহমান দাউদ এই বিনিয়োগ পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ২.২ বিলিয়ন ডলারের যুগান্তকারী এই বিনিয়োগ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিকমানের হাসপাতাল, নার্সিং বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিল্প-কারখানা স্থাপন। এর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে ১.৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে একটি আধুনিক হাসপাতাল কমপ্লেক্ষ এবং বিশেষায়িত নার্সিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে জানান ড. দাউদ।
চট্টগ্রামে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে একটি সার কারখানা নির্মাণের কথাও জানান ড. দাউদ। আমেরিকান বিনিয়োগকারী গ্রুপ ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যৌথভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
মার্কিন এই বিনিয়োগকারী গ্রুপের চেয়ারম্যান মিস্টার ফ্র্যাংক জাও, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিলিয়নিয়ার উদ্যোক্তা হিসেবে সুপরিচিত। এ ছাড়া দলটিতে আছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. স্যাম বেটেটা, যিনি ফিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক গণিত বিভাগের প্রধান।
বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়ানো ও বিনিয়োগের কথা জানিয়েছে তিনটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে—স্পেনের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিটেক্স, সিমেন্ট খাতের কম্পানি লাফার্জহোলসিম ও চীনের অ্যাপারেল কম্পানি হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিজ।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনা দেখতে আগামী মাসে ২০০ বিনিয়োগকারীসহ বাংলাদেশ সফরে আসার কথা জানিয়েছেন চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী।
তিনি জানান, চীনের তৈরি পোশাক কম্পানি হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশে ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে।
এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ইনডিটেক্স ও হোলসিম গ্রুপের শীর্ষ নির্বাহীরা সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ইনডিটেক্সের কর্মকর্তারা তাঁদের জন্য বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ (পণ্য) সরবরাহকারী হিসেবে উল্লেখ করে এখান থেকে পণ্য নেওয়ার পরিমাণ আরো বাড়ানোর কথা জানান। হোলসিমের কর্মকর্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কার্বন ক্যাপচার প্রকল্প চালুর কথাও জানান।
এ ছাড়া দুবাইভিত্তিক বৈশ্বিক সরবরাহ ও বন্দর উন্নয়ন কম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড গ্রুপের চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম সম্মেলনে অংশ নিয়ে বিনিয়োগের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের সময় ডিপি ওয়ার্ল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এটি সুযোগের ভূমি। আপনারা বাংলাদেশে আসুন। আসুন, আমরা আপনাদের সহযোগিতা করে বিনিয়োগ বাস্তবায়ন করি।’
বড় আকারে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা। গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এক বৈঠকে বিনিয়োগ পরিকল্পনার ঘোষণা দেয় ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সং-এর নেতৃত্বে কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিদল।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান জানান, বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি বিনিময় ও দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারির বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
এ ছাড়া টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উন্নয়নের লক্ষ্যে বিডা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) একটি অভিপত্র সই করেছে।
সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গে ‘আর্টেমিস অ্যাকর্ডস’ চুক্তিতে সই করেছে বাংলাদেশ। এর ফলে শান্তিপূর্ণ ও অসামরিক মহাকাশ অনুসন্ধানের উদ্যোগে ৫৪তম স্বাক্ষরকারী দেশ হলো বাংলাদেশ।
নতুন উদ্যোক্তাদের ৯০০ কোটি টাকার তহবিল : বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিতে ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেছেন, বিশেষ এই তহবিলের অর্থ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা হবে এবং শুধু স্টার্টআপ কম্পানিগুলোকে মূলধন জোগান দেওয়া হবে। এ বিষয়ে শিগগিরই একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
ইয়াংওয়ান প্রধানকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব : বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের অগ্রদূত এবং ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাংকে দেশের অর্থনীতিতে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়েছে।
স্টারলিংক পরীক্ষামূলক চালু : যুক্তরাষ্ট্রের টেলিকম জায়ান্ট স্টারলিংক বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছে। এখন আবেদনের মাধ্যমে এনজিএসও (নন-জিওস্টেশনারি অরবিট) লাইসেন্স পেলেই বাংলাদেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম শুরু হবে।