<p>মুসলিম স্পেনে (৭১১-১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ, অতীত নাম আন্দালুস) একসময় ছিল বিজ্ঞান, সাহিত্য, স্থাপত্য ও ধর্মীয় সহাবস্থানের অনন্য নজির। মুসলমান শাসনের অধীনে আন্দালুস একটি সাম্যবাদী সমাজে পরিণত হয়, যেখানে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিরা একত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বসবাস করেছিল। এটি ‘Convivencia’ নামে পরিচিত, যা এই যুগে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সামাজিক সম্প্রীতির ধারণা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। <br />  <br /> আন্দালুসে ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রীতি</p> <p>১. ধর্মীয় সহাবস্থান : আন্দালুসে মুসলমান শাসকরা খ্রিস্টান ও ইহুদিদের তাদের ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা দিয়েছিল।শাসনব্যবস্থার অধীনে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে বসবাস করত।</p> <p>জিজিয়া : অমুসলিমদের জন্য জিজিয়া কর আরোপিত ছিল, কিন্তু তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রাখতে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি, যা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার বিনিময়ে নেওয়া হতো। এর মাধ্যমে তাদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়। এটি তাদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিত। গ্রানাডায় খ্রিস্টান পুনরুদ্ধারের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করত। এখানে মসজিদ, গির্জা ও সিনাগগ একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করত। (উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াট, A History of Islamic Spain.)</p> <p>২. শাসনব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি : মুসলমান শাসকরা অমুসলিমদের (খ্রিস্টান ও ইহুদি) প্রশাসন, বাণিজ্য এবং শিক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছিল। কর্ডোবার খলিফা আবদুর রহমান তৃতীয়-এর সময়ে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি পণ্ডিতরা একসঙ্গে কাজ করত। <br /> (ড্যানিয়েল জি. নেটেলিং, The Jews of Moslem Spain.) </p> <p>৩. বৈষম্যহীন বিচারব্যবস্থা : ইসলামী শরিয়া আইন অনুযায়ী, প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় আইন মেনে চলার অনুমতি ছিল।  ইহুদি সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ‘বাইবেলিকাল’ আইনের অধীনে ছিল। খ্রিস্টানরা তাদের ক্যানোনিক্যাল আইনে বিচার পেত। (আন্নে-মারি এডউইনসন, Muslims and Christians in Medieval Spain.)</p> <p>৪. সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ : আন্দালুসে ইসলামিক সংস্কৃতি এবং স্থানীয় রোমান ও ভিসিগথ ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটে। স্থাপত্যে মুদ্রিত হয় ইসলামী ও খ্রিস্টান শৈলীর মিশ্রণ। উদাহরণত—কর্ডোবার মসজিদ। (ওলেয়ারি, Arabic Thought and its Place in History)</p> <p>সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানচর্চার বিকাশ</p> <p>১. জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র : মুসলিম শাসন আন্দালুসকে বিজ্ঞান, গণিত, সাহিত্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত করে। সে সময়ে গড়ে ওঠে কর্ডোবার গ্রন্থাগার (Cordoba Library), যেটি ছিল মধ্যযুগের বৃহত্তম গ্রন্থাগার। মুসলিম পণ্ডিত ইবনে রুশদ (Averroes) , ইহুদি দার্শনিক মাইমোনিডেস (Maimonides)  ও খ্রিস্টান পণ্ডিতরা একসঙ্গে কাজ করতেন। </p> <p>২. ত্রিভাষিক জ্ঞানচর্চা : আন্দালুসে আরবি, লাতিন ও হিব্রু ভাষায় সাহিত্য ও বিজ্ঞান চর্চা করা হতো। আরবরা গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞানকে সংরক্ষণ করে ইউরোপে প্রবর্তন করে। </p> <p>সম্প্রীতি অবসানের কারণ</p> <p>১. খ্রিস্টান পুনরুদ্ধার অভিযান  (Reconquista) :  ১৩ শ শতাব্দী থেকে স্পেনের খ্রিস্টান শাসকরা পুনরায় আন্দালুস পুনরুদ্ধার শুরু করে।  ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতনের মাধ্যমে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। মুসলমান ও ইহুদিদের দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় অথবা ধর্মান্তরিত হতে বলা হয়। </p> <p>২. ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা : খ্রিস্টান শাসকদের অধীনে ধর্মীয় সহাবস্থান ভেঙে পড়ে। সে সময়ে স্প্যানিশ ইনকুইজিশন মুসলমান ও ইহুদিদের কঠোরভাবে দমন করা হতো। (হেনরি চার্লস লি, A History of the Inquisition of Spain.)</p> <p>ইসলামের মহত্ত্বের প্রকাশ</p> <p>মুসলিম আন্দালুসে (৭১১-১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ) ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রীতির মাধ্যমে ইসলামের মহত্ত্ব অসাধারণভাবে প্রকাশিত হয়। এই সময় মুসলমান শাসকরা কোরআনের নীতি অনুসরণ করে এমন এক সমাজ গঠন করেছিলেন, যেখানে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, ন্যায়বিচার ও জ্ঞানচর্চার প্রতি শ্রদ্ধা বজায় ছিল। এই ঘটনাগুলো ইসলামের মানবিক ও উদারনৈতিক আদর্শকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরে।</p> <p>১. সহিষ্ণুতার শিক্ষা : ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি সহিষ্ণুতা। মুসলিম শাসকরা এই নীতিকে বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছেন, যা কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা নির্দেশিত—‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। সত্য পথ এবং ভ্রান্ত পথ পরিষ্কার।’ (সুরা : আল-বাকারাহ, আয়াত : ২৫৬) </p> <p>মুসলিম আন্দালুসে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে ইসলাম একটি মানবিক ও উদার ধর্ম। </p> <p>২. ন্যায়বিচার ও সাম্যের আদর্শ : ইসলাম একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের ওপর জোর দেয়। মুসলিম শাসকরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের নিজস্ব ধর্মীয় আইন অনুযায়ী বিচার পাওয়ার অধিকার দিয়েছিলেন। </p> <p>ইসলামের শিক্ষা : ‘আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেন যে তোমরা ন্যায়বিচার ও সদাচরণ করো।’ (সুরা : আন-নাহল, আয়াত : ৯০) </p> <p>এই নীতির অধীনে মুসলিম শাসকরা সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। </p> <p>৩. জ্ঞানচর্চার প্রতি উৎসাহ : ইসলামের প্রথম বাণী ছিল ‘পড়ো’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ১)</p> <p>আন্দালুসে এই নির্দেশনা অনুসরণ করে মুসলিম শাসকরা জ্ঞানচর্চার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান পণ্ডিতরা একত্রে বিজ্ঞান, চিকিৎসা, দর্শন ও শিল্পকলায় যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন। কর্ডোবা ও গ্রানাডার মতো শহরগুলো বিশ্বজুড়ে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। ইসলামের এই জ্ঞানচর্চার উদারতা ও বহুমুখিতা আজও উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত। </p> <p>৪. অমুসলিমদের প্রতি উদারতা : মুসলিম শাসন ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারকে নিশ্চিত করে। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ওপর জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার কোনো ঘটনা ঘটেনি, বরং তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চর্চায় স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। মুসলমানদের উদার মনোভাব এবং ইসলামের সহিষ্ণুতা নীতি গোটা আন্দালুসে স্থায়ী শান্তি ও উন্নতির সূচনা করে। </p> <p>৫. সংস্কৃতির বিকাশ ও সংমিশ্রণ : ইসলামী সংস্কৃতি স্থানীয় রোমান, ভিসিগথ ও খ্রিস্টান ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলে এক অনন্য সংমিশ্রণ গড়ে তোলে। </p> <p>স্থাপত্য : কর্ডোবার মসজিদ এবং আলহামরা প্রাসাদ ইসলামের নান্দনিকতা ও শিল্পকলার মহত্ত্বকে প্রকাশ করে। </p> <p>সংগীত ও সাহিত্য : আন্দালুসে আরবি ভাষার পাশাপাশি স্থানীয় ভাষায়ও সাহিত্য ও সংগীত চর্চা বিস্তার লাভ করে। </p> <p>বিশ্বের প্রতি বার্তা</p> <p>১. সাম্য ও সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত : মুসলিম আন্দালুস দেখিয়েছে যে ইসলাম একটি বিশ্বজনীন ধর্ম, যা বিভিন্ন জাতি, সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে শান্তি ও সৌহার্দ্য স্থাপন করতে পারে। </p> <p>২. ইসলামের বিশ্বজনীন নীতি : ইসলামের শিক্ষাগুলো মানবজাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য। ধর্ম-বর্ণ-জাতি-নির্বিশেষে এটি একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের দিকে আহ্বান জানায়। কোরআনের নির্দেশ—‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে এবং তোমাদের বিভক্ত করেছি জাতি ও গোষ্ঠীতে, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক পরহেজগার।’ (সুরা : আল-হুজুরাত, আয়াত : ১৩)</p>